বাংলা বানানে স্বেচ্ছাচারিতা / ড. মোহাম্মদ আমীন
ভাষাভাষীর সংখ্যা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে বাংলা পৃথিবীর অন্যতম একটি সমৃদ্ধ ভাষা। তবু কবি-সাহিত্যিক, বৈয়াকরণ ও প-িতবর্গের মতানৈক্য এবং নিজ নিজ ধারণাকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার মানসে সৃষ্ট স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কারণে বাংলা ভাষা প্রচ- অস্থির। এ অস্থিরতা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব বাংলা বানানে ভুলের অন্যতম কারণ।
রবীন্দ্র-সুনীতি থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলার অনেক কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকদের মধ্যে এমন মনোভাব লক্ষণীয়। বাংলা একাডেমির অনেক বিষয়ে এমনকি একই গ্রন্থে সাংঘর্ষিক বিবরণ রয়েছে। বানান নিয়ে স্বাধিকার প্রবণতা ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য শুধু কলঙ্ক নয়, লজ্জাকরও বটে। যিনি রক্ষক তিনিই যদি ভক্ষক হন তাহলে সে দেশ ও জাতির পতন অনিবার্য। তেমনি যিনি ভাষার কারুকর্মী তিনিই যদি বানানে স্বেচ্ছাচারী হন তাহলে ভাষার অঙ্গহানি ও বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। শব্দই হচ্ছে লেখ্য ভাষার প্রাথমিকতম অপরিহার্য উপাদান। চুন-সুড়কি ভবন-নির্মাণের প্রাথমিকতম উপাদান হলেও ভবনের তুলনায় এর দাম অতি তুচ্ছ। তবু এ উপাদানে ভেজাল মেশালে পুরো ভবনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য।
বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকগণের অনেকে নানা ক্ষেত্রে ব্যাকরণের রীতি-নীতি অগ্রাহ্য করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানান লিখেছেন ও লিখছেন। ভাবটি এমন, 'আমি এত বড় লেখক, যা লিখি তা-ই পড়বে, আমিই শুদ্ধ, আমিই ভুল।' অথবা হতে পারে, অনেকে বাংলা বানানে দক্ষ নন এবং তাই প্রুফ রিডারের উপর সংশোধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজের বিখ্যাত সুনামটি বই প্রকাশে ব্যবহার করেছেন। বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে তাদের মতৈক্যের অভাব বাংলা বানানে সর্বজনীন নীতি প্রণয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে।
অনেক কথা বলেছেন, লিখেছেন; যা আবার নিজেরই লঙ্ঘন করেছেন। এর ফল শুভ হয়নি তা এখন অনুধাবন করা যাচ্ছে। অবস্থা এখন এতই সঙ্গীন যে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কোথায় তা নিয়ে প্রচ- সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ ভাষা নিয়ে স্বেচ্ছাচার, ব্যাকরণ-অবহেলা, বানানলাঞ্ছনা সাংঘাতিক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এ বিশৃঙ্খলার জন্য সৃজনশীল লেখকবর্গের ভূমিকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ সাক্ষর জনগোষ্ঠীর কাছে মুখ্যত সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে লেখ্য ভাষার অভিঘাত ও প্রভাব সংক্রমিত হয়; পাঠ্য ব্যাকরণ গ্রন্থের মাধ্যমে নয়।
সাহিত্য ও ব্যাকরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ও নির্ভরশীল। দুটোর ভেতরে যে গোপন বৈরিতা, ঈর্ষা ও অসহিষ্ণুতা প্রবল এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। তবে এর পরিমাণ যতই হোক, হিন্দু দম্পতির ন্যায় সম্পর্ক ছিন্ন করা অসম্ভব। হায়াৎ মামুদের ভাষায়, 'কে কার বশ্যতা স্বীকার করবে সে প্রশ্ন অবান্তর, কারণ ব্যাকরণ নিয়মতন্ত্রী বলে এ ঔচিত্যবুদ্ধি তার থাকে যা তাকে সাবধান করে দেয় যে সাহিত্যের সীমানা তার চৌহদ্দিতে পড়ে না, ঢুকতে হলে অনুমতি বা আইনসঙ্গত অধিকার নিয়ে ঢুকতে হবে, অন্যথায় নয়। সমস্যা কিন্তু এখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে বৈয়াকরণ ও সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা ও আত্মবোধের। যিনি সাহিত্য রচনা করেন তিনি ব্যাকরণ অবমাননাকে শৈলীমাহাত্ম্য হিসেবে ধরে নিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য ভাষার উপর স্বেচ্ছচার ও ভাষার নিয়মভঙ্গ করে চলেন। যা সাধারণ্যে দ্রুত বাহিত হয়। ভাবটা এমন- বাপু আমি কি কম জানি? তোমার কথা মানব কেন, আমার কথা মান।' যে সাহিত্যিক যত বেশি জনপ্রিয় তার স্বেচ্ছাচারিতার অনুসারী তত বেশি হয়ে যায়। এদিকে ভাষা ও ব্যাকরণ হতাশ হয়ে চেয়ে থাকে ভাষাসন্ত্রাসীগণের দিকে। রক্তাক্ত ভাষার কিছু করার থাকে না। বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও ব্যাকরণের এ পরস্পরবিরোধী দ্বৈরথাবস্থানের কারণে ক্ষতি হয়েছে সাহিত্যের, ব্যাকরণের নয়। পৃথিবীতে বাংলার মতো এমন সমৃদ্ধ আর কোনো ভাষা নেই, যার সাহিত্য এত পরিণত, অথচ ব্যাকরণ এমন অপরিণত, দুর্বল, অসহায় ও অস্থির।
বাঙ্গলা, বাংলা, বাঙলা, বাঙালা_ আরও অনেক পদে এমন বানান-ভিন্নতা দেখা যায়। আগে খিষ্টাব্দ ও খ্রিষ্ট বানান প্রচলিত ছিল। তারপর আসে খ্রীস্টাব্দ ও খ্রীষ্ট। রীবন্দ্রনাথ খৃষ্ট, খৃস্ট, খ্রীস্ট, খ্রীস্ট প্রভৃতি লিখেছেন। তাঁর মতো বিশ্বখ্যাত বাঙালি আর্ষের এমন ভিন্ন বানান বাংলা বানানের ভুল ও অস্থিরতার জন্য দায়ী- এটি অস্বীকার করা যায় না। একটি শব্দ তাঁর মতো কালজয়ী আর্ষ এত রকমের লিখলে সাধারণ মানুষের কী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। নীহারঞ্জন রায় লিখেছেন : ক্রিস্টীয়, খ্রিস্টাব্দ, ক্রিস্টান, খ্রিস্ট। ষত্ব বিধানের প্রয়োগের জন্য খ্রষ্টাব্দ ও খ্রীষ্ট শব্দে 'ষ্ট' ব্যবহার করা হতো। আসলেই কী এ শব্দ দুটোতে আদৌ ষত্ব-বিধান প্রযোজ্য? একসময় বিদেশি শব্দেও ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধানের প্রয়োগ-অপ্রয়োগ নিয়ে তেমন কঠিন নিয়ম ছিল না। এখন কিন্তু বিদেশি শব্দে ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অনেকে খ্রিস্টাব্দ শব্দকে তৎসম শব্দ মনে করেন। ড. হায়াৎ মামুদও এ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ইংরেজি ঈযৎরংঃ, শব্দ বাংলায় লিখলে হবে ক্রাইস্ট। ঔবংঁৎং ঈযৎরংঃ শব্দকে যখন যিশু বা যিশু খ্রিস্ট লেখা হয় তখন এটি প্রতিবর্ণীকরণ হয় না, বঙ্গীকরণ করা হয়। তবে অনেকে বলেন, তৎসম শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দে যেহেতু ষত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়, সেহেতু খ্রিস্ট বা খ্রিস্টাব্দ শব্দে 'ষ্ট' দেয়া সমীচীন নয়। তাই বানান হবে খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্ট, খ্রিস্টীয়।
বাংলা ভাষায় এখনও অনেক ক্ষেত্রে আদর্শ মান ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অনেকে লিখেন 'ভালোবাসা' আবার অনেকে লিখেন 'ভালবাসা'। হায়াৎ মামুদ লিখেন 'ভালো' কিন্তু 'ভালবাসা'। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'দেখুন, 'ভালো' ও ভালবাসা' দুটো পৃথক শব্দ, এক মড়ড়ফ, আর একটির ষড়াব। ষড়াব যদি ভালোবাসা হয়, তা হলে মড়ড়ফ যড়ঁংব কী হবে?' বৈয়াকরণ ও ভাষা বিশেষজ্ঞ প-িতবর্গের মতানৈক্য ছাড়াও উভয় বাংলার ভাষাবিষয়ক চিন্তাধারার প্রায়োগিক পার্থক্য মতানৈক্যের জন্য বহুলাংশে দায়ী। উপযুক্ত প্রয়াস ও কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীন মান প্রতিষ্ঠা না-হওয়া পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এমন মতদ্বৈততা ও অস্থিরতা চলতে থাকবে।
