Translate

Wednesday 16 January 2013

একুশ গর্দভের নীলদর্পণ

একুশ গর্দভের নীলদর্পণ

একুশ গর্দভের নীলদর্পণ
নিয়োগ পরীক্ষা শেষ। এবার উত্তরপত্র যাছাইয়ের পালা।
একুশ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা উত্তরপত্র নীরিায় আমন্ত্রিত। সবাই উচ্চ শিতি, বিসিএস; অনেক আট-ঘাট পোড়া। জ্যাক অব অল ট্রেড্‌স, মাস্টার অব নান; বাট এভরিথিং ক্যান ডান।
পরীার সার্বিক দায়িত্বে জনাব আবু তাকের, কমিশনার। অনেক কমিশনার আছেন, পুলিশ কমিশনার, কাস্টম কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার, সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার; তবে গল্পের কমিশনার কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার নন। বড় অফিসার। নিজেই প্রশ্ন-পত্র করেছেন, কাক-পীও জানতে পারেন নি। ঠিক যেমনটি হওয়া দরকার। বিসিএস পরীার প্রশ্নপত্রও লিক হয় কিন্তু তাকের সাহেবের হাত লিকহীন।
উত্তরপত্র সামনে নিয়ে সবাই কমিশনার সাহেবের অপোয়।
অপোর পালা শেষ হওয়ার আগে তিনি কে ঢুকেন। মুখে এক সমুদ্র অহঙ্কার, অহঙ্কারের বন্যা, চোখে গর্বের ফালি ফালি মেঘ। প্রাইম মিনিস্টারের বিশেষ পেয়ারের লোক।
সবাই দাঁড়িয়ে। তিনি নির্বিকার, চারিদিকে চোখ বুলিয়ে হাত নাড়েন। তার মানে- বসে পড়ো তোমরা, আমি বসব না।
তিনি দাঁড়িয়ে শুরু করেন ইনস্ট্রাকশান: অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রশ্ন-পত্রটা করেছি, এঙ্ট্রা অর্ডিনারি। দুদিন দু রাত ঘুমোয় নি, ঘুমোতে পারি নি। তোমরা হলে দু মাস ঘুমোতে পারতে না। যাক, সে কথা, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, প্রশ্নের চেয়ে আরও বেশি সতর্কতায় প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর লেখা হয়েছে। আমি আনসার স্ক্রিপ্টও সাথে নিয়ে এসেছি। তোমাদের দেব। আনসার স্ক্রিপ্টে প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া আছে। সে মতে যাছাই করো, উল্টো-পাল্টা করো না। আনসার ছাড়া তোমরা উত্তরপত্র যাছাই করতে পারবে না বলে আটঘাট বেঁধে আসতে হয়েছে। আমি বিসিএস অফিসারদের দৌড় জানি, এক লাইনে চৌদ্দটি ভুল করে বসে। লেখা-পড়া তো গোল্লায় গেছে। সিএসপি পরীক্ষা দিলে বুঝতে কত রসে কত গুড়, কত চুল কাটে  ক্ষুর।
সবাই ুব্ধ নয়নে শুনছিলেন। সিএসপি-দের এ একটা বড় দোষ। তারা ছাড়া আর কেউ কিছু জানেন না।
আজাদের ভাষায় সিএসপি মিনস- কন্ট্রাকচুয়্যাল সার্ভিস বাই পাম্প। মুনীর চৌধুরী বলেন: কাম সার্ভ এন্ড পাম্প। শামীমেরটা আরও এপ্রোপিয়েট: ক্রিমিনাল সাপ্লাইয়ার্স টু দ্যা পলিটিশিয়ানস্‌।
মোট একুশ জন উচ্চ পদস্থ অফিসার আবু তাকেরকে শুনছিলেন। এসি-র শব্দ ছাড়া বাকি সব নিস্তব্ধ। এসি মানে এসিসট্যান্ট কমিশনার নন, এয়ার কন্ডিশন।
আবু তাকের নিজে হেটে হেটে সবার হাতে আনসার স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিচ্ছেন।
জাকিরের ভাগে পড়ে বাংলা সাহিত্য ও সাধারণ জ্ঞান।
সবাই উত্তরপত্রে একাগ্র।
চোখে খাতা, হাতে কলম, মগজে আনসার স্ক্রিপ্ট, বুকে কমিশনার। আবু তাকের সাহেব ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর বকে যাচ্ছেন অনর্গল: আমরা যে পরীা দিয়ে চাকুরি নিয়েছি তোমরা একশ বছর পড়েও তা পারবে না।
মডেল আনসার স্ক্রিপ্টে চোখ বুলাতে বুলাতে একটি লাইনে এসে জাকিরের চোখ আটকে যায়। অদ্ভুত লাইন- “নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন।”
হোয়াট?
