Translate

Tuesday 16 October 2018

সংখ্যা নয়, সংগঠিত রূপই শক্তির নিয়ামক / ড. মোহাম্মদ আমীন



মনুষ্য জগতে পথচারীরা সংখ্যায় এককভাবে সর্বাধিক হলেও তারাই বর্তমানে সবচেয়ে অসংগঠিত। অসংগঠিত বলে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়েও অতি দুর্বল এবং দুর্বল বলে চরমভাবে অবহেলিত। এটা প্রমাণ করে যে, শুধু সংখ্যাঘরিষ্ঠতা
শক্তির একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, সংখ্যাকে শক্তিতে পরিণত করতে হলে লক্ষ্যের ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়া অপরিহার্য। তা না হলে এক কোটি চল্লিশ লাখ ইহুদির কাছে একশ ষাট কোটি মুসলিমকে নতজানু হয়ে থাকতে হতো না বছরের পর বছর; পরাজিত হতে হতো না বার বার বিভিন্নভাবে যুগের পর যুগ। মনে রাখতে হবে, সংখ্যা নয়, সংগঠিত রূপই শক্তির নিয়মক। 

আইনানুগ মালিক যদি তার সম্পদের দখলত্ব প্রতিষ্ঠা ও ভোগের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ না-করে তা হলে আইনানুগ অধিকারও ব্যহত হয়ে চলে যেতে পারে স্বার্থান্বেষী কারো অবৈধ দখলে। মনে রাখতে হবে, বেদখলের শঙ্কা হতে স্বার্থ রক্ষার বিধি প্রণীত হয়েছে। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস প্রথমে আবশ্যিকভাবে মালিকপক্ষ হতে সূচিত হতে হয়। নইলে যে কোনো সম্পত্তি অন্যের অধিকারে চলে যেতে পারে। সাধারণত ভোগের সময় বিবেচনা করে দখল ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেওয়া হয়। দখলাধিকার যত বেশি সময় বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা থাকে তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তত বেশি প্রয়াস উৎসরিত হয়।এজন্য সাধারণ জনগণে সংগঠিত অধিকার প্রতিষ্ঠার নজির খুব বেশি নয়, শক্তও নয়। 

ফুটপাত করা হয় পথচারীদের জন্য। বিধি-নীতি, ব্যবহার ও নজিরগতভাবে ফুটপাতে পথচারীদের একচ্ছত্র স্বার্থ, অধিকার ও দখল থাকার কথা। কিন্তু দখল রাখার জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা প্রয়োজন তা প্রতিষ্ঠার জন্য পথচারীদের প্রয়াস থাকে না বলে অধিকার ও দখল দুটোই লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আমাদের জরিপে দেখা গিয়েছে, ঢাকা শহরের এক
কোটি আশি লাখ জনগণ এবং প্রতিদিন প্রায় পঁচাশি লাখ পথচারীর অধিকার দশ হাজারের কমসংখ্যক লোকের কব্জায়। শুধু ঢাকা নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে এমন চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর চিত্র ভিন্ন। সেখানে পথচারীদের অধিকার রক্ষায় তাদের সরকার এত সচেতন থাকে যে, কোনো অবস্থাকে কোটি জনের অধিকার কটি জনের কব্জায় পতিত হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। 

একজন পথচারী দীর্ঘসময় পথে হাঁটলেও তার প্রতিটি পদক্ষেপ একটি স্থানে খুব কম সময়ের জন্য স্থায়ী থাকে। ফলে পথচারীগণ ওই স্বল্পসময়ের জন্য ওই পদক্ষেপভূমে দখলাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে পরিমাণ প্রয়াসকে নিয়োজিত করা উচিত তা করে না। এটাও ভাবে না যে, একটা একটা পদক্ষেপে রচিত হচ্ছে পুরো পথের উপর তার অধিকার। একটা পদক্ষেপের অধিকারকে অবহেলা করতে গিয়ে তাই সে হারিয়ে ফেলে পুরো পথ। অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তার খেয়াল অবহেলায় পতিত হয়। তাই পথচারীরা পথের অধিকার হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়। 

বিপুল সংখ্যক কিন্তু নিজেদের চারণিক অধিকার সম্পর্কে অসংগঠিত নিরীহ পথচারীর পক্ষে উচ্চকিত আওয়াজ তোলার ন্যুনতম সামর্থ্যও রাখে না।তাই সরকার তাদের চলাচলের জন্য ফুটপাত বানায় একই সঙ্গে সেখানে তাদের
দখলাধিকার ও সাবলীল ভোগ সুরক্ষিত রাখার সর্বপ্রকার উদ্যোগ অক্ষুণ্ন রাখে। কিন্তু অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে সরকারের এই উদ্যোগ নানা কারণে এতই হালকা-আলগা ও স্বার্থগৃধ্নু হয়ে পড়ে যে, নিরীহ পথচারীগণ পথাধিকার হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়। হাজার হাজার পথচারীর আইনানুগ অধিকারকে অবহেলা করে কয়েকজন লোক ফুটপাতে নিজেদের একচ্ছত্র ভোগ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ফুটপাতে গড়ে ওঠে দোকান, নির্মাণসামগ্রী রাখার স্টোর, রাজনীতিক দলের অফিস, গ্যারেজ, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়, ভিক্ষুকাগার, গানাসর আরো কতো কী! 

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দেশে পরিচালিত জরিপে, উন্নয়নশীল দেশসমূহের বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত জনগণের অধিকার হরণের মহোৎসবই দেখা গেছে। মূলত এসব নিরীহ লোকদের ভোটেই গঠিত হয় সরকার। ফলে সরকারই এদের সংগঠিত রূপ এবং শক্তির আধার হয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার কথা, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে তা খুব কমই দেখা যায়। উন্নত এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে সরকার সবক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক নিরীহ এবং অসংগঠিত জনগণের আধিকারিক হিসেবে অনড় থেকে তাদের পক্ষে কাজ করে যায়। ফলে বিস্তৃত হয় সুশাসন, নিশ্চিত হয়ে যায় সবার অধিকার। কিন্তু অনুন্নত ও নামমাত্র গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যায় তার উলটো।

যে দেশের ফুটপাত পথচারীদের নিয়ন্ত্রণের যত বেশি বাইরে সে দেশের জনগণ তত অধিকমাত্রায় বঞ্চিত, লাঞ্ছিত,
ক্ষোভিত, নির্যাতিত, অরক্ষিত এবং অবহেলিত। ওই দেশের সরকার অতিমাত্রায় দুর্বল বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরীহ জণগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনানুগ প্রয়াসকে অবহেলা করে কয়েকজন কায়েমি স্বার্থবাজের বেআইনি অধিকারকেও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যায়। ফলে অসংগঠিত পথচারী হারিয়ে ফেলে তার স্বাচ্ছন্দ্য-হাঁটার চিরন্তন অধিকার। এই দখল ফুটপাত থেকে বিস্তৃত হয়ে নেমে আসে রাজপথে। 

ফলে যানজট আর জানজটে (মানবজট) বেহাল হয়ে যায় প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা। পথচারীগণ হাঁটার জন্য যানপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। লৌহনির্মিত লৌহযানের সঙ্গে নরম মাংসনির্মিত মনুষ্যজানের সংঘর্ষে শুধু বাংলাদেশে নিহত হচ্ছে বছরে সাড়ে ছয় হাজারের অধিক মানুষ।

Monday 8 October 2018

ভারতে চিকিৎসা কী এবং কেন / ড. মোহাম্মদ আমীন



ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে ভারত গমনের জন্য মেডিকাল ভিসা দেওয়া হয়েছে। রোগী প্রতি তিন লাখ টাকা খরচ ধরলেও ১ লাখ ৩০ হাজার রোগীর চিকিৎসায় বাংলাদেশি ৩৯০০ কোটি টাকা ভারতে চলে গেছে। বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভারত যা আয় করে তার ৫০ ভাগ আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে থাকে। এ অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১.৯৪%। ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস-এর হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে ভারত আয় করেছে মোট ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ কোটি ১৩ লাখ ও ইরাক থেকে ৫ কোটি ডলার আয় করেছে ভারত।

ভারতে কেন বাড়ছে বাংলাদেশি রোগরি সংখ্যা ? বাংলাদেশের স্থানীয় চিকিৎসকের উপর আস্থার অভাব এবং ভুল চিকিৎসার ভয়ে অনিচ্ছা ও আর্থিক অক্ষমতা সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, বলা যায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। এ দুটি দূর করা গেলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসার প্রবণতা আশি ভাগ কমে যাবে। 
ভারত হতে চিকিৎসা-ফেরত রোগীদের অভিমত, আস্থাহীনতা ও ভুল চিকিৎসা ছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের হার্দিক আচরণ এবং আন্তরিক দেখভাল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত গমনের অন্যতম একটি কারণ। চিকিৎসক ও নার্সদের অমায়িক ব্যবহারের কারণে রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজন আনন্দ, আবেগ আর আস্থায় বিমোহিত হয়ে পড়ে। ফলে মূল চিকিৎসার আগেই ৩০ ভাগ সুস্থ হয়ে যান। একই মানের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একই রোগীর পরীক্ষার একেক ধরনের ফল দিয়ে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার হার অনেক বেশি। ভারতে তা অনেক কম। ভারতে চিকিৎসার নামে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। একই ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা একাধিকবার করানো, রোগীকে সময় কম দেয়া, বাড়তি আয়ের জন্য রোগীকে অতিরিক্ত সময় কেবিন বা বিছানায় রাখার প্রবণতা নেই সেখানে। অধিকন্তু সার্বিক বিবেচনায় চিকিৎসার খরচও কম। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। 
অত্যন্ত প্রশিক্ষিত নার্সদের পেশাদারিত্ব এবং যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি বাংলাদেশিদের মুগ্ধ করে। যে কোন সমস্যা শুধু ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে জানালেই সমাধান হয়ে যায়। ওদের অন্তরিকতা প্রশংসনীয় এবং অত্যন্ত প্রফেশনাল। রোগী এবং রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা যেন সন্তুষ্ট হয়ে যেন পরবর্তীকালে আবার আসে সেই চেষ্টাই সবসময় করে। চিকিৎসা শুরুর সূচনায় এরা যে প্যাকেজ অফার করে সাধারণত তার থেকে এক পয়সাও বেশি দাবি করে না। রোগী এবং প্যাকেজের অর্থ পেলে বাকি সবকিছুর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। ফলে রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোগীর পরিজনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, চিকিৎসকদের বেতন ব্যবস্থা, তুলনামূলক কম খরচ, প্রযুক্তির সাহায্যে ধাপে ধাপে চিকিৎসার ব্যবস্থা, রোগ চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত ভর্তি না নেওয়া— এই সব কারণে ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশের অনেক চিকিৎসকও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। তাদের অভিমত, হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে কর্মীদের ব্যবহার আরও ভালো হওয়া দরকার। না হলে এখানে যত ভালই পরিকাঠামো গড়ে তোলা হোক না কেন, মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি দেবেন। 
ভারতের চিকিৎসক, নার্স, কর্মী— সবাই রোগীর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করেন। রোগীর কী অবস্থা, সে ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য দেন। এ ছাড়া চিকিৎসায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে হবে। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কম রয়েছেন, এমন নয়। তবে তাদের ব্যবহার ভালো নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। প্রথমত. যোগাযোগ ব্যবস্থা; উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় আসতে যত সময় লাগে, ভারত যেতে লাগে তার চেয়ে কম সময়। আমাদের কিছু জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি চিকিৎসকদের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে রোগীবান্ধব নয়। রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই মূলত বেশি সংখ্যক রোগী ভারতে যাচ্ছে। 
বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হওয়ার প্রবণতার জন্য অনেকে বাংলাদেশের চিকিৎসা-প্রশাসন এবং ডাক্তারগণকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মতে, যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের হর্তকর্তাদেরও আস্থা নেই, যে দেশে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির চিকিৎসার মতো চিকিৎসালয় নেই সেই দেশের চিকিৎসায় কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে, সে দেশের চিকিৎসালয়ে কীভাবে সাধারণ মানুষের কার্যকর চিকিৎসা হবে? তাই উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনও চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। তাদের অভিমত, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় যেমন সস্তা তেমন কার্যকর। ফাও হিসেবে একটা দেশও দেখা হয়ে যায়। থাকে টাকার ব্যবধানও। ভুল চিকিৎসা হয় অনেক ক্ষেত্রে। আর একটা বিষয়, ভারতের ডাক্তারগণ আমাদের দেশের মতো ওষুধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশন ভরিয়ে ফেলে না, দু একটা ওষুধ দেয়।