ছোটবেলা থেকে বাংলা অভিধান দেখার অভ্যাস বাঙালিদের তেমন নেই। তাই প্রচলিত বানানটি শুদ্ধ-জ্ঞানে অহরহ ব্যবহার করে আসছে। ভুল কি না যাচাই করার চিন্তাও মাথায় আসে না। যে শিক্ষকগণ বাংলা শেখান তাঁরাও অভিধান অবহেলা করে প্রচলিত বানানটাই শিক্ষার্থীদের গেঁথে দিয়েছেন। যা ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে অশুদ্ধটাই শুদ্ধরূপ লাভ করেছে। এখন শুদ্ধটাই অশুদ্ধ হয়ে গেছে। আর্থ-সামাজিক ও প্রাশাসনিক অবস্থাও বাংলা ভাষার অস্থিরতার জন্য দায়ী। বাংলাদেশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও এখনও নানাবিধ কারণে ইংরেজির প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। অধ্যয়ন ও কর্মজীবনে ইংরেজিকে যত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে মাতৃভাষাকে তত গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করেনি। আর্থ-সামাজিক কর্মকা-ও এর সঙ্গে জড়িত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম এর বরাক উপত্যাকায় বাংলা ভাষার অবস্থা আরও করুণ। বলা হয়, ইংরেজিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। ইংরেজিকে গুরুত্ব দেয়া হোক কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। মাতৃভাষার ভিত শক্ত হলে ভাষা হোক আর অর্থ হোক সব ভিত শক্ত হয়ে যাবে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাপান ও চীন।
তিন শতকের ব্রিটিশ শাসনের ফলে সুস্থ সুন্দর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত জীবনযাপন ও জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে ইংরেজি ভাষাটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে। ইংরেজি জানা বাঙালি আর ইংরেজি না-জানা বাঙালির মধ্যে সুস্পষ্ট আর্থনীতিক শ্রেণি-বিভাজন তৈরি হয়েছে। ফলে সমাজে উন্নততর জীবনযাপনের প্রধানতম শর্তই হয়ে গেল ভালোভাবে ইংরেজি শিক্ষা। যে কারণে বাংলাদেশের সর্বত্র ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনোর জন্য এত স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। যার ফলে আর একবার বংশ পরম্পরায় অর্থনীতিক শ্রেণি সৃষ্টির ধারা চালু হয়ে যায়। যেখানে ইংরেজি ছাড়া উচ্চশিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত আজও গড়ে ওঠেনি, সেখানে এটাই নিদারুণ বাস্তব। কোনো ভাষা তখনই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যখন সেই ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা যায়, সেই ভাষা স্বদেশবাসীর জীবনজীবিকায় নির্ভরতা দেয় এবং সেই ভাষায় সৃষ্টি হওয়া উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি স্বদেশবাসীর পুষ্টি নিশ্চিত করে বিশ্বমানবকেও পুষ্টি যোগাতে সক্ষম হয়। দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার অবদান প্রথম দুটোর ক্ষেত্রে একেবারে নেই বললেই চলে; শেষেরটির ক্ষেত্রে বাঙালিরা যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে, বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে বঙ্গসাহিত্য-সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে ততটা বিখ্যাত নয় বরং বেশ পিছনের সারিতে অবস্থান করছে।
বাংলা ভাষায় এখনও সর্বজন গ্রাহ্য কোনো ব্যাকরণ, অভিধান বা বানান রীতি প্রতিষ্ঠা হয়নি। বাংলা একাডেমি প্রমিত রীতি প্রচলনে মাধ্যমে এ প্রয়াসে উদ্যোগী হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত প্রমিত রীতি অনুসরণ করে বাংলা একাডেমির প্রমিত রীতি অনুসরণপূর্বক বাংলা ভাষা ও বানানের আদর্শ মান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। যেহেতু এখনও কোনো আদর্শ ও সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা রীতি নেই সেহেতু অনেককে সাহিত্যকর্ম হতে দাফতরিক পর্যায়ে যে কোনো লেখা হোক না কেন, একজন লেখককে বানান নিয়ে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো পথনির্দেশনা কোনো ব্যাকরণে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক লেখক ও বৈয়াকরণগণের কাছেও কোনো সর্বজনীন