Translate

Saturday 6 October 2018

অণ্ড ডিম্ব ডিম / ড. মোহাম্মদ আমীন



সেমিনারের পর ডিনার। 
ক্যামব্রিজের মেডিংলে হল-এর বিশাল ডাইনিং রুম আলো আর রসনার কোলাকোলি। আমার সামনে প্রফেসর মাসাহিতো ও প্রফেসর নন্দিতা চোপড়া, ডানে প্রফেসর রচনা, বামে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের খাদ্য-পুষ্টি বিভাগের প্রফেসর ড. ক্যাথরিনা ক্যাসলার এবং তার পাশে দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর কিচুকি।
কিচুকির বয়স শ ছুঁই ছুঁই করছে। নন্দিতা চোপড়ার ওজন দেড়শ কেজির মতো হবে। আসল দাঁত একটাও নেই, তবে নকল দাঁতের হাসিটা নন্দিতার মোটা শরীরকে প্রত্যুষের মতো নন্দিত করে রাখে। তিনি বলেন, আমি চর্বিনদী। ক্যাথরিনা এবং আমি ছাড়া বাকি সবাই অক্সফোর্ডের শিক্ষক।
আমাদের সামনে নানা উপাদেয় খাবার। আমার চোখ-মন অণ্ড মানে ডিম্বে সমাহিত। এক সময় ডিম্ব দেখলে পৃথিবীর সব রস-লালসা জিহ্বায় এসে ভিড় করত। এখনো করে, তবে খাই না। বয়স বাড়লে নাকি ডিম কম খাওয়া ‍উচিত।
ক্যাথরিনা আমার দিকে ডিমের ডিশটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন প্রফেসর।
“থ্যাংক ইউ”আমি ডিম্বের ডিশটা রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, আমি খাব না, তুমি নাও।
খাবেন না কেন? ক্যাথরিনা ক্যাসলার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন নয় যেন, পুলিশের জেরা।আমি বললাম, বয়স হয়েছে। ডিম্ব খেলে কোলেস্টরেল বেড়ে যায়।
ডিম্ব খেলে কোলেস্টরল বাড়ে এটা ঠিক, তবে সেটি এইচডিএল- ভালো কোলেস্টরল। শরীরে এইচডিএল যত বাড়বে শরীর তত বেশি চাঙ্গা থাকবে। প্রফেসর, আপনি কি চাঙ্গা থাকতে চান না?
ডিম্ব না কি স্ট্রোকের আশংকাও বাড়িয়ে দেয়?
প্রফেসর ক্যাথরিনা দৃঢ় গলায় বললেন, একদম বাজে কথা। আমার এখন সেভেন্টি থ্রি। প্রতিদিন চারটা করে ডিম খাই। প্রতিদিন ডিম খাবেন তবে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দেবেন। তাহলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যাবে। তবে ডায়াবেটিকস রোগীদের ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
মাসাহিতো বললেন, আমি কিন্তু প্রতিদিন তিন-চারটা ডিম খাই।
ক্যাথরিনা বললেন, ডিমে রয়েছে ভিটামিন এ, ই, বি৬, বি১২, থিয়ামিন, রিবোফ্লেবিন ফলেট, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম-সহ শরীর-গঠনে সহায়ক আরো নানা উপাদান। মাসাহিতো ম্যাম, আপনি ডিম খান বলেই আপনার চুরাশীয় শরীরকে আটচল্লিশীয় মনে হয়। হাড় শক্তকরণে ক্যালসিয়ামের কোনো বিকল্প নেই। ক্যালসিয়াম শোষণ করার কারণে হাড় মজবুত হয়। শোষণ-কর্মটা করে ভিটামিন-ডি। ডিমে কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি আছে।
কিচুকি বললেন, আমার হয়েছে জ্বালা।
কী হয়েছে? ক্যাথরিনা বললেন।