চিকিৎসার খরচের ধারণা দেওয়ার জন্য একটা বাইপাস অপারেশনের খরচ বিভিন্ন হাসপাতালে কত হতে পারে তা জানা যাক : সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল ও থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাড ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে খরচ প্রায় সমান এবং তা প্রায় ২৭ হাজার ডলার। ভারতের বিভিন্ন ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত হাসপাতালে বাইপাস বা ট্রিটম্যান্ট প্লান এর খরচ ৫০০০ ডলার থেকে ৬৫০০ ডলার। দেশে বাইপাস করায় এমন হাসপাতাল হচ্ছে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এপোলো, ল্যব এইড, নাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, দিনাজপুরের জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এখানে বাইপাস অপারেশন করাতে কেবিনে ৫০০০ ডলার থেকে ৬০০০ ডলার এবং ওয়ার্ডে ৩৭৫০ থেকে ৪০০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। দেশে কিংবা বিদেশে সব হাসপাতালের বাইপাস অপারেশন এর প্যাকেজ কম বেশী একই (৭ -৯ দিন হাসপাতালে অবস্থান, রোগীর সাথে সার্বক্ষনিক একজন সহযোগীর থাকার সুযোগ খাওয়াসহ, টুইন শেয়ারিং রুম - মানে একরুমে দুই রোগী ইত্যাদি)। এছাড়াও সিংগেল কেবিন রুম আছে, সেক্ষত্রে উপরে বর্ণিত মোট অংকের চেয়ে হাসপাতালভেদে ১০০০-২০০০ ডলার বেশি খরচ পড়ে।

ভারত চিকিৎসার জন্য পাড়ি দেওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে কম খরচে চিকিৎসা। একটি ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলো। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়স্ক হেনরি কনজ্যাক। পেশায় গীতিকার ও ভিডিও প্রযোজক। ২০০৮ সালের দিকে হঠাৎ তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জানা গেল তার রক্তে দূষণ দেখা দিয়েছে। এরপর টানা এক মাস এন্টিবায়োটিক নিতে থাকেন তিনি। কিছুদিন পর জানা গেল যে, তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার মিট্রাল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করতে হবে। হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। তা-ও আবার সার্জনের ফি বাদ দিয়ে। কনজ্যাকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বয়স ৫০ পেরিয়ে যাওয়ার পর তার স্বাস্থ্য বীমা বাতিল হয়ে যায়। আরেকটি বীমা করার সামর্থ্যও তার ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খরচ কমাতে রাজি নয়। কনজ্যাকের হাতে তখন দু’টি রাস্তা খোলা। এক. দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। দুই. মৃত্যু। কনজ্যাক এই দুই বিকল্প বাদ দিয়ে, তৃতীয় একটি বিকল্প বেছে নিলেন। সেটি হলো, ভারত।
ওই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রশান্ত এ্যাপোলো হাসপাতালে সফলভাবে তার অস্ত্রোপাচার সম্পন্ন হয়। ভারতে তিন সপ্তাহের সফর, বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে হাসপাতালের খরচ সহ তার মোট ব্যয় হয় মাত্র ১০ হাজার ডলার। কনজ্যাকের ভাষায়, ভারতে চিকিৎসা করিয়ে তিনি নিজের জীবন ও ব্যবসা দু’টোই বাঁচিয়েছেন। এক সরকারি জরিপ জানা যায়, ব্যয় কম হওয়ার জন্য প্রতিবছর ৩ লাখেরও বেশি আমেরিকান নাগরিক চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন। তাদের বেশির ভাগই আসেন ভারতে।
ভারতে কী ঝামেলা এবং হয়রানি কম হয়? না। ভারতে যাবার জন্য ভিসা-সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাতায়াত, অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া, ম্যাডিক্যাল টেস্ট ও রিপোর্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট ঝামেলা ছাড়াও প্রচুর হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অধিকন্তু একবার চিকিৎসার জন্য গেলে ফলোআপ হিসেবে আরো অনেক বার ভারত যেতে হয়। তারপরও ভারত-ফেরত রোগীরা বাংলাদেশে এসে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার এতই উচ্ছসিত প্রশংসা করে যে, অনিচ্ছুকরাও দেশে চিকিৎসার কথা বাদ দিয়ে ভারত চলে যায়। কেন এমন প্রশংসা? এর কারণ হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস এবং হার্দিক আচরণ। তবে শুধু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছেন তা নয়। কারণ এমন অনেক প্রভাবশালী রোগী আছেন তারা খুব ভালো ব্যবহার পেয়ে থাকেন। তবু তারা বিদেশ চলে যায়। চিকিৎসার জন্য ভারত যাবার সবচেয়ে বড়ো কারণ স্থানীয় ডাক্তারদের প্রতি চরম অনাস্থা এবং ভুল চিকিৎসার ভয়। 
আমি মনে করি, শুধু ডাক্তার নয়, এজন্য জনগণ এবং সাধারণ রোগীদের দায়ও কম না। বিদেশের প্রতি আমাদের দুর্বলতা একটা অসভ্য বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাজারে গেলে কেবল হাঁসমুরগি ছাড়া প্রত্যেক কিছুতে বিদেশি তমকা খুঁজে বেড়াই। অধিকন্তু ভারতীয় চিকিৎসকদের কৌশল ও প্রচারের কাছেও আমরা মার খাচ্ছি। এ বিষয়ে সরকার ও জনগণের কার্যকর সচেতনতা প্রয়োজন এবং মাথা থেকে এই সচেতনতা শুরু করতে হবে। 

Sunday 7 October 2018

সাবধান : সচেতন হউন / ড. মোহাম্মদ আমীন


মন খারাপ কেন? 
আমার এক সিনিয়র বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম। তার নাম জে চৌধুরী। প্রসঙ্গত, তিনি চট্টগ্রাম থেকে
ঢাকা এসেছেন বড়ো ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে নামিদামি একটা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য।
আমার প্রশ্নের উত্তর তিনি বললেন, গলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত বড়ো ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, গলার নষ্ট অংশ কেটে প্লাস্টিকের গলা লাগিয়ে দিতে হবে। নইলে বেশি দিন বাঁচবে না।
কত দাম হতে পারে? ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলাম।
ডাক্তার বললেন, আমেরিকান লাগালে চার লাখ টাকা এবং ভারতীয় লাগালে সত্তর হাজার টাকা। আমেরিকারটার মেয়াদ পঞ্চাশ বছর এবং ভারতীয়টার মেয়াদ দশ বছর।
বড়ো ভাইয়ের বয়স আশি চলছে। অনেক দিন ধরে অসুস্থ। কথাও বলতে পারছেন না। তার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতীয় পার্টসটাই লাগাব। ডাক্তারকে সেভাবে বলে দেওয়া হলো। প্লাস্টিকের গলা লাগানোর চার দিন পর বড়ো ভাই মারা গেলেন। বিল দিল হাসপাতাল, সব মিলিয়ে পনের লাখ টাকা। প্লাস্টিক গলার দাম ধরেছে চার লাখ। ।
এত টাকা কেন? আমি তো ভারতীয়টা লাগতে বলেছিলাম।
ডাক্তার বললেন, আপনি বললে কী হবে, আপনার বড়ো ভাই বলেছেন, যত টাকাই লাগুক আমেরিকানটা লাগাতে হবে। নইলে লাগাবেন না। আপনাদের সঙ্গে আলাপের কথা বলাতে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, ওসব কঞ্জুসদের কথা মুখেই আনবেন না।
তারপর কী হলো? আমি আগ্রহসহকারে জানতে চাইলাম।
কোন দেশি পার্টস লাগানো হলে তা পরীক্ষার জন্য অন্য এক হাসপাতালে নিয়ে মৃত বড়ো ভাইয়ের গলায় আবার অপারেশন করা হলো। অপারেশনের পর আমরা বিমূঢ়, তার গলায় কোনো পার্টসই লাগানো হয়নি।ক্ষুব্ধ মনে মামলা করতে গেলাম। পুলিশ প্রাথমিক অনুসন্ধান করে প্রাথমিকভাবে সত্য পেলে মামলা নেবে জানিয়ে ওই হাসপাতালে গেলেন। সাত দিন পর পুলিশ জানাল, ওই হাসপাতালে আমার বড়ো ভাইকে ভর্তিই করা হয়নি।
পরদিন আমি ওই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলাম। ডাক্তার কিছুক্ষণ পর জানালেন কম্পিউটারে জে চৌধুরী নামের কোনো রোগীর ভর্তি হওয়া সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। অন্য কোনো হাসপাতালে গিয়ে দেখেন।

যেহেতু ঘটনাটি শোনা তাই হাসপাতালের নাম দিলাম না। না দিলেও ধারণা করে নিতে পারেন, ধারণা করতে না পারলেও সতর্ক হতে পারেন। ধারণার চেয়ে সতর্কতা অধিক প্রয়োজনীয়।