উত্তর নেই- এক একজন এক-এক রকম উত্তর দেন। আধুনিকগণ ঐ সুযোগে আরও স্বেচ্ছাচারে নিমজ্জিত। এ অবস্থায় বাংলাকে স্থির, আদর্শময় ও প্রমিত মানে স্থির করার ক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন তাঁরা হচ্ছেন সমাজের সকল স্তরে প্রভাববিস্তারকারী অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা, বিচারক, পেশাজীবী, শিক্ষক প্রমুখ। তাঁরা যদি বাংলা বানানে আদর্শরীতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তা হলে বাংলা বানানের এমন অস্থিরতা সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। নির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার আলয়ে তাদের কর্মকা- পরিবাহিত বলে কেবল তাদের পক্ষে সারা বাংলাদেশ বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিন্ন বানান ও ভাষারীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত প্রিয় বাংলা আপন সৌকর্যে বিভূষিত হয়ে উঠবে।
বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত নতুন শব্দ একদিকে এই ভাষার ভেতর থেকে তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে বাইরে থেকে এসে ঢুকছে। এগুলো সামাল দেয়া, শৃঙ্খলার মধ্যে আনা বাংলার অভিভাবকদের, বাংলা একাডেমির, অভিধান প্রণেতা ও বৈয়াকরণদের কাজ। বিভিন্ন ভাষার অভিভাবকেরা প্রতিবছর সদ্য-স্বীকৃত ও আত্তীকৃত নতুন শব্দের তালিকা প্রকাশ করেন। ঙীভড়ৎফ ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু প্রতিবছর তাদের শব্দভা-ার চার বার হালনাগাদ করে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চে তাদের অভিধানে নয় শতের বেশি শব্দ, পদবন্ধ (ঢ়যৎধংবং) ও অর্থ (ংবহংব) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তাদের পরবর্তী হালনাগাদ সংস্করণ প্রকাশ পাবে। সে তুলনায় বাংলা প্রায়-অভিভাবকহীন, যেন খোলা রাস্তায় রোদ-বৃষ্টি-শীত-বসন্তে আপন শক্তিতে টিকে থাকা কঙ্কালসার এক অসহায় এতিম।
বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ছাড়া বাংলায় এখন আর কোনো প্রমিত অভিধান নেই। অভিধানটির প্রথম প্রকাশ : স্বরবর্ণ অংশ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ও ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। মাঝখানে ফাঁক দশ বছর। দ্বিতীয় সংস্করণ : ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ, মাঝখানে ফাঁক আট বছর। পরবর্তী সংস্করণ, যাকে বাংলা একাডেমি তৃতীয় সংস্করণ বলা থেকে সংগত কারণেই বিরত থেকেছে, বলেছে পরিমার্জিত সংস্করণ, এর প্রকাশ ২০০০ খ্রিস্টাব্দ। পরিমার্জিত সংস্করণ করতে সময় লেগেছে আট বছর। পরিমার্জিত সংস্করণেরই সপ্তদশ পুনর্মুদ্রণ প্রকাশ হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৪ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলি্লশ বছরে অভিধানটির মাত্র দুটো সংস্করণ এবং একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে।
ভাষা নিয়ে আমাদের আপামর মানুষের দরদ ও ভূমিকা প্রশ্নাতীত। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলার অভিভাবকদের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে উপরের পরিচ্ছেদে বর্ণিত একটি অভিধানের প্রকাশনা ছাড়া আর কোথাও কিছু লক্ষ্য করা যায় না। মুদ্রিত না হোক, বছরে অন্তত একবার অনলাইন বাংলা শব্দভা-ারের হালনাগাদ তথ্য প্রক্রিয়াজত করা আবশ্যক। অধিকন্তু যখনই দরকার অনলাইনে শব্দসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিয়ে বাংলা বানানের অস্থিরতা ও স্বেচ্ছাচার রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ না থাকলে বাংলা অভিধানের আগামী চলি্লশ বছরের ইতিহাস বিগত বছরসমূহের ইতিহাস থেকে উন্নততর হবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলা একাডেমি এককভাবে এ কাজটি পারবে না। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) গ্রুপের হাজার হাজার উৎসাহী ও উদ্যোগী সদস্যের সহায়তা নিতে পারেন।
