ছোটবেলায় পড়েছি, “ যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধভাবে লিখিতে, বলিতে, পড়িতে ও বুঝিতে পারা যায়- তাহাকে ব্যাকরণ বলে।” এটি আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংজ্ঞার্থের শিশুরূপ। তিনি বলেছেন, “যে বিদ্যার দ্বারা কোনও ভাষাকে বিশ্লেষ করিয়া তাহার স্বরূপটী (স্বরূপটি) আলোচিত হয়, এবং সেই ভাষার গঠনে ও লিখনে এবং তাহাতে কথোপকথনে শুদ্ধ-রূপে তাহার প্রয়োগ করা যায়, সেই বিদ্যাকে সেই ভাষার ব্যাকরণ বলে।” ব্যাকরণ নিয়ে রচিত পৃথিবীর সব বৈয়াকরণের সংজ্ঞার্থ প্রায় অভিন্ন। আমি কিন্তু প্রচলিত সংজ্ঞার্থসমূহের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না-করে সংজ্ঞার্থগুলোর বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতে চাই। ব্যাকরণ যদি প্রচলিত সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে ভাষা, প্রকৃতির মতো প্রত্যহ নতুন আঙ্গিকে আমাদের বিমোহিত করার সুযোগ পেত না। সুনীতিবাবুর ‘টী’ আমরা ‘টি’-লিখতে পারতাম না।
অনেকে বলেন, ভাষা নদীর মতো। তা যথার্থ নয়; ভাষাকে এত ক্ষুদ্র বৈচিত্র্যে সীমাবদ্ধ করা সমীচীন মনে হয় না। আমি বলি, ভাষা প্রকৃতির মতো; নদী প্রকৃতির একটি উপাদান মাত্র। ভাষার প্রতিবর্ণকে প্রকৃতির একেকটি উপাদানের মতো ভাবা যায় — বাংলা ভাষায় ‘দন্ত্য-ন’-কে যদি ধরা হয় নদী; হ-হিমালয়, আ- আকাশ, স- সমুদ্র, ঐ— ঐশ্বর্য। নদী থেকে সাগর; হ থেকে হিমালয়; ম থেকে মাটি; আ থেকে আকাশ; আকাশ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে বন্যা, পলি, সবুজ- - -। ভাষাকে নদীর মতো করে ভাবা হলে ‘দন্ত্য-ন’-এর মতো একটা অক্ষর নিয়ে ভাষাকে সীমিত অঞ্চলে মরার অপেক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকতে হতো, এভাবে হারিগে গেছে কত ভাষা, হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। ন-কে চলতে হলেও ম-লাগে। সুতরাং ভাষা নদীর মতো নয়, ভাষা প্রকৃতির মতো বলেই এটি এত বৈচিত্র্যময়, ভাষার এত উত্থান, এত হৃদয়বিদারক পতন এবং এত আকর্ষণীয় স্বভাব-তাণ্ডব।
প্রায় সব সংজ্ঞার্থে বলা হয়েছে, ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানার জন্য এবং ভাষার অশুদ্ধতা রোধে ভাষাভাষীকে সতর্ক করার জন্য বা ঋদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যাকরণ। অনেকে আরও জোর দিয়ে বলেন, “ব্যাকরণ ভাষার সংবিধান”। এটি কোনোভাবে যথার্থ নয়। আমি এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে অনেকটা জোর করে বাকস্বাধীনতা রূদ্ধ করে দেওয়ার মতো নৃসংশতার সঙ্গে তুলনা করি। ব্যাকরণকে যারাই ভাষার সংবিধান বলেছেন, তাদের আচরণই অনেক সমৃদ্ধ ভাষার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তা যদি না-হতো তাহলে ব্যাকরণ-কঠোর সংস্কৃত ভাষা আজ মৃত কেন? কেন এককালের বিখ্যাত ল্যাটিন আজ হারিয়ে! এরূপ অনেক ভাষা ব্যাকরণ নামক কাঠোন শাসন-বিধির যাতনায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। ওসব ভাষার বৈয়াকরণগণ ভাষাকে শাসন করার জন্য ব্যাকরণকে ব্যবহার করেছেন। তাদের কাছে ব্যাকরণ ছিল ভাষার সংবিধান, রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে যেমন বিধি। প্রচলিত ব্যাকরণের সংজ্ঞায় তারা ভাষাকে শাসন করতে গিয়ে ভাষা-প্রকৃতির সীমাহীন সৃষ্টিশীলতা তথা প্রাণবায়ুকে শ্বাসরোধ করে খুন করার মতো হত্যা করে ফেলেছেন। ফলে ভাষাপ্রকৃতি নির্বাক হয়ে গিয়েছে। প্রেম আর ধর্ষণ উভয়ের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য প্রায় এক হলেও, প্রক্রিয়াটা ভিন্ন। প্রেম সৃষ্টির উল্লাসে আবেশিত, ধর্ষণ ধ্বংসের লীলায় আতঙ্কিত। ভাষাকে প্রেমিকার মতো আদরে লালন করতে হবে, ধর্ষকের মতো নৃশংসতায় নয়। তাই ব্যাকরণ হবে এমন — যেটি শাসন করবে ধর্ষকদের, ধর্ষিতকে নয়। কিন্তু প্রচলিত ব্যাকরণের সংজ্ঞায় ভাষাকে শাসনের কথা বলা হয়েছে, যা পক্ষান্তরে ভাষার সাবলীল প্রবাহের প্রতিকূল।
তাই, আমি করি, ব্যাকরণের প্রচলিত সংজ্ঞার্থ যথার্থ নয়। তবু্ এ ভাষা টিকে আছে, শুধু প্রচলিত ব্যাকরণ-বিরোধী সৃজনশীল কিছু ভাষাভাষীর উদারতায়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলা ভাষার ব্যাকরণের বিরুদ্ধে যদি কথা না-বলতেন, তাহলে বাংলাকে এখনও তৎসম শব্দের বিধি-কলে সে আগের মতো কঠিন নিগড়ে আটকে থাকতে হতো। তাহলে ব্যাকরণ কী? এর কি প্রয়োজনীয়তা নেই? অবশ্যই আছে এবং সে ব্যাকরণ বর্তমানে প্রচলিত সংজ্ঞার্থের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। এটি হচ্ছে সে ব্যাকরণ যা ভাষাকে নয়, বরং ভাষাভাষীকে শাসন করবে, ভাষাভাষীকে শিক্ষা দেবে — কীভাবে ভাষাকে লালন করতে হবে, ধারণ করতে হবে, পুষ্ট করতে হবে, আদর করতে হবে; মমতা দিতে হবে মায়ের, বোনের-প্রেমিকের- প্রেমিকার।
প্রকৃতিকে শাসন করা সম্ভব নয়, তাই ভাষাকেও শাসন করা সম্ভব নয়; কিন্তু প্রকৃতির অন্যতম কুশীলব মানুষের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতিকে রক্ষা করা যায়; তেমন উদ্যোগে ভাষাকে ধারণ করতে হবে। আমার এ ব্যাকরণ সংজ্ঞার্থ এভাবেই সজ্জিত। প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য একসময় প্রকৃতি-শাসন কৌশল উপযুক্ত মনে করা হতো; এখন তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন মানুষের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য। অতএব আমাদের ভাষাপ্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভাষাকে নয়, বরং ভাষার উপর ভাষাভাষীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থকে এভাবে উপস্থাপন করতে চাই —“যে শাস্ত্র ভাষার উপর ভাষাভাষীর স্বেচ্ছাচার, শাসন ও যথেচ্ছাচার রোধ করে ভাষাপ্রকৃতিকে সর্বজনীন প্রগলভতায় উদ্দীপ্ত করার; ভাষাভাষীকে ভাষার প্রতি প্রমুগ্ধ ভালোবাসায় মোহিত করার এবং ভাষার সাবলীল সঞ্চরণ মেনে নেওয়ার মতো অভিজ্ঞানে দ্যোতিত করার উপাদনে ভূষিত- সেটিই হচ্ছে ব্যাকরণ।”
অতএব ব্যাকরণ ভাষার গতিপ্রকৃতি নির্ধারক কোনো সংবিধান নয়, বরং ভাষাভাষীর গতিপ্রকৃতি নির্ধারক একটি বিধান। ব্যাকরণ ভাষাকে শাসন করার জন্য বরং ভাষাভাষীর আচরণকে, যারা ভাষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক না-গড়ে, ধর্ষকের মতো উন্মত্ত আচরণ করে — তাদের সংশোধন করার জন্য।
-----------------------------------------------------------------------------------
পোস্ট : রচনা, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউকে।
পোস্ট : রচনা, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউকে।
সূত্র: ইউনিভার্সিটি অব ক্যাম্ব্রিজ, ড. মোহাম্মদ আমীন স্যারের বক্তৃতার (ব্যাকরণ : অভিজ্ঞতার দ্যোতনায় নতুন অভিধা) কিয়দংশ।
No comments:
Post a Comment