Saturday 6 October 2018

উদ্ভাবনশীলতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


‘গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স-২০১৮’ এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম উদ্ভাবনশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশ। উদ্ভাবন বিবেচনায় প্রথমে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চিন ও মালয়েশিয়া। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম স্থানে যথাক্রমে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়া। উদ্ভাবনশীলতা বিবেচনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান এমন কি নেপালের চেয়েও পিছিয়ে। কিন্তু কেন এমন অবস্থা?
প্রথম শ্রেণি থেকে একটা শিশুর মাথায় ও ঘাড়ে বইয়ের যে বোঝা তুলে দেওয়া হয় তা বহন করতে করতে মেধার পঞ্চাশ ভাগ শেষ হয়ে যায়। উচ্চ জিপিএ-সনদ লাভের জন্য শুধু নাম্বারের পেছনে ছুটে। ফলে তাদের সৃজনশীলতা মুখ থুবরে পড়ে থাকে নাম্বারের নিচে। মা বাবারাও চায় না তাদের ছেলে সৃজনশীল হোক, তারা চাই তাদের সন্তান নাম্বারশীল হোক।
বিষয় আর বিষয় এবং বই আর বই মুখস্থ করে শিক্ষার্থীরা সব বিষয়ে ভাসা ভাসা অল্পস্বল্প কিছু হয়তো শিখতে পারে কিন্তু ভালোভাবে কিছুই শিখতে পারে না। সবকিছু শিখতে গিয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে কিছুই শিখতে পারে না। যেমন :
পানি পান করতে গিয়ে নদীতে ডুবে বাতাসের জন্য হাহাকার করা। বিজ্ঞানপ্রধান বিশ্বে সব বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান জানার চেয়ে একটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়াই উদ্ভাবনশীলতার প্রথম সোপান- এ বিষয়টা আমাদের দেশে চরমভাবে অবহেলিত।
সামরিক বাহিনীতে সরকারের ব্যয় বেশি বলে ওখানে ক্যারিয়ার গঠনকে মর্যাদাকর মনে করা হয়। ফলে এইচএসসি পাস করার পর মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা অংশ সামরিক বাহিনীতে ঢুকে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রকৃত মেধাবীদের সিংহভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সৃজনশীল নয়, এরকম প্রশ্ন দিয়ে কাকাতুয়ার মতো মুখস্থবিদ্যার শক্তি যাচাই করা যায়, জিনায়সনেস জানা যায় না। দেড় লাখ
পরীক্ষার্থীর মধ্যে তিন হাজারকে যোগ্য নির্বাচন করা হয়, তাহলে বাকিরা কী অযোগ্য? স্বাভাবিকভাবে বাকি এক লাখ সাতচল্লিশ হাজারে মেধাবী ও জিনিয়াসের সংখ্যা নির্বাচনী পরীক্ষায় যোগ্য-বিবেচিত তিন হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তারা অকার্যকর ভর্তি পরীক্ষার ফাঁদে পড়ে অযোগ্য হয়ে যায়। এদের অনেকে চলে যায় বিদেশে পড়তে এবং অনেকে আর ফিরেই আসে না। ফলে বাংলাদেশের উদ্ভাবনশীলতা বিদেশে গিয়ে লালিত হয় বা গলিত হয়।
বুয়েটের মতো প্রাযুক্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার অবস্থা আরো শোচনীয়। পূর্বের পরীক্ষাসমূহে জিপিএ ফাইভ না পেলে ভর্তির দরখাস্তই করা যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় যারা ভালো নাম্বার পায় কিংবা ভালো নাম্বার পাওয়ার জন্য মেধাবী হিসেবে পরিচিত হয় অথবা যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তাদের মেধাবী বলার চেয়ে মুখস্থবি বলাই সংগত। জিনিয়াসরা সাধারণত বাংলাদেশের মতো মুখস্থবি নির্ভর প্রশ্নপত্রমণ্ডিত প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় টিকে না। তারা সৃজনশীল বলে সৃষ্টির নেশায় এতই বিভোর থাকে যে, কোন দেশের রাজধানী কোথায়, কোন নায়িকার চুলের রং গোলাপি কিংবা রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসে কয়টি শব্দ আছে-- এসব সাধারণ বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় পায় না। ফলে জিনিয়াস ও মেধাবীদের এক বিরাট অংশ নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ হতে ছিটকে পড়ে। অন্যদিকে যারা চিকিৎসক প্রকৌশলী কিংবা কৃষিবিদ হিসেবে পড়ার সুযোগ পান তাদের সবাই যে মেধাবী এমনটি বলা যায় না।
যে কারণেই হোক না কেন, প্রাযুক্তিক বিদ্যাধারীদের অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে বিষয়ভিত্তিক পেশায় না গিয়ে এমন সব পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়ে যেখানে তাদের প্রাযুক্তিক জ্ঞান এক বিন্দুও কাজে লাগানো যায় না। বলা হয় ক্ষমতার জন্য বা অতিরিক্তি আয়ের জন্য এমন করে থাকে। বুয়েট-ম্যাডিকেলের অনেক ছাত্রকে প্রশাসন, পুলিশ, কর, শুল্ক প্রভৃতি ক্যাডারে চাকুরি করতে দেখা যায়। পদার্থ-রসায়ন থেকে পাস করে পুলিশের ওসি হয়, হাতে লাঠি পায়; পদার্থবিদ হলে তো এটি আর পাবে না। ফলে উদ্ভাবনশীলতা হারিয়ে যায়।
রাজনীতিক অস্থিরতা এবং যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার তাদের কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়নকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে অধিক আগ্রহী। এরূপ উন্নয়ন করতে গিয়ে নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয় দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন। কিন্তু একটি জাতিতে প্রকৃত অর্থে উদ্ভাবনশীল জাতিতে পরিণত করতে হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে যে, পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয় সে বোধ অনেকের থাকলেও দেখানোর সুযোগ হয় না। 
যেসব দেশ উদ্ভাবনশীলতায় এগিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উদ্ভাবন ব্যয় বাড়িয়েছে বলেই উদ্ভাবনশীলতা বেড়েছে। এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনাকে রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা করা হয়নি। উদ্ভাবন ব্যয়ের পরিবর্তে প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবছর প্রতিরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও প্রাশাসনিক খাতে যে ব্যয় করা হয় তার অর্ধেক কমিয়ে উদ্ভাবনে খরচ করা গেলে বাংলাদেশ উদ্ভাবনশীলতায় সিঙ্গাপুরকে পিছিয়ে দিতে পারবে।

অণ্ড ডিম্ব ডিম / ড. মোহাম্মদ আমীন



সেমিনারের পর ডিনার। 
ক্যামব্রিজের মেডিংলে হল-এর বিশাল ডাইনিং রুম আলো আর রসনার কোলাকোলি। আমার সামনে প্রফেসর মাসাহিতো ও প্রফেসর নন্দিতা চোপড়া, ডানে প্রফেসর রচনা, বামে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের খাদ্য-পুষ্টি বিভাগের প্রফেসর ড. ক্যাথরিনা ক্যাসলার এবং তার পাশে দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর কিচুকি।
কিচুকির বয়স শ ছুঁই ছুঁই করছে। নন্দিতা চোপড়ার ওজন দেড়শ কেজির মতো হবে। আসল দাঁত একটাও নেই, তবে নকল দাঁতের হাসিটা নন্দিতার মোটা শরীরকে প্রত্যুষের মতো নন্দিত করে রাখে। তিনি বলেন, আমি চর্বিনদী। ক্যাথরিনা এবং আমি ছাড়া বাকি সবাই অক্সফোর্ডের শিক্ষক।
আমাদের সামনে নানা উপাদেয় খাবার। আমার চোখ-মন অণ্ড মানে ডিম্বে সমাহিত। এক সময় ডিম্ব দেখলে পৃথিবীর সব রস-লালসা জিহ্বায় এসে ভিড় করত। এখনো করে, তবে খাই না। বয়স বাড়লে নাকি ডিম কম খাওয়া ‍উচিত।
ক্যাথরিনা আমার দিকে ডিমের ডিশটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন প্রফেসর।
“থ্যাংক ইউ”আমি ডিম্বের ডিশটা রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, আমি খাব না, তুমি নাও।
খাবেন না কেন? ক্যাথরিনা ক্যাসলার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন নয় যেন, পুলিশের জেরা।আমি বললাম, বয়স হয়েছে। ডিম্ব খেলে কোলেস্টরেল বেড়ে যায়।
ডিম্ব খেলে কোলেস্টরল বাড়ে এটা ঠিক, তবে সেটি এইচডিএল- ভালো কোলেস্টরল। শরীরে এইচডিএল যত বাড়বে শরীর তত বেশি চাঙ্গা থাকবে। প্রফেসর, আপনি কি চাঙ্গা থাকতে চান না?
ডিম্ব না কি স্ট্রোকের আশংকাও বাড়িয়ে দেয়?
প্রফেসর ক্যাথরিনা দৃঢ় গলায় বললেন, একদম বাজে কথা। আমার এখন সেভেন্টি থ্রি। প্রতিদিন চারটা করে ডিম খাই। প্রতিদিন ডিম খাবেন তবে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দেবেন। তাহলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যাবে। তবে ডায়াবেটিকস রোগীদের ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
মাসাহিতো বললেন, আমি কিন্তু প্রতিদিন তিন-চারটা ডিম খাই।
ক্যাথরিনা বললেন, ডিমে রয়েছে ভিটামিন এ, ই, বি৬, বি১২, থিয়ামিন, রিবোফ্লেবিন ফলেট, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম-সহ শরীর-গঠনে সহায়ক আরো নানা উপাদান। মাসাহিতো ম্যাম, আপনি ডিম খান বলেই আপনার চুরাশীয় শরীরকে আটচল্লিশীয় মনে হয়। হাড় শক্তকরণে ক্যালসিয়ামের কোনো বিকল্প নেই। ক্যালসিয়াম শোষণ করার কারণে হাড় মজবুত হয়। শোষণ-কর্মটা করে ভিটামিন-ডি। ডিমে কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি আছে।
কিচুকি বললেন, আমার হয়েছে জ্বালা।
কী হয়েছে? ক্যাথরিনা বললেন।
বয়স যত বাড়ছে স্মৃতিশক্তি তত কমছে। মস্তিষ্কে কোলিনের সরবরাহ কমে গেছে। তাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে সব ভুলে যাই। কী করি বল তো ক্যথরিনা?
ক্যাথরিনা বললেন, স্যার, ডিম্ব কোলিনের ভাণ্ডার। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতিশক্তিটাও সচল রাখে। আপনি ডিম্ব খান না?
কিচুকি চশমটা নামিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, মগজ ঠিক রাখলাম, কিন্তু চোখ? চোখে কম দেখি কেন? তাও কি অণ্ডের অভাব?
হ্যাঁ।
সব অঘটনই অণ্ডের অভাবে ঘটে?
ক্যাথরিনা : অণ্ডে রয়েছে লুটিন, জিজেনন্থিন, ক্যারোটিনয়েড ভিটামিন। এগুলো দৃষ্টিশক্তির মহৌষধ। প্রবীণদের চোখের জটিলতা কমানোর জন্যই প্রকৃতি ডিম নামের ডিম্বাকৃতির গোলকটায় এতগুলো উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছেন। স্যার, আপনার প্রতিদিন কমপক্ষে দুটো অণ্ড খাওয়া উচিত।
আগামীকাল থেকে চারটা করে খাব।
তাহলে আরো ভালো।
রচনা মায়ের খবর কী? প্রফেসর কিচুকি বললেন।
আমি এত ব্যস্ত থাকি যে, খাওয়ার সময়ই পায় না। পর্যাপ্ত প্রোটিন নিতে পারি না।
“আমিও পাই না”, প্রফেসর ক্যাথরিনা বললেন, “ ডিম্ব যেমন সস্তা, তেমনি সহজভক্ষ্য, রান্না না-করেও খেয়ে ফেলা যায়, খেতেও বেশিক্ষণ লাগে না, ছেলেবুড়ো সবাই খেতে পারে সহজে, দাঁতেরও প্রয়োজন নেই। কুসুমটা প্রোটিনের কোহিনুর। এতে প্রোটিনের পরিমাণ মাংসের সমান। প্রতিদিন দুটো করে ডিম্ব খেলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
অণ্ড না কি চর্বি বাড়ায়? নন্দিতা বললেন।
ক্যাথরিনা : মাংসের প্রোটিন চর্বি বাড়ায় কিন্তু ডিম্বের প্রোটিন মাংস বাড়ায়। ডিম্ব অ্যামাইনো অ্যাসিডের সাগর। শরীর যাতে ঠিক মতো প্রোটিনকে কাজে লাগাতে পারে, অ্যামাইনো অ্যাসিড সেটি দেখভাল করে। আমার স্বামী প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধ কেজি মাংস গিলে। গিলিত মাংস যাতে চর্বি হতে না পারে সেজন্য সে মাংস খাওয়ার পর একটা ডিম্ব খেয়ে ফেলে।
কিচুকি বললেন, বুঝেছি।
কী বুঝেছেন?
তোমাদের মতো ব্যস্ত, আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত দরিদ্র, নন্দিতার মতো দন্তহীনদের জন্য ইশ্বর অণ্ড নামের গোলকটায পৃথিবীর সব কিছু ভরে দিয়েছেন।
কিন্তু অণ্ডটা কে সৃষ্টি করল? মাসাহিতো বললেন।
কিচুকি : ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্তই অণ্ড সৃষ্টি করেছেন। আসলে এটাই পৃথিবী। এজন্য পৃথিবীকে বলা হয় ব্রহ্মাণ্ড। মানে ব্রহ্মের অণ্ড।
নন্দিতা : গণিতের শূন্যটাও অণ্ড। এই শূন্য ছাড়া গণিতও অর্থহীন। গণিত অর্থহীন মানে সবকিছু অর্থহীন। কারণ, গণিতই বিজ্ঞানের বাবা।
মা-টা কে? কিচুকি বললেন।
নন্দিতা : অণ্ড।
--------------------------------
সূত্র : আমার লেখা রায়োহরণ উপন্যাসের একটি অধ্যায়।