মনে মনে প্রশ্ন করে জিবে কামড় দেন জাকির, আঁতকে উঠা কামড়। এটি তার বদ অভ্যাস, ছোট বেলা হতে।
‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র। লেখা হয়েছে মীর মোশাররফ হোসেন। বাংলা সাহিত্যে নীলদর্পণ পিরিয়ডে মীর মোশাররফ হোসেন বলে কোন নাট্যকার কিংবা ঔপন্যাসিক ছিলেন না। ‘জমিদার দর্পণ’ নামের একটি নাটক আছে। এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন নয়।
সম্ভবত প্রিন্টিং মিস্টেক।
নীল দর্পণ আর জমিদার দর্পণের প্রতিবিম্বে এ রকম ভুল হতে পারে। টু এরর ইজ হিউম্যান। ভুল শোধরে দেয়া কৃতিত্বের কাজ, কর্তব্যও বটে। কমিশনার স্যার খুশি হবেন।
জাকির দাঁড়িয়ে দৃষ্টি টানেন আবু তাকের সাহেবের: স্যার, সাত নম্বর প্রশ্নের উত্তরটা আনসার স্ক্রিপ্টে ভুল উঠেছে। হবে দীনবন্ধু মিত্র, মীর মোশাররফ হোসেন লেখা হয়েছে, মোস্ট প্রোবাবলি ক্যারিক্যাল মিসটেইক।
আঁতকে উঠেন আবু তাকের সাহেব, লজ্জায় নয়, জাকিরের সাহস দেখে। সাহস নয়, রীতিমত দুঃসাহস, বেয়াদবি।
আবু তাকের সাহেব বিকৃত স্বরে বললেন: কী বললে? ক্যারিক্যাল মিসটেক? তুমি কী আমাকে কার্ক মনে করো? জানো, আমি কার্কদের সাথে কথাও বলি না! বললাম আমি নিজেই আনসার স্ক্রিপ্ট তৈরি করেছি আর তুমি আমাকে কার্ক বানিয়ে ছাড়লে, এতবড় হারামজাদা আমি তো দেখি নি! আমার উত্তরে ভুল? এ অসম্ভব।
জ্বী স্যার, ভুল।
হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু সে?
আরেকটু উত্তপ্ত হন আবু তাকের সাহেব। উত্তপ্ত হলে তাঁর কপাল আর মুখ প্রচন্ডভাবে কুঁচকে যায়, ঠিক এবড়ো থেবড়ো অ্যালুমিনিয়ামের ডেঙ্রি মত। সবাই খাতা হতে চোখ তুলে আবু তাকের সাহেবের উপর রাখেন। তিনি কাঁপছেন, চোখ জাকিরের দিকে। এত বড় দুঃসাহস কল্পনা করা যায় না। আবু তাকের মাথা ঘুরে পড়ে যাবার দশায় উপনীত।
জাকির আবার বলে উঠেন: সরি স্যার, নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন নয়, দীনবন্ধু মিত্র। মীর মোশাররফ বলে কোন লেখক তৎকালে ছিল না। থাকলেও তিনি নীলদর্পণ লিখেন নি।
এবার প্রচন্ড রেগে যান জনাব আবু তাকের, তুমি কোন্‌- ব্যাচের?
ভয় পেলেও সাহস হারান নি জাকির। যারা জানেন তারা সহজে সাহস হারান না। অজ্ঞতা ভীরুতার ফ্যাটফরম,ঋদ্ধতা সাহসের আধার। জ্ঞান সাহসীদের কান্ডারি। জাকির ভুল ধরেছে, তার ভয়ের কিছু নেই। কারও বালখিল্য হুমকি জ্ঞানীদের এট বেস্ট হাসায় তার বেশি নয়।
তাকের সাহেব জাকিরের উত্তরের তোয়াক্কা না করে আবার শুরু করেন: তোমার চেয়ে অনেক সিনিয়র, অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি দিয়ে আনসারস্ক্রিপ্ট তৈরি করা হয়েছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না তুমি বিসিএস পাশ করলে কীভাবে? মীর মোশাররফ হোসেনকে চেন না। এমন একটি গর্দভ বিসিএস ক্যাডারের সদস্য, এটি ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। ‘বিষাদসিন্ধু’ কী তোমার বাবা লিখেছে? নাকি তাও জানো না? জানবে কীভাবে, নকলিশ পাশদের অত জানার সুযোগ কোথায়? আমি পিএসসি-র মেম্বার হলে তোমাকে পিয়নের চাকুরিও দিতাম না।
বিনীত আত্মবিশ্বাসে উত্তপ্ত জাকির বললেন: ‘বিষাদসিন্ধ’ুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন নয়। ‘মো’ আর ‘ম’ এক নয়; যেমন এক নয় ‘মল’ আর মোল্যা কিংবা গরু আর গুরু।
জাকিরের ধারাল জবাবে তাকির সাহেবের চোখে যেন মরিচ পড়ে। তিনি লাফ দিয়ে উঠেন এক হাত: এ ছেলে তো গন্ডমূর্খ। জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে গিয়ে দেখে এসো, মীর মোশাররফ হোসেন হল। তারা কী ভুল করেছেন?
