Translate

Saturday 13 August 2016

ব্যাকরণ : অভিজ্ঞতার দ্যোতনায় নতুন অভিধা /ড. মোহাম্মদ আমীন


ছোটবেলায় পড়েছি, “ যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধভাবে লিখিতে, বলিতে, পড়িতে ও বুঝিতে পারা যায়- তাহাকে ব্যাকরণ বলে।” এটি আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংজ্ঞার্থের শিশুরূপ। তিনি বলেছেন, “যে বিদ্যার দ্বারা কোনও ভাষাকে বিশ্লেষ করিয়া তাহার স্বরূপটী (স্বরূপটি) আলোচিত হয়, এবং সেই ভাষার গঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শুদ্ধ-রূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।” ব্যাকরণ নিয়ে রচিত পৃথিবীর সব বৈয়াকরণের সংজ্ঞার্থ প্রায় অভিন্ন। আমি কিন্তু প্রচলিত সংজ্ঞার্থসমূহের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না-করে সংজ্ঞার্থগুলোর বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতে চাই। ব্যাকরণ যদি প্রচলিত সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে ভাষা, প্রকৃতির মতো প্রত্যহ নতুন আঙ্গিকে আমাদের বিমোহিত করার সুযোগ পেত না। সুনীতিবাবুর ‘টী’ আমরা ‘টি’-লিখতে পারতাম না। 
অনেকে বলেন, ভাষা নদীর মতো। তা যথার্থ নয়; ভাষাকে এত ক্ষুদ্র বৈচিত্র্যে সীমাবদ্ধ করা সমীচীন মনে হয় না। আমি বলি, ভাষা প্রকৃতির মতো; নদী প্রকৃতির একটি উপাদান মাত্র। ভাষার প্রতিবর্ণকে প্রকৃতির একেকটি উপাদানের মতো ভাবা যায় — বাংলা ভাষায় ‘দন্ত্য-ন’-কে যদি ধরা হয় নদী; হ-হিমালয়, আ- আকাশ, স- সমুদ্র, ঐ— ঐশ্বর্য। নদী থেকে সাগর; হ থেকে হিমালয়; ম থেকে মাটি; আ থেকে আকাশ; আকাশ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে বন্যা, পলি, সবুজ- - -। ভাষাকে নদীর মতো করে ভাবা হলে ‘দন্ত্য-ন’-এর মতো একটা অক্ষর নিয়ে ভাষাকে সীমিত অঞ্চলে মরার অপেক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকতে হতো, এভাবে হারিগে গেছে কত ভাষা, হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। ন-কে চলতে হলেও ম-লাগে। সুতরাং ভাষা নদীর মতো নয়, ভাষা প্রকৃতির মতো বলেই এটি এত বৈচিত্র্যময়, ভাষার এত উত্থান, এত হৃদয়বিদারক পতন এবং এত আকর্ষণীয় স্বভাব-তাণ্ডব। 
প্রায় সব সংজ্ঞার্থে বলা হয়েছে, ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানার জন্য এবং ভাষার অশুদ্ধতা রোধে ভাষাভাষীকে সতর্ক করার জন্য বা ঋদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যাকরণ। অনেকে আরও জোর দিয়ে বলেন, “ব্যাকরণ ভাষার সংবিধান”। এটি কোনোভাবে যথার্থ নয়। আমি এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে অনেকটা জোর করে বাকস্বাধীনতা রূদ্ধ করে দেওয়ার মতো নৃসংশতার সঙ্গে তুলনা করি। ব্যাকরণকে যারাই ভাষার সংবিধান বলেছেন, তাদের আচরণই অনেক সমৃদ্ধ ভাষার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তা যদি না-হতো তাহলে ব্যাকরণ-কঠোর সংস্কৃত ভাষা আজ মৃত কেন? কেন এককালের বিখ্যাত ল্যাটিন আজ হারিয়ে! এরূপ অনেক ভাষা ব্যাকরণ নামক কাঠোন শাসন-বিধির যাতনায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। ওসব ভাষার বৈয়াকরণগণ ভাষাকে শাসন করার জন্য ব্যাকরণকে ব্যবহার করেছেন। তাদের কাছে ব্যাকরণ ছিল ভাষার সংবিধান, রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে যেমন বিধি। প্রচলিত ব্যাকরণের সংজ্ঞায় তারা ভাষাকে শাসন করতে গিয়ে ভাষা-প্রকৃতির সীমাহীন সৃষ্টিশীলতা তথা প্রাণবায়ুকে শ্বাসরোধ করে খুন করার মতো হত্যা করে ফেলেছেন। ফলে ভাষাপ্রকৃতি নির্বাক হয়ে গিয়েছে। প্রেম আর ধর্ষণ উভয়ের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য প্রায় এক হলেও, প্রক্রিয়াটা ভিন্ন। প্রেম সৃষ্টির উল্লাসে আবেশিত, ধর্ষণ ধ্বংসের লীলায় আতঙ্কিত। ভাষাকে প্রেমিকার মতো আদরে লালন করতে হবে, ধর্ষকের মতো নৃশংসতায় নয়। তাই ব্যাকরণ হবে এমন — যেটি শাসন করবে ধর্ষকদের, ধর্ষিতকে নয়। কিন্তু প্রচলিত ব্যাকরণের সংজ্ঞায় ভাষাকে শাসনের কথা বলা হয়েছে, যা পক্ষান্তরে ভাষার সাবলীল প্রবাহের প্রতিকূল। 
তাই, আমি করি, ব্যাকরণের প্রচলিত সংজ্ঞার্থ যথার্থ নয়। তবু্ এ ভাষা টিকে আছে, শুধু প্রচলিত ব্যাকরণ-বিরোধী সৃজনশীল কিছু ভাষাভাষীর উদারতায়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলা ভাষার ব্যাকরণের বিরুদ্ধে যদি কথা না-বলতেন, তাহলে বাংলাকে এখনও তৎসম শব্দের বিধি-কলে সে আগের মতো কঠিন নিগড়ে আটকে থাকতে হতো। তাহলে ব্যাকরণ কী? এর কি প্রয়োজনীয়তা নেই? অবশ্যই আছে এবং সে ব্যাকরণ বর্তমানে প্রচলিত সংজ্ঞার্থের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। এটি হচ্ছে সে ব্যাকরণ যা ভাষাকে নয়, বরং ভাষাভাষীকে শাসন করবে, ভাষাভাষীকে শিক্ষা দেবে — কীভাবে ভাষাকে লালন করতে হবে, ধারণ করতে হবে, পুষ্ট করতে হবে, আদর করতে হবে; মমতা দিতে হবে মায়ের, বোনের-প্রেমিকের- প্রেমিকার। 
প্রকৃতিকে শাসন করা সম্ভব নয়, তাই ভাষাকেও শাসন করা সম্ভব নয়; কিন্তু প্রকৃতির অন্যতম কুশীলব মানুষের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতিকে রক্ষা করা যায়; তেমন উদ্যোগে ভাষাকে ধারণ করতে হবে। আমার এ ব্যাকরণ সংজ্ঞার্থ এভাবেই সজ্জিত। প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য একসময় প্রকৃতি-শাসন কৌশল উপযুক্ত মনে করা হতো; এখন তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন মানুষের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য। অতএব আমাদের ভাষাপ্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভাষাকে নয়, বরং ভাষার উপর ভাষাভাষীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থকে এভাবে উপস্থাপন করতে চাই —“যে শাস্ত্র ভাষার উপর ভাষাভাষীর স্বেচ্ছাচার, শাসন ও যথেচ্ছাচার রোধ করে ভাষাপ্রকৃতিকে সর্বজনীন প্রগলভতায় উদ্দীপ্ত করার; ভাষাভাষীকে ভাষার প্রতি প্রমুগ্ধ ভালোবাসায় মোহিত করার এবং ভাষার সাবলীল সঞ্চরণ মেনে নেওয়ার মতো অভিজ্ঞানে দ্যোতিত করার উপাদনে ভূষিত- সেটিই হচ্ছে ব্যাকরণ।” 
অতএব ব্যাকরণ ভাষার গতিপ্রকৃতি নির্ধারক কোনো সংবিধান নয়, বরং ভাষাভাষীর গতিপ্রকৃতি নির্ধারক একটি বিধান। ব্যাকরণ ভাষাকে শাসন করার জন্য বরং ভাষাভাষীর আচরণকে, যারা ভাষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক না-গড়ে, ধর্ষকের মতো উন্মত্ত আচরণ করে — তাদের সংশোধন করার জন্য।

-----------------------------------------------------------------------------------
পোস্ট : রচনা, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউকে।
সূত্র: ইউনিভার্সিটি অব ক্যাম্ব্রিজ, ড. মোহাম্মদ আমীন স্যারের বক্তৃতার (ব্যাকরণ : অভিজ্ঞতার দ্যোতনায় নতুন অভিধা) কিয়দংশ।

Monday 18 July 2016

অভিধান ও বানান / ড. মোহা্ম্মদ আমীন

অনেকে মনে করেন, অভিধানে কোনো একটি শব্দের যে কয়টি বিকল্প বানান দেখা যায় সবগুলো শুদ্ধ। এ ধারণা  ঠিক নয়। যেসব শব্দ অতীতে ব্যবহৃত হতো কিন্তু এখন হচ্ছে না, বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে তবে শুদ্ধ নয় এবং শুদ্ধ ও প্রমিত- সব ধরণের শব্দ অভিধানে থাকতে পারে। অভিধান ব্যাকরণ নয়, প্রমিত রীতিও নয় এটি শব্দ ভাণ্ডার। তাই ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হোক বা অশুদ্ধ হোক সব ধরণের শব্দ অভিধানে রাখা হয়।   
যাঁরা অভিধান রচনা করেন তাঁরা বৈয়াকরণ হিসাবে অভিধান রচনা করেন না, আভিধানিক হিসাবে অভিধান রচনা করেন। পাঠক অভিধান দেখেন শব্দের অর্থ বা অর্থানুসারে বানান এবং প্রমিত বানান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য, ব্যাকরণ রীতি জ্ঞাত হওয়ার জন্য নয়।  যে সকল শব্দ প্রচলিত ছিল বা আছে সবগুলো অভিধানে না-দিলে বিভিন্ন বানানে লেখা শব্দের অর্থ-উদ্ধারে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য কোনো শব্দের যতগুলো বানান প্রচলিত ছিল বা আছে তা শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনা না করে অভিধানে উল্লেখ করা হয়। অতএব কেবল অভিধানভুক্তির কারণে  কোনো শব্দ শুদ্ধ বা প্রমিত হয়ে যায় না। কোনো শব্দকে প্রকৃত অর্থে শুদ্ধ হতে হলে তা ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হতে হয়। বিকল্প বিষয়টি দুর্ঘটনার জন্য রাখা হয়।  স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ বিকল্প পন্থা গ্রহণ করে না; অজ্ঞাতা, অযোগ্যতা, অসামর্থ্যতা, দুর্যোগ প্রভৃতি কারণে বিকল্প রাখা হয়। অভিধানে বিকল্প বানান হিসেবে রাখা শব্দের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তাই বিকল্প বানান স্বাভাবিক বানান নয়।

