অনেকে মনে করেন, অভিধানে কোনো একটি শব্দের যে কয়টি বিকল্প বানান দেখা যায় সবগুলো শুদ্ধ। এ ধারণা ঠিক নয়। যেসব শব্দ অতীতে ব্যবহৃত হতো কিন্তু এখন হচ্ছে না, বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে তবে শুদ্ধ নয় এবং শুদ্ধ ও প্রমিত- সব ধরণের শব্দ অভিধানে থাকতে পারে। অভিধান ব্যাকরণ নয়, প্রমিত রীতিও নয় এটি শব্দ ভাণ্ডার। তাই ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হোক বা অশুদ্ধ হোক সব ধরণের শব্দ অভিধানে রাখা হয়।
যাঁরা অভিধান রচনা করেন তাঁরা বৈয়াকরণ হিসাবে অভিধান রচনা করেন না, আভিধানিক হিসাবে অভিধান রচনা করেন। পাঠক অভিধান দেখেন শব্দের অর্থ বা অর্থানুসারে বানান এবং প্রমিত বানান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য, ব্যাকরণ রীতি জ্ঞাত হওয়ার জন্য নয়। যে সকল শব্দ প্রচলিত ছিল বা আছে সবগুলো অভিধানে না-দিলে বিভিন্ন বানানে লেখা শব্দের অর্থ-উদ্ধারে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। এজন্য কোনো শব্দের যতগুলো বানান প্রচলিত ছিল বা আছে তা শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনা না করে অভিধানে উল্লেখ করা হয়। অতএব কেবল অভিধানভুক্তির কারণে কোনো শব্দ শুদ্ধ বা প্রমিত হয়ে যায় না। কোনো শব্দকে প্রকৃত অর্থে শুদ্ধ হতে হলে তা ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ হতে হয়। বিকল্প বিষয়টি দুর্ঘটনার জন্য রাখা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ বিকল্প পন্থা গ্রহণ করে না; অজ্ঞাতা, অযোগ্যতা, অসামর্থ্যতা, দুর্যোগ প্রভৃতি কারণে বিকল্প রাখা হয়। অভিধানে বিকল্প বানান হিসেবে রাখা শব্দের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তাই বিকল্প বানান স্বাভাবিক বানান নয়।
এবার দেখা যাক, অভিধান কী? অভিধানকে দোকানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পার্থক্য হচ্ছে, দোকান পণ্যভাণ্ডার এবং অভিধান শব্দভাণ্ডার। ক্রেতাসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী দোকানকে পণ্যসজ্জিত করা দোকানির কাজ। পণ্যের ভালোমন্দ, ক্রেতাসাধারণের লাভক্ষতি বা প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নির্ধারণ দোকানির কাজ নয়। সময়-স্থান ও প্রচলন বা চাহিদা অনুযায়ী দোকানি যেমন পণ্য সজ্জিত করেন, তেমনি আভিধানিক সজ্জিত করেন অভিধান। এজন্য একশ বছরের আগের অভিধানের শব্দভুক্তি আর পরের অভিধানের শব্দভুক্তিতে পার্থক্য দেখা যায়। একটি দোকানে চাহিদার সব পণ্য থাকার চেয়ে না-থাকাটাই অধিক স্বাভাবিক। তাই কোনো দোকানে কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি না-ও পাওয়া যেতে পারে। এর মানে এই নয় যে, পণ্যটি কোথাও নেই কিংবা অস্তিত্বহীন। তেমনি, কোনো নির্দিষ্ট অভিধানে বা প্রচলিত সবকটি অভিধানেও যদি কোনো শব্দ পাওয়া না-যায়, তবু কারও এমনটি বলা সমীচীন হবে না যে, ওই শব্দটি নেই। বাংলা ভাষায় কমবেশি চার লাখের মতো শব্দ আছে। তবে এ পর্যন্ত অভিধানভুক্ত শব্দের সংখ্যা দেড় লাখের কম। তাই কোনো শব্দ কোনো অভিধানে না পেলে তা নেই কিংবা অস্তিত্বহীন বলা উচিত নয়।