জ্বী স্যার, তাঁরা ভুল করেছেন।
বিরক্তিতে লাল হয়ে যান আবু তাকের সাহেব: না জেনে শাখামৃগের মত তর্ক করে সময় নষ্ট করো না। বাইরে পরীার্থীরা অপো করছে। কাজ করো। তোমার শাস্তি পরে হবে। দেখি তোমার চাকুরি কোন শালা বাঁচায়।
জাকির তার বক্তব্যের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত, এক বিন্দু সংশয় নেই। বললেন: আমি স্যার জেনেই বলছি। আমার…
জাকিরের কথা কেড়ে নেন আবু তাকের: আমাকে শেখানোর চেষ্টা করো না, আমি যতটি বই পড়েছি তুমি ততটি বাক্যও পড় নি, কয় ধানের চাল খেয়েছ?
মুখটা মলিন করে বসে পড়ে জাকির।
রাগে গজগজ করছে তার বুক, তবে মাথা এখনও ঠাণ্ডা। বুক যতই গরম হোক, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। নইলে আবু তাকেরদের মত মো এবং ম একাকার হয়ে মোমের মত জমে যাওয়ার সম্ভাবনা। জাকিরের মাথা সহজে গরম হয় না, গরম হলে মুশকিল। বস-পস কিচ্ছু মানে না।
অফিসারেরা উত্তরপত্র বাদ দিয়ে তর্ক উপভোগ করছেন, রসালো তর্ক, যশোরের খেজুর রসের মত।
অভিব্যক্তিতে সবাই জাকিরের দিকে, কিন্তু কারও মুখে রা নেই। প্রতিবাদ মানে প্রতিঘাত, চাকরের অত সাহস থাকে না। হোক ডিসি, এসপি, জজ-ব্যারিস্টার, সচিব, কমিশনার সবাই চাকর। হেলাল চাকর-এর এব্রিভিয়েশন করেছে; চা-কর আর চা-করি হতে চাকরি।
ডেপুটি কমিশনার মাহবুব ও জামিল থেমে থাকতে পারলেন না। আবু তাকের সাহেবের কথা শেষ হলে দুজন এক সঙ্গে উঠে দাঁড়ান: স্যার, উইথ কাইন্ড পারমিশন, জাকিরের কথাই ঠিক, মীর মশাররফ নয়, দীনবন্ধু মিত্রই ‘নীলদর্পণ’ লিখেছেন।
এবার প্রচণ্ড েেপ যান আবু তাকের। মুখ আরও কুঁচকে, চোখগুলো বাচ্চাদের ইলেকট্রনিঙ্ পুতুলের মত উঠানামা করছে, মনে হয় সবাইকে গিলে খাবেন: তোমরা এখানে কয়জন?
একুশ জন।
কয়জেলার দায়িত্বে?
এক জেলার।
আমি কয়জন?
একজন।
কয় জেলার দায়িত্বে?
সতের জেলার।
তোমরা একুশ জন এক জেলার দায়িত্বে, আর আমি একজনই সতের জেলার প্রধান। অতএব মিজার ইউর সেলভ্‌স। ব্যাঙ, ব্যাঙই থাকো, হাতি হওয়ার চেষ্টা কর না। চুপ-চাপ কাজ করে যাও। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ, কোন ব্লাডি বলেছেন দীনবন্ধু? আমার চেয়ে বেশি জানলে তোমরাও কমিশনার হতে। আন্ডারস্ট্যান্ড?
জ্বী, বলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েন দুজন।
এবার জাকিরের মাথায় কিছুটা উষ্ণতা ঢুকে পড়ে। আসলে সে ডোন্ট-কেয়ার টাইপের, রেস্টিভ এন্ড ব্রেভ; কিন্তু সিনিয়রেরা বলেন অন্য কথা: বেয়াদব।
হ্যাঁ, প্রতিবাদিরা সবসময় সুবিধাভোগীদের কাছে বেয়াদব। সিনেমাতেও এমন।
বেপরোয়া ভঙ্গীতে পরোয়াহীন বিনয়ে জাকির বলে উঠেন: স্যার, আমার কাছে বইটা আছে, সময় দেন তো নিয়ে আসি।
ডেপুটি কমিশনার পুলিন বাবু নাভির গোড়ায় দুহাতকে প্রণামের ভঙ্গীতে ধরে রেখে জাকিরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন।
জাকির তাকাচ্ছিলেন না, চোখ আবু তাকেরের দিকে। যমের চেয়ে বিপজ্জনক।
তাকাবে এ প্রত্যাশায় ডেপুটি কমিশনার পুলিন বাবু জড়ো হাত উপর-নিচ দুলিয়ে জাকিরকে মৌন ইঙ্গিতে বসানোর তথ্য সরবরাহ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জাকিরের কথায় আবু তাকের সাহেব আরও রেগে, এবার তেলে-বেগুনে তপ্ত কড়াই। চিৎকার দিয়ে বলে উঠেন: থাকতে পারে। তোমার ঐ বই যে ভুল নয় তার প্রমাণ কী? আমি কমিশনার বলছি বিশ্বাস হয় না, আর কোন্‌ বইয়ে কী লেখা আছে, কোথাকার কোন নচ্ছার কী লিখেছে তা নিয়ে তুমি তুলকালাম শুরু করেছ, বেয়াদব! চাকুরি করার ইচ্ছা আছে?