Monday 21 May 2018

বিশ্বকাপ ফাইনাল / ড. মোহাম্মদ আমীন


আজ স্বপ্ন দেখলাম, স্বপ্ন দেখলাম জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, মূখ্যমন্ত্রীশাসিত রাজ্যে 
প্রতিটি জেলা, বিভাগে
প্রতিটি উপজেলা, স্বয়সম্পূর্ণ জেলায়
প্রতিটি ইউনিয়ন, এক একটি উপজেলায়
প্রতিটি ওয়ার্ড, চেয়ারম্যানের আওতাধীন ইউনিয়নে 
প্রতিটি পাড়া, মেম্বারের অধীন ওয়ার্ডে এবং বিশ্বাস করুন,
প্রতিটি বাড়ি আয়তন অনুপাতে কমিউনিটি সেন্টার, শপিং মল, মাঠ, বিল বা পুকুরে পরিণত হয়েছে। আমাদের গ্রামের বাড়িটা একটু বড়ো। দেখলাম অবাক হয়ে, এটি ফুটবলের মাঠ হয়ে গেছে। এত বড়ো বাড়িতে থাকব কীভাবে? 
হায় হায়!
স্বপ্নরাজ জানাল, আগামী ১৫ই জুলাই, ২০১৮, রোববার রাত ৯টায় মস্কোতে বিশ্বকাপের যে ফাইনাল অনুষ্ঠানের কথা ছিল তা ওখানে হবে না।
কোথায় হবে?
ফুটবল মাঠের মতো বিশাল হয়ে যাওয়া তোমাদের চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে। লোকজন বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার জন্য দলে দলে চট্টগ্রাম যাওয়া শুরু করেছে। তাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২০ কিলোমিটার যানজট। ফাইনালের আগে এই জট কমবে না।
জানতে চাইলাম, ফাইনাল খেলবে কোন দুটি দেশ?
স্বপ্নরাজ বলল, দুই নয়, তিন দেশ একসঙ্গে খেলবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা একত্রে ফাইনাল খেলবে। 
কীভাবে জানলে?
স্বপ্নরাজ বলল, বিশ্বকাপের অনেক বাকি। তারপরও তোমাদের দেশের যুবশক্তি যেভাবে ব্রাআ-ব্রাআ করছে তাতে সারা ফুটবল বিশ্ব ভয় পেয়ে কাঁপছে। তাদের ধারণা বাংলাদেশি এসব লোকেরা পাগল হয়ে গেছে। হুজুগে, অথর্ব, নিষ্কর্মা এবং ঐতিহ্যহীন কিছু কিছু বাংলাদেশি যেভাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে পরপূজকের মতো মস্তক অবনত করে যাচ্ছে তাতে মনে তাদের কোনো দেশ নেই, ভাষা নেই, ঐতিহ্য নেই, স্বকীয়তা নেই, কর্ম নেই, বিবেচনা, বই নেই, সাহিত্য নেই, সংস্কৃতি নেই।
তাহলে তাদের কী আছে?
পরনির্ভরশীল মন। তাদের অর্থহীন চিৎকারে বিশ্বের তাবৎ ফুটবল খেলোয়াড়দের হাত-পা অবশ হয়ে পড়েছে ভয়ে। তাদের কানের পর্দা ফেটে গেছে বাংলাদেশিদের ব্রাআ-ব্রাআ পাগলা চিৎকারে। বাংলাদেশিরা ল্যাটিন আমেরিকার যে দুটি দেশ নিয়ে এমন লজ্জাকর লাফালাফিতে উন্মাদ, বলা যায় সেই দেশদুটির প্রায় কোনো লোকই বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত জানে না। দু-একজন হয়তো দাপ্তরিক প্রয়োজনে জানতে পারে।
স্বপ্নরাজকে বললাম, বাংলাদেশের সঙ্গে যদি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলা হয়, তাহলে বাংলাদেশিরা কেন বাংলাদেশের কথা না বলে ব্রাআ-ব্রাআ করছে?
স্বপ্নরাজ বলল, এদের দেশপ্রেম নেই। এরা মাতৃভাষাটাও ভালো জানে না। 
তাই বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও এদের আচরণ দেশদ্রোহী রাজাকারদের মতো 
ভয়ংকর। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় তারা ‘পরধনলোভে মত্ত’। বিবেচনাশূন্য এসব বাংলাদেশিরা নিজের দেশের মাটির উপর দণ্ডায়মান ঘরের ছাদে, ভবনের শৃঙ্গে, বৃক্ষের শিখরে বিদেশের পতাকা ওড়ায়। এরা পুরোই ঐতিহ্যহীন, ছি! তোমার লজ্জা করে না এদের দেখে?
এরা ফুটবল প্রেমিক, লজ্জা করবে কেন?
এদের বুকে দেশপ্রেমের চিহ্নমাত্র নেই। তাই নিজের বুকে বিদেশি পতাকা লাগিয়ে গর্বভরে ঘুরে বেড়ায়। নিজের গায়ে বিদেশি নামাঙ্কিত জামা জড়িয়ে ঐতিহ্য ও স্বকীয়হীনতাকে আরো উগ্র করে তোলে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন বিদেশ-বন্দনা দেখা যায় না। যারা নিজের দেশ, ঐতিহ্য আর স্বকীয়তাকে অবহেলা করে অন্য দেশের পূজো-বন্দনায় আনত হয় তাদের দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ হতে পারে না।
ঠিক বলেছে স্বপ্নরাজ।জাতীয় দিবসেও বাংলাদেশিরা এত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না, বিশ্বকাপে যত বিদেশে পতাকা উত্তোলন করে। এমন হীনম্মন্য জাতি পৃথিবীতে আর নেই।
তাদের বোধোদয় হোক। কামনা করি, যেভাবে তারা বিদেশ-প্রেম ও বিদেশ-বন্দনায় উন্মাদ সেভাবে তারা যেন স্বদেশ-বন্দনায় রত হয়।
তাতে তোমার লাভ? 
আমার প্রশ্নের উত্তরে স্বপ্নরাজ বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই, যে নিজ দেশকে অবহেলা করে নিজের দেশে বসে পরদেশের বন্দনা করে। এরা আমার স্বপ্নকেও কুলষিত করে দিয়েছে। ছি বাঙালি ছি!