এবার দেখা যাক, অভিধান কী? অভিধানকে দোকানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পার্থক্য হচ্ছে, দোকান পণ্যভাণ্ডার এবং অভিধান  শব্দভাণ্ডার। ক্রেতাসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী দোকানকে পণ্যসজ্জিত করা দোকানির কাজ। পণ্যের ভালোমন্দ, ক্রেতাসাধারণের লাভক্ষতি বা প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নির্ধারণ দোকানির কাজ নয়। সময়-স্থান ও প্রচলন বা চাহিদা অনুযায়ী দোকানি যেমন পণ্য সজ্জিত করেন, তেমনি আভিধানিক সজ্জিত করেন অভিধান। এজন্য একশ বছরের আগের অভিধানের শব্দভুক্তি আর পরের অভিধানের শব্দভুক্তিতে পার্থক্য দেখা যায়। একটি দোকানে চাহিদার সব পণ্য থাকার চেয়ে না-থাকাটাই অধিক স্বাভাবিক। তাই কোনো দোকানে কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি না-ও পাওয়া যেতে পারে।  এর মানে এই নয় যে, পণ্যটি কোথাও নেই কিংবা অস্তিত্বহীন। তেমনি, কোনো নির্দিষ্ট অভিধানে বা প্রচলিত সবকটি অভিধানেও যদি কোনো শব্দ পাওয়া না-যায়, তবু কারও এমনটি বলা সমীচীন হবে না যে, ওই শব্দটি নেই। বাংলা ভাষায় কমবেশি চার লাখের মতো শব্দ আছে। তবে এ পর্যন্ত অভিধানভুক্ত শব্দের সংখ্যা দেড় লাখের কম। তাই কোনো শব্দ কোনো অভিধানে না পেলে তা নেই কিংবা অস্তিত্বহীন বলা উচিত নয়। 
পণ্যের ভালোমন্দ বিবেচনার চেয়ে ক্রেতার চাহিদা মেটানো এবং পণ্যবিক্রি করা দোকানির মুখ্য বিষয়। ক্রেতার লাভক্ষতি কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতি-অবনতির দিকে নজর দেওয়া দোকানির কাজ নয়। এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে, নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। ভাষার জন্য এই আইনটির নাম  ব্যাকরণ। দোকানে থাকা সবপণ্য যেমন ভালো হতে পারে - এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় না, তেমনি অভিধানে থাকা সকল শব্দ শুদ্ধ- এটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না। সিগারেট, মদ্য, ভেজাল পণ্য কিংবা পচ খাদ্যবস্তু স্বাস্থ্যহানিকর। তবু তা দোকানে রাখা হয়, বিক্রি করা হয়। দোকানি যদি ক্রেতার স্বাস্থ্য বিবেচনায় রত হয় তাহলে ব্যবসায় লাটে উঠবে। অভিধানও ঠিক দোকানের মতো। অভিধানকে শব্দের গুদামও বলা যেতে পারে। গুদামে রাখা সব পণ্য মানসম্মত ও ভালো কিংবা স্বাস্থ্যকর তা বলা যাবে না। গুদামে ভালো-মন্দ, আংশিক ভালো, আংশিক মন্দ- সব রকমের পণ্য রাখা হয়। তাই গুদামে রাখা সব পণ্য মানসম্মত- এমনটি ভাবা যেমন সমীচীন নয় তেমনি সমীচীন নয় অভিধানে উপস্থাপিত সব শব্দ শুদ্ধ ভাবা। শব্দের শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনার জন্য রয়েছে ব্যাকরণ বা ভাষা-বিধি। কোনো শব্দ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ব্যাকরণ রীতি অনুসরণ না করলে তা অভিধানে যতই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, সেটি শুদ্ধ বলে গণ্য হয় না।প্রচলিত আর প্রমিত বা শুদ্ধ এক জিনিস নয়। যেমন ঈদ বানান যতই প্রচলিত হোক, প্রমিত বানান বিধি অনুযায়ী শুদ্ধ নয়। তবু অশুদ্ধ ‘ঈদ’ শব্দটিও অভিধানে পাওয়া যায়। অর্থের যোগান দেওয়ার জন্য এমন প্রচলিত শব্দ অভিধানে রাখতে হয়া। 
শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনা না করে বর্তমানে প্রচলিত ও অতীতে প্রচলিত ছিল এমন সব শব্দের বানান অভিধানে রাখা অভিধান রচয়িতাগণের কর্তব্য। তাঁদের দায়িত্ব কেবল প্রচলিত শব্দের অর্থ উপস্থাপন, শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া নয়। তবে কোনো কোনো অভিধানে শব্দের শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে কিছু ধারণা উপস্থাপন করা হলেও  তা ব্যাকরণ রীতির আলোকে দেওয়া হয়। পাঠকের দায়িত্ব হচ্ছে বিচক্ষণতার সাথে প্রমিত রীতি অনুসরণ করে তা গ্রহণ-অগ্রহণ ও ব্যবহার।

সুতরাং, অভিধানে ‘কোনো শব্দের যতগুলো বানান উল্লেখ আছে সবকটি শুদ্ধ’ এমন ভাবা বিধেয় নয়। একই শব্দের একাধিক বানান উল্লেখের ক্ষেত্রে অভিধানে সাধারণত যে শব্দটি শুদ্ধ, প্রচলিত ও প্রমিত-রীতি অনুসরণ করে সেটি প্রথম লেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংক্ষেপে শব্দসমূহের অবস্থানগত বিবরণও দেওয়া হয়। তবু কোন বানানটি শুদ্ধ তা অভিধানে উল্লেখ না থাকলে জানার জন্য প্রমিত রীতি সম্পর্কে অবগত থাকা সমীচীন।

কোনো বিষয়, রীতি বা কার্যক্রম জনসাধারণের কাছে যতই জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, সরকারি নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তা বেআইনি বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে জন-চাহিদার স্বার্থে তার আইনানুগ স্বীকৃতি দিতে পারে। এভাবে আইন পরিবর্তন হয়, নতুন রীতির প্রবর্তন ঘটে। কোনো শব্দ শুধু ব্যাপক প্রচলনের কারণে যে শুদ্ধ হয়ে যাবে তা ঠিক নয়। ব্যাকরণবিধি অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ না-হলে অথবা বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রণকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা শব্দটির স্বীকৃতি না এলে তা অশুদ্ধই থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সার্বিক বিবেচনায় বহুল প্রচলিত শব্দটির বিষয়ে তাঁদের অবস্থান দ্রুত স্পষ্ট করা। অন্যথায় তাঁরা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন -এমনটি ভাবা যাবে না।

ভাষা বহমান নদীর মতো নয়, প্রকৃতির মতো। এর পরিবর্তন বহুমাত্রিক দ্যোতনায় অভিযোজিত হয় নানা কারণে। তাই ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহে কোনো পক্ষের প্রতিবন্ধকতা বা বলপ্রয়োগ মঙ্গলজনক হতে পারে না। প্রেমিক বা প্রেমিকার উদ্দেশ্য এবং ধর্ষণকারীর উদ্দেশ্য অনেকটা অভিন্ন হলেও উত্তরণের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাষাকে প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সাবলীল কলহাস্যে অভিষিক্ত করে বরণ করার আবহ সৃষ্টি করলে তা সর্বজনীন হয়ে উঠতে বাধ্য। কেউ যদি মাতৃভাষার প্রচলিত রীতি-নীতি আত্মস্থ করাকে কষ্টকর গণ্যে কিংবা নিজের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার অজুহাতে তা পাল্টে দিতে চেষ্টা করেন সেটি ধর্ষণের মতোই বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নিজের প্রতি প্রেমমুগ্ধ করতে না পারার কারণে তাকে জোরপূর্বক নিজের বাহুডোরে আনার চেষ্টা করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি ভাষাকে শুধু আত্মস্থ করতে না পারার কারণে জটিলতার দোহাই দিয়ে ব্যাকরণের রীতিনীতি অগ্রাহ্যপূর্বক তা বদলিয়ে ফেলার কিংবা ব্যাকরণ রীতি অনুসরণে পরিবর্তনযোগ্য কোনো শব্দের পরিবর্তনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টাও স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। আর একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যারা বিদ্যমান বিষয়কে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে নতুন কিছু গ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব থাকে তারা সে নতুন লভ্য বস্তুকেও দ্রুত পরিত্যাগ করার জন্য আরও বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠে। এটি অস্থিরতার লক্ষণ। এমন কর্ম উন্নয়নের মারাত্মক অন্তরায়। মড়ার আগে কাউকে মেরে ফেলা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মড়াকে আঁকড়ে ধরাও ঠিক নয়। 
ভাষা পরিবর্তনশীল। চর্যাপদ হতে আধুনিক বাংলা ভাষার দিকে তাকালে এ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আমি ভাষার পরিবর্তনের বিপক্ষে নই। তবে তা হবে প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের মতো সাবলীল, ভালোবাসার মতো মোহনীয়, গ্রহণের মতো মুগ্ধকর। কখনও কোনো অবস্থাতেই স্বেচ্ছাচারমূলক নয়। অতএব অভিধানে কোনো শব্দ থাকার জন্য ওই শব্দকে (বানানকে) শুদ্ধতার নজির হিসেবে উপস্থাপন আদৌ উচিত নয়।

Friday 22 April 2016

টিকাটুলি নামের ইতিাস / টিকাটুলি

‘টিকা’ ও ‘টুলি’ হতে টিকাটুলি নামের উদ্ভব। টিকা হচ্ছে কয়লা দিয়ে তৈরি একপ্রকার জ্বালানি। এর আকার ছিল বাতাসার মতো চ্যাপ্টা ও গোলাকার। এটি আগুনে জ্বালিয়ে হুকোর কল্কেতে রাখা তামাকে বসিয়ে হুকা টানা হতো। এবার ‘টুলি’ অর্থ কী তা দেখা যাক। ‘টুল’ হতে টুলি শব্দের উদ্ভব। যারা টুলে বসে ক্রয়-বিক্রিয় করতেন তাদের বলা হতো টুলি। একসময় ঢাকায়  প্রতিঘরে হুকো ছিল। হুকোর তামাক জ্বালানোর জন্য প্রতিদিন শতশত মন টিকা বিক্রি হতো। তাই টিকা ব্যবসায় অনেক লোক জড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত এলাকায় টিকা তৈরির অনেক কারখানা ছিল। টিকা তৈরির জন্য এলাকাটি বিখ্যাত ছিল। এখানকার টিকা ব্যবসায়ীরা টুলে বসে টিকা বিক্রি করতেন। অনেকে টুলের মাঝে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। এজন্য এলাকাটির নাম হয় টিকাটুলি।

পাগলাপুল / ড. মোহাম্মদ আমীন

একসময় ঢাকা ছিল নদীর শহর। লতার মতো ইতঃস্তত ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য নদী আর খাল। ভেনিসের মতো সৌন্দর্যে ঢাকা ছিল অপরূপ। এখন ঢাকায় কোনো নদী নেই। সব নদী-নালা মানুষের দেওয়া মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে। সপ্তদশ শতকে ঢাকায় বর্তমান পাগলাপুল নামক স্থান দিয়ে পাগলা নামের একটি নদী প্রবাহিত ছিল। নদীটি পাগলের মতো যখন যেদিকে ইচ্ছে সেদিক দিয়ে প্রবাহিত হতো বলে নাম ছিল পাগলা নদী। বঙ্গদেশে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি সুবাদার মীর জুমলা (১৫৯১ খ্রি:-১৬৬৩ খ্রি:) যাতায়াতের সুবিধার্থে পাগলা নদীর উপর একটি সুন্দর পুল তৈরি করেন। প্রতিদিন অনেক লোক পুলটি দেখতে আসতেন। পাগলানদীর উপর পুল নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই পুলটিকে বলা হতো পাগলাপুল। এভাবে পাগলাপুল হতে পুরো এলাকাটির নাম হয়ে যায় পাগলাপুল।

সূত্রাপুর নামের ইতিহাস / ড. মোহাম্মদ আমীন

 সূত্রাপুর ঢাকার একটি বিখ্যাত এলাকা। সূত্র ও পুর হতে সূত্রাপুর এলাকার নাম। যারা কাঠের কাজ যারা করতেন তাদের বলা হতো সূত্রধর। ‘পুর’ মানে এলাকা বা স্থান। সুতরাং সূত্রাপুর অর্থে কাঠের কাজে নিয়োজিত লোকদের এলাকা। এ এলাকায় এককালে অনেক সূত্রধর পরিবার বসবাস করতেন। তাই এলাকাটি কাঠের কাজের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এজন্য এলাকাটির নাম হয় সূত্রাপুর।

কাকরাইল নামের ইতিহাস / ড. মোহাম্মদ আমীন


ঊনিশ শতকের শেষ দশকে  ককরোল নামের এক ইংরেজ ঢাকা জেলার কমিশনার হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। ইংরেজ আমলে কমিশনার পদটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনার ছিলেন পুরো প্রশাসনিক বিভাগের প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তির অন্যতম। এলাকাবাসী ও জেলাপ্রশাসকসহ অন্যান্য অধস্তন কর্মকর্তৃবৃন্দ কমিশনারকে খুশি করে তার অনুগ্রহ লাভের জন্য রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থান ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতেন। বর্তমানে যেমনটি দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী বা ক্ষমতাশীল কোনো মন্ত্রীর ক্ষেত্রে। আলোচ্য এলাকায় কমিশনার মিস্টার ককরোল-এর নামানুসারে ‘ককরোল রোড’ নামের একটি রাস্তা করা হয়েছিল।   সেই ককরোল রোড থেকে কালক্রমে এলাকাটির নাম হয়ে যায় কাকরাইল

পরীবাগ নামের ইতিহাস : ড. মোহাম্মদ আমীন

নবাব আহসানউল্লাহর মেয়ে পরীবানুর নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় পরীবাগ। বাগ শব্দের অর্থ বাগান, স্থান বা এলাকা। সুতরাং পরীবাগ মানে পরীর বাগ বা পরীর বাগান বা পরীর এলাকা। তৎকালে ঢাকা ছিল বাগানে বাগানোে ভরপুর অতি মনোহর একটি শহর। অনেকের মতে আলোচ্য এলাকায় একটি বিশাল বাগান ছিল। নবাব আহসানউল্লাহর মেয়ে পরীবানুর নামানুসারে বাগানটির নাম রাখা হয় পরীরবাগ। পরীবাগ নামের বাগান থেকে এলাকাটি পরীবাগ নাম ধারণ করে।