এবার পুলিন বাবু মরিয়া।
জাকিরকে থামাতে হবে, লণ ভাল নয়। আস্তে আস্তে জাকিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
কানে মুখ নিয়ে বলেন: তুই আমার বাপ, তোর পায়ে পড়ি যাদু, একটু থাম্‌। ‘নীলদর্পণ’ কেউ না, তুমিই লিখেছ, প্রয়োজনে আমি তোমার নামে অফিস আদেশ করে দেব, আমাকে রেহাই দাও। নিয়োগটা ভণ্ডুল করে দিও না।
এবার চমকে উঠে জাকির।
পুলিন বাবুকে বললেন: স্যার, এত বড় ভুল আমি মেনে নিতে পারব না। কমিশনার বললে কলা কি লিচু হয়ে যায়? অনেক কিছুর সীমা থাকে না, কিন্তু ভুলের সীমা থাকে, থাকতে হয়। তাই ভুল হলে মানুষ আপশোস করে। এজন্য ভুল সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে না। যারা সীমাহীন ভুল করে তারা ক্রিমিনাল। কমিশনারের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁদের কীভাবে পোস্টিং দেয় সরকার? আমি বসব না, তাঁর অজ্ঞতা টেনে বের করব, চাকুরি থাক আর যাক।
ভয়ে কুচকে যান পুলিন বাবু: তোমার হাতে ধরি জাকির, এবার থাম, পরীার খাতিরে হলেও তুমি ান্ত হও। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর, তোমাকে আবার ফোর্স নিয়ে বাইরে যেতে হবে।
এসিস্ট্যান্ট কমিশনার মোনায়েম রাগে এতণ হুলো বিড়ালের মত ফুসছিলেন। তবু পুলিন স্যারের বিগলিত বিনয় তার সহানুভূতি টানে। জাকিরকে ল্য করে বললেন: স্যার,কমিশনার যা বলছেন তাই সঠিক। দুমাস আগে এ কইে এক সেক্রেটারি কালিদাসের বিখ্যাত উক্তি, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই”-চরণকে রবীন্দ্রনাথের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। দুজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। কেউ তো প্রতিবাদ করেন নি। আপনি কেন অযথা বিপদে পড়তে যাবেন, আপনি ছাড়া বাকি বিশ জনই তো চুপ।
আমি থাকলে মন্ত্রীর সামনেও প্রতিবাদ করতাম, জাকির জবাব দেয়।
পুলিন বাবু বললেন: এজন্যই তোমাকে দাওয়াত দেয়া হয় নি।
কেন জানি আবু তাকের সাহেব কিছু বলছেন না, এদের কথাতেও বাঁধা দিচ্ছেন না। হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাঁর কপালে এসি-র বাতাসেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যায়।
আবু তাকের সাহেবের অজ্ঞতায় জাকির শঙ্কিত। করুণায় ঘেমে উঠে মন। এত বড় মাপের অফিসারের জ্ঞানের বহরের নিদারুন দীনতা করুণারই বটে। মেনে নেয় যায় না। মেনে নিলে পরীার খাতায় যারা সঠিক উত্তর দিয়েছেন তাদেরকে মার্ক দেয়া যাবে না। জাকির তা কিছুতেই করবে না।
জাকিরের পাশে আবু তোরাব, তার পাশে মোশাররফ। দুজনে ডেপুটি কমিশনারর্ যাংকের।
কাণ্ডকারখানা দেখে মোশাররফ সাহেব মুচকি মুচকি হাসছেন।
আবু তোরাব বললেন: মোশাররফ ভাই আপনার হাসারই কথা।
কেন?