পণ্যের ভালোমন্দ বিবেচনার চেয়ে ক্রেতার চাহিদা মেটানো এবং পণ্যবিক্রি করা দোকানির মুখ্য বিষয়। ক্রেতার লাভক্ষতি কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতি-অবনতির দিকে নজর দেওয়া দোকানির কাজ নয়। এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে, নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। ভাষার জন্য এই আইনটির নাম ব্যাকরণ। দোকানে থাকা সবপণ্য যেমন ভালো হতে পারে - এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় না, তেমনি অভিধানে থাকা সকল শব্দ শুদ্ধ- এটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না। সিগারেট, মদ্য, ভেজাল পণ্য কিংবা পচ খাদ্যবস্তু স্বাস্থ্যহানিকর। তবু তা দোকানে রাখা হয়, বিক্রি করা হয়। দোকানি যদি ক্রেতার স্বাস্থ্য বিবেচনায় রত হয় তাহলে ব্যবসায় লাটে উঠবে। অভিধানও ঠিক দোকানের মতো। অভিধানকে শব্দের গুদামও বলা যেতে পারে। গুদামে রাখা সব পণ্য মানসম্মত ও ভালো কিংবা স্বাস্থ্যকর তা বলা যাবে না। গুদামে ভালো-মন্দ, আংশিক ভালো, আংশিক মন্দ- সব রকমের পণ্য রাখা হয়। তাই গুদামে রাখা সব পণ্য মানসম্মত- এমনটি ভাবা যেমন সমীচীন নয় তেমনি সমীচীন নয় অভিধানে উপস্থাপিত সব শব্দ শুদ্ধ ভাবা। শব্দের শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনার জন্য রয়েছে ব্যাকরণ বা ভাষা-বিধি। কোনো শব্দ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ব্যাকরণ রীতি অনুসরণ না করলে তা অভিধানে যতই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, সেটি শুদ্ধ বলে গণ্য হয় না।প্রচলিত আর প্রমিত বা শুদ্ধ এক জিনিস নয়। যেমন ঈদ বানান যতই প্রচলিত হোক, প্রমিত বানান বিধি অনুযায়ী শুদ্ধ নয়। তবু অশুদ্ধ ‘ঈদ’ শব্দটিও অভিধানে পাওয়া যায়। অর্থের যোগান দেওয়ার জন্য এমন প্রচলিত শব্দ অভিধানে রাখতে হয়া।
শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনা না করে বর্তমানে প্রচলিত ও অতীতে প্রচলিত ছিল এমন সব শব্দের বানান অভিধানে রাখা অভিধান রচয়িতাগণের কর্তব্য। তাঁদের দায়িত্ব কেবল প্রচলিত শব্দের অর্থ উপস্থাপন, শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া নয়। তবে কোনো কোনো অভিধানে শব্দের শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে কিছু ধারণা উপস্থাপন করা হলেও তা ব্যাকরণ রীতির আলোকে দেওয়া হয়। পাঠকের দায়িত্ব হচ্ছে বিচক্ষণতার সাথে প্রমিত রীতি অনুসরণ করে তা গ্রহণ-অগ্রহণ ও ব্যবহার।সুতরাং, অভিধানে ‘কোনো শব্দের যতগুলো বানান উল্লেখ আছে সবকটি শুদ্ধ’ এমন ভাবা বিধেয় নয়। একই শব্দের একাধিক বানান উল্লেখের ক্ষেত্রে অভিধানে সাধারণত যে শব্দটি শুদ্ধ, প্রচলিত ও প্রমিত-রীতি অনুসরণ করে সেটি প্রথম লেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংক্ষেপে শব্দসমূহের অবস্থানগত বিবরণও দেওয়া হয়। তবু কোন বানানটি শুদ্ধ তা অভিধানে উল্লেখ না থাকলে জানার জন্য প্রমিত রীতি সম্পর্কে অবগত থাকা সমীচীন।