Translate

Thursday 20 July 2017

বাংলা বানানে স্বেচ্ছাচারিতা / ড. মোহাম্মদ আমীন

বাংলা বানানে স্বেচ্ছাচারিতা / ড. মোহাম্মদ আমীন

ভাষাভাষীর সংখ্যা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে বাংলা পৃথিবীর অন্যতম একটি সমৃদ্ধ ভাষা। তবু কবি-সাহিত্যিক, বৈয়াকরণ ও প-িতবর্গের মতানৈক্য এবং নিজ নিজ ধারণাকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার মানসে সৃষ্ট স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে বাংলা ভাষা প্রচ- অস্থির। এ অস্থিরতা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব বাংলা বানানে ভুলের অন্যতম কারণ।

রবীন্দ্র-সুনীতি থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলার অনেক কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকদের মধ্যে এমন মনোভাব লক্ষণীয়। বাংলা একাডেমির অনেক বিষয়ে এমনকি একই গ্রন্থে সাংঘর্ষিক বিবরণ রয়েছে। বানান নিয়ে স্বাধিকার প্রবণতা ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য শুধু কলঙ্ক নয়, লজ্জাকরও বটে। যিনি রক্ষক তিনিই যদি ভক্ষক হন তাহলে সে দেশ ও জাতির পতন অনিবার্য। তেমনি যিনি ভাষার কারুকর্মী তিনিই যদি বানানে স্বেচ্ছাচারী হন তাহলে ভাষার অঙ্গহানি ও বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। শব্দই হচ্ছে লেখ্য ভাষার প্রাথমিকতম অপরিহার্য উপাদান। চুন-সুড়কি ভবন-নির্মাণের প্রাথমিকতম উপাদান হলেও ভবনের তুলনায় এর দাম অতি তুচ্ছ। তবু এ উপাদানে ভেজাল মেশালে পুরো ভবনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য।

বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকগণের অনেকে নানা ক্ষেত্রে ব্যাকরণের রীতি-নীতি অগ্রাহ্য করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানান লিখেছেন ও লিখছেন। ভাবটি এমন, 'আমি এত বড় লেখক, যা লিখি তা-ই পড়বে, আমিই শুদ্ধ, আমিই ভুল।' অথবা হতে পারে, অনেকে বাংলা বানানে দক্ষ নন এবং তাই প্রুফ রিডারের উপর সংশোধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজের বিখ্যাত সুনামটি বই প্রকাশে ব্যবহার করেছেন। বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে তাদের মতৈক্যের অভাব বাংলা বানানে সর্বজনীন নীতি প্রণয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে।

অনেক কথা বলেছেন, লিখেছেন; যা আবার নিজেরই লঙ্ঘন করেছেন। এর ফল শুভ হয়নি তা এখন অনুধাবন করা যাচ্ছে। অবস্থা এখন এতই সঙ্গীন যে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কোথায় তা নিয়ে প্রচ- সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ ভাষা নিয়ে স্বেচ্ছাচার, ব্যাকরণ-অবহেলা, বানানলাঞ্ছনা সাংঘাতিক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এ বিশৃঙ্খলার জন্য সৃজনশীল লেখকবর্গের ভূমিকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ সাক্ষর জনগোষ্ঠীর কাছে মুখ্যত সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে লেখ্য ভাষার অভিঘাত ও প্রভাব সংক্রমিত হয়; পাঠ্য ব্যাকরণ গ্রন্থের মাধ্যমে নয়।

সাহিত্য ও ব্যাকরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ও নির্ভরশীল। দুটোর ভেতরে যে গোপন বৈরিতা, ঈর্ষা ও অসহিষ্ণুতা প্রবল এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। তবে এর পরিমাণ যতই হোক, হিন্দু দম্পতির ন্যায় সম্পর্ক ছিন্ন করা অসম্ভব। হায়াৎ মামুদের ভাষায়, 'কে কার বশ্যতা স্বীকার করবে সে প্রশ্ন অবান্তর, কারণ ব্যাকরণ নিয়মতন্ত্রী বলে এ ঔচিত্যবুদ্ধি তার থাকে যা তাকে সাবধান করে দেয় যে সাহিত্যের সীমানা তার চৌহদ্দিতে পড়ে না, ঢুকতে হলে অনুমতি বা আইনসঙ্গত অধিকার নিয়ে ঢুকতে হবে, অন্যথায় নয়। সমস্যা কিন্তু এখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে বৈয়াকরণ ও সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা ও আত্মবোধের। যিনি সাহিত্য রচনা করেন তিনি ব্যাকরণ অবমাননাকে শৈলীমাহাত্ম্য হিসেবে ধরে নিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য ভাষার উপর স্বেচ্ছচার ও ভাষার নিয়মভঙ্গ করে চলেন। যা সাধারণ্যে দ্রুত বাহিত হয়। ভাবটা এমন- বাপু আমি কি কম জানি? তোমার কথা মানব কেন, আমার কথা মান।' যে সাহিত্যিক যত বেশি জনপ্রিয় তার স্বেচ্ছাচারিতার অনুসারী তত বেশি হয়ে যায়। এদিকে ভাষা ও ব্যাকরণ হতাশ হয়ে চেয়ে থাকে ভাষাসন্ত্রাসীগণের দিকে। রক্তাক্ত ভাষার কিছু করার থাকে না। বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও ব্যাকরণের এ পরস্পরবিরোধী দ্বৈরথাবস্থানের কারণে ক্ষতি হয়েছে সাহিত্যের, ব্যাকরণের নয়। পৃথিবীতে বাংলার মতো এমন সমৃদ্ধ আর কোনো ভাষা নেই, যার সাহিত্য এত পরিণত, অথচ ব্যাকরণ এমন অপরিণত, দুর্বল, অসহায় ও অস্থির।

বাঙ্গলা, বাংলা, বাঙলা, বাঙালা_ আরও অনেক পদে এমন বানান-ভিন্নতা দেখা যায়। আগে খিষ্টাব্দ ও খ্রিষ্ট বানান প্রচলিত ছিল। তারপর আসে খ্রীস্টাব্দ ও খ্রীষ্ট। রীবন্দ্রনাথ খৃষ্ট, খৃস্ট, খ্রীস্ট, খ্রীস্ট প্রভৃতি লিখেছেন। তাঁর মতো বিশ্বখ্যাত বাঙালি আর্ষের এমন ভিন্ন বানান বাংলা বানানের ভুল ও অস্থিরতার জন্য দায়ী- এটি অস্বীকার করা যায় না। একটি শব্দ তাঁর মতো কালজয়ী আর্ষ এত রকমের লিখলে সাধারণ মানুষের কী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। নীহারঞ্জন রায় লিখেছেন : ক্রিস্টীয়, খ্রিস্টাব্দ, ক্রিস্টান, খ্রিস্ট। ষত্ব বিধানের প্রয়োগের জন্য খ্রষ্টাব্দ ও খ্রীষ্ট শব্দে 'ষ্ট' ব্যবহার করা হতো। আসলেই কী এ শব্দ দুটোতে আদৌ ষত্ব-বিধান প্রযোজ্য? একসময় বিদেশি শব্দেও ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধানের প্রয়োগ-অপ্রয়োগ নিয়ে তেমন কঠিন নিয়ম ছিল না। এখন কিন্তু বিদেশি শব্দে ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অনেকে খ্রিস্টাব্দ শব্দকে তৎসম শব্দ মনে করেন। ড. হায়াৎ মামুদও এ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ইংরেজি ঈযৎরংঃ, শব্দ বাংলায় লিখলে হবে ক্রাইস্ট। ঔবংঁৎং ঈযৎরংঃ শব্দকে যখন যিশু বা যিশু খ্রিস্ট লেখা হয় তখন এটি প্রতিবর্ণীকরণ হয় না, বঙ্গীকরণ করা হয়। তবে অনেকে বলেন, তৎসম শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দে যেহেতু ষত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়, সেহেতু খ্রিস্ট বা খ্রিস্টাব্দ শব্দে 'ষ্ট' দেয়া সমীচীন নয়। তাই বানান হবে খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্ট, খ্রিস্টীয়।

বাংলা ভাষায় এখনও অনেক ক্ষেত্রে আদর্শ মান ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অনেকে লিখেন 'ভালোবাসা' আবার অনেকে লিখেন 'ভালবাসা'। হায়াৎ মামুদ লিখেন 'ভালো' কিন্তু 'ভালবাসা'। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'দেখুন, 'ভালো' ও ভালবাসা' দুটো পৃথক শব্দ, এক মড়ড়ফ, আর একটির ষড়াব। ষড়াব যদি ভালোবাসা হয়, তা হলে মড়ড়ফ যড়ঁংব কী হবে?' বৈয়াকরণ ও ভাষা বিশেষজ্ঞ প-িতবর্গের মতানৈক্য ছাড়াও উভয় বাংলার ভাষাবিষয়ক চিন্তাধারার প্রায়োগিক পার্থক্য মতানৈক্যের জন্য বহুলাংশে দায়ী। উপযুক্ত প্রয়াস ও কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীন মান প্রতিষ্ঠা না-হওয়া পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এমন মতদ্বৈততা ও অস্থিরতা চলতে থাকবে।