কমিশনার স্যার আপনাকে নীলদর্পণের মত একটি বিখ্যাত নাটকের রচয়িতা বানিয়ে দিয়েছেন, হাসবেন না? আমি হলে এতণে ভবন হতে লাফ দিতাম খুশিতে।
তার কথা কেড়ে নেন হাসিব: বস ক্যান নট রং, জাকির স্যার, আপনি চুপচাপ আপনার ইচ্ছামত মার্কিং করে যান। অত ঝামেলা করে কাজ নেই।
আবু তাকের উত্তর পত্রে চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে ফূঁসে চলেছেন।
কী ব্যাপার, এত তর্ক কিসের? দরজার দিকে সবার চোখ যায়।
ধবধবে জামায় আবৃত একজন লম্বা লোক ধীর পায়ে রুমে ঢুকে আবু তাকের সাহেবকে সালাম টুকেন। সবাই এক ঝলক তাকিয়ে। পুলিন বাবুর দেখাদেখি সবাই দাঁড়িয়ে, নিশ্চয় হোমরা চোমরা কেউ।
হ্যাঁ, হোমরা-চোমরাই। জয়েন্ট সেক্রেটারি কাতেব। সস্ত্রীক চাবেড়ায় এসেছেন। চাবেড়া মানে চাকুরির অজুহাতে বেড়ানো। রথ দেখা আর কলা বেচা।
সালাম নিলেন কিনা সেদিকে সাহেবের খেয়াল নেই। আবু তাকেরকে ল্য করে বললেন: কোন অসুবিধা স্যার?
এবার আবু তাকের সাহেবের মুখে জোয়ার আসে, কথার জোয়ার: দেখ, “নীলদর্পণ” নাকি মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা নয়, দীনবন্ধু মিত্রের। শুনেছ কখনও?
আঁতকে উঠেন কাতেব সাহেব: কে বলেছে? কোন বানচুত? বলেন স্যার, দুটো লাথি মারি দুগালে। আপনার মুখের উপর কথা!
আমাদের গণ্ডমুর্খ সহকর্মী বেয়াদব জাকির।
লাথির ভাষা হারিয়ে ফেলেন কাতেব, তার চোখে আফশোসের কালো রাগ। জাকিরকে তিনি চেনেন। আসলেই সে শয়তান।
পিয়ন একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। চেয়ারের পিঠে হাত রেখে অজির সাহেব বললেন: আমি বুঝি না, আজকালকার ছেলেগুলো সব ক্রেডিট কেন হিন্দুদের দিয়ে দিতে চায়। এজন্যই তো আজ মুসলমানদের এ দুর্দশা। আই এ্যাম সিউর, ‘নীলদর্পণ’ মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছেন, দীনবন্ধু নয়। চন্দ্রসূর্য মিথ্যা হতে পারে কিন্তু আপনি কীভাবে মিথ্যা হবেন? হিন্দুরা বড় কিপটে, তারা দর্পণ দিয়ে কী করবে? মোশাররফ সাহেব আমার পাশের বাড়ির লোক। তার সাথে আমার অনেক বার দেখা হয়েছে। ভদ্রলোক খুব জ্ঞানী। আমাকে খুব স্নেহ করেন। এ তো কিছুদিন আগেও টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। বড় মিষ্টি কণ্ঠ, সাতীরার ীরের মত।
কাতেব সাহেবের মিথ্যাচারে সবার মাথা নত। আবু তাকের নিজেও সংকোচে মুখ ফিরিয়ে জাকিরের উপর চোখ রাখেন।
কাতেব সাহেবের সেদিকে খেয়াল নেই, তিনি বলেই যাচ্ছেন: এগুলো নিয়ে এত তর্ক করে লাভ কী স্যার? বেলজিয়ামের দর্পণই সবচেয়ে ভাল। মোশাররফের দর্পণ কিংবা দীনবন্ধুর দর্পণ দিয়ে ঈদানীং চলে না, ব্যাকড্যাটেড, সহজে নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানির দর্পণের উপর কোন দর্পণ নেই। আছে কি?
আবু তাকের এবার কাতেব সাহেবকে ধমক লাগান: তুমি বিষয়টা বুঝতে পার নি কাতেব। আমরা বইয়ের কথা বলছি, আয়নার কথা নয়। আর লেখকের সাথে তোমার দেখা হয় কীভাবে? মানলাম তোমার পাড়ার লোক কিন্তু তিনি তো তোমার জন্মের অনেক পুর্বেই মারা গেছেন।
কাতেব সাহেব তথমত খেয়েও এগিয়ে যান: ঠিক আছে স্যার দেখা হয় নি, আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন। তবে আমাদের পাড়ায় দুজন মোশাররফ আছেন। একজন মারা যেতে পারে। আমি যার কথা বলছি তিনি মারা যান নি।
তুমি এসব কী বলছ?
দর্পণের কথা বলছি। লেখক খুব চমৎকারভাবে নীলদর্পণ উপন্যাসে নীল রঙের আয়নার বর্ণনা দিয়েছেন। আমি তো ঐ বই পড়ে আপনার ভাবীকে তিনটা নীল আয়না কিনে দিয়েছিলাম। খুব ভাল বই স্যার। কিছু মনে না করলে আপনার জন্য পাঠিয়ে দিতে পারি।
আবু তাকের বললেন: নীলদর্পণ উপন্যাস নয়, নাটক।
জ্বী স্যার। তবে নাটক হোক কিংবা উপন্যাস হোক সবই তো মিথ্যা কথার ফুলঝুরি, এগুলোর কোন দাম আছে? আপনি স্যার একটা সার্কুলার করে দিন যে, নীলদর্পণ মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা, দীনবন্ধুর নয়।
আবু তাকের ধমকে সাথে বললেন: থামো, তুমি কি বই পড়?