Wednesday 9 May 2018

জীবনান্দ / ড. মোহাম্মদ আমীন


১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তথা বর্তমানে বাংলাদেশর বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার অধিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে চলে আসেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবেও তিনি খ্যাত ছিলেন।
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন বিখ্যাত কবি। আদর্শ ছেলে তার একটি বিখ্যাত কবিতা। ওই কবিতায় তিনি লিখেছেন,
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে।
জীবনানন্দ পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তার ডাকনাম ছিল মিলু। ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তাকে ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। দু’ বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন।
জীবনানন্দ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ওই বছর ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল বর্ষ আবাহন। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয়নি, কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল। তবে ম্যাগাজিনটির বর্ষশেষের নির্ঘন্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয়: শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগ-সহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রেও অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম কাব্য ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ লিখা শুরু করেন।
প্রথম কাব্য প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি সিটি কলেজের চাকরিটি হারান। কলকাতায় তার কোনো কাজ ছিল না। তাই তিনি বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে তিন মাস পর পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় জীবনধারণের জন্যে তিনি টিউশানি করতেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মে তিনি লাবণ্য দেবীর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের পর আর দিল্লি ফিরে যাননি। এরপর প্রায় পাঁচ বছর কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। কিছু দিন ইনসিউরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। এই সময় ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি তাঁর বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ কবিতা রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে 'রূপসী বাংলা' কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ ব্রজমোজন কলেজে ফিরে এসে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
দেশবিভাগের কিছুদিন আগে তিনি বিএম কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর আর পূর্ববঙ্গে ফিরে আসেননি। কলকাতায় তিনি দৈনিক স্বরাজপত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন কয়েক মাস। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে তিনি দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন – মাল্যবান ও সুতীর্থ, তবে আগেরগুলোর মতো ও দুটিও প্রকাশ করেননি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তাঁর পঞ্চম কাব্য 'সাতটি তারার তিমির' প্রকাশিত হয়। একই মাসে কলকাতায় তার মাতা কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে। ততদিনে জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে 'বনলতা সেন' সিগনেট প্রেস হতে পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ঘোষিত “রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরষ্কার” লাভ করে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা'। বইটি ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের “সাহিত্য একাডেমি” পুরষ্কার লাভ করে।
চাকুরি ও জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু নিগৃহ হতে হয়েছে। একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশের অনুরোধে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন। এ সময় কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশকে কদাচিৎ কাছে দেখা গেছে। তখন তিনি টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একদিন বাসায় এসে বাড়িতে এত লোক দেখে স্ত্রী বলেছিলেন, জীবনানন্দ এত জনপ্রিয় হলো কবে থেকে।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর জীবননান্দ দাশ মারা যান। আসলে তিনি ট্রামের নিচে পড়ে আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।গত এক শত বৎসরে কোলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কেউ মারা যায়নি।
জীবদ্দশায় তিনি তেমন খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। মৃত্যুর অব্যবহিত পর বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতায় শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম একজনে পরিণত হন। তিনি কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। তবে তিনি ঔপন্যাসিকও লিখেছেন। তার লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ১৪ এবং গল্পের সংখ্যা শতাধিক।

উন্নয়নশীল ও অনুন্নত / ড. মোহাম্মদ আমীন


কোনো ভদ্রলোক অপ্রিয় কথা সোজাসুজি বলতে চান না। কিন্তু অপ্রিয় কথাটি যখন না
বললেই নয়, তখন ব্যক্তিত্ব বা মানসম্মান কিছুটা হলেও রক্ষার জন্য একটু ঘুরিয়ে শোভনীয়ভাবে বলেন। ইংরেজিতে শব্দ চয়নের এই কৌশলকে Euphemism বলা হয়। বাংলায় এটি মঞ্জুভাষণ। ‘চাল নেই’ বলাটা লজ্জাকর মনে করেন অনেকে। তাই বলেন, চাল বাড়ন্ত। ভিক্ষকুকে ভিক্ষা দেওয়ার অপারগতা প্রকাশ করা হয়, ‘মাফ করো’ কথা দিয়ে। কিন্তু তাতে ভিক্ষুকের ঝুলিতে কিছু পড়ে না। না-পড়লেও ভিক্ষুক কিছুটা মানসিক তৃপ্তি পায়। সাহেব তার কাছে মাফ চেয়েছেন। সাহেবও খুশি হয়ে যান, শুধু কথা দ্বারা খুশি করা গেল।বেড়াতে গেলেন দার্শনিক। তিনি আবার নেতিবাচক কোনো কথা বলেন না। মিথ্যাও বলেন না। দুর্ভাগ্যবশত তার পাতে পড়ল একটা পচা ডিম। মুখে দিতে গিয়ে গন্ধ পেয়ে রেখে দিলেন বোন প্লেটে। গৃহস্বামী বললেন, ডিমটা কি ভালো না?দার্শনিক বললেন, খুব ভালো। তবে কিছুটা রাসায়নিক পরিবর্তন হয়েছে।কেউ নিজের দুর্বলতা ফলাও করে প্রচার করতে চায় না। যতটুকু সম্ভব ঢেকে রাখতে চায়। কিন্তু যখন প্রকাশ না করে উপায় থাকে না, তখন এমনভাবে প্রচার করে যেন, মানসম্মান কিছুটা হলেও বজায় থাকে। করিম সাহেবের ছেলে ছাত্রজীবনে সব পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেয়েছে। অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার ছেলে কোন বিভাগ পেয়েছে। ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছ বলতে পারলে ভালো লাগত কিন্তু ডাহা মিথ্যা তো আর বলা যায় না। হাস্যকর হয়ে যাবে।তাই বলেন, আমার ছেলে জীবনে কখনো ফেল করেনি।সচিবালয়ে এখন কোনো কেরানি নেই। আগের সব প্রধান কেরানি এখন প্রাশাসনিক কর্মকর্তা। সব পিয়ন এক কলমের খোঁচায় ‘অফিস সহায়ক’ নামে বারিত। তহশিলদার পদ বিলুপ্ত, তারা ইউনিয়ন ভুমি সহকারী কমর্কতা। পদের নাম শোভনীয় হয়েছে কিন্তু কাজ একই।গলি আর অ্যাভিনিউ এবং মামলেট আর ডিমভাজির মধ্যে তফাৎ কেবল নামে।
অনুন্নত শব্দটি নেতিবাচক। ইংরেজিতে বলা হয় আন্ডার ডেভেলাপমেন্ট। অর্থাৎ উন্নয়নের নিচে। উন্নয়নশীল শব্দের অর্থ ডেভলাপিং অর্থাৎ উন্নয়নকে ধরার চেষ্টায় রত। ‘আন্ডার ডেভেলাপমেন্ট’ এবং ‘ ডেভেলাপিং’ দুটোর অবস্থানই উন্নয়নের নিচে। উন্নয়নের নিচে কেউ থাকতে চায় না। কিন্তু উন্নয়নের ওপরে ওঠাও সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থানকে অপ্রকাশ্য রাখাও যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নিজের সম্মান রক্ষার্থে কী বলা উচিত? আপনার অবস্থান কোথায়?উন্নয়নের নিচে বলাটা সমীচীন হবে না। মান-সম্মানের ব্যাপার।তাই বলব, উন্নয়নকে ধরার চেষ্টা করছি। মানে উন্নয়নশীল।ডিমভাজা ও মামলেট, তহশিলদার এবং ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, পিয়ন আর অফিস সহায়ক, হেডক্লার্ক এবং প্রাশাসনিক কর্মকর্তা যেমন, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল কথাটাও ঠিক তেমন।

শিশ্ন আকৃতির ফল / ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রকৃতির মতো বৈচিত্র্যময় আর কিছু নেই। বৈচিত্র্যময় বলে তার খেয়ালও বৈচিত্র্র্যময়।
এক ব্রাজিলিয়ান মালি বহু বছর আগে উত্তর ব্রাজিলের প্রত্যন্ত San Jose de Ribamar
এলাকায় এক বিশেষ প্রজাতির প্যাশান ফ্রুট (passion fruit) এর সন্ধান পান। মনুষ্য শিশ্ন-আকৃতির ফ্রুটটি তাকে বিস্মিত করে দেয়। তার চেষ্টায় ফলটির কথা অনেকে জেনে যায়। এরপর এটি দক্ষিণ আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ প্যাশান ফ্রুটটি এখন ব্রাজিল-সহ দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যন্ত বিলাসবহুল হোটেলসমূহে ডেজার্ট থেকে শুরু করে তরকারি, সালাদ এবং ফল হিসেবে খাওয়া হয়। আকার অবিকল শিশ্নের মতো বলে ফলটি তার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি কদর পেয়ে থাকে। আসলে, ব্যতিক্রমে মানুষের আগ্রহ চিরকাল। কথিত হয়, ইভ এই ফলের রসই খেয়েছিলেন। 
ব্রাজিল কৃষি বিভাগের গবেষক Marcelo Cavallari- এর ভাষায়, “এটি যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যকর। দেখলে প্রথমে মাথা ঘুরে যায়। দেশি-বিদেশি সবাই ফলটি আগ্রহ
সহকারে দেখতে চায়। তবে এর চাষাবাদ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল এবং ফলনের হারও অত্যন্ত কম। তাই প্রচুর জনপ্রিয়তা এবং দাম সত্ত্বেও ফলটির ফলন খুব কম। ” কীভাবে ফ্রুটটি এমন আকৃতি পেল তা জানা যায়নি।কৃষিবিদদের ধারণা- প্রকৃতিগতভাবে ফলটি এমন আকার পেয়েছে। 
৫৫ বছর বয়স্ক Brazilian মালি Maria Rodrigues de Aguiar Farias এই প্যাশান
ফ্রুটের বাগান করে অল্প সময়ে বেশ ধনী হয়ে যান। তিনি, তার বাসায় এই ফলের বাগান সৃজন করেন। পারিয়াস, দর্শনার্থীদের অর্থের বিনিময়ে এই প্যাশান ফ্রুটের ছবি তোলার অনুমতি দিয়ে থাকেন। শুধু দেখার জন্য দুই রিয়াল, ছবি তোলার জন্য ১৫ রিয়াল এবং ভিডিও করার জন্য ২০ রিয়াল দিতে হয়। আমি কিন্তু এই ফলটি দেখিনি, ছবি দেখেছি। আবার ব্রাজিল গেলে দেখার চেষ্টা করব।
আপনার কি কেউ দেখেছেন?