ছোটবেলা থেকে বাংলা অভিধান দেখার অভ্যাস বাঙালিদের তেমন নেই। তাই প্রচলিত বানানটি শুদ্ধ-জ্ঞানে অহরহ ব্যবহার করে আসছে। ভুল কি না যাচাই করার চিন্তাও মাথায় আসে না। যে শিক্ষকগণ বাংলা শেখান তাঁরাও অভিধান অবহেলা করে প্রচলিত বানানটাই শিক্ষার্থীদের গেঁথে দিয়েছেন। যা ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে অশুদ্ধটাই শুদ্ধরূপ লাভ করেছে। এখন শুদ্ধটাই অশুদ্ধ হয়ে গেছে। আর্থ-সামাজিক ও প্রাশাসনিক অবস্থাও বাংলা ভাষার অস্থিরতার জন্য দায়ী। বাংলাদেশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও এখনও নানাবিধ কারণে ইংরেজির প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। অধ্যয়ন ও কর্মজীবনে ইংরেজিকে যত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে মাতৃভাষাকে তত গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করেনি। আর্থ-সামাজিক কর্মকা-ও এর সঙ্গে জড়িত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম এর বরাক উপত্যাকায় বাংলা ভাষার অবস্থা আরও করুণ। বলা হয়, ইংরেজিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। ইংরেজিকে গুরুত্ব দেয়া হোক কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। মাতৃভাষার ভিত শক্ত হলে ভাষা হোক আর অর্থ হোক সব ভিত শক্ত হয়ে যাবে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাপান ও চীন।

তিন শতকের ব্রিটিশ শাসনের ফলে সুস্থ সুন্দর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত জীবনযাপন ও জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে ইংরেজি ভাষাটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে। ইংরেজি জানা বাঙালি আর ইংরেজি না-জানা বাঙালির মধ্যে সুস্পষ্ট আর্থনীতিক শ্রেণি-বিভাজন তৈরি হয়েছে। ফলে সমাজে উন্নততর জীবনযাপনের প্রধানতম শর্তই হয়ে গেল ভালোভাবে ইংরেজি শিক্ষা। যে কারণে বাংলাদেশের সর্বত্র ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনোর জন্য এত স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। যার ফলে আর একবার বংশ পরম্পরায় অর্থনীতিক শ্রেণি সৃষ্টির ধারা চালু হয়ে যায়। যেখানে ইংরেজি ছাড়া উচ্চশিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত আজও গড়ে ওঠেনি, সেখানে এটাই নিদারুণ বাস্তব। কোনো ভাষা তখনই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যখন সেই ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা যায়, সেই ভাষা স্বদেশবাসীর জীবনজীবিকায় নির্ভরতা দেয় এবং সেই ভাষায় সৃষ্টি হওয়া উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি স্বদেশবাসীর পুষ্টি নিশ্চিত করে বিশ্বমানবকেও পুষ্টি যোগাতে সক্ষম হয়। দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার অবদান প্রথম দুটোর ক্ষেত্রে একেবারে নেই বললেই চলে; শেষেরটির ক্ষেত্রে বাঙালিরা যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে, বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে বঙ্গসাহিত্য-সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে ততটা বিখ্যাত নয় বরং বেশ পিছনের সারিতে অবস্থান করছে।

বাংলা ভাষায় এখনও সর্বজন গ্রাহ্য কোনো ব্যাকরণ, অভিধান বা বানান রীতি প্রতিষ্ঠা হয়নি। বাংলা একাডেমি প্রমিত রীতি প্রচলনে মাধ্যমে এ প্রয়াসে উদ্যোগী হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত প্রমিত রীতি অনুসরণ করে বাংলা একাডেমির প্রমিত রীতি অনুসরণপূর্বক বাংলা ভাষা ও বানানের আদর্শ মান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। যেহেতু এখনও কোনো আদর্শ ও সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা রীতি নেই সেহেতু অনেককে সাহিত্যকর্ম হতে দাফতরিক পর্যায়ে যে কোনো লেখা হোক না কেন, একজন লেখককে বানান নিয়ে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো পথনির্দেশনা কোনো ব্যাকরণে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক লেখক ও বৈয়াকরণগণের কাছেও কোনো সর্বজনীন উত্তর নেই- এক একজন এক-এক রকম উত্তর দেন। আধুনিকগণ ঐ সুযোগে আরও স্বেচ্ছাচারে নিমজ্জিত। এ অবস্থায় বাংলাকে স্থির, আদর্শময় ও প্রমিত মানে স্থির করার ক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন তাঁরা হচ্ছেন সমাজের সকল স্তরে প্রভাববিস্তারকারী অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা, বিচারক, পেশাজীবী, শিক্ষক প্রমুখ। তাঁরা যদি বাংলা বানানে আদর্শরীতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তা হলে বাংলা বানানের এমন অস্থিরতা সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। নির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার আলয়ে তাদের কর্মকা- পরিবাহিত বলে কেবল তাদের পক্ষে সারা বাংলাদেশ বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিন্ন বানান ও ভাষারীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত প্রিয় বাংলা আপন সৌকর্যে বিভূষিত হয়ে উঠবে।

বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত নতুন শব্দ একদিকে এই ভাষার ভেতর থেকে তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে বাইরে থেকে এসে ঢুকছে। এগুলো সামাল দেয়া, শৃঙ্খলার মধ্যে আনা বাংলার অভিভাবকদের, বাংলা একাডেমির, অভিধান প্রণেতা ও বৈয়াকরণদের কাজ। বিভিন্ন ভাষার অভিভাবকেরা প্রতিবছর সদ্য-স্বীকৃত ও আত্তীকৃত নতুন শব্দের তালিকা প্রকাশ করেন। ঙীভড়ৎফ ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু প্রতিবছর তাদের শব্দভা-ার চার বার হালনাগাদ করে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চে তাদের অভিধানে নয় শতের বেশি শব্দ, পদবন্ধ (ঢ়যৎধংবং) ও অর্থ (ংবহংব) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তাদের পরবর্তী হালনাগাদ সংস্করণ প্রকাশ পাবে। সে তুলনায় বাংলা প্রায়-অভিভাবকহীন, যেন খোলা রাস্তায় রোদ-বৃষ্টি-শীত-বসন্তে আপন শক্তিতে টিকে থাকা কঙ্কালসার এক অসহায় এতিম।

বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ছাড়া বাংলায় এখন আর কোনো প্রমিত অভিধান নেই। অভিধানটির প্রথম প্রকাশ : স্বরবর্ণ অংশ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ও ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। মাঝখানে ফাঁক দশ বছর। দ্বিতীয় সংস্করণ : ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ, মাঝখানে ফাঁক আট বছর। পরবর্তী সংস্করণ, যাকে বাংলা একাডেমি তৃতীয় সংস্করণ বলা থেকে সংগত কারণেই বিরত থেকেছে, বলেছে পরিমার্জিত সংস্করণ, এর প্রকাশ ২০০০ খ্রিস্টাব্দ। পরিমার্জিত সংস্করণ করতে সময় লেগেছে আট বছর। পরিমার্জিত সংস্করণেরই সপ্তদশ পুনর্মুদ্রণ প্রকাশ হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৪ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলি্লশ বছরে অভিধানটির মাত্র দুটো সংস্করণ এবং একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে।

ভাষা নিয়ে আমাদের আপামর মানুষের দরদ ও ভূমিকা প্রশ্নাতীত। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলার অভিভাবকদের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে উপরের পরিচ্ছেদে বর্ণিত একটি অভিধানের প্রকাশনা ছাড়া আর কোথাও কিছু লক্ষ্য করা যায় না। মুদ্রিত না হোক, বছরে অন্তত একবার অনলাইন বাংলা শব্দভা-ারের হালনাগাদ তথ্য প্রক্রিয়াজত করা আবশ্যক। অধিকন্তু যখনই দরকার অনলাইনে শব্দসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিয়ে বাংলা বানানের অস্থিরতা ও স্বেচ্ছাচার রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ না থাকলে বাংলা অভিধানের আগামী চলি্লশ বছরের ইতিহাস বিগত বছরসমূহের ইতিহাস থেকে উন্নততর হবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলা একাডেমি এককভাবে এ কাজটি পারবে না। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) গ্রুপের হাজার হাজার উৎসাহী ও উদ্যোগী সদস্যের সহায়তা নিতে পারেন।