কোনো বিষয়, রীতি বা কার্যক্রম জনসাধারণের কাছে যতই জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, সরকারি নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তা বেআইনি বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে জন-চাহিদার স্বার্থে তার আইনানুগ স্বীকৃতি দিতে পারে। এভাবে আইন পরিবর্তন হয়, নতুন রীতির প্রবর্তন ঘটে। কোনো শব্দ শুধু ব্যাপক প্রচলনের কারণে যে শুদ্ধ হয়ে যাবে তা ঠিক নয়। ব্যাকরণবিধি অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ না-হলে অথবা বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রণকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা শব্দটির স্বীকৃতি না এলে তা অশুদ্ধই থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সার্বিক বিবেচনায় বহুল প্রচলিত শব্দটির বিষয়ে তাঁদের অবস্থান দ্রুত স্পষ্ট করা। অন্যথায় তাঁরা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন -এমনটি ভাবা যাবে না।ভাষা বহমান নদীর মতো নয়, প্রকৃতির মতো। এর পরিবর্তন বহুমাত্রিক দ্যোতনায় অভিযোজিত হয় নানা কারণে। তাই ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহে কোনো পক্ষের প্রতিবন্ধকতা বা বলপ্রয়োগ মঙ্গলজনক হতে পারে না। প্রেমিক বা প্রেমিকার উদ্দেশ্য এবং ধর্ষণকারীর উদ্দেশ্য অনেকটা অভিন্ন হলেও উত্তরণের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাষাকে প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সাবলীল কলহাস্যে অভিষিক্ত করে বরণ করার আবহ সৃষ্টি করলে তা সর্বজনীন হয়ে উঠতে বাধ্য। কেউ যদি মাতৃভাষার প্রচলিত রীতি-নীতি আত্মস্থ করাকে কষ্টকর গণ্যে কিংবা নিজের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার অজুহাতে তা পাল্টে দিতে চেষ্টা করেন সেটি ধর্ষণের মতোই বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নিজের প্রতি প্রেমমুগ্ধ করতে না পারার কারণে তাকে জোরপূর্বক নিজের বাহুডোরে আনার চেষ্টা করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি ভাষাকে শুধু আত্মস্থ করতে না পারার কারণে জটিলতার দোহাই দিয়ে ব্যাকরণের রীতিনীতি অগ্রাহ্যপূর্বক তা বদলিয়ে ফেলার কিংবা ব্যাকরণ রীতি অনুসরণে পরিবর্তনযোগ্য কোনো শব্দের পরিবর্তনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টাও স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। আর একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যারা বিদ্যমান বিষয়কে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে নতুন কিছু গ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব থাকে তারা সে নতুন লভ্য বস্তুকেও দ্রুত পরিত্যাগ করার জন্য আরও বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠে। এটি অস্থিরতার লক্ষণ। এমন কর্ম উন্নয়নের মারাত্মক অন্তরায়। মড়ার আগে কাউকে মেরে ফেলা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মড়াকে আঁকড়ে ধরাও ঠিক নয়।
ভাষা পরিবর্তনশীল। চর্যাপদ হতে আধুনিক বাংলা ভাষার দিকে তাকালে এ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আমি ভাষার পরিবর্তনের বিপক্ষে নই। তবে তা হবে প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের মতো সাবলীল, ভালোবাসার মতো মোহনীয়, গ্রহণের মতো মুগ্ধকর। কখনও কোনো অবস্থাতেই স্বেচ্ছাচারমূলক নয়। অতএব অভিধানে কোনো শব্দ থাকার জন্য ওই শব্দকে (বানানকে) শুদ্ধতার নজির হিসেবে উপস্থাপন আদৌ উচিত নয়।
No comments:
Post a Comment