কী বলেন স্যার। আমি রবীন্দ্রনাথের সবগুলো বই পড়েছি। কি গল্প, কি উপন্যাস কি কবিতা যেন মাধুর্যের বন্যা, আহ্‌, বই নয়, যেন সিনেমা। শুরু করলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। তবে শেষের কবিতার মত বই আমি আর দেখি নি। প্রতিটি কবিতা প্রাণের ছোঁয়ায় ভরা। এত সুন্দর কবিতার বই বাংলা সাহিত্যে আর নেই। বনলতা সেন আর শেষের কবিতা দুটো পাশাপাশি রেখে আমি পড়েছি। দুটোই অসাধারণ। শেষের কবিতা আমার মেয়েকে পড়তে দিলাম। মেয়েটাও ব্রিলিয়ান্ট। পড়ে বলল: বাবা এত ভাল বই আমি আর পড়ি নি। আপনি তো জানেন আমার স্ত্রী ভাল গায়িকা। সে শেষের কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক না হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে শেষের কবিতা দিয়ে। তিনি যেন আমাদের জন্যই শেষের কবিতাটি লিখে গেছেন। কী সুন্দরভাবে রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতায় প্রকৃতির বন্দনা করছেন:
“আহা আজি এ বসন্তে…….” কী সুন্দর কথা।
সবার মুখ চাপা হাসিতে ফেটে পড়ার দশা। চারিদিক তাঁকিয়ে কাতেব একটু থামেন। বুঝতে পারেন কোথায় কিছু বিভ্রাট ঘটেছে। তিনি তো জানেন, শেষের কবিতা তিনি পড়েন নি। ভেবেছিলেন তিনি না পড়লে অন্যরা পড়বে কেন?
আবু তাকেরের উপর হতে চোখ ঘুরিয়ে সবার মুখে বুলিয়ে যান। সবার মুখে কেমন একটা উপহাসের ছটা, এবার তিনি শিওর, তার ভন্ডামী ধরা পড়ে গেছে। তাতে কিছু যায় আসে না, অন্যদিকে মোড় ঘুড়িয়ে দেন। নিজেকে এত অজ্ঞ প্রমাণ করতে দেয়া যাবে না।
কাশি দিয়ে আবার শুরু করেন: আমরা কি? স্বয়ং সেঙ্পিয়ার পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। সাধে কী নোবেল পেয়েছেন?
এবার সবাই একসাথে আগের চেয়ে জোরে হেসে উঠেন, আবু তাকেরও। অবস্থা বেগতিক। তাড়াতাড়ি কাতেব রহমানের কানে কান লাগায় পিএস: স্যার, থামুন, আমি না বলেছিলাম গল্পটি যেখানে সেখানে না বলার জন্য।
কিন্তু আমি এ বক্তব্য দিয়ে গত বছর রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বিশটি হাততালি পেয়েছিলাম। এরা মনে হয় কম জানে।
তবু বলে যেতে থাকেন: আমি অফিসার নিয়োগের পরীায় ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম: আকবরনামার লেখক কে?
বলেছিলেন: আবুল ফজল।
আবুল ফজল সাহেবে কে ছিলেন এবং বাড়ি কোথায়? প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছেন তা শুনলে আপনি হার্টফেল করবেন। বলে কি না আবুল ফজল সম্রাট আকবরের সভা কবি ছিলেন। অথচ আবুল ফজল ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বাড়ি চট্টগ্রাম। আমার সাথে তাঁর খুব খাতির ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন আকবরনামা তাঁর লেখা।
কাতেবের কাণ্ড দেখে সবাই হতভম্ব।
জাকির কিন্তু স্বাভাবিক। সে কাতেবের সাথে অনেকদিন কাজ করেছে। অফিসার ও প্রভাষক নিয়োগের ইন্টারভিউতে কাতেব সাহেবের ভেড়া থিওরির ইমপ্লিমেনটেশন এখনও হাসির জোয়ারে ভাসিয়ে ছাড়ে। তার আসল নাম কাতেব রহমান, সবাই ডাকেন খায় রহমান। যা পান তা-ই খান।