তথ্যসূত্র : শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) গ্রুপ।

Thursday 13 July 2017

শব্দশক্তি / Subhasis Chirakalyan Patra


শব্দের ত্রিবিধ শক্তির কথা এখানে প্রকাশ করা হচ্ছে। যিনি শব্দশক্তিকে করায়ত্ত করতে পারবেন তিনি ভাষার আলোয় বিশ্বরূপ দেখবেন।
অভি পূর্ব্বক ধারণ যাহাতে তাহাকে অভিধা কয়,কোনো শব্দের অভিধা অর্থ শব্দনিষ্ঠ হয়।অভিধা যাহাতে অন হয়ে যায় তাকে অভিধান বলে,ক্রিয়াভিত্তিক অভিধান পেলে পড়িব নিদ্রা ভুলে। ১।লক্ষণা লক্ষণের আধার, তাতে লক্ষণ রয়;লক্ষণার্থে আঁকোড়তলার মানে আদালত হয়।বিষ্ণুপুরের আদালতে আছে একটি আঁকোড় গাছ,চল ছুঁড়ি তোকে নিয়ে যাব সেই আঁকোড় গাছের কাছ। ২।ব্যঞ্জনা নামে আরও একখানি শব্দবৃত্তি রয়,সোজা কথাটির বাঁকা মানে হলে তাকে ব্যঞ্জনা কয়।ব্যঞ্জনার্থে অভিধাদি ছাড়া ভিন্ন অর্থ পাই;'স্নান করিয়াছি' মানে হতে পারে ' ভাত চাই।' ৩।---- 'বর্ণসঙ্গীত'।
টীকা
১. শব্দবৃত্তি মানে শব্দের অর্থ প্রকাশ করার শক্তি। বৃত্তি শব্দের অর্থ কাজ বা পেশা। অর্থকে প্রকাশ করাই শব্দের কাজ, তাই তাকে শব্দবৃত্তি বলে। শব্দের ত্রিবিধ বৃত্তি --- অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা। শব্দবৃত্তিকে শব্দশক্তিও বলে, যথা লক্ষণাবৃত্তিকে লক্ষণাশক্তি বলা যায়। এখানে শব্দশক্তি মানে Sound energy বুঝলে চলবে না।
শব্দকে ভেঙে যে আক্ষরিক অর্থ পাওয়া যায় তাকে অভিধা অর্থ (literal meaning) বলে। এই অর্থ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক হয়। যে গ্রন্থে শব্দের অভিধা অর্থ বলে দেওয়া হয় তাকে অভিধান (=অভিধা অন হয় যাহাতে) বলে। শব্দের বানান কীভাবে তার অর্থকে ধরে রাখে তা অভিধানে ফুটে উঠার কথা, অবশ্য আধুনিক অভিধানকারেরা প্রায়ই এই দিকটাতে অবহেলা করেন। তারা শব্দের বানানের ব্যাপারে শুধু উচ্চারণকেই গুরুত্ব দেন। শু.বা.চ-এর বন্ধুদের অনুরোধ করব শব্দের অভিধার্থের দিকে সর্ব্বদা নজর রাখতে।
২. আমাদের পাঁচাল গ্রামের (জেলা বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ) মহিলারা ঝগড়ার সময় একে অন্যকে 'তোকে আঁকোড়তল দেখাবো লো!' বলে গালি দেয়। এখানে আঁকোড়তল শব্দের অর্থ হল বিষ্ণুপুর শহরের আদালত, যেখানে একটি আঁকোড় গাছ আছে। চোখ হলুদ হওয়া লক্ষ্য করে ডাক্তারবাবু যেমন ভাইরাল হেপাটাইটিস (viral hepatitis) রোগ ধরতে পারেন তেমনি আঁকোড় গাছটি লক্ষ্য করে আমাদের আদালতটি চেনা যায়। আদলত বুঝাতে আঁকোড়তল শব্দের প্রয়োগ লক্ষণার্থে প্রয়োগ হয়। প্রসঙ্গত, রোগলক্ষণগুলিকে ডাক্তারবাবুরা লক্ষ করেন বলেই সেগুলিকে লক্ষণ বলে।
শব্দকে প্রকৃতি-প্রত্যয় এবং প্রয়োজনে বর্ণে ভেঙে তার অভিধার্থ নিষ্কাশন করা যায় এবং একটু চেষ্টা করলেই লক্ষণার্থও বোঝা যায়। মৎপ্রণীত পদ্যাভিধান ''বর্ণসঙ্গীত''-এ বিষয়টা দেখানো হয়েছে। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা এই ব্যাপারটি ভাল করে না বুঝে শব্দার্থ যাদৃচ্ছিক (Word meanings are arbitrary) বলে ঘোষণা করেছেন।
জৈমিনি, যাস্ক, কালিদাস, ভর্তৃহরি, প্রমুখেরা বাক ও অর্থ পরস্পর সম্পৃক্ত বলে মনে করতেন। আজকের বাঙালী বিদ্বানরা সেসব ভুলে পশ্চিমের পো ধরছেন এবং তার ফলে বাংলা ভাষার শরীরে নানা রোগলক্ষণ (ভুল বানান, ভুল অর্থ করা ইত্যাদি) দেখা যাচ্ছে। এসব আমাদের পক্ষে খুবই পরিতাপের বিষয়। আমাদের উচিত হবে পশ্চিমকে শব্দার্থের নিয়ম বুঝিয়ে বলা। শব্দার্থের দর্শনে ভারতবর্ষের অর্জ্জন পাশ্চাত্যের তুলনায় অনেক বেশী। শব্দার্থ যাদৃচ্ছিক নয়, তা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক --- 'বর্ণসঙ্গীত' গ্রন্থে ইহা দেখানো হয়েছে।
৩. অভিধা বা লক্ষণা বাদ দিয়ে শব্দের আরও ভিন্ন অর্থ হলে তাকে ব্যঞ্জনার্থ বলে। একে ভঙ্গীভাষণ বা বক্রোক্তিও বলা হয়।

বাংলা বানানে ভুল : কারণ ও প্রতিকার / ড, মোহাম্মদ আমীন

বানান ভুলের জন্য শাস্তির বিধানের অভাব ও প্রয়োগ বাংলা বানানে অস্থিরতা, ভুল ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রধান কারণ। প্রচলিত বিধি লংঘন করলে শাস্তি পেতে হয়, তিরস্কৃত হতে হয়; কিন্তু বানান-বিধি ভঙ্গ করলে কোনো সমস্যা হয় না।----- এখন নাকি বাংলা বানানে ভুল করলে উত্তরপত্রে নাম্বার কর্তনেরও বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। - - - বাঙালিরা সাধারণত শাস্তির ভয় বা প্রাপ্তির প্রত্যাশা না-থাকলে যে কোনো বিষয়ে অবহেলা দেখান এবং যথেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। - - -
বাংলায় প্রচলিত প্রায় ৫৫ হাজার (মোট শব্দের তুলনায় অতি নগণ্য) শব্দের নামে বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণ জিইয়ে রাখা হয়েছে।- - - - সংস্কৃত শব্দ- যেগুলো বাংলায় এসেছে তারা এখন বাংলার নিজস্ব শব্দ, সংস্কৃত নয়। তাই বাংলা ব্যাকরণের নিয়মেই তাদের লালন করা সমীচীন। - - - আমরা এগুলোকে সংস্কৃত নিয়মে লালন করছি, এটি আত্ম-মর্যাদা-বিসর্জন তুল্য। অতিথি স্বভাবতই নিমন্ত্রণকারীর- এবং বধু বা ঘরজামাই নিবাস-স্থলের রীতিই অনুসরণ করে, পূর্বরীতি নয়। কিন্তু বাংলায় দেখছি উল্টো। ----লন্ডনে এসে কোনো বাঙালি কি বাংলার আইনে চলবে? এবং তা কি আদৌ উচিত?
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে যেভাবে লালন- ও মর্যাদা প্রদানের কথা, তা দেওয়া হচ্ছে না। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, ইউনিয়ন পর্যায় হতে শুরু করে সর্বোচ্চ কার্যালয় পর্যন্ত বাংলা বানান ও শব্দচয়নে ব্যাপক অবহেলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। - - - অধিকন্তু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নিজ নিজ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে ইচ্ছেমতো বানান, বিষয়টিকে আরও জটিল করে দিচ্ছে।----- কেউ লেখেন বাংলা, কেউ বা বাঙালা, বাঙলা, বাঙ্গালা - - -। ক্রিয়ায় স্বেচ্ছাচারিতা বাংলাকে মহা অস্থির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। -- করল, করলেম, করলুম, করলাম, করলেন, করলো, দেয়া, দেওয়া, দিলাম, দিলেম, দিচ্ছিলাম, দিচ্ছলুম, দিচ্ছিলেম ---। পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় এমন দেখা যায় না।
---- ------- অভিধান না-দেখা এবং মাতৃভাষার শব্দ হিসাবে প্রচলিত ভুল-বানানকে যাচাই না-করে শুদ্ধ গণ্য করা ভুলের আর একটি কারণ। অনেকে সমধ্বনির বর্ণ, যুক্তাক্ষর প্রভৃতি উল্লেখ করে বাংলাকে কঠিন ভাষা আখ্যায়িত করে থাকেন। --- এসব অজুহাত মাত্র, ভাষার প্রতি দরদ থাকলে, একটু চর্চা করলেই হয়। পৃথিবীর অনেক ভাষা বাংলার চেয়েও জটিল। - - --। পৃথিবীর আর কোনো ভাষাভাষীকে নিজ ভাষার প্রতি এমন অশালীন মন্তব্য করতে দেখা যায় না।
---- আর্থ-সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে বাংলা ভাষার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব, বাংলার প্রতি বাংলাভাষীর অবহেলা, বানানে ভুল ও যথেচ্ছাচারের আর একটি কারণ। বাংলা না-জানলেও চলে,- - --- চাকরি-বাকরি, সামাজিক-মর্যাদা কিছুই বাংলাকে ঘিরে আবর্তিত হয় না, যেমন হয় ইংরেজি, হিন্দি বা অন্য ভাষাকে ঘিরে। ---- বাংলা ভুল করলে লজ্জিত হওয়ার কারণ ঘটে না - এমন একটি উন্নাসিক ভাব ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে ।----- বাংলা ভালো না-করলেও ভালো চাকরি পাওয়া যায়, তাই বাংলা মায়ের জন্য অত সময় দিয়ে লাভ কী! বরং পরের মায়ের গোলামি --- । মধুসূদনও করেছিলেন - - -।
তো- - - - - কেন বাংলা শিখব, হোক না মাতৃভাষা; তাতে কী! গরীব মায়ের চেয়ে সুন্দরী প্রেমিকার ধনী মায়ের সেবা করলে অনেক লাভ- এমন নিকৃষ্ট মানসিকতা আমাদের মজ্জাগত। এজন্য ভালো বাংলা জানেন না এমন অনেক পিতা-মাতা তাদের পুত্র-কন্যার বিয়েতে ইংরেজি ভাষায় দাওয়াতপত্র দেন। অথচ ওই বিয়েতে হয়তো একজনও ইংরেজ থাকেন না - - - - -।
(চলবে-)
[ এ যাত্রায় এটি স্যারের শেষ অভিভাষণ, অভিভাষণটি একটায় শেষ হয়েছে; তারপর স্যারকে বিদায় দিয়ে এটি অনুবাদ করে পোস্ট করা হলো, তাড়াহুড়ো ভুলের কারণ হতে পারে, মার্জনীয়]