Monday 8 February 2016

তিলোত্তমা হাতিয়া : প্রজন্মের কণ্ঠস্বর/ ড. মোহাম্মদ আমীন

হঠাৎ এবং বলা যায় বেশ আকস্মিকভাবেই ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’র সঙ্গে আমার পরিচয়। এটি একটি অনলাইন গ্রুপ। গ্রুপটির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক এ পরিচয় আমার কাছে নতুন দিগন্তের শুভ সূচনা,
অভিজ্ঞতার নিলয় কেতন। গ্রুপের কার্যক্রম, অ্যাডমিন প্যানেল ও সদস্যদের বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গী আমার দুটি চোখে অসংখ্য চোখের দ্যোতনা এনে দেয়। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে সৃষ্টির যে দুরন্ত ইতিহাস ও অতলান্ত নজির গ্রুপটি তুলে ধরেছে- তা অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে আমাকে টেনে নিয়ে যায় গ্রুপটির গভীর হতে আরও গভীরে। রাতে গ্রুপটির পোস্ট পড়া শুরু করি। পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে যায়, অনেক রাত। রাতের খাওয়ার জন্য ডাকছিল, কিন্তু যেতে পারছিলাম না, উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না গ্রুপ ছেড়ে। গ্রুপের পরতে পরতে জানা-অজানা শিহরিত বিষয়গুলোর বর্ণীল ছটা আমার খাদ্য ক্ষুধাকে খেয়ে ফেলে নিমিষে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি পড়তে থাকি আগ্রহের সীমাহীন ভাবালুলতায়। গ্রুপ তবু শেষ হয় না, রাত শেষ হয়ে যায়। আসলে, এ গ্রুপ শেষ হওয়ার নয়। কখনও শেষ হবে না, এর জন্ম সৃষ্টির জন্য, স্বপ্নের জন্য, প্রকৃতির লাস্যে সবুজ মাঠে নদীর স্রোতের মতো রূপলী মৎস্যের চঞ্চলতা অবিকল রাখার জন্য। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ চিরন্তন, শেষ হয় কীভাবে?


বস্তুত অনলাইন গাটতে গিয়ে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ কথাটি দেখে থমকে গিয়েছিলাম। কারণ ছিল থমকে যাওয়ার। অনেক বছর আগে আমি হাতিয়ায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন ‘তিলোত্তমা হাতিয়া : ইতিহাস ও ঐতিহ্য” নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলাম। তাই ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ নামটি আমাকে থামিয়ে দেয়। তারপর গ্রুপের পেইজগুলো আমাকে পরম আনন্দে উদ্বেল করে রাখে। দেখতে দেখতে এবং পড়তে পড়তে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। এ কী গ্রুপ? শুধু পেইজ? না এটি শুধু গ্রুপ নয়, লেখাগুলো শুধু লেখা নয়- জীবনের অভিধানে অনিবার্য মাধুর্য। এটি হাতিয়ার প্রতিভূ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবায় থাবায় অপরাজেয় হয়ে উঠা হাতিয়ার মানুষের সংকল্প নিনাদিত উত্তর পুরুষের উত্তরদ্রোহ;  বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষের চেতনা,  সার্বিক কল্যাণের লালিত্যে প্রেমের মাধুরী আর সৃষ্টির সৌকর্ষে দ্রোহের বহ্নিশিখা।

যতটুকু জানতে পারি, মাহবুব, শিবলু, নিশান, জুয়েল ও সুমন নামের পাঁচজন স্বপ্নাচারী কিন্তু বাস্তববাদী তরুণ প্রকৃত অর্থে প্রথমে, কোনোরূপ পরিকল্পনা ছাড়াই ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রুপটি গড়ে তুলেছিল। কয়েক দিনের মধ্যে তাদের আদর্শ, প্রতীতি ও অনিমেষ ঐকান্তিকতার মহৎ মিথষ্ক্রিয়া বিপ্লবের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনলাইনের কারণে তা বিদ্যুৎগতিতে চমকে উঠে। ঝঙ্কৃত করে দেয় হাতিয়া, বাংলাদেশ এবং বিশ্ব। পৃথিবীতে এখন এমন দেশ খুব
কমই আছে, যে দেশে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ গ্রুপের সদস্য নেই। এমন সফলতা দেখে গ্রুপের প্রারম্ভিক অ্যাডিমনগণ উৎসাহিত হয়ে ওঠে। সংগতকারণে তারা নিজেদের আরও নিবেদিত করার প্রেরণা পায়। ফলে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’কে তারা  শুধু গ্রুপে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার ও চেতনার শ্বাসত বিকাশের অবিরাম আন্দোলনের যুগোপযোগী মাধ্যমে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়। মূলত পৃথিবীর প্রত্যেক মহৎ আন্দোলনই এভাবে গড়ে উঠেছে। লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার কৌশল হিসাবে তারা ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তব জগতের মিলন ঘটানোর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ আরও গতি পায়। ভার্চুয়াল জগত নেমে আসে মাটির ধরায়। এ যেন স্বর্গ হতে মর্ত্যে দেবতার আগমন। গ্রুপের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাতিয়ার লোকজন গ্রুপের কর্মকাণ্ডে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। দলে দলে যোগ দিতে শরু করে অনলাইনভিত্তিক গ্রুপ ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’র ছায়ায়।  এখন গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছয় লাখ ১০ হাজারের অধিক এবং পরিচালক  ২৫। হাতিয়ার শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পর্যটন, সৌন্দর্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরাই ছিল গ্রুপের অন্যতম প্রারম্ভিক উদ্দেশ্য। এখন গ্রুপ এ উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা গ্রুপটিকে দিন দিন আরও বিকশিত করছে। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ এখন শুধু সেবায় আনত নয়,  অন্যায়, অনিয়ম, জুলুম, নির্যাতন প্রভৃতির বিরুদ্ধেও দ্রোহের মতো সোচ্চার। ছবি আর লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরেন সমাজের অবস্থা, নির্ভয় অবলীলায় ছুটে যান যেখানে দলিত হয় মানুষ, মথিত হয় প্রকৃতি। সবাই উদার উদারতায় ছুটে যান অসহায় মানুষের কল্যাণে, দুর্গতদের সাহায্যে। হাতিয়াকে হাতিয়ার মতো লালিত্যে উপস্থাপন করে গ্রুপটি হাতিয়ার সৌন্দর্য ঐতিহ্য ও স্বকীয়তাকে বিশ্বময় উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। প্রাচীনকাল হতে স্বকীয় মর্যাদার অধিকারী, প্রবীণ ও বিগত হাতিয়াবাসী তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গেছেন- গ্রুপটির ৬ লাখ ১০ হাজার সদস্য ও তাদের কর্মকাণ্ড এটা আবারও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে।

একটা গল্প বলি, না, গল্প নয় ঘটনা। জনৈক কাউসার কয়েক বছর যাবত কানের সমস্যায় ভুগছিলেন।অপারেশন জরুরী হয়ে পড়েছিল। খবর নিয়ে জানতে পারেন জাতীয় নাক,কান ও গলা ইনস্টিটিউটের  পরিচারক ডাঃ জাহিদুল আলম  হাতিয়ার'ই সন্তান।কিন্তু তিনি কোনভাবেই পরিচালক সাহেবের সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলেন
না। তখন কাউসার "তিলোত্তমা হাতিয়া" গ্রুপের  সাহায্য চেয়ে পোস্ট করেন। এরপর কী ঘটেছে তা কাউসারের জবানিতে শোনা যাক : আমার পোস্ট দেখে সেদিন অনেকেই অনেক ভাবে আমার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে "তিলোত্তমা হাতিয়া”র অ্যাডমিন প্যানেল থেকে নিশান ভাই, শিবলু ভাই, জুয়েল ভাই, সাঈফ ভাইসহ অনেকেই। কেউ ঠিকানা দিয়ে, কেউ ফোন নাম্বার দিয়ে, কেউ রেফারেন্স দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সত্যি বলতে কি আমি কখনও ভাবতেই পারিনি এই গ্রুপের সদস্যরা এতটা আন্তরিকভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসবেন।” তিলোত্তমা হাতিয়া গ্রুপের সহায়তায় কাউসারের অপারেশন এমনভাবে  সম্পন্ন হয় যেন, গ্রুপের সব অ্যাডমিনই তার নিকটাত্মীয়। তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ কাউসারের আবেগময় প্রকাশ : "ফেসবুকের কোটি কোটি গ্রুপের মধ্যে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ আমার দেখা সবচেয়ে আন্তরিক গ্রুপ"।
 
কী নেই এ গ্রুপে? সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, পরিবেশ, নৈতিকতা, সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, জাতি, দেশ, মাটি, নদী, প্রাত্যহিক জীবনের স্বাদ-বিস্বাদ, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা, দলিত মানুষের হাসি-কান্না, শোষক শ্রেণির চরিত্র, রাজনীতির কুটিলতা, লোভীদের হায়েনাপনা, ভালো মানুষের ভালবাসা, মন্দ লোকের হীনম্মন্যতা- সব আছে। এখানে সবকিছু মিলেমিশে অথচ অদ্ভুদ কৌশলে পৃথক অবয়বে আপন স্থানে বিপুল আশার বাণী হয়ে ছড়িয়ে, মাতিয়ে, নাড়িয়ে এবং এগিয়ে। নামে গ্রুপ হলেও ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ প্রকৃতপক্ষে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের কোলে নির্যাস বৈশ্বিকতার চিরন্তন আলাপ যেন। এটি অতীত হয়ে সুদূর ভবিষ্যতের বিদুর সেতুবন্ধন। ফলে এর বিদ্যমানতা সর্বত্র - শিল্পের নান্দনিকতা হতে শুরু করে কৃষকের লাঙ্গলে আর কুলবধূর কলসী হতে দুর্গতদের ভাঙ্গা নীড়ে।

‘তিলোত্তমা হাতিয়া’র ছয় লাখ দশহাজারের অধিক সদস্য। সংখ্যাটি হাতিয়ার জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। তার মানে বাংলাদেশের শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর একটি বৃহদংশ এ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত।
দেশপ্রেমের দৃঢ়কঠিন অঙ্গীকারে গ্রুপটি অনল প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ঐতিহ্য তাদের স্তম্ভ হয়ে অনাগত দিনকে স্বপ্নীল মায়ায় প্রশান্তময় করে তুলতে বিভোর। হাতিয়ার প্রতি তাদের ঐকান্তিক ভালবাসার মৃণ্ময় দায়বদ্ধতা গ্রুপটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। হাতিয়াকে তারা ভালবাসে প্রাণের চেয়েও, তাদের এ ভালবাসা নিঝুম দ্বীপের হরিণ চকিত আখির তড়িৎ চাঞ্চল্য হয়ে হাতিয়ার সবুজ প্রান্তরকে অন্তর করে, সারা বাংলাদেশে রক্তিম আবেগের বন্যা এনে দিয়েছে, উল্লাস বিলাসে। সালাহউদ্দিন আহমেদের ভাষায় :

“এই আমার সবুজ শ্যামল গ্রাম এই আমার বাংলা।
গ্রামের সবুজ-শ্যামল নয়নাভিরাম দৃশ্য না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ি,
ধন্য আমি ধন্য এমন একটি গ্রামে আমার জম্ম.........”

যেদিক দিয়ে বিবেচনাকেরা হোক না কেন, নিঃসন্দেহে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ অসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী একটি অনলাইন গ্রুপ। যে গ্রুপটি অনলাইন হতে মানুষের অন্তরের গভীরতায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে, সে গ্রুপটির পক্ষে যে কোনো কিছু করা সম্ভব। এটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি উদহারণ হয়ে থাকবে। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ ভার্চুয়াল হলেও কাউসারের চিকিৎসা, দূর্গতদের সাহায্য, অসুস্থদের সেবা, শীতার্তদের বস্ত্রদান
কোনোটাই ভার্চুয়াল নয়। এর প্রতিটি সত্যের মতো নিরেট এবং জীবনের মতো বাস্তব। ভার্চুয়াল জগতকে বাস্তব জগতে নিয়ে এসে মানুষের সেবা করার এমন জলন্ত প্রমাণ যে গ্রুপটি রাখতে পারে – সেটি কত কার্যকর একটি গ্রুপ তা সহজে অনুমেয়। আমার জানামতে, বাংলাদেশে এমন গ্রুপের সংখ্যা খুব কম, নেই বললেই চলে। তাই ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ অনলাইন গ্রুপ মাত্র নয়; এটি একটি আন্দোলন, একটি বিপ্লব এবং জনপদের প্রাগ্রসর একদল মহীয়ান তরুণের স্বপ্ন-মঞ্জরির স্বপ্ন-শিরা বেয়ে বাস্তবে নেমে আসা সীমাহীন কল্যাণের দৃঢ় প্রত্যয়।
একটি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আবশ্যক। গ্রুপে অনেক পোস্টে শব্দের বানানে ভুল পরিলক্ষিত হয়। এটি একটি অনেক বড় গ্রুপ। এতবড় একটি গ্রুপের প্রভাব অনেক বেশি। তাই শব্দের
প্রমিত বানানে আরও গভীরভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আর একটি বিষয় হচ্ছে পোস্ট। কিছু কিছু পোস্ট ও ছবি গ্রুপে  রয়েছে, যা গ্রুপের উদ্দেশ্য, প্রভাব ও বৃহত্তর পরিসর বিবেচনায় অনুমোদন করা সমীচীন মনে হয়নি। এ বিষয়টির প্রতিও সচেতন থাকা প্রয়োজন। কারণ, এখানে একটি ভুল বানান কিংবা একটি অপ্রাসঙ্গিক পোস্ট ছয় লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, তিলোত্তমা হাতিয়া’ এখন একটি প্রচণ্ড প্রভাবশালী গ্রুপ। তাই তাদেরকে অবশ্যই বানান যাতে ভুল না-হয় এবং পোস্ট যাতে গ্রুপের মতোই মানসম্মত হয় সেটি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।

পরিশেষে, আমি এ গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেল, সদস্য, শুভাকাঙ্খী এবং সর্বোপরি এত বড় একটি গ্রুপ সৃষ্টিতে ও তাদের লক্ষ্যপূরণের কর্মযজ্ঞে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন ও করেছেন সবার ভূয়শী প্রশংসা করছি। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ আরও তিলোত্তম হয়ে উঠবে- এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।


লেখক পরিচিতি : উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাহিত্যিক, গবেষক, ভাষাবিদ, ইতিহাসবেত্তা ও জীবনীকার।

Sunday 31 January 2016

ড. মোহাম্মদ আমীন : বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ সাধক / মো: আব্দুস সালাম খান

মোহাম্মদ আমীনের চকরিয়ার ইতিহাস  অভয়নগরের ইতিহাস গ্রন্থে যে সকল চমৎকার তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা পড়ে মুগ্ধ হতে হয়। পুঁটি মাছের মুখ দিয়ে  “ পৃথিবীতে একমাত্র  মানুষই  নিজের  মলমূত্র খায়”  বলিয়ে যেভাবে মানুষের বিবেককে জাগিয়ে  তুলতে চেষ্টা করা হয়েছে তাতে স্যানিটেশন সম্পর্কে মানুষ মানুষ  সচেতন  না হয়ে পারে না। তার গ্রন্থসমূহে অতীতকে  জানার এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ  রচনার জন্য  মানব  সমাজকে সাহায্য করবে  বলে আমি বিশ্বাস করি। সাহিত্য চর্চায় তার মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে মানব কল্যাণে তিনি আরও ব্রতী হবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তার সাধানা তাকে খ্যাতির উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করবে এটাই কামনা করি।
জনাব আমীনের লেখা  ‘বনমামলা দায়ের ও পরিচালনার কৌশল’ এবং ‘ম্যাজিস্ট্রেসি ও আদেশনামা’ বইদুটো আমাদের সহকর্মীদের দৈনন্দিন কর্তব্যপালনে উপকারে আসবে। বই দুটো প্রশাসনে নিয়োজিত উদীয়মান কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি কার্যক্রমে আরও সুদক্ষ করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। জনাব মোহাম্মদ আমীন আমাদের গর্ব। আমি তার চমৎকার লেখার প্রশংসা করছি। তার এ কর্ম প্রচেষ্টা অন্যদেরকে বই লিখতে অনুপ্রাণিত করবে।
কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জনাব আমীনের সাহিত্য চর্চায় আমি মুগ্ধ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ম্যাজিস্ট্রেসির পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ যিনি লিখেত পারেন তার পক্ষে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করা অসম্ভব নয়। তার জন্য আমি গর্ববোধ করি।

লেখক : মো: আব্দুস সালাম খান, প্রাক্তন সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও  রেক্টর, বিপিএটিসি, সাভার, ঢাকা ও প্রাক্তন জেলাপ্রশাসক, চট্টগ্রাম।

ড. মোহাম্মদ আমীনের চোখে আহমদ ছফা / সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস

 পশ্চিমবঙ্গ হতে ড. মোহাম্মদ আমীনের কাছে লেখা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাসের চিঠি
প্রিয় মোহাম্মদ আমীন সাহেব 
আশা করি ভালো আছেন। আপনার লেখা ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ বইটা পড়লাম। সকাল দশটায় বইটায় একটু চোখ বুলানোর জন্য হাতে নিয়ে বিছানায় বসলাম। হাতে কিছু অন্য কাজও ছিল। কিন্তু অন্য কাজ আর হলো না। দুপুর দুটা নাগাদ বইটা শেষ করে তারপর স্নান করতে গেলাম। কী যে ভালো লাগলো! তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।মনটা যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল।  
বর্ডারের ঝামেলার কথা মনে করে মাত্র দুই সেট বই নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। তার এক সেট আপনাকে দিয়ে দিই। পরে অনেকে বই চেয়েছেন দিতে পারিনি।একবাই বোধহয় ভেবেছিলাম, তাঁকে বই দুটো না দিলেই ভালো হতো। কারণ সাধারণত সরকারি কর্তাব্যক্তিরা বইপত্র তেমন পড়েন না। যত বড় কর্তা হন, বই পড়ার হার তত কমে যায়। এখন বুঝতে পারছি- আমার ওই ছাইটুক না দিলে এই ‘সোনার তাল’ কোনোদিনই হয়তো বা পেতাম না। আহমদ ছফা হয়তো বা আমার অজানাই থেকে যেতেন।  
আমি সাহিত্যের ছাত্র নই। সাহিত্য বুঝি না, সাহিত্যিকদের চিনি না তেমন। এপার বা ওপার বাংলার সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তেমন কোনো পরিচয় নেই। যতদূর মনে পড়ে ওপার বাংলার সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচয় বলতে -ইলিয়াস সাহেবের ‘খোয়াবনামা’, অন্য কোনো এক লেখকের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এমন এক আধটু। আহমদ ছফা সাহেবের সৃষ্টি সাথে পরিচয় না ঘটা তাই আমার ক্ষেত্রে অগৌরবের হলেও অস্বাভাবিক নয়।  
আপনি লিখেছেন ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি পেলাম ‘ আপনার চোখে আহমদ ছফা’।আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! বেনিয়া গোষ্ঠীর কবল থেকে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রাম! উহ্- এ আর এক মহান যুদ্ধের সুতীব্র আহবান। আহমদ ছফার সাহিত্য সৃষ্টির সাথে আমার এখনও পরিচয় ঘটেনি। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় নয়। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রনমুক্ত হবার যে দিক্‌নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, তাতেই তাঁর চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।  
‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থ পাঠ করার পর বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আহমদ ছফা একজন বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী চরিত্র। আপনার বইয়ে তাঁর যে তেজ, যে আদর্শ, যে সাহস এবং যে নির্লোভ দৃঢ়তা প্রকাশ হয়েছে তা দলিত মানুষের জন্য  একটি বড় সুখবর। কিন্তু এ বই থেকে পরিষ্কার হলো না - তিনি কোনো স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন কি না; যা একান্তই প্রয়োজন। 
পশ্চিম বাংলায় একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার আন্দোলন শুরু হয়েছে। যা ‘দলিত সাহিত্য আন্দোলন’ নামে পরিচিত। প্রচলিত সাহিত্য বা আনন্দবাজারী সাহিত্যকে তারা ‘ব্রাহ্মন্যবাদী সাহিত্য’ নামে চিহ্নিত করে। দলিত সাহিত্য, ব্রাহ্মন্যবাদী শিল্প-সাহিত্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দলিত, গরিব এবং প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাকে উপজীব্য করে তাদের বিকাশের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করে। দলিত সাহিত্য নিছক কোনো সাহিত্য কর্ম নয়; এটি হলো একটি আন্দোলন-- সময় বদলের সংগ্রাম। তাদের সংগঠন ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’ এবং তাদের মুখপত্র ‘চতুর্থ দুনিয়া’(তৃতীয় বিশ্বে দলিতরা অন্য আর এক জাতের মানুষ)। 
মনে হচ্ছে আহমদ ছফা সৃষ্টি করেছেন একটি স্ফুলিঙ্গ- য দিয়ে দাবানল তৈরি হতে পারে। সে গুরুদায়িত্ব আপনাদের। ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থের মাধ্যমে তা আপনারা অতি সাহসের সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়েছেন । আহমদ ছফাকে অনুসরণ করে যদি একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলন আপনারা গড়ে তুলতে ও বাঁচিয়ে রাখতে না পারেন, তাহলে ছফা একদিন হয়তো বা হারিয়ে যাবেন, তাতে সমাজ বদলের সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। 
আহমদ ছফাকে নিয়ে যিনি লেখেন, সেই লেখার মধ্যে আহমদ ছফার সাথে লেখককেও খুঁজে পাওয়া যায়। লেখকের সত্ত্বায় যদি আহমদ ছফা মিশে না থাকতেন, তাহলে এমন প্রাণবন্ত ছফাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। অসম্ভব ভালো আপনার অনুভূতি, সুউচ্চ আপনার মূল্যবোধ, সুতীক্ষ্ণ আপনার কলম।আহমদ ছফার কথাকে ঠিক আহমদ ছফার মতো অগ্নিস্বরে আপনার কলম দিয়ে বের করেছেন।  
মনে হচ্ছে আপনার বইয়ে কোনো এক জায়গার ‘চৈতন্য দেব’ এর উল্লেখ করেছেন। তিনি নমস্য, তাঁকে নমস্কার জানিয়ে আপনাকে অনুরোধ করব, ‘হরি গুরু চাঁদ’ এর খোঁজ নিন একটু। জন্ম গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে। আমার লেখা বইয়ে ‘গ্রাম বাংলার রেনেসাঁর জনক গুরুচাঁদ ঠাকুর’ শিরোনামে একটা লেখায় তাঁর প্রাথমিক পরিচয় পাবেন। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে আপনার কলমের আঁচড়ে তাঁরা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারবেন। 
আমার জন্ম মশিয়াহাটিতে। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে কেটেছে। তারপর একান্ত অনিচ্ছায় ভারতে বন্দি হয়ে আছি। পালাবার পথ করে উঠতে পারিনি কিন্তু পালাবার ইচ্ছা এখনও শেষ হয়ে যায়নি।মনে হয়, ওই মাটি (বাংলাদেশের) আপনাদের থেকেও আমার বেশি প্রিয়। দীর্ঘ বিরহে প্রেমাকর্ষণ যেন বেড়েই চলেছে। খুব তাড়াতাড়ি ্আবার মশিয়াহাটি (যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার একটি গ্রাম) যাবার ইচ্ছা আছে।  
দেখুন, সাহিত্য, সাহিত্যমূল্য এসব বুঝি না। আমি ‘লিফলেট’ লেখা মানুষ। তাই, মনের কথাগুলো ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারলাম না। আপনার বীরপ্রতীক পিতামহ -- ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি থেকে উদ্ধার করার মতই একটু কষ্ট করে আমার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস যদি বুঝে নেন, কৃতজ্ঞ থাকব।   
আপনার লেখা ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থটা পড়ে আমি নতুন আলোর আগমন টের পাচ্ছি। তাই আপনার মাধ্যমে ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’র একজন কর্মী হিসাবে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ও প্রাগ্রসর প্রজন্মকে আহমদ ছফার মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে উজ্জীবিত ও দলিতের কল্যাণে নিবেদিত একটি সার্বজনীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, দলিত মানুষের হাহাকার, বঞ্চিতের চীৎকার। 
ধন্যবাদসহ,
আপনার গুণমুগ্ধ
সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস নতুন পল্লী, মছলন্দপুর উত্তর চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

ড. মোহাম্মদ আমীনের চোখে আহমদ ছফা / সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস

 পশ্চিমবঙ্গ হতে ড. মোহাম্মদ আমীনের কাছে লেখা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাসের চিঠি
প্রিয় মোহাম্মদ আমীন সাহেব 
আশা করি ভালো আছেন। আপনার লেখা ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ বইটা পড়লাম। সকাল দশটায় বইটায় একটু চোখ বুলানোর জন্য হাতে নিয়ে বিছানায় বসলাম। হাতে কিছু অন্য কাজও ছিল। কিন্তু অন্য কাজ আর হলো না। দুপুর দুটা নাগাদ বইটা শেষ করে তারপর স্নান করতে গেলাম। কী যে ভালো লাগলো! তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।মনটা যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল।  
বর্ডারের ঝামেলার কথা মনে করে মাত্র দুই সেট বই নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। তার এক সেট আপনাকে দিয়ে দিই। পরে অনেকে বই চেয়েছেন দিতে পারিনি।একবাই বোধহয় ভেবেছিলাম, তাঁকে বই দুটো না দিলেই ভালো হতো। কারণ সাধারণত সরকারি কর্তাব্যক্তিরা বইপত্র তেমন পড়েন না। যত বড় কর্তা হন, বই পড়ার হার তত কমে যায়। এখন বুঝতে পারছি- আমার ওই ছাইটুক না দিলে এই ‘সোনার তাল’ কোনোদিনই হয়তো বা পেতাম না। আহমদ ছফা হয়তো বা আমার অজানাই থেকে যেতেন।  
আমি সাহিত্যের ছাত্র নই। সাহিত্য বুঝি না, সাহিত্যিকদের চিনি না তেমন। এপার বা ওপার বাংলার সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তেমন কোনো পরিচয় নেই। যতদূর মনে পড়ে ওপার বাংলার সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচয় বলতে -ইলিয়াস সাহেবের ‘খোয়াবনামা’, অন্য কোনো এক লেখকের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এমন এক আধটু। আহমদ ছফা সাহেবের সৃষ্টি সাথে পরিচয় না ঘটা তাই আমার ক্ষেত্রে অগৌরবের হলেও অস্বাভাবিক নয়।  
আপনি লিখেছেন ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি পেলাম ‘ আপনার চোখে আহমদ ছফা’।আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! বেনিয়া গোষ্ঠীর কবল থেকে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রাম! উহ্- এ আর এক মহান যুদ্ধের সুতীব্র আহবান। আহমদ ছফার সাহিত্য সৃষ্টির সাথে আমার এখনও পরিচয় ঘটেনি। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় নয়। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রনমুক্ত হবার যে দিক্‌নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, তাতেই তাঁর চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।  
‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থ পাঠ করার পর বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আহমদ ছফা একজন বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী চরিত্র। আপনার বইয়ে তাঁর যে তেজ, যে আদর্শ, যে সাহস এবং যে নির্লোভ দৃঢ়তা প্রকাশ হয়েছে তা দলিত মানুষের জন্য  একটি বড় সুখবর। কিন্তু এ বই থেকে পরিষ্কার হলো না - তিনি কোনো স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন কি না; যা একান্তই প্রয়োজন। 
পশ্চিম বাংলায় একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার আন্দোলন শুরু হয়েছে। যা ‘দলিত সাহিত্য আন্দোলন’ নামে পরিচিত। প্রচলিত সাহিত্য বা আনন্দবাজারী সাহিত্যকে তারা ‘ব্রাহ্মন্যবাদী সাহিত্য’ নামে চিহ্নিত করে। দলিত সাহিত্য, ব্রাহ্মন্যবাদী শিল্প-সাহিত্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দলিত, গরিব এবং প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাকে উপজীব্য করে তাদের বিকাশের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করে। দলিত সাহিত্য নিছক কোনো সাহিত্য কর্ম নয়; এটি হলো একটি আন্দোলন-- সময় বদলের সংগ্রাম। তাদের সংগঠন ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’ এবং তাদের মুখপত্র ‘চতুর্থ দুনিয়া’(তৃতীয় বিশ্বে দলিতরা অন্য আর এক জাতের মানুষ)। 
মনে হচ্ছে আহমদ ছফা সৃষ্টি করেছেন একটি স্ফুলিঙ্গ- য দিয়ে দাবানল তৈরি হতে পারে। সে গুরুদায়িত্ব আপনাদের। ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থের মাধ্যমে তা আপনারা অতি সাহসের সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়েছেন । আহমদ ছফাকে অনুসরণ করে যদি একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলন আপনারা গড়ে তুলতে ও বাঁচিয়ে রাখতে না পারেন, তাহলে ছফা একদিন হয়তো বা হারিয়ে যাবেন, তাতে সমাজ বদলের সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। 
আহমদ ছফাকে নিয়ে যিনি লেখেন, সেই লেখার মধ্যে আহমদ ছফার সাথে লেখককেও খুঁজে পাওয়া যায়। লেখকের সত্ত্বায় যদি আহমদ ছফা মিশে না থাকতেন, তাহলে এমন প্রাণবন্ত ছফাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। অসম্ভব ভালো আপনার অনুভূতি, সুউচ্চ আপনার মূল্যবোধ, সুতীক্ষ্ণ আপনার কলম।আহমদ ছফার কথাকে ঠিক আহমদ ছফার মতো অগ্নিস্বরে আপনার কলম দিয়ে বের করেছেন।  
মনে হচ্ছে আপনার বইয়ে কোনো এক জায়গার ‘চৈতন্য দেব’ এর উল্লেখ করেছেন। তিনি নমস্য, তাঁকে নমস্কার জানিয়ে আপনাকে অনুরোধ করব, ‘হরি গুরু চাঁদ’ এর খোঁজ নিন একটু। জন্ম গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে। আমার লেখা বইয়ে ‘গ্রাম বাংলার রেনেসাঁর জনক গুরুচাঁদ ঠাকুর’ শিরোনামে একটা লেখায় তাঁর প্রাথমিক পরিচয় পাবেন। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে আপনার কলমের আঁচড়ে তাঁরা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারবেন। 
আমার জন্ম মশিয়াহাটিতে। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে কেটেছে। তারপর একান্ত অনিচ্ছায় ভারতে বন্দি হয়ে আছি। পালাবার পথ করে উঠতে পারিনি কিন্তু পালাবার ইচ্ছা এখনও শেষ হয়ে যায়নি।মনে হয়, ওই মাটি (বাংলাদেশের) আপনাদের থেকেও আমার বেশি প্রিয়। দীর্ঘ বিরহে প্রেমাকর্ষণ যেন বেড়েই চলেছে। খুব তাড়াতাড়ি ্আবার মশিয়াহাটি (যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার একটি গ্রাম) যাবার ইচ্ছা আছে।  
দেখুন, সাহিত্য, সাহিত্যমূল্য এসব বুঝি না। আমি ‘লিফলেট’ লেখা মানুষ। তাই, মনের কথাগুলো ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারলাম না। আপনার বীরপ্রতীক পিতামহ -- ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি থেকে উদ্ধার করার মতই একটু কষ্ট করে আমার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস যদি বুঝে নেন, কৃতজ্ঞ থাকব।   
আপনার লেখা ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থটা পড়ে আমি নতুন আলোর আগমন টের পাচ্ছি। তাই আপনার মাধ্যমে ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’র একজন কর্মী হিসাবে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ও প্রাগ্রসর প্রজন্মকে আহমদ ছফার মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে উজ্জীবিত - একটি সার্বজনীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, দলিত মানুষের হাহাকার, বঞ্চিতের চীৎকার। 
ধন্যবাদসহ,
আপনার গুণমুগ্ধ
সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস নতুন পল্লী, মছলন্দপুর উত্তর চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।


Monday 25 January 2016

মা নাকি বউ / ড. মোহাম্মদ আমীন


অক্সফোর্ডে MS এর বিষয় ছিল Impact of marriage on Person and Family. শিক্ষার্থী ৪৯ জন প্রথম ক্লাশের ঘটনা। শিক্ষক প্রত্যেকের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। লেখা ছিল : আপনার কাছে একটি একটি খাবারের প্যাকেট আছে । ওটি দুজনের যে কোনো একজনকে দিতে হবে। ওই দুজনের মধ্যে্ একজন তোমার মা এবং অন্যজন সদ্য-বিবাহিতা স্ত্রী। প্রশ্ন হচ্ছে বস্তুটি তুমি কার হতে তুলে দেবে? 
সময় ছিল মাত্র দুই সেকেন্ড।শিক্ষার্থীরা জবাব লিখে শিক্ষকের হাতে ‍তুলে দিলেন। তিনি কাগজগুলো পড়ে বললেন : যারা প্যাকেটটি মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার কথা লিখেছেন, তারা বাস্তবতা বিবর্জিত, অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ, পশ্চাৎপদ, অদূরদর্শী, বোকা, স্বার্থপর, অপরিনামদর্শী, মায়ের অকল্যাণকামী, সর্বোপরি নিজের, পরিবারের ও সমাজের সঙ্গে সুন্দর সেতুবন্ধন রচনায় বিচক্ষণ নয়। যারা মা-কে প্রকৃত অর্থে ভালবাসে তারা কখনও প্যাকেটটি মায়ের হাতে তুলে দেবে না।কয়েকজন প্রশ্ন করলেন : কেন?শিক্ষক : দেখ, প্যাকেটটা তোমার মাকে দিলে তিনি খুশি হবেন কিন্তু বউকে দিলে তিনি আরও বেশি খুশি হবেন। বউ ভাববেন, নিজের জন্মদত্রীকে না-দিয়ে আমাকে দিয়েছে। আমার স্বামী আমাকে খুব ভালবাসেন। তিনি আপনার প্রতি আরও অনুরক্ত হবেন। মা ভাববেন, আমার ছেলে, দশমাস পেটে রেখেছি, লালন করেছি; আমাকে না দিয়ে কী বউকে দেবে? বউ ভাববেন ভালবাসা, মা ভাববেন কর্তব্য।বউকে দিলে মা কষ্ট পাবেন সত্য, কিন্তু তোমার সংসার করতে হবে বউয়ের সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে নয়। তোমার মাকে অধিকাংশ সময় পুত্রবধূর সঙ্গে কাটাতে হবে। তুমি যদি প্যাকেটা বউকে দাও সে খুশিতে আপ্লুত হয়ে ওঠবে। খুশিতে আপ্লুত বউ বস্তুটা তোমার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলতে পারেন : মা, আপনার ছেলের উপহার, আপনি রাখুন, দেখুন কী দিয়েছে আপনার ছেলে। আর যদি মাকে দাও, বউ খুব কষ্ট পাবে। ওই কষ্ট তাকে ঈর্ষাপরায়ণ ও হিংস্র করে তুলতে পারে। যা ক্রমশ আপনাদের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে দূরত্ব, অবিশ্বাস আর ভালবাসাহীনতা।
মায়ের হাতে তুলে দিলে বউ ভাববেন, না-জানি কী মূল্যবান বস্তু প্যাকেটে আছে। এটা আমাকে পেতেই হবে। স্বামী আমাকে ভালবাসে না। যত ভালবাসা মায়ের প্রতি। আমি পরের মেয়ে তাই এত অবহেলা। এবার বুড়ির মজা দেখাব। এ অবস্থায়, বউ স্বামীর অবর্তমানে শাশুড়ীকে মানসিক অশান্তিতে জর্জরিত করে তুলতে পারেন। অধিকন্তু তুমি মা-কে প্যাকেটটা দিলেও তোমার মা রাখতে পারবেন না। বউ ওই বস্তুটা কোনো এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে জোর করে বা কৌশলে নিয়ে নেবেন। সংসারে শুরু হবে অশান্তি, জীবন অতীষ্ঠ হয়ে ওঠবে, এমনকি মায়ের অবর্তমানেও তোমাকে খোচা দেবে।মাকে বউয়ের সেবায় সংসারকে আনন্দময় করে তুলতে হলে বউয়ের হাত দিয়ে মায়ের উপহার দিন। কারণ, মা যতটুকু সহ্য করতে পারবেন, মেনে নিতে পারবেন- বউ তত পারবেন না। কম বয়সী মেয়েরা অভিমানী হন, তারা ভালবাসা ছাড়া কিছু বুঝেন না। বাস্তবতাকে আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে সংসারে অশান্তি আসে। তাই প্যাকেটটা মায়ের হাতে দিলে তিনি তার সামান্য সুফলও পাবেন না। কিন্তু বউয়ের হাত দিয়ে মাকে দিলে অন্তত সামান্য হলেও সুফল পাবেন।একজন শিক্ষার্থী বললেন : বউ যদি মাকে পুরো বঞ্চিত করেন?সাধারণত করেন না। কারণ, বউ আপনার মাকে বঞ্ছিত করে আপনার বিরাগভাজন হবেন না। যদি কেউ করেন, সেটি হবে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম উদাহরণ হতে পারে না। গবেষণায় এমনটি দেখা যায়নি।তোমাদের হয়তো অনেকের জানা আছে, সম্রাট আকবরের দরবারে আগত এক অতিথি রাজাকে পানের বাটা তুলে দেওয়ার গল্প! পানের বাটাধারী এসে দ্বন্ধে পড়ে গেলেন। কার হতে তুলে দেবেন বাটা। রাজার দিলে সম্রাট ভাববেন, আমার খায, আমার পরে, সে কিনা আমার অধীন সামান্য এক রাজার কাছে পানের বাটা তুলে দিল। যদি সম্রাটের হাতে তুলে দেন তো, রাজা ভাববেন, মেহমান হিসাবে ডেকে এনে অপমান! এ অবস্থায় পানদার সম্রাট আকবরের হাতে পানের বাটা তুলে দিয়ে বললেন : মহামহিম সম্রাট, আপনি নিজ হাতে আপনার মেহমানকে পানের বাটা তুলে দিয়ে সম্মানিত করুন। দুজনেই খুশি।বউ যদি আমার মাকে কষ্ট দেন?শিক্ষক : কারণটা খুঁজে বের করতে হবে এবং তোমাকেই সেটি বন্ধ করতে হবে। সংসারকে রাষ্ট্রের চেয়েও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। এখানে আবেগ নয, স্ববেগ প্রয়োগ করতে হবে। মাঝে মাঝে মা ও বউ উভয়কে নিয়ে বেড়াতে যাবে। গল্পচ্ছলে বউকে বুঝাতে হবে, একদিন তিনিও শাশুড়ী হবেন, মাকে বুঝাতে হবে একদিন তিনিও বউ ছিলেন। তবে সবক্ষেত্রে মা-কে বেশি মেনে নিতে হবে। তিনি মা, তার অভিজ্ঞতা বেশি।একজন শিক্ষার্থী বললেন : আমি অবশ্যই প্যাকেটটা মায়ের হাতে তুলে দেব।এতবড় প্যাকেট আপনার বৃদ্ধা মা রাখতে পারবেন না। মাটিতে পড়ে ভেঙে যাবে। মাকে দিয়ে হচ্ছে না বলেই তো বিয়ে করেছ, নাকি? মাকে যদি কেউ সংসার জীবনের জন্য যথেষ্ট মনে করেন এবং বউ এলে মা অত্যচারিত হবে ভাবেন, তাদের বিয়ে না-করাই উত্তম। অন্তত মা গত হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরা উচিত|
আফ্রিকান এক শিক্ষার্থী বলল : কে বড়, মা না বউ?
শিক্ষক : জন্ম তারিখ দেখেই তো তা বোঝা যায়।
না, মানে বলতে চাইছি মায়ের গুরুত্ব বেশি নাকি বউয়ের?
শিক্ষক : শ্বাসনালীর গুরুত্ব বেশি নাকি ফুসফুসের? কলিজার নাকি হৃদপিণ্ডের? মুরগির নাকি ডিমের?
একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন।

