Translate

Wednesday 9 May 2018

জীবনান্দ / ড. মোহাম্মদ আমীন


১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তথা বর্তমানে বাংলাদেশর বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার অধিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে চলে আসেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবেও তিনি খ্যাত ছিলেন।
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন বিখ্যাত কবি। আদর্শ ছেলে তার একটি বিখ্যাত কবিতা। ওই কবিতায় তিনি লিখেছেন,
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে।
জীবনানন্দ পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তার ডাকনাম ছিল মিলু। ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তাকে ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। দু’ বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন।
জীবনানন্দ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ওই বছর ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল বর্ষ আবাহন। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয়নি, কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল। তবে ম্যাগাজিনটির বর্ষশেষের নির্ঘন্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয়: শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগ-সহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রেও অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম কাব্য ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ লিখা শুরু করেন।
প্রথম কাব্য প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি সিটি কলেজের চাকরিটি হারান। কলকাতায় তার কোনো কাজ ছিল না। তাই তিনি বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে তিন মাস পর পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় জীবনধারণের জন্যে তিনি টিউশানি করতেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মে তিনি লাবণ্য দেবীর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের পর আর দিল্লি ফিরে যাননি। এরপর প্রায় পাঁচ বছর কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। কিছু দিন ইনসিউরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। এই সময় ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি তাঁর বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ কবিতা রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে 'রূপসী বাংলা' কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ ব্রজমোজন কলেজে ফিরে এসে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
দেশবিভাগের কিছুদিন আগে তিনি বিএম কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর আর পূর্ববঙ্গে ফিরে আসেননি। কলকাতায় তিনি দৈনিক স্বরাজপত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন কয়েক মাস। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে তিনি দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন – মাল্যবান ও সুতীর্থ, তবে আগেরগুলোর মতো ও দুটিও প্রকাশ করেননি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তাঁর পঞ্চম কাব্য 'সাতটি তারার তিমির' প্রকাশিত হয়। একই মাসে কলকাতায় তার মাতা কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে। ততদিনে জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে 'বনলতা সেন' সিগনেট প্রেস হতে পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ঘোষিত “রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরষ্কার” লাভ করে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা'। বইটি ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের “সাহিত্য একাডেমি” পুরষ্কার লাভ করে।
চাকুরি ও জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু নিগৃহ হতে হয়েছে। একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশের অনুরোধে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন। এ সময় কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশকে কদাচিৎ কাছে দেখা গেছে। তখন তিনি টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একদিন বাসায় এসে বাড়িতে এত লোক দেখে স্ত্রী বলেছিলেন, জীবনানন্দ এত জনপ্রিয় হলো কবে থেকে।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর জীবননান্দ দাশ মারা যান। আসলে তিনি ট্রামের নিচে পড়ে আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।গত এক শত বৎসরে কোলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কেউ মারা যায়নি।
জীবদ্দশায় তিনি তেমন খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। মৃত্যুর অব্যবহিত পর বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতায় শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম একজনে পরিণত হন। তিনি কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। তবে তিনি ঔপন্যাসিকও লিখেছেন। তার লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ১৪ এবং গল্পের সংখ্যা শতাধিক।

No comments:

Post a Comment