Wednesday 12 July 2017

কুম্ভীলক / ড. মোহাম্মদ আমীন

 কুম্ভীলক / ড. মোহাম্মদ আমীন
অন্যের লেখা চুরি করাকে ইংরেজি ভাষায় plagiarism বলে। যারা এ ধরনের চুরি করেন তাদের বলা হয় plagiarist, বাংলায় কুম্ভীলক।জানামতে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের প্রথমার্ধে কুম্ভীলকবৃত্তি শুরু হয়।রোমান কবি মার্শাল প্রথম, কিছু কবির বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা চুরির অভিযোগ আনেন।সাধারণত অখ্যাত লেখকগণ কুম্ভীলকবৃত্তির শিকার হয়ে থাকেন। খ্যাতিমান লেখক, পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক প্রমুখ এমন চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকেন। আধুনিক সাহিত্যকর্মে Google কুম্ভীলকদের একটি বিশাল স্বর্গরাজ্য। এটি চৌর্যবৃত্তি হলেও বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকদের কেউ নাকি এর থেকে মুক্ত নন। তবে বস্তু চুরি আর লেখা চুরির মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি লেখা বিভিন্ন জন্য বার বার চুরি করতে পারেন কিন্তু বস্তুর ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। 
অনেকে বলেন, কুম্ভীলক না হলে কারও পক্ষে এক পঙ্‌ক্তিও লেখা সম্ভব নয়। আর্চিবাল্ড ম্যাকলিসের ভাষায়, A real writer learns from earlier writers the way a boy learns from an apple orchard - by stealing what he has a taste for and can carry off. না শেখে যেমন জ্ঞানী হওয়া যায় না, তেমনি না-চুরি করে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। বলা হয়, ধরা না পড়লে কুম্ভীলকবৃত্তি একটি চৌকষ শিল্পকর্ম, তবে ধরা পড়লে অপরাধ। সুতরাং অপরাধ আর শিল্পের সম্পর্ক খুব নিবিড়।
উইলসন মিজনার বলেছেন, “এক জনের লেখা চুরি করা কুম্ভীলকবৃত্তি কিন্তু একাধিক লেখকের লেখা চুরি করা গবেষণা।”এজন্য চার্লস মোভেল্লি বলেছেন, “কাউকে কপি করো না, সবার লেখা ইচ্ছেমতো চুরি করো।” ডেভিড শিল্ডস আর একধাপ এগিয়ে বলেছেন, “প্রত্যেক শিল্পকর্মই চুরি।” অনেকে মনে করেন, কুম্ভীলক না হলে কারও পক্ষে বড়ো শিল্পী ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়। বাট্রান্ড রাসেলের ভাষায় “প্রত্যেক খ্যাতিমান লেখক একজন কুম্ভীলক।”
সাহিত্য জগতে কুম্ভীলকবৃত্তির গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে লিউনেল ট্রিলিং বলেছেন, “অপরিপক্ক সাহিত্যিক অনুকরণ করেন আর পরিপক্ক সাহিত্যিক করেন চুরি।” পল গগুইন-এর ভাষায়, “শিল্প-সাহিত্য হয়তো চুরি, নয়তো বিপ্লব। যে সাহিত্যকর্ম বিপ্লব নয়, তা কুম্ভীলকবৃত্তির ফসল।” রালফা ওয়াল্ডো ইমারসন বলেছেন, “আমার সব উত্তম ও মৌলিক চিন্তারাশি আমার পূর্ববর্তী লেখকগণ চুরি করে ফেলেছেন। সুতরাং চোরের উপর বাটপারি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
পারস্যের কবি জালালুদ্দিন রুমি (১২০৭ খ্রিষ্টাব্দ -১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছেন : “বায্ আঁ, বায্ আঁ,হর আঁচে হাস্তী বায্ আঁ,গর কাফির গর গবরওয়াবোত পরস্তি বায্ আঁ ।ই দরগাহে মা দরগাহেনা উম্মিদ নীস্ত ।শতবার গর তওবাহ শিকস্তী বায্ আঁ ।”অন্যদিকে ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ - ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছেন :“এসো হে আর্য, এসো অনার্যহিন্দু্ মু্সলমান,এসো এসো আজ তুমি ইংরাজএসো এসো খ্রিস্টান ।মা’র অভিষেক এসো এসো ত্বরামঙ্গলঘট হয়নি যে ভরাসবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরেএই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।” 
রুমি আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা দুটোর মিল দেখে কী মনে হয়? মার্ক টোয়েনের কথা মনে পড়ে, “আদম ছাড়া কেউ চুরি না করে এক লাইনও লিখতে পারেননি।” ডেন ইনেজকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছেলিন, মৌলিক সাহিত্য বা শিল্পকর্ম কী? তিনি বলেছিলেন, “Undetected plagiarism. অর্থাৎ ধরা পড়েনি এমন কুম্ভীলকবৃত্তিই মৌলিক সাহিত্যকর্ম।” অতএব রাল্ফ- এর গলায় সুর মিলিয়ে বলতে হয়, চুরি না করে বিখ্যাত হয়েছেন এমন সাহিত্যিক বিশ্বে নেই।
দেখবেন, বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে চুরি করে নিয়ে লেখা, আমার এ লেখাটিও চুরি হয়ে যাচ্ছে।

Tuesday 11 July 2017

মাতৃভাষা ও দেশপ্রেম / প্রমিতা দাস লাবণী


অন্য ভাষার বর্ণে যারা নিজভাষার বাক্য চয়ন করে, তারা অনেকটা জাত-পরিচয়হীন। চিন্তন মানসে স্বকীয়-ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আত্মমর্যাদা, স্বাজাত্যবোধ, দেশপ্রেম, উৎস-নির্ধারক মূল্যবোধ প্রভৃতি গুণাবলীর মারাত্মক অভাব ঘটলে সে ব্যক্তি নিজের মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার বর্ণ দিয়ে সাজায়। এমন ব্যবহার গর্ভধারিনীর সঙ্গে উপহাস করার চেয়েও লজ্জাকর ও অশালীন। মাতৃভাষা মায়ের মতন। কুলাঙ্গার ছাড়া কেউ মায়ের সঙ্গে উপহাস করে না। 
যে ব্যক্তি বাঙালি হয়েও বাংলা লিখতে জানেন না কিংবা যন্ত্রের দোহাই দিয়ে মাতৃভাষাকে অন্য ভাষায় প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হন না - তাদের মাতৃভক্তি ও দেশপ্রেম থাকার কথা নয়। ভাষাপ্রেম হচ্ছে দেশপ্রেমের অম্লজান। প্রকাশ যদি হৃদ্যিক অনুভূতির আলো হয় তাহলে এমন কুলাঙ্গার ব্যক্তির কাছে বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম থাকতে পারে না। আলো ছাড়া যেমন দৃষ্টি নিষ্প্রভ তেমনি মাতৃভাষা ছাড়া ব্যক্তির স্বদেশপ্রেম নিষ্প্রভ। যার স্বদেশপ্রেম নিষ্প্রভ তার সবকিছু নিষ্প্রভ। ভাষাপ্রেম অন্তরে স্বাজাত্যবোধের অনুপ্রেরণা দিয়ে মানুষকে ঐতিহ্যের সঙ্গে একাকার করে দেয়। আর তখনই সৃষ্টি হয় জাতির । 
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির সুমহান মর্যাদা আর অমিয় স্বাধীনতার উৎস ক্ষেত্র। বাংলা ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্মবীজকে বিশ্বব্যাপী মহাসম্মানে পরিব্যপ্ত করার সমুদয় প্রেরণা যুগিয়েছিল।তাই ভাষাপ্রেম ও দেশপ্রেম অভিন্ন। অন্তত বাঙালিদের জন্য এটি আরও বেশি সত্য। 
যে ব্যক্তি নিজের মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার বর্ণ দিয়ে প্রকাশ করে তার মন সূর্যহীন পৃথিবীর মতো নিষ্প্রভ এবং তার বিদ্যমানতা অস্তিত্ব পরিচয়বিহীন প্রাণীর মতো হীন। সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম এদের লক্ষ করেই বলে গিয়েছেন-যে সব বঙ্গেত জান্মি হিংসে বঙ্গবাণীসে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, বিচিন্তকথন।

Friday 7 July 2017

গোমাংস ভক্ষণ করতেন শ্রীকৃষ্ণ / প্রমিতা দাস লাবণী


বাবু দীলিপ দেবনাথ তাঁর ‘শব্দচিন্তা চমৎকারা’ গ্রন্থে লিখেছেন, হিন্দু ধর্মের অবতার ও মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ গোমাংস ভক্ষণ করতেন। সূত্রাংশে পুস্তকটির বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলে সংগ্রহ করে নিতে পারেন। দিলীপ কুমার দেবনাথ যা লিখেছেন তা হুবুহু তুলে দেওয়া হলো :
“প্রাচীন যুগের আর্যরা বেশ আয়েশ করে কচি বাছুরের শূলপক্ব মাংস মৈরেয় ণ যখন তার পিসি কুন্তীর বাড়িতে যেতেন তখন তাকে আপ্যায়নের জন্য গরু জবাই করা হতো। সম্মানিত অতিথি বলে কথা! কৃষ্ণকে এজন্য তার মাসতুতো ভাই শিশুপাল গোঘ্ন বলে ঠাট্টা করতেন। পরবর্তীকালে এই কৃষ্ণই হিন্দুদের কাছে অবতারে পরিণত হন। অথর্ব বেদেও গর্ভিনী নারীকে মেধাবী ও বীর্যবান পুত্র প্রসবের জন্য গোমাংস খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ কালের ব্যবহারে এ নিয়ম পরিত্যক্ত হয়েছে। হিন্দুরা এখন গোমাংস ভক্ষণের কথা শুনলে ভয়ে আঁতকে ওঠেন।”
(এক ধরনের মদ), সহযোগে খেত। কথিত আছে মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র কৃষ্
-----------------------------------------------------------------------------
সূত্র : দিলীপ দেবনাথ, শব্দচিন্তা চমৎকারা, পৃষ্ঠা ৫৯, দ্বিতীয় মুদ্রণ, নভেম্বর ২০১১। প্রকাশক : দিব্যপ্রকাশ, ৩৮/২ক, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০।যুক্তরাজ্য পরিবেশক : সঙ্গীতা লিমিটেড, ২২ ব্রিকলেন, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।ISBN 979 984 8830 12 3
সংগ্রহ সূত্র : https://www.facebook.com/photo.php?fbid=236159716902043&set=a.178507052667310.1073741828.100015240497415&type=3&theater