এটাই আসল কথা। বোন আর বোনের স্বামীর মধ্যে যেরূপ মধুর সম্পর্ক তুমি আশা কর, তোমার আর তোমার স্ত্রীর সম্পর্ক কমপক্ষে ততটুক মধুর হওয়া উচিত। প্রত্যেক মায়ের উচিত তার পুত্রবধূর সঙ্গে এমন আচরণ করা, যা তিনি তার কন্যার জন্য কন্যার শাশুড়ি হতে আশা করেন। 

Sunday 24 January 2016

নিকৃষ্ট জাতির বৈশিষ্ট ; ড, মোহাম্মদ আমীন

নিকৃষ্ট জাতির বৈশিষ্ট্য

---------------------------------------------------------------------পৃথিবীর অতি নিকৃষ্ট জাতির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হলো। আপনার জানা থাকলে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য দিন এবং যদি আপনি অকুতোভয় হোন তো বলুন, পৃথিবীর এক বা একাধিক অথবা অন্তত একটি নিকৃষ্ঠ জাতির নাম বলুন।
নিকৃষ্ট জাতির বৈশিষ্ট্য : 
১. অতি সংখ্যাগুরু হয়েও সংখ্যালঘু জাতির পদানত থাকতে বাধ্য হয়। তারা কেবল মাথা গণনা করে কিন্তু মাথার মগজ নিয়ে ভাবে না। ফলে, মাথাগুলো মৃত খুলির মতো ভয়ঙ্কর ভৌতিকতায় কেবল জন্ম দেয়। অজ্ঞতা ও সামর্থ্যহীনতার জন্য তারা কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। তারা সাহসী নয়, পাশব; এর ভীরু এবং প্রচণ্ড লোভী। সামান্য অর্থের জন্য বিশ্বাসঘাতকতা করতে কুণ্ঠিত হয় না। 
২. কুসংস্কার, পৌরাণিক কাহিনি, অলৌকিকতা, পশ্চাদপদতা ও একগ্রন্থমুখীনতায় কঠিনভাবে আবদ্ধ থাকার কারণে পরিবর্তনকে পাপ মনে করে। পরিবর্তন এদের কাছে ভয়ঙ্কর, এরা কেবল অতীত আঁকড়ে ধরতে চায়। মনে করে অতীতের সবকিছু ভালো, বর্তমান জঘন্য। অতীত আকড়ে থাকে বলে আধুনিকতা তাদেরকে চরম অবহেলা করে। তাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অতীতের বাস্তবতা বিবর্জিত বিশ্বাস দ্বারা ছেয়ে থাকে। ফলে, তারা আধুনিক যানের সঙ্গে ঠেলাগাড়ি নিয়ে অসম প্রতিযোগিতার শিকারে বার বার পরাজিত হতে থাকে। এমন জাতির বুদ্ধিজীবীরা মিথ আর বিজ্ঞান, কল্পকাহিনি আর জ্ঞানকে মিশিয়ে পুরো জাতিকে উদ্ভট করে দেয়।
৩. সর্বজনীনতা না-থাকায় তারা নিজ জাতি ছাড়া অন্য সবাইকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে,  তারা ভালবেসে টেনে নিতে জানে না তবে গ্রাস করে নিতে উদগ্রীব থাকে। কিন্তু সামর্থ্যহীনতার কারণে তা-ও পারে না। বরং নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যায়, নিজেদের ভূমি হারিয়ে ফেলে।  নিজস্ব মতবাদ প্রচারের জন্য অনুসারীদেরকে জোড়ায় জোড়ায় কতল করার নির্দেশ দেয়। হিংস্রতা দেখাতে গিয়ে তারা নিজেরাই বিশ্বব্যাপী হিংস্রতার শিকারে পরিণত হয়। এদের একাধিক উপজাতি বা উপগোত্র রয়েছে এবং এক উপজাতি বা উপগোত্র অন্যকে ভূয়া বলে বাতিল ঘোষণা করে। একজন আর একজনকে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাসঘাতকতা তাদের মজ্জাগত। 
৪. একান্ত অনুসারী ছাড়া অন্যদের চরম শত্রু ভাবে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের চরম অকল্যাণ কামনা করে। অথচ নিজেদের মৌলিক চাহিদা ও প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনা করার জন্য ভিন্ন মতাবলম্বীদের আবিষ্কারের দিকে তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকে। অন্য ধর্মাবলম্বীকে পাপিষ্ঠ বলে গালি দেয় কিন্তু পাপিষ্ঠদের নির্মিত যন্ত্রে চড়ে পূণ্য অর্জনের জন্য তীর্থে যায়। 
৫. সংখ্যায় এর অগণিত, লাখে লাখে বেশুমার। তারপরও অন্য জাতির কেউ জাত বা ধর্ম ত্যাগ করে নিজেদের দলে যোগ দিলে সত্যমিথ্যা যাচাই না-করে কথিত সংবাদে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। অথচ জানে না ঘটনাটা আদৌ সত্য কিনা। যোগদানকারী কি এবং কে- তাও বিবেচনা করে না। এদর কাছে সংখ্যাই মুখ্য, গুণের কোনো মূল্য নেই। এদের কাছে একজন রিক্সাওয়লা ও একজন পাইলট সমান। কায়িক শ্রমের উপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল।
৬. সর্বক্ষণ অন্তর্কলহ ও পরচর্চায় নিয়োজিত থাকে। স্বার্থের জন্য নিজের ভাই, বন্ধু, অনুসারী এমনকি মা-বাবাকেও শেষ করে দিতে কুণ্ঠিত বোধ করে না। স্বার্থানুযায়ী মতবাদ প্রচার করে ও ব্যাখ্যা দেয়। নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করে। অন্য জাতির দুর্যোগে চরম আনন্দ পায় এবং বিপদ কামনা করে। আবার নিজেদের দুর্যোগে তাদেরই সহায়তায় বিপদমুক্তির জন্য ধর্ণা দেয়। 
৭. এরা মাতৃভাষার চেয়ে অন্য ভাষাকে অধিক পবিত্র মনে করে। পিতা-মাতার চেয়ে গুরু-ঠাকুরকে অধিক মর্যাদা দেয়। শিক্ষিত, জ্ঞানী ও প্রগতিশীল লোকদের সমালোচনা করে এবং তাদেরকে পাপিষ্ঠ ভাবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শোনালে পৌরানিক কাহিনির দোহাই দিয়ে জ্ঞানীদের কটাক্ষ করে। মিথ-পিরিত তাদের সকল অগ্রসর চিন্তাকে অন্ধের মতো কালো অন্ধকারে ঢেকে রাখে।
৮. তাদের কাজ আর কথার মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। তারা যা বলে তা করে না এবং যা করে তা বলে না। দিনের বেলা যা নিষিদ্ধ, রাতে তা দিব্যি আরামে উপভোগ করে যায়। সাধারণ জীবনযাপনকে পূণ্যময় মনে করলেও নিজেরা অত্যন্ত বিলাসী জীবন উপভোগ করে। 
১০. অপার্থিব ক্ষমতার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন, শত্রু মোকাবেলা এবং সম্পদশালী হওয়ার চিন্তা করে। তাই প্রকৃতপক্ষে তারা সবাই দরিদ্র থেকে যায়- আজীবন এবং প্রগতিশীল জাতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। 
১১. এরা শিক্ষায় পিছিয়ে আছে এবং আধুনিক শিক্ষাগ্রহণকে এখনও পাপ মনে করে। যারা শিক্ষিত হন, তাদেরকে পাপিষ্ঠ ও ঈশ্বরদ্রোহী গণ্য করে একঘরে করে দেয়। 
১২. বিজ্ঞানের সকল সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করলেও বিজ্ঞানকে ঘৃণা করে। বিজ্ঞানের অনেক কথা মেনে নিতে চায় না কিন্তু বিপদে পড়লে আশ্রয় নেয় বিজ্ঞানে। বলে, পৃথিবী গোলাকার নয়, সমতল। 
১৩. এরা শাক্ত। শক্তির পুজা করে কিন্তু নিজেরা শক্তিহীন। সবসময় আচার-আচরণে শক্তের ভক্ত, নরমের যম। মিথ্যা বলে বেশি, সত্য বলে কম। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব আদর্শ ও বিশ্বাস বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত বোধ করে না। অথচ প্রকৃত ক্ষমতা কখনও পায় না। এদের বিশ্বাস সর্বদা পার্থিব প্রাপ্তি ও সংকীর্ণ স্বার্থকে ঘিরে আবর্তিত হয়। শাক্ত বলে এর সাধারণ মানুষের শক্তি ও গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে প্রয়োগ করে না।
১৩. অনেক ক্ষেত্রে এদের ধর্ম ও সংস্কৃতি অভিন্ন থাকে না। এজন্য তারা ধর্ম ও সংস্কৃতি কোনোটাকে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতে পারে না। তারা জাতীয়তাবোধ, স্বকীয়তা, ব্যক্তিত্ব ও দেশপ্রেমের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ গুনাবলি  হতে অনেক পিছিয়ে থাকে। এজন্য সহজে, তারা অন্য জাতির পদানত হয়ে পড়ে। এদের কেবল বিশ্বাস আছে কিন্তু বিশ্বাসে আস্থা নেই। ইহকালের চেয়ে পরকাল অনেক আনন্দময় বিশ্বাস করলেও, কেউ সহজে পরকালের ওই আনন্দময় জগতে প্রবেশের জন্য মোটেও আগ্রহী থাকে না।
১৪. এরা বিবর্তনবাদে অবিশ্বাসী কিন্তু বিবর্তন হয়ে এতদূর যে এসেছে- এটা মোটেও মেনে নিতে চয় না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিয়ে এত মগ্ন থাকে যে, সারাক্ষণ ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করে। নিজের ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে অন্যকে আহত করে, হত করে। 
১৫. এদের কিছু সদস্য বিজ্ঞান পড়লেও বিজ্ঞানমনস্ক হয় না। কারণ এরা শুধু পার্থিব লোভ আর সহজে চাকরি পাওয়ার জন্য বিজ্ঞান পড়ে। জাতি বা গোষ্ঠী বা দেশের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা দেখা যায় না। প্রত্যেকে কেবল নিজের চিন্তা করে বলে, জাতি গঠন ও দেশনির্মাণে তাদের প্রকৃত অর্থে কোনো আন্তরিকাতা পরিলক্ষিত হয় না। 
১৬. এদের আনুগত্য, জাত্যাভিমান, দেশপ্রেম বা নেতৃত্ববোধ কেবল ব্যক্তিস্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। নিজেদের নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না-করে নেতার ক্ষমতা, সম্পত্তি ও সম্পদ ভাগাভাগির ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে এবং নেতার লাশ পচে গন্ধ বের না-হওয়া পর্যন্ত হুশ ফেরে না। 
১৭. এরা শিক্ষিত হলেও জ্ঞানী নয়, প্রকৃতি ও বাস্তবতা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না, জানে না। এরা মারাত্মক ধর্মবাজ, কুসংস্কাচ্ছান্ন, গোড়া, উগ্র জাতীয়তাবাদী, জীবনের সবক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে নিয়ে আসে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করে। যারা প্রগতির কথা বলে,তাদের নির্যাতন করাকে পুণ্য মনে করে। 
১৮. এর ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার চরম বিরোধী। যারা নতুন কিছু বলে বা নতুন কিছু করতে চায়, তাদেরকে স্বগোত্রীয় হলেও ক্ষমা করে না। এরা সবসময় সংস্কার বিরোধী এবং প্রবলভাবে অন্ধবিশ্বাসে আবদ্ধ। এদের রীতি-নীতি ও অনুভব মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধির প্রতিবন্ধক বলে কোনো সংস্কারককে মেনে নেয় না। এদের মতবাদ ভিত্তিহীন বলে কোনো সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। ভয় পায়, যদি আলোচনা তাদের ভিত্তিহীন ভত্তিকে চুরামার করে দেয়!  
১৯. অজ্ঞ বলে এদের কাছে যুক্তির কোনো দাম নেই। যুক্তিবাদীদের মনে করে শত্রু। তাদের বিচার ও বিবেচনাবোধ একগ্রন্থমুখী নির্দেশনার আলোকে অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিদের ইচ্ছায় তাড়িত হয়। এখানে না থাকে বিজ্ঞান, না থাকে দর্শন, না থাকে কোনো সংস্কৃতি। ফলে একই ভাষা, একই ধর্ম এবং একই সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র গঠন করতে পারে না। বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে বলে সহজে শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

