Translate

Wednesday, 12 July 2017

কুম্ভীলক / ড. মোহাম্মদ আমীন

 কুম্ভীলক / ড. মোহাম্মদ আমীন
অন্যের লেখা চুরি করাকে ইংরেজি ভাষায় plagiarism বলে। যারা এ ধরনের চুরি করেন তাদের বলা হয় plagiarist, বাংলায় কুম্ভীলক।জানামতে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের প্রথমার্ধে কুম্ভীলকবৃত্তি শুরু হয়।রোমান কবি মার্শাল প্রথম, কিছু কবির বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা চুরির অভিযোগ আনেন।সাধারণত অখ্যাত লেখকগণ কুম্ভীলকবৃত্তির শিকার হয়ে থাকেন। খ্যাতিমান লেখক, পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক প্রমুখ এমন চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকেন। আধুনিক সাহিত্যকর্মে Google কুম্ভীলকদের একটি বিশাল স্বর্গরাজ্য। এটি চৌর্যবৃত্তি হলেও বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকদের কেউ নাকি এর থেকে মুক্ত নন। তবে বস্তু চুরি আর লেখা চুরির মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি লেখা বিভিন্ন জন্য বার বার চুরি করতে পারেন কিন্তু বস্তুর ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। 
অনেকে বলেন, কুম্ভীলক না হলে কারও পক্ষে এক পঙ্‌ক্তিও লেখা সম্ভব নয়। আর্চিবাল্ড ম্যাকলিসের ভাষায়, A real writer learns from earlier writers the way a boy learns from an apple orchard - by stealing what he has a taste for and can carry off. না শেখে যেমন জ্ঞানী হওয়া যায় না, তেমনি না-চুরি করে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। বলা হয়, ধরা না পড়লে কুম্ভীলকবৃত্তি একটি চৌকষ শিল্পকর্ম, তবে ধরা পড়লে অপরাধ। সুতরাং অপরাধ আর শিল্পের সম্পর্ক খুব নিবিড়।
উইলসন মিজনার বলেছেন, “এক জনের লেখা চুরি করা কুম্ভীলকবৃত্তি কিন্তু একাধিক লেখকের লেখা চুরি করা গবেষণা।”এজন্য চার্লস মোভেল্লি বলেছেন, “কাউকে কপি করো না, সবার লেখা ইচ্ছেমতো চুরি করো।” ডেভিড শিল্ডস আর একধাপ এগিয়ে বলেছেন, “প্রত্যেক শিল্পকর্মই চুরি।” অনেকে মনে করেন, কুম্ভীলক না হলে কারও পক্ষে বড়ো শিল্পী ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়। বাট্রান্ড রাসেলের ভাষায় “প্রত্যেক খ্যাতিমান লেখক একজন কুম্ভীলক।”
সাহিত্য জগতে কুম্ভীলকবৃত্তির গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে লিউনেল ট্রিলিং বলেছেন, “অপরিপক্ক সাহিত্যিক অনুকরণ করেন আর পরিপক্ক সাহিত্যিক করেন চুরি।” পল গগুইন-এর ভাষায়, “শিল্প-সাহিত্য হয়তো চুরি, নয়তো বিপ্লব। যে সাহিত্যকর্ম বিপ্লব নয়, তা কুম্ভীলকবৃত্তির ফসল।” রালফা ওয়াল্ডো ইমারসন বলেছেন, “আমার সব উত্তম ও মৌলিক চিন্তারাশি আমার পূর্ববর্তী লেখকগণ চুরি করে ফেলেছেন। সুতরাং চোরের উপর বাটপারি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
পারস্যের কবি জালালুদ্দিন রুমি (১২০৭ খ্রিষ্টাব্দ -১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছেন : “বায্ আঁ, বায্ আঁ,হর আঁচে হাস্তী বায্ আঁ,গর কাফির গর গবরওয়াবোত পরস্তি বায্ আঁ ।ই দরগাহে মা দরগাহেনা উম্মিদ নীস্ত ।শতবার গর তওবাহ শিকস্তী বায্ আঁ ।”অন্যদিকে ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ - ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছেন :“এসো হে আর্য, এসো অনার্যহিন্দু্ মু্সলমান,এসো এসো আজ তুমি ইংরাজএসো এসো খ্রিস্টান ।মা’র অভিষেক এসো এসো ত্বরামঙ্গলঘট হয়নি যে ভরাসবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরেএই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।” 
রুমি আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা দুটোর মিল দেখে কী মনে হয়? মার্ক টোয়েনের কথা মনে পড়ে, “আদম ছাড়া কেউ চুরি না করে এক লাইনও লিখতে পারেননি।” ডেন ইনেজকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছেলিন, মৌলিক সাহিত্য বা শিল্পকর্ম কী? তিনি বলেছিলেন, “Undetected plagiarism. অর্থাৎ ধরা পড়েনি এমন কুম্ভীলকবৃত্তিই মৌলিক সাহিত্যকর্ম।” অতএব রাল্ফ- এর গলায় সুর মিলিয়ে বলতে হয়, চুরি না করে বিখ্যাত হয়েছেন এমন সাহিত্যিক বিশ্বে নেই।
দেখবেন, বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে চুরি করে নিয়ে লেখা, আমার এ লেখাটিও চুরি হয়ে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment