ম্যালামাইন নন্দিত বিষ / ড. মোহাম্মদ আমীন
খাদ্যগ্রহণের পাত্র হিসেবে যারা যত বেশি ম্যালেমাইনের তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করেন, তাদের মেধা, সৃজনশীলতা, স্থৈর্য এবং দূরদর্শী চিন্তা তত বেশি ব্যহত হয়। এটি একটি জৈব যৌগ। যার গাঠনিক
সংকেত C3H6N6। মেলামাইনের বিষাক্ত কণা খাদ্যের সঙ্গে মিশে শরীরের অন্যান্য অংশের মতো নিউরনেও আঘাত হানে। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে শিশুদের। এভাবে অতিরিক্ত ম্যালামাইনের যথেচ্ছ ব্যবহার উন্নয়নশীল দেশ-সমূহের শিশুদের মেধা ধীরে ধীরে হ্রাস করে দিচ্ছে। আমরা অসচেতন, বলতে গেলে প্রায় অজ্ঞ পিতামাতা নন্দিত হাস্যে আমাদের শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছি এই মারাত্মক বিষ।
অ্যামোনিয়াম থাইয়োসায়ানাইড থেকে উদ্ভুদ মেলাম ((melam) এবং আমিন (amine) শব্দ থেকে মেলামাইন শব্দের উদ্ভব। শব্দটির উৎস গ্রিক এবং এর অর্থ কালো। এই কালো বলতে বুঝানো হয়েছে মোহনীয় ভয়ঙ্কর। দেখতে সুন্দর হলেও এটি প্রাণীদেহের জন্য মারাত্মক কাল বা ক্ষতিকর।
খাদ্যবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদের অভিমান, ম্যালামাইন ফরমালিনের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। নানা রঙেঢঙে সজ্জিত মেলামাইনের পাত্র দেখে শুধু শিশু নয়, শিশুর প্রপিতামহ পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কত মজা করে ব্যবহার করা হয় ওই সজ্জিত পাত্রপাত্রী। কিছুদিনের মধ্যে রং আর আগের মতো থাকে না। পুরানো বউয়ের গোমড়া মুখের মতো বিমর্ষ হয়ে যায়। কোথায় যায় মেলামাইনের বিষাক্ত কণায় মেশানো ওই রং?
আপনার আমার শরীরে।
ইউরিয়া ও ফরমালডিহাইডের মিশ্রণে মেলামাইন রেজিন তৈরি হয়। দুটোই সাধারণভাবে প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। তবে, কেউ যদি নিজেকে উদ্ভিদ মনে করেন, সেটি অন্য কথা। এই প্রসঙ্গে ইউরিয়া অল্প আলোচনা আবশ্যক মনে করছি। তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং আ্যমোনিয়ার মিশ্রনকে উচ্চচাপে এবং 130-150 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে ইউরিয়া উৎপাদন করা হয় ইউরিয়ার ৪৫%ই উদ্ভিদের প্রধান পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন । তাই এটি সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।কেউ যদি মনে করেন, ইউরিয়া, উদ্ভিদের মতো মানুষেরও পুষ্টি যোগায়, তাহলে তিনি প্রতিদিন মুড়ির মতো কয়েক মুঠো ইউরিয়া সার চিবোতে পারেন। অনেক দেশে, দুধ বা পুষ্টিকার খাদ্যসমূহে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি দেখানোর জন্য ম্যালামাইন মেশানো হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অষ্টাদশ শতকের পর ম্যালামাইনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানী লোকের বিকাশও কমে গেছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন-এর ( ১৬৪৩ – ১৭২৭) শতবর্ষ পর বিশ্ব পেয়েছে আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯ - ১৯৫৫)। তারপর?
একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, তাপের অনুপস্থিতিতে মেলামাইন-রেজিন সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। তবে তাপের প্রভাবে, তা যতই সামান্য হোক না কেন, ম্যালামাইন পরিবর্তিত হতে শুরু করে, বিশ্লিষ্ট হতে থাকে তার শরীরে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত উপাদান-সমূহ। তাই ওভেনে মেলামাইন-পাত্র দেওয়া উচিত নয়। আমার অনুরোধ- একাজটি করবেন না। কেউ করলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। আমি দিই না কিন্তু বউ দিয়ে দেয়, নিষেধ করলে বলে, অত উপদেশ দিও না। যাই হোক, এটি আমাদের দাম্পত্য বিষয়, আসল কথা হচ্ছে ক্ষতি, মেধাশূন্য ভবিষ্যপ্রজন্ম। আপনি কী চান আপনার শিশুটা মেধাশূন্য হয়ে যাক? আর একটা বিষয়, মেলামাইনের তৈজস বহুল প্রচলিত হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, মেলামাইন মানুষের মানসিক স্থৈর্যকেও স্পর্শকাতর করে তোলে।
তাপের সংস্পর্শে মেলামিন রেজিনের রাসায়নিক উপাদানগুলো আলাদা হয়ে পড়ে, যা বিষাক্ততার জন্য দায়ী। মেলামাইনের পাত্রে পরিবেশিত গরম খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তা ছাড়া কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং কিডনির ক্যান্সারও হতে পারে একই কারণে। তাইওয়ানে মেলামাইন নিয়ে একটি গবেষণা থেকে এই বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পেয়েছিলো বিশ্ববাসী। মেলামাইনের পাত্রে গরম খাবার পরিবেশন করলে উচ্চ তাপমাত্রায় মেলামাইনের কিয়দংশ খাবারে মিশে যায়। আমেরিকায় পরিচালিতক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ম্যালামাইনের তৈরী পাত্র নয়, ম্যালামাইনের তৈরী যে কোনো কিছুই ক্ষতিকর। এমনকি সেটি যদি টেবিল ক্লথও হয়।
দেশের ৭৭ ভাগ মানুষ সীসাজনিত দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। শহরে এর পরিমাণ শতকরা ৯৭.৭ ভাগ এবং গ্রামে ৯৩.৭ ভাগ। এছাড়া দেশের ৮৮ ভাগ মানুষ কোন না কোনভাবে সীসাজনিত দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত রং থেকে এ সীসা ছড়াচ্ছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। কিন্তু কেন? সিরামিক ও ম্যালামাইনের তৈজসপত্রের প্রচুর ব্যবহারই এর অন্যতম কারণ। ম্যালামাইনের তৈরী রঙ্গিন পাত্র থেকে সীসা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি করছে।
সীসা খুবই বিষাক্ত পদার্থ। এটি সব সবার জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশুদের জন্য মারাত্মক। সীসাযুক্ত রং সবচেয়ে মারাত্মক এবং আপনি জানেন বা না জানেন এটিই ব্যবহৃত হচ্ছে ম্যালামাইনে।ম্যালামাইনে ব্যবহৃত এই রং খুব সহজে খাদ্যকণার সাথে মিশে যায়। বিশ্বাস হয় না! তা না হলে ম্যালামাইনের পাত্র কেনার কয়েক মাস পর রঙচঙে রং কেন ওঠে যায়। ফলে শিশুরা বিষক্রিয়ার শিকার হয়। এতে মস্তিস্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, আচারণগত সমস্যা দেখা দেয়, শ্রবণে সমস্যা হয়, মাথাব্যথা সব সময় লেগে থাকে, পুরুষ ও মহিলাদের প্রজনন সমস্যা দেখা দেয়, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং স্নায়ুচাপ দেখা দেয়, স্মৃতি শক্তি কমে যায়, ঘুম কমে যায় এবং পেশী ও হাড়ের সংযোগ স্থানে ব্যথা হয়। পঙ্গুত্ব বা অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ায়।
এজন্য অনেকে মনে করেন, ম্যালামাইন মানে মেলা মাইন।মাইন শব্দের অর্থ বারুদ দ্বারা স্থাপনাদি ভূমিসাৎ করিবার লক্ষ্যে এর নিচে খনন করা সুড়ঙ্গ। সুতরাং ম্যালামাইন আমাদের সমুদয় প্রতিভাকে, প্রাণশক্তি আর চাঞ্চল্যকে ধ্বংস করার একটি মারাত্মক মাইন।
মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার- একই সঙ্গে বাড়ছে বিষ। খাদ্য, পাত্র, মাটি, বাতাস, শয়ন সবখানে বিষ। এত বিষ চারিদিকে, বিজ্ঞানের বিনাশ ছাড়া বিষমুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। তবে কিছুটা সাবধান থাকা যায়, তাহলে বিষ কিছুটা কম ঘেষতে পারবে। Something is better than nothing.
No comments:
Post a Comment