Saturday 23 January 2016

বরিশাল সদর উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন

বরিশাল সদর উপজেলা 
তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, কচা ও কীর্তনখোলা নদী বিধৌতা বরিশাল সদর উপজেলার আয়তন আয়তন ৩০৭.৫৯ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকষংখ্যা ৪,৬৯,৯৬০। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮ জানুয়ারি । বরিশাল সদর থানার নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। বরিশাল নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে।বাকলা অঞ্চল লবণ উৎপাদন ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবসার জন্য প্রাচীনকাল হতে বিখ্যাত ছিল।শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি ছিল গিরদে বন্দর। গিরদে অর্থ একটি নির্দিষ্ট এলাকা। গিরদে ছিল বরিশালের প্রাচীন একটি নাম। এখানে লবণের বড় বড় গোলা ছিল। গিরদে ছিল দক্ষিণ বাংলার লবণ শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি। ইউরোপীয় বণিকগণ গিরদে বন্দরকে বড়িশল্ট বলতে। অনেকে মনে করেন, বড়িশল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নাম ধারণ করে। আবার অনেকের মতে, এখানকার লবণের দানাগুলো বড় ছিল। তাই ইংরেজগণ এখানকার লবণকে বড়িশল্ট বলতেন। যা হতে বরিশাল নামের উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীনকালে বরিশালে বড় বড় শাল বৃক্ষ ছিল। তাদের মতে বড়শাল বৃক্ষ হতে এলাকার নাম হয় বরিশাল। বরিশাল নামের আর একট কিংবদন্তি বেরি নামের এক পর্তুগিজ যুবক ও শেলি নামের এক পর্তুগিজ কন্যার নামের সাথে সম্পৃক্ত। বেরী নামের এ যুবক শেলীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বেরি আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় ‘বেরিশেলী’ যুগল নাম তখন লোকের মুখে মুখে। ‘বেরীশেলী’ই পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়। কারো কারো মতে, শঅল অর্থ গৃহ, বরিশালে বড় বড় গৃহ নির্মিত হয় বলে এর নাম বড়শাল বা বরিশাল। আলোচ্য এলাকাটি একসময় ঘন জঙ্গলে আচ্ছন্ন ছিল। জঙ্গল পরিষ্কার করে এ জনপদের পত্তন হয়। জঙ্গলে প্রচুর বাঘ ছিল। স্থানীয় লোকজনের কাছে বাঘ বড় শিয়াল নামে পরিচিত ছিল এবং এর আঞ্চলিক উচ্চারণ ছিল বশিয়াল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে ‘বশিয়াল’ অর্থ বাঘ নির্দেশ করেছেন। কথিত হয়, এ বশিয়াল বা বড় শিয়াল থেকে বরিশাল নামের উদ্ভব। আবার অনেকের ধারণা, বুকরি চাল নামক এক প্রকার মোট জাতের চাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভ। এক সময় আলোচ্য এলাকায় প্রচুর বুকরি চাল উৎপন্ন হতো। কথিত হয়, এ বুকরি চাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভব। অন্য একটি প্রবাদমতে, বরিষার কাল বা বর্ষাকাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভব। 

বাকেরগঞ্জ উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন




তেঁতুলিয়া, খারাবাদ, চরামুদ্দি, পাণ্ডব ও পাণ্ডো নদী বিধৌত বাকেরগঞ্জ উপজেলার আয়তন ৪১৭.২ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ৩,৫৪ম২৬০। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগষ্ট এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। নবাব আলীবর্দি খার আমলে আগা বাকের খান বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের বুজর্গ উমেদপুর পরগণার জমিদারি লাভ করে। আগা বাকের ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে সুগন্ধার শাখা নদী খয়রাবাদ নদীর তীরে নিজ নামে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন নাম দেন বাকেরগঞ্জ। বাকেরগঞ্জ বন্দরের গুরুত্বের কারণে বাকলা তার পূর্ব গৌরব ও পরিচিতি হারিয়ে ফেলে এবং পুরো এলাকা বাকেরগঞ্জ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

বানারীপাড়া উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


সন্ধ্যা, হারতা, নলশ্রী, জৈনকাঠি ও স্বরূপকাঠি নদী বিধৌত বানারীপাড়া উপজেলা আয়তন ১৩৪.৩২ বর্গ কিলোমটিার এবং লোকসংখ্যা ১,৫৩,১৬০। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বানারীপাড়া নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন এককালে এ অঞ্চলে প্রচুর বানর ছিল। তাই এলাকার নাম হয় বানরপাড়া। যার অপভ্রংশ বানারীপাড়া। অনেকে মনে করেন বানা ও আড়াআড়ি হতে বানারীপাড়া। বানা শব্দের অর্থ বাঁশের পাতলা সরু চটা দিয়ে প্রস্তুত মাছ আটকানোর বেড়া। এক সময় আলোচ্য এলাকায় মাছ আটকানোর জন্য খাল, নদী ও হাউড় কিংবা বিলে আড়াআড়িভাবে প্রচুর বানা বসানো হতো। বানা ও আড়াআড়ি শব্দদ্বয় যুক্ত হয়ে বানারী। যে পাড়া বা লোকালয়ে  এ বানা বেশি ছিল সেটি বানারীপাড়া নামে পরিচিতি পায়। আবার অনেকে মনে করেন বেনিয়া শব্দের তদস্থানের কথ্যরূপ বানারী। বেনিয়া অর্থ ব্যবসায়ী। এককালে আলোচ্য এলাকায় বহু বানারী ছিল। তাই পাড়াটির নাম হয় বানারীপাড়া।

উজিরপুর উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


আমতলী, কালিজিরা, উজিরপুর, বিষারকান্দি, নান্দা ও হারতা নদী বিধৌত উজিরপুর জেলার আয়তন ২৪৮.৩৫ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ২,৪২,৭২০। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। উজিরপুর নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন, উজির আল মামুন নামক এক জলদস্যু এখানে আস্তানা গেড়ে দস্যুতা করে বেড়াতো। তার নামানুসারে এলাকার নাম হয় উজিরপুর। আবার অনেকের মতে, ‘ফকির মোহাম্মদ’ নামক নবাবে মুর্শিদাবাদের এক উজির এ অঞ্চলে বসবাস করতেন। সে উজির হতে এলাকার নাম হয় উজিরপুর। উজিরপুর নামকরণের আরেকটি প্রবাদ  উজার বা উজোড় শব্দের সাথে সম্পৃক্ত। এর অর্থ জনশুণ্য স্থান বা বিরানভূমি। ষষ্ঠদশ শতকের এক ভয়ঙ্কর বন্যায় এলাকাটির জনমানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা ইত্যাদি উজার হয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল। তাই এলাকাটির নাম হয় উজারপুর। যার অপভ্রংশ উজিরপুর। 

বাবুগঞ্জ উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


আমতলী, আড়িয়াল খাঁ, সুগন্ধা, সন্ধ্যা ও শিকারপুর নদী বিধৌত বাবুগঞ্জ উপজেলার আয়তন ১৬৪.৮৮ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১,৪৭,৪০০ জন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্র“য়ারি এখানে থানা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় । বাবুদের গঞ্জ হতে বাবুগঞ্জ। এলাকার অভিজাত ও প্রভাবশালী হিন্দুদের বাবু বলা হতো। আড়িয়াল খা নদীর তীরে অনেক পূর্বে এলাকার অভিজাত ও প্রভাবশালী লোকজন এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাবুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এ বাজার বাবুগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার অনেকে মনে করেন, আলোচ্য এলাকাটি যশোর পরগনার জমিদার ‘বাবু বিরাজ রায় চৌধুরী’র জমিদারির অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রজাসাধারণের সুবিধার্থে তিনি আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে তার নামানুসারে বাবুগঞ্জ নামের একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে এলাকাটির নাম হয় বাবুগঞ্জ। 

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা 
আজিমপুর, আড়িয়াল খাঁ, চিলমারি, মাসকাটা, সুলতানা, খালিয়ার, গনেশপুরা, তেঁতুলিয়া, লোয়ারা মেঘনা ও ধর্মগঞ্জ নদী বিধৌত মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আয়তন ৪৩৫.৮০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২,৯৬,৪৪০। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর স্থাপিত হয়। আগা বাকেরের আমলে ‘মেহেন্দী খান’ নামক এক আমাত্য নদীর তীরে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তুলেন। মেহেন্দি খানের নামানুসারে বাণিজ্য কেন্দ্রটির নাম হয় মেহেন্দিগঞ্জ। আবার অনেকে মনে করেন আগা বাকেরের পুত্র  মেহেদী খান এর নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় মেহেন্দিগঞ্জ।

হিজলা উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


জয়ন্তী, নয়াভাঙানি, মেঘনা, লোয়ার মেঘনা ও আজিমপুর নদী বিধৌত হিজলা উপজেলার আয়তন ৫১৫.৩৬ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১,৭৭,০২০। এটি জেলার বৃহত্তম উপজেলা। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর বদরটুনিতে প্রথম থানা সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। কথিত হয়, হিজল গাছ হতে হিজলা। এক সময় এ এলাকায় প্রচুর হিজল গাছ ছিল। এ হিজল গাছ থেকে হিজলা নামের উদ্ভব। হিজলা শব্দের অর্থ হিজল গাছ সম্বলিত লোকালয়।

মুলাদী উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


জয়ন্তী, আড়িয়াল খাঁ, খালিয়ার নদী, নয়াভাঙ্গা ও পলারদি নদী বিধৌত মুলাদী উপজেলার আয়তন ২৬১.০২ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১,৭৮,৬২০। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয়। মুলাই খান নামক জনৈক দরবেশের নামানুসারে এলাকার নাম হয় মুলাদি। মুলাদি অর্থ মুলই খানের দ্বীপ। নদী বেষ্টিত ও দ্বীপসদৃশ এ ভূখণ্ডে মুলাখান আস্তান স্থাপন করলে দ্বীপটির নাম হয় মুলাইদি; যার অপভ্রংশ মুলাদি। আবার অনেকে মনে করেন, এ দ্বীপে এক সময় প্রচুর মুলা জন্মাতো। তাই এলাকার নাম হয় মুলারদী। যার অপভ্রংশ মুলাদী।