তাকের সাহেবের ধার কম হলেও ভার আছে। খায় রহমানের ধার-ভার কিছু নেই। আস্ত একটা বলদ।
চার নং প্রশ্ন ছিল বাগধারা। অর্থসহ বাক্য রচনা, প্রথমে- ‘গড্ডালিকা প্রবাহ’।
সেখানেও জাকির প্রতিবাদ করে: স্যার, গড্ডালিকা নয়, গড্ডলিকা।
কাতেব সাহেব কলমের মুখে ছিপি ভরতে ভরতে বলেছিলেন: ত্রিশ বছর চাকুরি করছি, কোনদিন গড্ডলিকা শুনি নি, তুমি কী আবোলতাবোল বলছ? এজন্যই তো কেউ তোমাকে পছন্দ করে না। ডুন্ট বি সিলি।
জাকির কাতেব সাহেবের কথা গায়ে মাখার পাত্র নয়। সে জানে চোরের মায়ের বড় গলা। কাতেব সাহেব চুরি করেন না তবে ছাড়েন না কিছু, যা পান তাই খান, রীতিমত সর্বভূক।
জাকির বললেন: বাংলা ভাষায় গড্ডালিকা প্রবাহ বলে কোন বাগধারা নেই।
কাতেব সাহেবের কোষে কোষে বিরক্ত ছড়িয়ে পড়ে: আমাকে বাংলা শেখাতে এসো না। গড্ডালিকা প্রবাহ অর্থ স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া। গড্ডালিকা অর্থ স্রোত।
জাকির এবার হেসে উঠে। কাতেব সাহেব বিরক্তিতে মুখ লাল করে চোখে এক মগ ঘৃণা নিয়ে জাকিরের দিকে তাকান।
চন্দন জাকিরকে চুপ মেরে যাবার পরামর্শ দেয়।
জাকিরকে চুপ মেরে যেতে দেখে কাতেব সাহেব উল্টো বুঝেন। বেটা ভুল বুঝতে পেরে চুপ মেরে আছে, তাকে ছাড়া যায় না।
বললেন: প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পড়ে আসছি ‘গড্ডালিকা’ তুমি সেদিনের ছ্যাবলা ছেলে ‘আকার’ তুলে দিয়ে আমাকে বাংলা শেখাচ্ছ। পিএসসি তোমাদের মত গর্দভদের কীভাবে সিলেক্ট করে আমি বুঝি না। আমি তোমার ‘আকার’ তুলে দেব।
বোর্ডের সদস্য বাংলার প্রফেসর জাহিদ সাহেবের দিকে তাকান কাতেবর রহমান: জাহিদ সাহেব, আপনি তো বাংলার শিক, অনেক লেখা-জোকাও আছে; আমার সার্ভিসের গাধাটাকে কিছুদিন বাংলা পড়াতে পারবেন? এভাবে আকার তুলে দিতে থাকলে তো বাংলা ভাষার বারোটা বাজবে, ‘বাবা’ হয়ে যাবে ‘বব’ এবং ‘মাল’ হয়ে যাবে ‘মল’।
জাহিদ সাহেব রাশভারী মানুষ। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলেন না। তবে বলতে শুরু করলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেই ছাড়েন, অনেকটা কচ্ছপের মত। কাতেব সাহেবের রিকোয়েস্ট তাকে কিছু বলার প্রেরণা দেয়: স্যার, ফয়সল সাহেব ঠিকই বলেছেন। ‘গড্ডালিকা’ নয়, ‘গড্ডলিকা’। গড্ডালিকা শব্দের অর্থ স্রোত নয়, ভেড়া।
কাতেব সাহের একটা ধাক্কা খায়। লজ্জা আর অপমানের ঝাপটায় মুখটা জণ্ডিস রোগীর মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। তবে তা ণিকের জন্য। তিনি এসব বিষয়ে অভ্যস্ত। চাকুরি জীবনে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে অপমানিত হন নি। চট্টগ্রামের মৌলবীর দোকানে ছাত্ররা চড় মেরে মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল। যে ছেলে চড় মারে তাকে নিয়ে এক সপ্তাহ পর মিনিস্টার সাহেবের আশীর্বাদ নিতে ঢাকা যান। মুর্খ আর পশু সমান, পশুর আবার লজ্জা কী?