তথ্যসূত্র : শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) গ্রুপ।
রবীন্দ্র-সুনীতি থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলার অনেক কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকদের মধ্যে এমন মনোভাব লক্ষণীয়। বাংলা একাডেমির অনেক বিষয়ে এমনকি একই গ্রন্থে সাংঘর্ষিক বিবরণ রয়েছে। বানান নিয়ে স্বাধিকার প্রবণতা ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য শুধু কলঙ্ক নয়, লজ্জাকরও বটে। যিনি রক্ষক তিনিই যদি ভক্ষক হন তাহলে সে দেশ ও জাতির পতন অনিবার্য। তেমনি যিনি ভাষার কারুকর্মী তিনিই যদি বানানে স্বেচ্ছাচারী হন তাহলে ভাষার অঙ্গহানি ও বিকৃতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। শব্দই হচ্ছে লেখ্য ভাষার প্রাথমিকতম অপরিহার্য উপাদান। চুন-সুড়কি ভবন-নির্মাণের প্রাথমিকতম উপাদান হলেও ভবনের তুলনায় এর দাম অতি তুচ্ছ। তবু এ উপাদানে ভেজাল মেশালে পুরো ভবনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য।
বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকগণের অনেকে নানা ক্ষেত্রে ব্যাকরণের রীতি-নীতি অগ্রাহ্য করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানান লিখেছেন ও লিখছেন। ভাবটি এমন, 'আমি এত বড় লেখক, যা লিখি তা-ই পড়বে, আমিই শুদ্ধ, আমিই ভুল।' অথবা হতে পারে, অনেকে বাংলা বানানে দক্ষ নন এবং তাই প্রুফ রিডারের উপর সংশোধনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজের বিখ্যাত সুনামটি বই প্রকাশে ব্যবহার করেছেন। বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে তাদের মতৈক্যের অভাব বাংলা বানানে সর্বজনীন নীতি প্রণয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে।
অনেক কথা বলেছেন, লিখেছেন; যা আবার নিজেরই লঙ্ঘন করেছেন। এর ফল শুভ হয়নি তা এখন অনুধাবন করা যাচ্ছে। অবস্থা এখন এতই সঙ্গীন যে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কোথায় তা নিয়ে প্রচ- সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ ভাষা নিয়ে স্বেচ্ছাচার, ব্যাকরণ-অবহেলা, বানানলাঞ্ছনা সাংঘাতিক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এ বিশৃঙ্খলার জন্য সৃজনশীল লেখকবর্গের ভূমিকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ সাক্ষর জনগোষ্ঠীর কাছে মুখ্যত সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে লেখ্য ভাষার অভিঘাত ও প্রভাব সংক্রমিত হয়; পাঠ্য ব্যাকরণ গ্রন্থের মাধ্যমে নয়।
সাহিত্য ও ব্যাকরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ও নির্ভরশীল। দুটোর ভেতরে যে গোপন বৈরিতা, ঈর্ষা ও অসহিষ্ণুতা প্রবল এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। তবে এর পরিমাণ যতই হোক, হিন্দু দম্পতির ন্যায় সম্পর্ক ছিন্ন করা অসম্ভব। হায়াৎ মামুদের ভাষায়, 'কে কার বশ্যতা স্বীকার করবে সে প্রশ্ন অবান্তর, কারণ ব্যাকরণ নিয়মতন্ত্রী বলে এ ঔচিত্যবুদ্ধি তার থাকে যা তাকে সাবধান করে দেয় যে সাহিত্যের সীমানা তার চৌহদ্দিতে পড়ে না, ঢুকতে হলে অনুমতি বা আইনসঙ্গত অধিকার নিয়ে ঢুকতে হবে, অন্যথায় নয়। সমস্যা কিন্তু এখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে বৈয়াকরণ ও সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা ও আত্মবোধের। যিনি সাহিত্য রচনা করেন তিনি ব্যাকরণ অবমাননাকে শৈলীমাহাত্ম্য হিসেবে ধরে নিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য ভাষার উপর স্বেচ্ছচার ও ভাষার নিয়মভঙ্গ করে