ম্যালামাইন নন্দিত বিষ / ড. মোহাম্মদ আমীন


খাদ্যগ্রহণের পাত্র হিসেবে যারা যত বেশি ম্যালেমাইনের তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করেন, তাদের মেধা, সৃজনশীলতা, স্থৈর্য এবং দূরদর্শী চিন্তা তত বেশি ব্যহত হয়। এটি একটি জৈব যৌগ। যার গাঠনিক
সংকেত C3H6N6। মেলামাইনের বিষাক্ত কণা খাদ্যের সঙ্গে মিশে শরীরের অন্যান্য অংশের মতো নিউরনেও আঘাত হানে। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে শিশুদের। এভাবে অতিরিক্ত ম্যালামাইনের যথেচ্ছ ব্যবহার উন্নয়নশীল দেশ-সমূহের শিশুদের মেধা ধীরে ধীরে হ্রাস করে দিচ্ছে। আমরা অসচেতন, বলতে গেলে প্রায় অজ্ঞ পিতামাতা নন্দিত হাস্যে আমাদের শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছি এই মারাত্মক বিষ। 
অ্যামোনিয়াম থাইয়োসায়ানাইড থেকে উদ্ভুদ মেলাম ((melam) এবং আমিন (amine) শব্দ থেকে মেলামাইন শব্দের উদ্ভব। শব্দটির উৎস গ্রিক এবং এর অর্থ কালো। এই কালো বলতে বুঝানো হয়েছে মোহনীয় ভয়ঙ্কর। দেখতে সুন্দর হলেও এটি প্রাণীদেহের জন্য মারাত্মক কাল বা ক্ষতিকর।
খাদ্যবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদের অভিমান, ম্যালামাইন ফরমালিনের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। নানা রঙেঢঙে সজ্জিত মেলামাইনের পাত্র দেখে শুধু শিশু নয়, শিশুর প্রপিতামহ পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কত মজা করে ব্যবহার করা হয় ওই সজ্জিত পাত্রপাত্রী। কিছুদিনের মধ্যে রং আর আগের মতো থাকে না। পুরানো বউয়ের গোমড়া মুখের মতো বিমর্ষ হয়ে যায়। কোথায় যায় মেলামাইনের বিষাক্ত কণায় মেশানো ওই রং?
আপনার আমার শরীরে। 
ইউরিয়া ও ফরমালডিহাইডের মিশ্রণে মেলামাইন রেজিন তৈরি হয়। দুটোই সাধারণভাবে প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। তবে, কেউ যদি নিজেকে উদ্ভিদ মনে করেন, সেটি অন্য কথা। এই প্রসঙ্গে ইউরিয়া অল্প আলোচনা আবশ্যক মনে করছি। তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং আ্যমোনিয়ার মিশ্রনকে উচ্চচাপে এবং 130-150 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে ইউরিয়া উৎপাদন করা হয় ইউরিয়ার ৪৫%ই উদ্ভিদের প্রধান পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন । তাই এটি সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।কেউ যদি মনে করেন, ইউরিয়া, উদ্ভিদের মতো মানুষেরও পুষ্টি যোগায়, তাহলে তিনি প্রতিদিন মুড়ির মতো কয়েক মুঠো ইউরিয়া সার চিবোতে পারেন। অনেক দেশে, দুধ বা পুষ্টিকার খাদ্যসমূহে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি দেখানোর জন্য ম্যালামাইন মেশানো হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অষ্টাদশ শতকের পর ম্যালামাইনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানী লোকের বিকাশও কমে গেছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন-এর ( ১৬৪৩ – ১৭২৭) শতবর্ষ পর বিশ্ব পেয়েছে আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯ - ১৯৫৫)। তারপর?
একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, তাপের অনুপস্থিতিতে মেলামাইন-রেজিন সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। তবে তাপের প্রভাবে, তা যতই সামান্য হোক না কেন, ম্যালামাইন পরিবর্তিত হতে শুরু করে, বিশ্লিষ্ট হতে থাকে তার শরীরে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত উপাদান-সমূহ। তাই ওভেনে মেলামাইন-পাত্র দেওয়া উচিত নয়। আমার অনুরোধ- একাজটি করবেন না। কেউ করলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। আমি দিই না কিন্তু বউ দিয়ে দেয়, নিষেধ করলে বলে, অত উপদেশ দিও না। যাই হোক, এটি আমাদের দাম্পত্য বিষয়, আসল কথা হচ্ছে ক্ষতি, মেধাশূন্য ভবিষ্যপ্রজন্ম। আপনি কী চান আপনার শিশুটা মেধাশূন্য হয়ে যাক? আর একটা বিষয়, মেলামাইনের তৈজস বহুল প্রচলিত হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, মেলামাইন মানুষের মানসিক স্থৈর্যকেও স্পর্শকাতর করে তোলে।
তাপের সংস্পর্শে মেলামিন রেজিনের রাসায়নিক উপাদানগুলো আলাদা হয়ে পড়ে, যা বিষাক্ততার জন্য দায়ী। মেলামাইনের পাত্রে পরিবেশিত গরম খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তা ছাড়া কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং কিডনির ক্যান্সারও হতে পারে একই কারণে। তাইওয়ানে মেলামাইন নিয়ে একটি গবেষণা থেকে এই বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পেয়েছিলো বিশ্ববাসী। মেলামাইনের পাত্রে গরম খাবার পরিবেশন করলে উচ্চ তাপমাত্রায় মেলামাইনের কিয়দংশ খাবারে মিশে যায়। আমেরিকায় পরিচালিতক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ম্যালামাইনের তৈরী পাত্র নয়, ম্যালামাইনের তৈরী যে কোনো কিছুই ক্ষতিকর। এমনকি সেটি যদি টেবিল ক্লথও হয়। 
দেশের ৭৭ ভাগ মানুষ সীসাজনিত দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। শহরে এর পরিমাণ শতকরা ৯৭.৭ ভাগ এবং গ্রামে ৯৩.৭ ভাগ। এছাড়া দেশের ৮৮ ভাগ মানুষ কোন না কোনভাবে সীসাজনিত দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত রং থেকে এ সীসা ছড়াচ্ছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। কিন্তু কেন? সিরামিক ও ম্যালামাইনের তৈজসপত্রের প্রচুর ব্যবহারই এর অন্যতম কারণ। ম্যালামাইনের তৈরী রঙ্গিন পাত্র থেকে সীসা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি করছে। 
সীসা খুবই বিষাক্ত পদার্থ। এটি সব সবার জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশুদের জন্য মারাত্মক। সীসাযুক্ত রং সবচেয়ে মারাত্মক এবং আপনি জানেন বা না জানেন এটিই ব্যবহৃত হচ্ছে ম্যালামাইনে।ম্যালামাইনে ব্যবহৃত এই রং খুব সহজে খাদ্যকণার সাথে মিশে যায়। বিশ্বাস হয় না! তা না হলে ম্যালামাইনের পাত্র কেনার কয়েক মাস পর রঙচঙে রং কেন ওঠে যায়। ফলে শিশুরা বিষক্রিয়ার শিকার হয়। এতে মস্তিস্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, আচারণগত সমস্যা দেখা দেয়, শ্রবণে সমস্যা হয়, মাথাব্যথা সব সময় লেগে থাকে, পুরুষ ও মহিলাদের প্রজনন সমস্যা দেখা দেয়, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং স্নায়ুচাপ দেখা দেয়, স্মৃতি শক্তি কমে যায়, ঘুম কমে যায় এবং পেশী ও হাড়ের সংযোগ স্থানে ব্যথা হয়। পঙ্গুত্ব বা অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ায়। 
এজন্য অনেকে মনে করেন, ম্যালামাইন মানে মেলা মাইন।মাইন শব্দের অর্থ বারুদ দ্বারা স্থাপনাদি ভূমিসাৎ করিবার লক্ষ্যে এর নিচে খনন করা সুড়ঙ্গ। সুতরাং ম্যালামাইন আমাদের সমুদয় প্রতিভাকে, প্রাণশক্তি আর চাঞ্চল্যকে ধ্বংস করার একটি মারাত্মক মাইন। 
মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার- একই সঙ্গে বাড়ছে বিষ। খাদ্য, পাত্র, মাটি, বাতাস, শয়ন সবখানে বিষ। এত বিষ চারিদিকে, বিজ্ঞানের বিনাশ ছাড়া বিষমুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। তবে কিছুটা সাবধান থাকা যায়, তাহলে বিষ কিছুটা কম ঘেষতে পারবে। Something is better than nothing.

Friday 16 March 2018

হকিং-এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম / ড. মোহাম্মদ আমীন



বাঙালি আত্মমর্যাদাহীন জাতি
নিজের ভাই মহাশয়, এই জ্বালা কি প্রাণে সয়!
হকিং এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম।
চতুর্থ প্রয়াণ-দিবসে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্মরণ : --------------
স্টিভেন হকিং নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় লেখালেখি আমার কাছে মনে হয়েছে অতিরঞ্জিত ও হীনম্মন্যতাপূর্ণ। কারণ এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী আমাদের ছিল কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমরা এমন করিনি। তাই হকিংকে নিয়ে লেখা আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে এবং হয়। এই বাড়াবাড়ি দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, আসলে বাঙালির কোনো আত্মমর্যাদা নেই। নেই স্বকীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার সামর্থ্য। তারা কেবল নিজেদের অবহেলা করে পরকে মাথায় নিয়ে নাচে। তাই অনেক মেধাবী থাকা সত্ত্বেও আমাদের অবস্থান পাতালের অতলে।

বলছিলাম, হকিং এর চেয়ে অনেক মেধাবী এবং বড়ো বিজ্ঞানী বাংলাদেশে ছিল। তিনি জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম। জন্মকালীন
তাঁর পিতা চাকরিসূত্রে ঝিনাইদহ অবস্থান করছিলেন। বলা হয়, আধুনিক বিশ্বের সাত জন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর নাম নিলেও জামাল নজরুল ইসলামের নাম চলে আসবে।তিনি সারা বিশ্বে জেএন ইসলাম নামে পরিচিত এবং বিজ্ঞানীদের কাছে বাংলাদেশ জেএন ইসলামের দেশ হিসেবে পরিচিত।

জেএন ইসলাম ছিলেন ক্যাম্ব্রিজে হকিং এর রুমমেট, বন্ধু এবং সহকর্মী। প্রায় সার্ধ ডজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেএন ইসলামকে বলা হতো আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম মেধাবী মানুষ। কেন এমন বলা হতো, তার দুটি উদাহরণ দিই। ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি থেকে গণিতে ট্রাইপস পাস করতে লাগে তিন বছর। জেএন ইসলাম তা দুই বছরে শেষ করে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পৃথিবী তাবৎ বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কয়েকজন বিখ্যাত বিশ্বতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের শরণাপন্ন হন। জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে পৃথিবীর মানুষকে আস্বস্ত করে বলেছিলেন, সে রকম কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ একই সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের কোনো ক্ষতি হবে না।

চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় এত ভালো করেছিলেন যে, শিক্ষকৃবন্দ তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে এক শ্রেণি উপরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষক ফাদার গোরে

জেএন ইসলামকে ডাকতেন জীবন্ত কম্পিউটার। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যেখানে কম্পিউটার ও ক্যালকুলেটর নিয়ে কাজ করতেন সেখানে জেএন ইসলাম এগুলি ছাড়া বড়ো বড়ো হিসাব মুহূর্তে করে দিতেন কোনো যন্ত্র ছাড়াই। তিনি বলতেন, কম্পিউটার আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। তবে তিনি কম্পিউটারের সাধারণ প্রয়োজনীয়তা কখনো অস্বীকার করেননি।

একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ জেএন ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হকিং বলেছিলেন, “জেএন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।” ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হকিং যেসব বিজ্ঞানীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন, তন্মধ্যে জেএন ইসলাম ছিলেন অন্যতম। কিন্তু বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম রেডিও আবিষ্কার করলেও কৃতিত্ব চলে গিয়ছিল মার্কনির কাছে।ঠিক তেমনটি ঘটেছে জেএন ইসলামেও। স্টিফেন হকিং যদি বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হন, তাহলে জেএন ইসলাম ব্রহ্মাণ্ড খ্যাত হওয়ার মতো যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে এভাবে লেখা হয়নি, যেমনটি লেখা হয়েছে হকিংকে নিয়ে। নিজের ভাই মহাশয়, এই জ্বালা কি প্রাণে সয়? বাঙালিরা এই বোধ থেকে কখন বের হয়ে আসতে পারবে জানি না।

পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণ করতে হয় কিন্তু হকিংয়ের কোনো বর্ণনা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। এজন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাই অনেকে মনে করেন, হকিং যত বড়ো না বিজ্ঞানী তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞানকল্পকাহিনি লেখক। তিনি মেধাবী ছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে বিশ্বব্যাপী যে প্রচার তিনি পেয়েছেন তা ‍শুধু মেধার জন্য নয়, বরং তার অসুস্থতা, অমুসলিম এবং ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার জন্য ঘটেছে। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম নিজ দেশ থেকেও এমন মূল্যায়ন পাননি। প্রচার ছাড়া প্রসার কীভাবে হয়? বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘কৃষ্ণবিবর’ গ্রন্থটি হকিং এর ব্ল্যাকহোল থিউরির অনেক আগেই প্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত। কিন্তু আমরা কেউ তা জানি না। জানলেও তা কেউ প্রচার করেনি।

সারা বিশ্বে বিজ্ঞানী মহলে জেএন ইসলাম জিনিয়াস ইসলাম নামেও পরিচিত ছিলেন। জাপানি প্রফেসর মাসাহিতোর ভাষায়, “ভারতের বিখ্যাত জ্যোর্তিপদার্থ
বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা জে এন ইসলামের সহপাঠী ছিলেন। ফ্রেডরিক হয়েল, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, স্টিভেন হকিং, প্রফেসর আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনমেন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের অন্যতম বন্ধু এবং তাঁর মেধামুগ্ধ সহকর্মী।” মাসাহিতো আরো বলেন, “তাঁদের মুখে আমি অনেক বার জেএন ইসলামের কথা শুনেছি।” তিনি আরো বলেন, “জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লেখা হয়েছে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কিন্তু হকিং এর ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লেখা হয়েছে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। দুটি গ্রন্থ তুলনা করলে নিঃসন্দেহে জেএন ইসলামের বইটি যে কোনো বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ।"

কিন্তু ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম নিয়ে আমরা যে তোলপাড় করেছি, জেএন ইসলামের আল্টিমেট ফেইট নিয়ে এক সহশ্রাংসও করিনি। তখনকার দিনে ইউরোপের বিভিন্ন খ্যাতিমান স্বীকৃত বিজ্ঞান-জর্নালে প্রবন্ধ জমা দেওয়া হতো কোন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী মাধ্যমে সুপারিস-সহ। জামাল নজরুল ইসলামের প্রবন্ধে সুপারিশ দিতেন ফ্রেড হয়েল, স্টিভেন হকিং ওমার্টিন রিজের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে স্টিভেন হকিংকে নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে এক লাইনও লেখা হয়নি।

হকিং তাঁর মূল্যবান গবেষণা সময়ের অধিকাংশই ব্যয় করতেন বাঙালি প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থেকে পারিবারিক বন্ধুত্বে উন্নীত হয়েছিল। হকিং এর জেষ্ঠ ছেলে রবার্ট, কন্যা লুসি
এবং কনিষ্ঠ ছেলে থিমোতি জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। জামাল নজরুল ইসলামের দুই মেয়ে সাদাফ যাস সিদ্দিকি ও নার্গিস ইসলাম ছিলেন তাদের খুব আদরের। সাদাফ যাসের আমন্ত্রণে লুসি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে লিট ফিস্টে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ এসেছিলেন। অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে এলে বন্ধু জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলেন।১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম বাংলাদেশে এলে বিমান বন্দরে নেমে বলেছিলেন, জেএন ইসলামকে খবরদিন। ওই সফরে জেএন ইসলামকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির পক্ষ থেকে তিনি একটা পদকও দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য বয়সে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন হকিং এর সিনিয়র কিন্তু আবদুস সালাম এবং অমর্ত্য সেন-এর জুনিয়র।

ক্যামব্রিজের শিক্ষক প্রফেসর সুসানার ভাষায়, “বিজ্ঞানময়তা বিবেচনায় হকিং এর ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’এর চেয়ে অনেক গুণ কার্যকর এবং বিজ্ঞানানুগ হচ্ছে জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’। বলা হয়, ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। বিজ্ঞানগুরুত্বে যদি এটি হয়ে থাকে, তাহলে জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ একশ কোটি কপি বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি।

কেন? কারণ প্রচার হয়নি। আমরা করিনি। জেএন ইসলাম মুসলিম, জেএন ইসলাম তৃতীয় বিশ্বের লোক। তাই পাশ্চাত্যে যথাগুরুত্ব পায়নি। জেএন ইসলামের দেশের লোকই তাকে তুলে ধরতে পারেনি, অন্য কেন করবে? জেএন ইসলামের লেখা এবং ক্যাম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ বইটাকে বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানের একটি অদ্বিতীয় বই। যেটা নিয়ে অধিকাংশ বাঙালি কিছুই জানে না। নিজের ঘরের কৃতিত্ব যদি ঘরের মানুষ না রাখে তাহলে বাইরের লোকে রাখবে কেন? জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ ছাড়া আর কোনো বাঙালির বই হিব্রু ভাষায় অনুদিত হয়নি। তার তিনটি বই এবং দুটি আর্টিক্যাল ক্যাম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিস্টনসহ পৃথিবীর শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। অথচ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় কি না আমার জানা নেই। এ হিসেবেও জামাল নজরুল ইসলাম হকিংয়ের চেয়ে অনেক বড়ো বিজ্ঞানী।

জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক। নিজের আয় থেকে অর্থ জমিয়ে অনেক দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৭১
খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন।

সর্বোপরি, বিদেশে সহস্র পাউন্ডের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন।শুধু তাই নয়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের পরামর্শ চাইলে তিনি, জাফর ইকবালকে দ্রুত দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন। দেশে ফিরে নিজের পিতৃভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৩০০০ টাকার বৃত্তিতে কাজ শুরু করেন। ভেবেছিলেন দেশ তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারবে, পারলেও করেনি। আমরা বাঙালিরা তাকে ওই তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পরিনি।

তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি বিজ্ঞানী যার ৭টি গ্রন্থ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যার একাধিক বই হিব্রু ভাষায় অনুদিত হয়েছে।অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক সভায়
আমন্ত্রিত হয়ে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর অংশগ্রহণ করলে, তাকে না কি কেউ চিনতেই পারেননি।অতিরিক্ত সচিব হঠাৎ চিনতে পেরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর দেশে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বিদেশে কেমন হতে পারে সহজে অনুমেয়। পদার্থ বিদ্যায় নোবেল বিজয়ী Weinberg I বলেছিলেন, We are particularly indebted to Jamal Islam, a physicist colleague now living in Bangladesh. For an early draft of his 1977 paper which started us thinking about the remote future. আবদুস সালাম বলেছিলেন, এশিয়া মহাদেশে আমার পরে যদি কেউ নোবেল পুরস্কার পান, তাহলে তিনি হচ্ছেন জামাল নজরুল ইসলাম।

১৯৮৪ থেকে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ত্রিশ বছর জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল এন্ড ফিজিকাল সায়েন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তবে এটাকে বিশ্বামানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে তার চেষ্টা ও স্বপ্ন সফল হয়নি। শত চেষ্টা করেও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ এবং মানসম্পন্ন গবেষকদল সৃষ্টি করতে পারেননি। এই ত্রিশ বছর বাইরে থাকলে বিজ্ঞানের জগতে বিস্ময়কর কিছু দিতে পারতেন। তিনি যদি দেশে না আসতেন তাহলে পৃথিবী অনেক কিছু পেত।
স্বার্থপর জেএন ইসলাম নিজের দেশের জন্য পৃথিবীকে বঞ্চিত করেছেন।

আজ এই মহাবিজ্ঞানীর প্রয়াণ-দিবস। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। চতুর্থ প্রয়াণ দিবসে এই মহাগুণী জনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

Sunday 14 January 2018

ভালোবাসা দিবসের শ্রেষ্ঠ উপহার / শ্রাবন্তী নাহা অথৈ

বইয়ের চেয়ে উত্তম উপহার এবং ভালোবাসার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ আর নেই আর এই দুটির সমন্বয় যদি ঘটানো যায় তাহলে যে কারো জীবন হয়ে ওঠে মধুর এবং ভালোবাসাময় যে জীবনে ভালোবাসা থাকে সে জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে যায় জীবন হয়ে ওঠে স্বর্গীয় প্রাপ্তির চেয়ে প্রত্যাশিত সুখের বিরল উৎস প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া, রুচি-অরুচির ভিন্নতা আছে, আলাদা অনুভূতি আছে, যা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন কিন্তু ভালোবাসা এবং বস্তু হিসেবে বইয়ের ক্ষেত্রে সবার ইচ্ছা অভিন্ন ভালোবাসা পেলে যে খুশি হয় না সে পশুও নয়, জড়; মরা লাশ বই পেয়ে যে আপ্লুত হয় না, সে লাশের চেয়েও অধম তবে বই হতে হবে প্রিয়জনের মনকে নাড়া দেওয়ার মতো অনিন্দ্য আমি এখানে এমন দুটি বই নিয়ে আলোচনা করব, যে বই দুটি আপনার প্রিয়জনকে দিলে এবং আপনার প্রিয়জন আপনাকে দিলে পরস্পরের প্রতি শুধু ভালোবাসা নয়, গভীর কৃতজ্ঞতার নিবিড় আবেশে নতুন একটা জগৎ সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যাবে বহুগুণ বেড়ে যাবে পরস্পর প্রীতি কারণ বই দুটিতে এমন বিষয় আছে, যা ভালোবাসার মূল্য কী এবং কীভাবে, কোথায় কাকে ভালোবাস দিতে হয় এবং কীভাবে তা স্থায়ী করা যায়- সেটিই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের আচরণে তুলে ধরা হয়েছে