আগৈলঝারা উপজেলার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


বিষারকান্দি, পয়সা ও নান্দা নদী বিধৌত আগৈলঝারা উপজেলার আয়তন ১৬১.৮২ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১,৪৯,৬০০। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের  ১৬ জুন এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয়। আগৈল অর্থ মাটি কাটার ঝুড়ি এবং ঝারা অর্থ ঝেরে ফেলা বা কোন পরিষ্কার করা। সুতরাং আগৈলঝারা শব্দের অর্থ মাটি কাটার ঝুড়ি ঝারা। সপ্তদশ শতকে নবাব আলী খাঁর আমলে ছবি খাঁ নামক এক সুবাদার বর্তমান আগৈলঝারা, গৌরনদী, উজিরপুর ও কোটালিপাড়া নিয়ে গঠিত একটি পরগনার আঞ্চলিক শাসক ছিলেন। তদকালে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট নিরসণের জন্য দীঘির কোন বিকল্প ছিল না। ছবি খাঁ দীঘি খননের সময় অনেক শ্রমিক নিয়োগ করেন। শ্রমিকেরা কাজ শেষে একটি নিচু স্থানে আগৈল ঝাড়তেন। এভাবে আগৈল ঝাড়তে ঝাড়তে সেখানে একটি মাটির ঢিবি গড়ে উঠে। এ ঢিবির পাশে য়ে লোকালয় গড়ে উঠে তার নাম হয় আগৈলঝারা। শ্রমিকদেরকে যে স্থানে মজুরি প্রদান করা হতো তার নাম হয় পয়সারহাট।

গৌরনদী উপজেলা ও নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


নুন্দা, আগরপুর ও তরকি নদী বিধৌত গৌরনদী উপজেলার আয়তন ১৪৪.১৮ বর্গ কিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা ১,৭৯,২৬০। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে থানা সদর প্রতিষ্ঠিত হয়। এক সময় এ এলাকাটির পাশ দিয়ে মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ ও গড়াই নদীর মিলিত প্রবাহ হতে সৃষ্ট একটি ছোট নদী প্রবাহিত হতো। ঐ নদীটির পানি ছিল গৌরবর্ণের। তাই লোকে স্রোতস্বিনীটিকে গৌরনদী বলতো। নদীটি এখন বিলুপ্ত। গৌরবর্ণের জলবাহিত এ নদীর পানির স্রোতধারায় আলোচ্য এলাকার জনপদ বিধৌত হতো। তাই এলাকার নাম নদীর নামানুসারে হয় গৌরনদী। 

বরিশাল ও বরিশাল জেলার নামকরণ / ড.মোহাম্মদ আমীন


মোঘল আমলের পূর্বে বাকলা নামকরণের পূর্বে এলাকার নাম ছিল ‘চন্দ্রদ্বীপ’। চন্দ্রদ্বীপ নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে আলোচ্য এলাকার চন্দ্রকলার মতো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতো বলে এর নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। আবার অনেকে বলেন, জনপদটির আকৃতি চাঁদের ন্যায় ছিল বলে নাম চন্দ্রদ্বীপ। দনুজমর্দন দেব তার গুরু চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর কৃপায় রাজ্য লাভ করেন। তাই তিনি এর নাম রাখেন চন্দ্রদ্বীপ। আবার অনেকের মতে, রাজা চন্দ্রবর্মার নামানুসারে নামকরণ হয় চন্দ্রদ্বীপ। অনেকে ধারণা, মহাদেবের কপালে চন্দ্রের  কারণে নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত চন্দ্রগোমিনের নাম থেকে এ জনপদের নাম চন্দ্রদ্বীপ হয়েছে বলেও অনেকের অভিমত। তবে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, চন্দ্রভন্ড্র নামক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। 
মোঘল শাসনামলে আলোচ্য এলাকার নাম হয় ‘বাকলা’। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী ও র‌্যালফ ফিচের বিবরণে বাকলা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এবার বাকলা নামের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করা যাক। বাকেরগঞ্জের প্রাচীন নাম বাকলা। বাঙ্গালার পরিবর্তিত রূপ বাকলা। প্রাগৈতিহাসিক আমলে বাকেরগঞ্জের উত্তরাংশে বাঙ জাতিগোষ্ঠীভূক্ত লোক বাস করতো। বাঙ শব্দ চিনা বা তিব্বতীয় গোষ্ঠী হতে আগত। প্রাচীনকালে বাকলা জলাভূমি ছিল। বাঙ জাতির লোকেরা তিন হাজার বছর পূর্বে জলাভূমি আবাদ করে বসতি স্থাপন করতো এবং বন্যা ও লোনা পানি হতে রক্ষার জন্য আইল বা আল দিতো। বাঙ জাতির নামের সাথে আল যুক্ত হয়ে হয় বাঙাল। বাঙাল জাতির আদি বাসস্থান বরিশাল। এদের একটা গোষ্ঠীকে চন্দ্রভণ্ড্র বলা হতো। চন্দ্রভণ্ড্র হতে বাকলার অপর নাম চন্দ্রদ্বীপ। বাকলা ছিল এর লোকায়ত নাম এবং চন্দ্রদ্বীপ ছিল রাজনীতিক নাম। ‘বাকলা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ শস্য ব্যবসায়ী। আলোচ্য এলাকাটি ছিল ধনধান্য ও শস্যে ভরপুর । তাই এখানে প্রচুর বাকলা বা শস্য ব্যবসায়ীর আগমন ঘটত। তাই এলাকার নাম হয় বাকল। অনেকের মতে বাকাল এক প্রজাতির সাপ। এ বাকাল হতে বাকলা নামের উৎপত্তি। আবার কারও কারও মতে গাছের বাকল হতে বাকলা নামের উদ্ভব। আলোচ্য এলাকাটি ছিল আবার কারো মতে, বাকাল নামক এক ধরে নর সাপের নাম থেকে ‘বাকলা’ নামের উদ্ভব। মধ্যযুগের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপূরাণ বা মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে বাকলা নামের উল্লেখ আছে। অবশ্য মোগল আমলে বাকলা ইসমাইলপুর নামেও অভিহিত হতো।

নবাব আলীবর্দি খার আমলে আগা বাকের খান বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের বুজর্গ উমেদপুর পরগণার জমিদারি লাভ করে। আগা বাকের ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে সুগন্ধার শাখা নদী খয়রাবাদ নদীর তীরে নিজ নামে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন নাম দেন বাকেরগঞ্জ। বাকেরগঞ্জ বন্দরের গুরুত্বের কারণে বাকলা তার পূর্ব গৌরব ও পরিচিতি হারিয়ে ফেলে এবং পুরো এলাকা বাকেরগঞ্জ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
বরিশাল নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে।বাকলা অঞ্চল লবণ উৎপাদন ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবসার জন্য প্রাচীনকাল হতে বিখ্যাত ছিল।শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি ছিল গিরদে বন্দর। গিরদে অর্থ একটি নির্দিষ্ট এলাকা। গিরদে ছিল বরিশালের প্রাচীন একটি নাম। এখানে লবণের বড় বড় গোলা ছিল। গিরদে ছিল দক্ষিণ বাংলার লবণ শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি। ইউরোপীয় বণিকগণ গিরদে বন্দরকে বড়িশল্ট বলতে। অনেকে মনে করেন, বড়িশল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নাম ধারণ করে। আবার অনেকের মতে, এখানকার লবণের দানাগুলো বড় ছিল। তাই ইংরেজগণ এখানকার লবণকে বড়িশল্ট বলতেন। যা হতে বরিশাল নামের উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীনকালে বরিশালে বড় বড় শাল বৃক্ষ ছিল। তাদের মতে বড়শাল বৃক্ষ হতে এলাকার নাম হয় বরিশাল। বরিশাল নামের আর একট কিংবদন্তি বেরি নামের এক পর্তুগিজ যুবক ও শেলি নামের এক পর্তুগিজ কন্যার নামের সাথে সম্পৃক্ত। বেরী নামের এ যুবক শেলীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বেরি আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় ‘বেরিশেলী’ যুগল নাম তখন লোকের মুখে মুখে। ‘বেরীশেলী’ই পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়। কারো কারো মতে, শঅল অর্থ গৃহ, বরিশালে বড় বড় গৃহ নির্মিত হয় বলে এর নাম বড়শাল বা বরিশাল। আলোচ্য এলাকাটি একসময় ঘন জঙ্গলে আচ্ছন্ন ছিল। জঙ্গল পরিষ্কার করে এ জনপদের পত্তন হয়। জঙ্গলে প্রচুর বাঘ ছিল। স্থানীয় লোকজনের কাছে বাঘ বড় শিয়াল নামে পরিচিত ছিল এবং এর আঞ্চলিক উচ্চারণ ছিল বশিয়াল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে ‘বশিয়াল’ অর্থ বাঘ নির্দেশ করেছেন। কথিত হয়, এ বশিয়াল বা বড় শিয়াল থেকে বরিশাল নামের উদ্ভব। আবার অনেকের ধারণা, বুকরি চাল নামক এক প্রকার মোট জাতের চাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভ। এক সময় আলোচ্য এলাকায় প্রচুর বুকরি চাল উৎপন্ন হতো। কথিত হয়, এ বুকরি চাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভব। অন্য একটি প্রবাদমতে, বরিষার কাল বা বর্ষাকাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভব। ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ‘বাংলাদেশের জেলা উপজেলা ও নদ নদীর নামকরণের ইতিহাস’ গ্রন্থে আরও বিস্তারিত আছে। 

রাজা রামমোহন রায় এবার বাংলাদেশে / ড. অনিমেষ চ্যটার্জি

ভেবেছিলাম, এবারও রাজা রামমোহন রায় অ্যাওয়ার্ড, ভারতে থেকে যাবে। কিন্তু না, তা হয়নি এবার রাজা রামমোহন চলে গেছেন বাংলাদেশে। পেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলা বানান-বিশারদ ও শুদ্ধ বানান চর্চা গ্রুপের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলা প্রমিত বানানে নব আন্দোলনের উদ্যোক্তা চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার অধিবাসী ড. মোহাম্মদ আমীন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তিনি বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শুদ্ধ বাংলা বানান, প্রমিত বাংলা প্রচলন, বাংলা ভাষার বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার, সর্বোপরি বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি রাজা রামমোহন রায় অ্যাওয়ার্ড, ২০১৫ লাভের বিরল গৌরব অর্জন করেন। আমরা কিন্তু কেউ তার নাম তেমন শুনিনি। কিন্তু জি বাংলার একজন পরিচালক যখন তাঁর নাম প্রস্তাব করেন, তখন টেবিল উল্টে যায়। নির্বাচকবৃন্দ জনাব আমীনকেই কেবল এ পুরষ্কারের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে মনোনীত করে বসেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও তার অবদান দেখে যথাযোগ্য গণ্যে মেনে নিয়েছেন সানন্দে।

উল্লেখ্য ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর রাজা রামমেহান রায় পর্ষদ একজন বাঙালিকে রাজা রামমোহন রায় পুরষ্কার দিয়ে আসছেন। এবছর এ সম্মানজনক পুরষ্কারটি পেয়েছেন ড. মোহাম্মদ আমীন। উল্লেখ্য, তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানায় জন্মগ্রহণ করেন। চন্দনাইশ থানা একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, নেলী সেনগুপ্ত প্রমুখের স্মৃতিধন্য চন্দনাইশ।
বাংলাদেশের বানান-বিশারদ ড. মোহাম্মদ আমীন। পুরষ্কারে একটি পদবিও উল্লেখ থাকে। ড. মোহাম্মদ আমীনকে দেওয়া হয়েছে বঙ্গভূষণ।রাজা রামমোহন রায় প্রথম ভারতীয় যিনি ধর্মীয় সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠতা এবং বাঙালি দার্শনিক।তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় শিক্ষা, বাংলা ভাষা ও সর্বজনীন শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন।বাংলা ভাষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। তার অবদানকে সম্মানিত করার জন্য প্রতিবছর রাজা রামমোহন রায় স্মৃতি পর্ষদ এমন একজন বাঙালিকে এ পদক দেন, যিনি বাংলা বানান ও বাংলা সাহিত্যের প্রমিত মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেন। এবার এমনটি পাওয়া গিয়েছে ড. মোহাম্মদ আমীনের কাছে। তাই পর্ষদ তাকে এ পুরষ্কারে ভূষিত করে। ড. মোহাম্মদ আমীনকে বঙ্গভূষণ পুরষ্কার তুলে দিচ্ছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির সচিব বিশিষ্ট কবি, গীতিকার ও সুরকার ভূইয় সফিকুল ইসলাম।