চলেন। যা সাধারণ্যে দ্রুত বাহিত হয়। ভাবটা এমন- বাপু আমি কি কম জানি? তোমার কথা মানব কেন, আমার কথা মান।' যে সাহিত্যিক যত বেশি জনপ্রিয় তার স্বেচ্ছাচারিতার অনুসারী তত বেশি হয়ে যায়। এদিকে ভাষা ও ব্যাকরণ হতাশ হয়ে চেয়ে থাকে ভাষাসন্ত্রাসীগণের দিকে। রক্তাক্ত ভাষার কিছু করার থাকে না। বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও ব্যাকরণের এ পরস্পরবিরোধী দ্বৈরথাবস্থানের কারণে ক্ষতি হয়েছে সাহিত্যের, ব্যাকরণের নয়। পৃথিবীতে বাংলার মতো এমন সমৃদ্ধ আর কোনো ভাষা নেই, যার সাহিত্য এত পরিণত, অথচ ব্যাকরণ এমন অপরিণত, দুর্বল, অসহায় ও অস্থির।
বাঙ্গলা, বাংলা, বাঙলা, বাঙালা_ আরও অনেক পদে এমন বানান-ভিন্নতা দেখা যায়। আগে খিষ্টাব্দ ও খ্রিষ্ট বানান প্রচলিত ছিল। তারপর আসে খ্রীস্টাব্দ ও খ্রীষ্ট। রীবন্দ্রনাথ খৃষ্ট, খৃস্ট, খ্রীস্ট, খ্রীস্ট প্রভৃতি লিখেছেন। তাঁর মতো বিশ্বখ্যাত বাঙালি আর্ষের এমন ভিন্ন বানান বাংলা বানানের ভুল ও অস্থিরতার জন্য দায়ী- এটি অস্বীকার করা যায় না। একটি শব্দ তাঁর মতো কালজয়ী আর্ষ এত রকমের লিখলে সাধারণ মানুষের কী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। নীহারঞ্জন রায় লিখেছেন : ক্রিস্টীয়, খ্রিস্টাব্দ, ক্রিস্টান, খ্রিস্ট। ষত্ব বিধানের প্রয়োগের জন্য খ্রষ্টাব্দ ও খ্রীষ্ট শব্দে 'ষ্ট' ব্যবহার করা হতো। আসলেই কী এ শব্দ দুটোতে আদৌ ষত্ব-বিধান প্রযোজ্য? একসময় বিদেশি শব্দেও ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধানের প্রয়োগ-অপ্রয়োগ নিয়ে তেমন কঠিন নিয়ম ছিল না। এখন কিন্তু বিদেশি শব্দে ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অনেকে খ্রিস্টাব্দ শব্দকে তৎসম শব্দ মনে করেন। ড. হায়াৎ মামুদও এ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ইংরেজি ঈযৎরংঃ, শব্দ বাংলায় লিখলে হবে ক্রাইস্ট। ঔবংঁৎং ঈযৎরংঃ শব্দকে যখন যিশু বা যিশু খ্রিস্ট লেখা হয় তখন এটি প্রতিবর্ণীকরণ হয় না, বঙ্গীকরণ করা হয়। তবে অনেকে বলেন, তৎসম শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দে যেহেতু ষত্ব বিধান প্রযোজ্য নয়, সেহেতু খ্রিস্ট বা খ্রিস্টাব্দ শব্দে 'ষ্ট' দেয়া সমীচীন নয়। তাই বানান হবে খ্রিস্টাব্দ, খ্রিস্ট, খ্রিস্টীয়।
বাংলা ভাষায় এখনও অনেক ক্ষেত্রে আদর্শ মান ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অনেকে লিখেন 'ভালোবাসা' আবার অনেকে লিখেন 'ভালবাসা'। হায়াৎ মামুদ লিখেন 'ভালো' কিন্তু 'ভালবাসা'। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'দেখুন, 'ভালো' ও ভালবাসা' দুটো পৃথক শব্দ, এক মড়ড়ফ, আর একটির ষড়াব। ষড়াব যদি ভালোবাসা হয়, তা হলে মড়ড়ফ যড়ঁংব কী হবে?' বৈয়াকরণ ও ভাষা বিশেষজ্ঞ প-িতবর্গের মতানৈক্য ছাড়াও উভয় বাংলার ভাষাবিষয়ক চিন্তাধারার প্রায়োগিক পার্থক্য মতানৈক্যের জন্য বহুলাংশে দায়ী। উপযুক্ত প্রয়াস ও কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীন মান প্রতিষ্ঠা না-হওয়া পর্যন্ত বাংলা ভাষায় এমন মতদ্বৈততা ও অস্থিরতা চলতে থাকবে।
ছোটবেলা থেকে বাংলা অভিধান দেখার অভ্যাস বাঙালিদের তেমন নেই। তাই প্রচলিত বানানটি শুদ্ধ-জ্ঞানে অহরহ ব্যবহার করে আসছে। ভুল কি না যাচাই করার চিন্তাও মাথায় আসে না। যে শিক্ষকগণ বাংলা শেখান তাঁরাও অভিধান অবহেলা করে প্রচলিত বানানটাই শিক্ষার্থীদের গেঁথে দিয়েছেন। যা ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে অশুদ্ধটাই শুদ্ধরূপ লাভ করেছে। এখন শুদ্ধটাই অশুদ্ধ হয়ে গেছে। আর্থ-সামাজিক ও প্রাশাসনিক অবস্থাও বাংলা ভাষার অস্থিরতার জন্য দায়ী। বাংলাদেশে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও এখনও নানাবিধ কারণে ইংরেজির প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। অধ্যয়ন