তিনে দুয়ে দশ

তিনে দুয়ে দশ. মোহাম্মদ আমীন স্যারের লেখা একটি উপন্যাস যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো বয়সের সিনিয়র, মুরব্বি, গুরুজন বা বয়স্কদের প্রতি কোনো জুনিয়র বা শিশুকিশোর কোনো উপহার দিতে চাইলেতিনে দুয়ে দশউপন্যাসের চেয়ে আর কোনো ভালো
উপহার হতে পারে না। মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, সব পর্যায়ের অগ্রজ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক শিক্ষিকা, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, সিনিয়র নেতা প্রভৃতিসহ যে কোনো মুরব্বি বয়স্ক গুরুজনকে যদি এমন কোনো উপহার দিতে চান, যে উপহার পেলে তিনি খুশি হবেন এবং আপনার প্রতি তার ভালোবাসা, দরদ, মায়ামমতা, স্নেহ, সহানুভূতি, ধৈর্য, বিবেচনাবোধ, সন্তুষ্টি প্রভৃতি বেড়ে যাবে; তাহলে আমি বলব আপনি, তাকে . মোহাম্মদ আমীন স্যারের লেখাতিনে দুয়ে দশউপন্যাসটি উপহার দিন। ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা ভালোবাসা দিয়ে আদায় করা যায় না- এটিই বইটির মূল্য বিষয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত এই বইটি হতে পারে ভালোবাসা দিবস-সহ যে কোনো দিবসে আপনার যে কোনো বয়সের এবং যে কোনো সম্পর্কের প্রিয়জনকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার

তিনে দুয়ে দশ একটি অনবদ্য উপন্যাস। অনবদ্য বলার কারণ আছে। এটি শুধু কথার কথা নয়। নিজের অভিজ্ঞতা হতে লিখিত এই উপন্যাসটি শিশুকিশোর হতে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার জন্য উপযোগী এবং দ্রুত মননশীলতার পরিবর্তনের এক যাদুকরি শক্তি রয়েছে। এই উপন্যাসের কাহিনী বিরল ভালোবাসার অনন্ত মহিমা যেন। যা সবার মনে দাগ কাটতে সক্ষম। শিশু-কিশোরদের মনমানসিকতাকে আদর্শ চেতনায় জাগ্রত করতে হলে বয়স্কদের কী করতে হবে, কেমন হতে হবে তাদের আচরণ, কীভাবে তাদের মূল্য দিতে হবে প্রভৃতি ছাড়াও এই বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষক সমাজের কর্তব্য কী, তা অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনুপম এক গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আবার জ্যেষ্ঠদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য পেতে হলে অনুজদের কী করতে হবে তাও এই উপন্যাসে বাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। এবার বইটিতে কী আছে তা সংক্ষেপে দেখা যাক :

লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন টিউশনি করতেন। ওমর সুলতান নামের তাঁর এক ছাত্র তিনি পড়াতেন। ওমর সুলতান ছিল খুব ডানপিটে, দুষ্ট, বেপরোয়া, যথেচ্ছাচারী, উচ্ছৃঙ্খল বেয়াদব। সে গৃহশিক্ষকের নিকট থেকে প্রতিমাসে বেতনের ৩০% কমিশন নিত। শিক্ষকের সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ়, অশালীন অপমানজনক আচরণ করত। সহপাঠীদের খুব তুচ্ছ ভাবত।বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করত। ওমরের পিতা ছিলেন খুব প্রভাবশালী ছিলেন। তাই স্কুলের শিক্ষক বা স্কুল কমিটি ওমরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করত না। ওমরের এমন অসভ্যতার কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কোনো শিক্ষক তাকে পড়াতে আসত না। এলেও কয়েক দিনের মধ্যে অতীষ্ঠ হয়ে পালিয়ে যেত। আস্তে আস্তে এমন এক অবস্থা উপনীত হয়, ওমর সুলতানকে পড়ানোর জন্যকোনো শিক্ষকই পাওয়া যাচ্ছিল না। স্কুলের শিক্ষক এবং সহপাঠীরাও ওমরকে এড়িয়ে চলত। এভাবে সে খুব একা হয়ে পড়ল। যত এক হয়ে পড়ছে ততই সে বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। মা-বাবার সঙ্গেও সে খারাপ ব্যবহার করত। বাবাকে বাবা ডাকত না। ডাকত ডিআইজি সাহেব।

লেখকের এক বন্ধু, লেখককে ওমরের গৃহশিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব করে। লেখক ওমরের এসব ঘটনা জানতেন না। তাই তিনি রাজি হয়ে যান। কিন্তু ওমরকে পড়াতে গিয়ে প্রথম দিনেই লেখক হতভম্ব হয়ে পড়েন। ওমরের আচরণ খুবই রূঢ়, অশালীন, অভদ্র, অসহনীয় এবং অপমানজনক। ওমরের মা এসে লেখককে কেঁদে কেঁদে ওমরের বিষয়গুলি জানায়। পড়াতে গেলে অন্যান্য শিক্ষকদের মতো লেখকের
কাছ থেকেও ওমর সুলতান বেতনের ৩০% কমিশন চেয়ে বসে। লেখক অপমানিত বোধ করে ওমর সুলতানকে মারতে গিয়েও থেমে যান। তিনি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন- তিনি দেখবেন ওমর সুলতান কতদূর যেতে পারে। তিনি যে কোনোভাবে হোক ওমরকে পরিবর্তন করার তিনি ওমরকে উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় নিয়ে নেন। তাই ওমরের সব অপমান কৌশলে হজম করে নিতে থাকেন। একদিন ওমর, তার শিক্ষক তথা লেখককে তার বালিকা-বান্ধবীর জন্য প্রেমপত্র লিখে দিতে বলে। লেখক তাও হজম করে নিয়ে প্রেমপত্র লিখে দেন। তবে কৌশলে তিনি ওমর সুলতানকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ক্লাসের সবার নিচে ছিল ওমরের স্থান। লেখক তার শিক্ষকের ভার নেওয়ার পর ওমর প্রথম কয়েক মাস আরো বেশি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্য শিক্ষকের মতো লেখক তাকে ছেড়ে চলে যাননি। 

লেখক, ভালোবাসা দিয়ে ওমরকে পরিবর্তনের প্রত্যয়ে আরো দীপ্ত হয়ে ওঠেন। আস্তে আস্তে ওমরের পরিবর্তন আসতে থাকে। পরের বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় ওমর শেষস্থান থেকে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়। কীভবে এক বছরের মধ্যে এমন পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল, তা এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা কিশোর উপন্যাসটি কিশোরদের শুধু আনন্দ দেবে না, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অনুপ্রেরণাও জোগাবে। সর্বোপরি, কিশোরদের সঙ্গে মা-বাবা পরিবেশের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত, কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত আমাদের প্রত্যেকের প্রাত্যহিক, পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রী জীবনে তাও অনবদ্য বাস্তবতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে

লেখকের জীবন থেকে নেওয়া এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পুথিনিলয়। পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার পুথিনিলয় স্টলে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। মূলত ভালোবাসা কী, কীভাবে ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করা যায়, অতি খারাপকেও ভালো লোকে পরিণত করা যায়, অতি খারাপ ছাত্র বা সন্তানকেও মেধাবী করে দেওয়া যায়; সেটাই এই গ্রন্থে লেখক তার জীবনের একটি ঘটনা দিয়ে উপন্যাসে উপন্যাসে বিধৃত করেছেন। আমি মনে করি, এটি ভালোবাসা দিবসসহ প্রত্যেক দিবসে, বিশেষ করে পিতামাতা মরুব্বিদের প্রতি এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রতি হতে পারে শ্রেষ্ঠ উপহার

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা . মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর একটি গল্প ফেসবুকে
প্রকাশিত হয়। গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফেসবুক ভাইরাল হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেকগুলি চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউশিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহল গল্পের নতুন আস্বাদন পায় যেন। আমি গল্প দুটি পড়ে এতই বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি যে, আমি আপনাদের জন্য এই লেখা লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম। এই বইয়ের ভালোবাসার গল্পগুলি পড়ে আমার মনে গল্প সম্বন্ধে যে ধারণা ছিল, তা পাল্টে গিয়ে নতুন একটা ধারণা সৃষ্টি করল। গল্প শুধু গল্প নয়। জীবন, জীবনটাই গল্প। আর একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারলাম, লিখতে জানলে যে কোনো সাধারণ বিষয়ও অসাধারণ হয়ে উঠে। যেমন পরিবেশনার গুণে সাধারণ খাবার হয়ে ওঠে তৃপ্তির চূড়ান্ত অবগাহন। ভালোবাসা কী এবং ভালোবাসা দিয়ে জীবনকে কীভাবে বদলে দেওয়া যায় তা আমি এই বই পড়ে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। ভালোবাসা জীবনের জন্য অপরিহার্য। যে জীবনে ভালোবাসা নেই সে জীবনে যেন কিছু নেই। এই বইয়ে ভালোবাসার মাধ্যমে জীবনগড়ার প্রতিটি দিক, প্রতিটি ক্ষণ এবং প্রতিটি বিষয় গল্পে গল্পে তুলে আনা হয়েছে। জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখলেও এমন লেখা যায় না, অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরীক্ষণ করতে হয় অনুভবের বাস্তবতায়। স্বপ্নকে টেনে নামাতে হয় জীবেনর কানায়। গল্পসমূহ পড়লে বোঝা যায়, লেখক তাই করেছেন এবং ভালোবাসাকে খুব ভালোভাবে প্রেমময় অনুভবে নিরীক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পসমূহের ভাষা এত সহজ এবং শব্দচয়ন এত
মনোরম যে, পড়লে মন বিগলিত হয়ে যায়। যে কোনো মন তা যতই কঠিন হোক না কেন, নরম হয়ে যায়। গল্পগুলির ভাষা ভালোবাসার মতোই প্রাঞ্জল। গল্পগুলিতে মুগ্ধতা যেন হৃদয়ের আবেগে তাড়িত হয়ে প্রেমে প্রেমে একাকার হয়ে গেছে। অল্পকথায় অনেক বেশি প্রকাশের ক্ষমতা, ছোটো কথায় ভালোবাসার সাহসী প্রকাশ এত ঋদ্ধ যে, গল্প শেষ না করে কোনোভাবে ছাড়া যায় না। এমন অনুভূতির জন্যই হয়তো বইকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ভালোবাসাকে বলা হয়েছে স্বর্গীয়

অসাধারণ ২০টি গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে পাঠক এবং পাঠকের উত্তরসুরী- সবার বিবেক ভালোবাসার মাধুর্যে আনন্দ আর মমতার ঔদার্যে সবার মন বিকশিত হয়ে উঠবে। পরস্পরের প্রতি সৃষ্টি হবে স্নেহপ্রেমপ্রীতি এবং উদার সহানুভূতি। ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে একজন দুষ্ট ছেলেকেও কিংবা অবাধ্য বন্ধুকেও নিজের একান্ত ভালোবাসার অানুগত্যে পরিণত করা যায়, তার কৌশল এই বইয়ে বাস্তব গল্পে বিধৃত করা হয়েছে। বইটি পাবেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। আমি ভালোবাসা দিবসে আপনার প্রিয়জনকে বইটি উপহার দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ এর চেয়ে ভালো বই ভালোবাসা দিবসের জন্য আর হয় না