বয়স যত বাড়ছে স্মৃতিশক্তি তত কমছে। মস্তিষ্কে কোলিনের সরবরাহ কমে গেছে। তাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে সব ভুলে যাই। কী করি বল তো ক্যথরিনা?
ক্যাথরিনা বললেন, স্যার, ডিম্ব কোলিনের ভাণ্ডার। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতিশক্তিটাও সচল রাখে। আপনি ডিম্ব খান না?
কিচুকি চশমটা নামিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, মগজ ঠিক রাখলাম, কিন্তু চোখ? চোখে কম দেখি কেন? তাও কি অণ্ডের অভাব?
হ্যাঁ।
সব অঘটনই অণ্ডের অভাবে ঘটে?
ক্যাথরিনা : অণ্ডে রয়েছে লুটিন, জিজেনন্থিন, ক্যারোটিনয়েড ভিটামিন। এগুলো দৃষ্টিশক্তির মহৌষধ। প্রবীণদের চোখের জটিলতা কমানোর জন্যই প্রকৃতি ডিম নামের ডিম্বাকৃতির গোলকটায় এতগুলো উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছেন। স্যার, আপনার প্রতিদিন কমপক্ষে দুটো অণ্ড খাওয়া উচিত।
আগামীকাল থেকে চারটা করে খাব।
তাহলে আরো ভালো।
রচনা মায়ের খবর কী? প্রফেসর কিচুকি বললেন।
আমি এত ব্যস্ত থাকি যে, খাওয়ার সময়ই পায় না। পর্যাপ্ত প্রোটিন নিতে পারি না।
“আমিও পাই না”, প্রফেসর ক্যাথরিনা বললেন, “ ডিম্ব যেমন সস্তা, তেমনি সহজভক্ষ্য, রান্না না-করেও খেয়ে ফেলা যায়, খেতেও বেশিক্ষণ লাগে না, ছেলেবুড়ো সবাই খেতে পারে সহজে, দাঁতেরও প্রয়োজন নেই। কুসুমটা প্রোটিনের কোহিনুর। এতে প্রোটিনের পরিমাণ মাংসের সমান। প্রতিদিন দুটো করে ডিম্ব খেলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
অণ্ড না কি চর্বি বাড়ায়? নন্দিতা বললেন।
ক্যাথরিনা : মাংসের প্রোটিন চর্বি বাড়ায় কিন্তু ডিম্বের প্রোটিন মাংস বাড়ায়। ডিম্ব অ্যামাইনো অ্যাসিডের সাগর। শরীর যাতে ঠিক মতো প্রোটিনকে কাজে লাগাতে পারে, অ্যামাইনো অ্যাসিড সেটি দেখভাল করে। আমার স্বামী প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধ কেজি মাংস গিলে। গিলিত মাংস যাতে চর্বি হতে না পারে সেজন্য সে মাংস খাওয়ার পর একটা ডিম্ব খেয়ে ফেলে।
কিচুকি বললেন, বুঝেছি।
কী বুঝেছেন?
তোমাদের মতো ব্যস্ত, আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত দরিদ্র, নন্দিতার মতো দন্তহীনদের জন্য ইশ্বর অণ্ড নামের গোলকটায পৃথিবীর সব কিছু ভরে দিয়েছেন।
কিন্তু অণ্ডটা কে সৃষ্টি করল? মাসাহিতো বললেন।
কিচুকি : ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্তই অণ্ড সৃষ্টি করেছেন। আসলে এটাই পৃথিবী। এজন্য পৃথিবীকে বলা হয় ব্রহ্মাণ্ড। মানে ব্রহ্মের অণ্ড।
নন্দিতা : গণিতের শূন্যটাও অণ্ড। এই শূন্য ছাড়া গণিতও অর্থহীন। গণিত অর্থহীন মানে সবকিছু অর্থহীন। কারণ, গণিতই বিজ্ঞানের বাবা।
মা-টা কে? কিচুকি বললেন।
নন্দিতা : অণ্ড।
--------------------------------
সূত্র : আমার লেখা রায়োহরণ উপন্যাসের একটি অধ্যায়।

No comments:

Post a Comment