ও কর্মজীবনে ইংরেজিকে যত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে মাতৃভাষাকে তত গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কেউ বোধ করেনি। আর্থ-সামাজিক কর্মকা-ও এর সঙ্গে জড়িত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম এর বরাক উপত্যাকায় বাংলা ভাষার অবস্থা আরও করুণ। বলা হয়, ইংরেজিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। ইংরেজিকে গুরুত্ব দেয়া হোক কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। মাতৃভাষার ভিত শক্ত হলে ভাষা হোক আর অর্থ হোক সব ভিত শক্ত হয়ে যাবে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জাপান ও চীন।
তিন শতকের ব্রিটিশ শাসনের ফলে সুস্থ সুন্দর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত জীবনযাপন ও জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে ইংরেজি ভাষাটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে। ইংরেজি জানা বাঙালি আর ইংরেজি না-জানা বাঙালির মধ্যে সুস্পষ্ট আর্থনীতিক শ্রেণি-বিভাজন তৈরি হয়েছে। ফলে সমাজে উন্নততর জীবনযাপনের প্রধানতম শর্তই হয়ে গেল ভালোভাবে ইংরেজি শিক্ষা। যে কারণে বাংলাদেশের সর্বত্র ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনোর জন্য এত স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। যার ফলে আর একবার বংশ পরম্পরায় অর্থনীতিক শ্রেণি সৃষ্টির ধারা চালু হয়ে যায়। যেখানে ইংরেজি ছাড়া উচ্চশিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত আজও গড়ে ওঠেনি, সেখানে এটাই নিদারুণ বাস্তব। কোনো ভাষা তখনই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যখন সেই ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা যায়, সেই ভাষা স্বদেশবাসীর জীবনজীবিকায় নির্ভরতা দেয় এবং সেই ভাষায় সৃষ্টি হওয়া উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি স্বদেশবাসীর পুষ্টি নিশ্চিত করে বিশ্বমানবকেও পুষ্টি যোগাতে সক্ষম হয়। দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার অবদান প্রথম দুটোর ক্ষেত্রে একেবারে নেই বললেই চলে; শেষেরটির ক্ষেত্রে বাঙালিরা যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে বঙ্গসাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে, বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে বঙ্গসাহিত্য-সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে ততটা বিখ্যাত নয় বরং বেশ পিছনের সারিতে অবস্থান করছে।
বাংলা ভাষায় এখনও সর্বজন গ্রাহ্য কোনো ব্যাকরণ, অভিধান বা বানান রীতি প্রতিষ্ঠা হয়নি। বাংলা একাডেমি প্রমিত রীতি প্রচলনে মাধ্যমে এ প্রয়াসে উদ্যোগী হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত প্রমিত রীতি অনুসরণ করে বাংলা একাডেমির প্রমিত রীতি অনুসরণপূর্বক বাংলা ভাষা ও বানানের আদর্শ মান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। যেহেতু এখনও কোনো আদর্শ ও সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা রীতি নেই সেহেতু অনেককে সাহিত্যকর্ম হতে দাফতরিক পর্যায়ে যে কোনো লেখা হোক না কেন, একজন লেখককে বানান নিয়ে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো পথনির্দেশনা কোনো ব্যাকরণে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক লেখক ও বৈয়াকরণগণের কাছেও কোনো সর্বজনীন উত্তর নেই- এক একজন এক-এক রকম উত্তর দেন। আধুনিকগণ ঐ সুযোগে আরও স্বেচ্ছাচারে নিমজ্জিত। এ অবস্থায় বাংলাকে স্থির, আদর্শময় ও প্রমিত মানে স্থির করার ক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন তাঁরা হচ্ছেন সমাজের সকল স্তরে প্রভাববিস্তারকারী অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা, বিচারক, পেশাজীবী, শিক্ষক প্রমুখ। তাঁরা যদি বাংলা বানানে আদর্শরীতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তা হলে বাংলা বানানের এমন অস্থিরতা সহজে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। নির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলার আলয়ে তাদের কর্মকা- পরিবাহিত বলে কেবল তাদের পক্ষে সারা বাংলাদেশ বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিন্ন বানান ও ভাষারীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত প্রিয় বাংলা আপন সৌকর্যে বিভূষিত হয়ে উঠবে।
বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত নতুন শব্দ একদিকে এই ভাষার ভেতর থেকে তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে বাইরে থেকে এসে ঢুকছে। এগুলো সামাল দেয়া, শৃঙ্খলার মধ্যে আনা বাংলার অভিভাবকদের, বাংলা একাডেমির, অভিধান প্রণেতা ও বৈয়াকরণদের কাজ। বিভিন্ন ভাষার অভিভাবকেরা প্রতিবছর সদ্য-স্বীকৃত ও আত্তীকৃত নতুন শব্দের তালিকা প্রকাশ করেন। ঙীভড়ৎফ ঊহমষরংয উরপঃরড়হধৎু প্রতিবছর তাদের শব্দভা-ার চার বার হালনাগাদ করে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চে তাদের অভিধানে নয় শতের বেশি শব্দ, পদবন্ধ (ঢ়যৎধংবং) ও অর্থ (ংবহংব) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তাদের পরবর্তী হালনাগাদ সংস্করণ প্রকাশ পাবে। সে তুলনায় বাংলা প্রায়-অভিভাবকহীন, যেন খোলা রাস্তায় রোদ-বৃষ্টি-শীত-বসন্তে আপন শক্তিতে টিকে থাকা কঙ্কালসার এক অসহায় এতিম।
বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ছাড়া বাংলায় এখন আর কোনো প্রমিত অভিধান নেই। অভিধানটির প্রথম প্রকাশ : স্বরবর্ণ অংশ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ও ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। মাঝখানে ফাঁক দশ বছর। দ্বিতীয় সংস্করণ : ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ, মাঝখানে ফাঁক আট বছর। পরবর্তী সংস্করণ, যাকে বাংলা একাডেমি তৃতীয় সংস্করণ বলা থেকে সংগত কারণেই বিরত থেকেছে, বলেছে পরিমার্জিত সংস্করণ, এর প্রকাশ ২০০০ খ্রিস্টাব্দ। পরিমার্জিত সংস্করণ করতে সময় লেগেছে আট বছর। পরিমার্জিত সংস্করণেরই সপ্তদশ পুনর্মুদ্রণ প্রকাশ হয়েছে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৪ থেকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলি্লশ বছরে অভিধানটির মাত্র দুটো সংস্করণ এবং একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে।
ভাষা নিয়ে আমাদের আপামর মানুষের দরদ ও ভূমিকা প্রশ্নাতীত। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলার অভিভাবকদের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে উপরের পরিচ্ছেদে বর্ণিত একটি অভিধানের প্রকাশনা ছাড়া আর কোথাও কিছু লক্ষ্য করা যায় না। মুদ্রিত না হোক, বছরে অন্তত একবার অনলাইন বাংলা শব্দভা-ারের হালনাগাদ তথ্য প্রক্রিয়াজত করা আবশ্যক। অধিকন্তু যখনই দরকার অনলাইনে শব্দসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিয়ে বাংলা বানানের অস্থিরতা ও স্বেচ্ছাচার রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ না থাকলে বাংলা অভিধানের আগামী চলি্লশ বছরের ইতিহাস বিগত বছরসমূহের ইতিহাস থেকে উন্নততর হবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলা একাডেমি এককভাবে এ কাজটি পারবে না। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) গ্রুপের হাজার হাজার উৎসাহী ও উদ্যোগী সদস্যের সহায়তা নিতে পারেন।
তথ্যসূত্র : শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ) গ্রুপ।
No comments:
Post a Comment