কাতেব সাহেব গোয়াড়ের কণ্ঠে উম্মাদ হয়ে উঠেন: আপনি এ থিওরি পেলেন কোথায়। সারাজীবন ‘গড্ডালিকা প্রবাহ’ লিখে আসছি। আজ বলছেন গড্ডলিকা প্রবাহ, এরূপ ভুল শিখিয়েই তো জাতির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন। বাংলা শিক হয়ে বহুল প্রচলিত একটা বাংলা শব্দের বানান জানেন না, কীভাবে ছেলেদের পড়ান।
অন্য কেউ হলে রেগে যেতেন কিন্তু জাহিদ সাহেব রাগলেন না, কাতেব সাহেবের অজ্ঞতায় একটু অবাক হলেন মাত্র। কাতেব সাহেবের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি বলে যাচ্ছেন: আপনার মত অজ্ঞ শিকেরা যাই শেখান, মেধাবীরা গড্ডালিকাই লেখবে। আপনারা ভুল করতে পারেন আমি পারি না।
ইতোমধ্যে তিনি চারটি বাংলা গ্রামার বই আনিয়ে নিয়েছেন। তিনটিতেই লেখা ‘গড্ডালিকা’ একটিতে ‘গড্ডলিকা’।
হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন কাতেব সাহেব: দেখুন, তিনটা বইতে ‘গড্ডালিকা’ আর আপনারা বলছেন ‘গড্ডলিকা’। ভুল নিয়ে বসে থেকো না শেখার চেষ্টা করো। জাহেদ সাহেব আপনি শিক মানুষ, আপনার কাছ হতে আমি এমন আশা করি নি।
এবার জাহেদ সাহেবকে উষ্ণতায় ধরে: আপনি যা করছেন এবং বলছেন তা সঠিক নয়। বস্তুত যারা প্রকৃত সত্যমিথ্যা যাচাই না করে এভাবে প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন এবং ‘গড্ডলিকা’ শব্দকে ‘গড্ডালিকা’ লিখেন তাদের জন্যই ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ বাগধারাটির উৎপত্তি।
ঘটনাটি মনে মনে আবৃত্তি করে আবার হেসে উঠে জাকির।
এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ে যায় জাকিরের। গল্পটির নাম ‘গার্লিক স্যার’। মিহির গল্পটি বলেছেন।
কাতেব সাহেব তখন ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে। পদটিতে বাইরের লোকদের আনাগোনা প্রবল। কিন্তু কাতেব সাহেব ইংরেজি জানেন না। এ পদে থাকতে হলে কিছু ইংরেজি জানা আবশ্যক। বাজার হতে অনেকগুলো ইংরেজি শেখার বই কিনেছেন। অনেক শব্দ শিখেছেন কিন্তু ‘বসুন’ শব্দের ইংরেজিটা এখনও পান নি। বইতে বসা, বসব, বসল প্রভৃতি শব্দের ইংরেজি অর্থ আছে কিন্তু বসুন শব্দের নেই।
এতদিন যেখানে চাকুরি করেছেন সেখানে ইংরেজি বলার প্রয়োজনীয়তা তেমন একটা হয় নি। এখন ইংরেজি জানা অপরিহার্য; বলতে না পারলে সম্মান আর থাকে না। জুনিয়রেরাও দিব্যি ইংরেজি বলে যাচ্ছে, তিনি পারেন না, চরম লজ্জা।
অন্তত বিদেশিদের সাথে ইংরেজি বলতে হয়, সৌজন্যবোধটুকু দেখাতে হয়। সৌজন্য দেখাতে প্রথম যে শব্দটি প্রয়োজন তা হচ্ছে ‘বসুন’।
কিন্তু তার ইংরেজি প্রতিশব্দ খুজে পান না। কারও নিকট হতে জানার মত আদর্শিক মনোবলও তার নেই। এত বড় পদের একজন মানুষ হয়ে অন্য কারও কাছ হতে শিখবেন কী করে? কেউ তার অজ্ঞতা জেনে যাক- মরে গেলেও এমনটি হতে দিতে পারেন না। এটি মুর্খদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এজন্য তারা আজীবন মূর্খ থেকে যায়।
হঠাৎ একদিন তার কিশোর ছেলের ওয়ার্ড বুকে বসুন শব্দের অর্থ পেয়ে যান।
সস্তামানের ছাপা ওয়ার্ড বইটিতে অসংখ্য প্রিন্টিং মিসটেক। বইটিতে গার্লিক শব্দের অর্থ বসুন লেখা হয়েছে। সবাই জানে এধৎষরপ (গার্লিক) শব্দের অর্থ রসুন। ভুলবশতঃ ‘ব’-এ বিন্দু না পড়ায় রসুন এর স্থলে ‘বসুন’ হয়ে গেছে। সেদিন অনেণ চেষ্টা করে বসুন শব্দের ইংরেজি হিসেবে গার্লিক শব্দটি মুখস্থ করে নেন জনাব কাতেব।
এক সপ্তাহ পর আসবে এক দল বিদেশি বিশেষজ্ঞ। সাথে থাকবেন সচিব স্বয়ং। কাতেব সাহেব সেজেগুজে প্রস্তুত, আজ বসুন শব্দের ইংরেজি তাঁর আয়ত্ত্বে। সৌজন্য দিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেবেন।
যথাসময়ে চলে আসেন সচিব মহোদয় উইথ ফরেন ডেলিগেট।
অতিথিদের বসার স্থান দেখিয়ে দিয়ে কাতেব সাহেব সচিব মহোদয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, গার্লিক স্যার। প্লিজ, গার্লিক স্যার।
ডেলিগেটরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। তারা কিছু বুঝতে পারছেন না।
সচিব বললেন: হোয়ার ইজ গার্লিক?
কাতেব সাহেব বিনয় বিগলিত স্বরে বললেন: অন দ্যা চেয়ার গার্লিক।
কিন্তু চেয়ারে কোন গার্লিক নেই, তবু খুজছেন অতিথিরা। না পেয়ে ধমক লাগান সচিব মহোদয়: কোথায় গার্লিক?
অন দ্যা চেয়ার, স্যার।