Translate

Monday 8 October 2018

ভারতে চিকিৎসা কী এবং কেন / ড. মোহাম্মদ আমীন



ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে ভারত গমনের জন্য মেডিকাল ভিসা দেওয়া হয়েছে। রোগী প্রতি তিন লাখ টাকা খরচ ধরলেও ১ লাখ ৩০ হাজার রোগীর চিকিৎসায় বাংলাদেশি ৩৯০০ কোটি টাকা ভারতে চলে গেছে। বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভারত যা আয় করে তার ৫০ ভাগ আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে থাকে। এ অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১.৯৪%। ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস-এর হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে ভারত আয় করেছে মোট ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ কোটি ১৩ লাখ ও ইরাক থেকে ৫ কোটি ডলার আয় করেছে ভারত।

ভারতে কেন বাড়ছে বাংলাদেশি রোগরি সংখ্যা ? বাংলাদেশের স্থানীয় চিকিৎসকের উপর আস্থার অভাব এবং ভুল চিকিৎসার ভয়ে অনিচ্ছা ও আর্থিক অক্ষমতা সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, বলা যায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। এ দুটি দূর করা গেলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসার প্রবণতা আশি ভাগ কমে যাবে। 
ভারত হতে চিকিৎসা-ফেরত রোগীদের অভিমত, আস্থাহীনতা ও ভুল চিকিৎসা ছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের হার্দিক আচরণ এবং আন্তরিক দেখভাল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত গমনের অন্যতম একটি কারণ। চিকিৎসক ও নার্সদের অমায়িক ব্যবহারের কারণে রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজন আনন্দ, আবেগ আর আস্থায় বিমোহিত হয়ে পড়ে। ফলে মূল চিকিৎসার আগেই ৩০ ভাগ সুস্থ হয়ে যান। একই মানের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একই রোগীর পরীক্ষার একেক ধরনের ফল দিয়ে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার হার অনেক বেশি। ভারতে তা অনেক কম। ভারতে চিকিৎসার নামে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। একই ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা একাধিকবার করানো, রোগীকে সময় কম দেয়া, বাড়তি আয়ের জন্য রোগীকে অতিরিক্ত সময় কেবিন বা বিছানায় রাখার প্রবণতা নেই সেখানে। অধিকন্তু সার্বিক বিবেচনায় চিকিৎসার খরচও কম। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। 
অত্যন্ত প্রশিক্ষিত নার্সদের পেশাদারিত্ব এবং যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি বাংলাদেশিদের মুগ্ধ করে। যে কোন সমস্যা শুধু ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে জানালেই সমাধান হয়ে যায়। ওদের অন্তরিকতা প্রশংসনীয় এবং অত্যন্ত প্রফেশনাল। রোগী এবং রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা যেন সন্তুষ্ট হয়ে যেন পরবর্তীকালে আবার আসে সেই চেষ্টাই সবসময় করে। চিকিৎসা শুরুর সূচনায় এরা যে প্যাকেজ অফার করে সাধারণত তার থেকে এক পয়সাও বেশি দাবি করে না। রোগী এবং প্যাকেজের অর্থ পেলে বাকি সবকিছুর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। ফলে রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোগীর পরিজনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, চিকিৎসকদের বেতন ব্যবস্থা, তুলনামূলক কম খরচ, প্রযুক্তির সাহায্যে ধাপে ধাপে চিকিৎসার ব্যবস্থা, রোগ চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত ভর্তি না নেওয়া— এই সব কারণে ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশের অনেক চিকিৎসকও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। তাদের অভিমত, হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে কর্মীদের ব্যবহার আরও ভালো হওয়া দরকার। না হলে এখানে যত ভালই পরিকাঠামো গড়ে তোলা হোক না কেন, মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি দেবেন। 
ভারতের চিকিৎসক, নার্স, কর্মী— সবাই রোগীর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করেন। রোগীর কী অবস্থা, সে ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য দেন। এ ছাড়া চিকিৎসায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে হবে। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কম রয়েছেন, এমন নয়। তবে তাদের ব্যবহার ভালো নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। প্রথমত. যোগাযোগ ব্যবস্থা; উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় আসতে যত সময় লাগে, ভারত যেতে লাগে তার চেয়ে কম সময়। আমাদের কিছু জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি চিকিৎসকদের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে রোগীবান্ধব নয়। রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই মূলত বেশি সংখ্যক রোগী ভারতে যাচ্ছে। 
বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হওয়ার প্রবণতার জন্য অনেকে বাংলাদেশের চিকিৎসা-প্রশাসন এবং ডাক্তারগণকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মতে, যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের হর্তকর্তাদেরও আস্থা নেই, যে দেশে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির চিকিৎসার মতো চিকিৎসালয় নেই সেই দেশের চিকিৎসায় কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে, সে দেশের চিকিৎসালয়ে কীভাবে সাধারণ মানুষের কার্যকর চিকিৎসা হবে? তাই উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনও চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। তাদের অভিমত, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় যেমন সস্তা তেমন কার্যকর। ফাও হিসেবে একটা দেশও দেখা হয়ে যায়। থাকে টাকার ব্যবধানও। ভুল চিকিৎসা হয় অনেক ক্ষেত্রে। আর একটা বিষয়, ভারতের ডাক্তারগণ আমাদের দেশের মতো ওষুধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশন ভরিয়ে ফেলে না, দু একটা ওষুধ দেয়।

চিকিৎসার খরচের ধারণা দেওয়ার জন্য একটা বাইপাস অপারেশনের খরচ বিভিন্ন হাসপাতালে কত হতে পারে তা জানা যাক : সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল ও থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাড ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে খরচ প্রায় সমান এবং তা প্রায় ২৭ হাজার ডলার। ভারতের বিভিন্ন ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত হাসপাতালে বাইপাস বা ট্রিটম্যান্ট প্লান এর খরচ ৫০০০ ডলার থেকে ৬৫০০ ডলার। দেশে বাইপাস করায় এমন হাসপাতাল হচ্ছে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এপোলো, ল্যব এইড, নাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, দিনাজপুরের জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এখানে বাইপাস অপারেশন করাতে কেবিনে ৫০০০ ডলার থেকে ৬০০০ ডলার এবং ওয়ার্ডে ৩৭৫০ থেকে ৪০০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। দেশে কিংবা বিদেশে সব হাসপাতালের বাইপাস অপারেশন এর প্যাকেজ কম বেশী একই (৭ -৯ দিন হাসপাতালে অবস্থান, রোগীর সাথে সার্বক্ষনিক একজন সহযোগীর থাকার সুযোগ খাওয়াসহ, টুইন শেয়ারিং রুম - মানে একরুমে দুই রোগী ইত্যাদি)। এছাড়াও সিংগেল কেবিন রুম আছে, সেক্ষত্রে উপরে বর্ণিত মোট অংকের চেয়ে হাসপাতালভেদে ১০০০-২০০০ ডলার বেশি খরচ পড়ে।

ভারত চিকিৎসার জন্য পাড়ি দেওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে কম খরচে চিকিৎসা। একটি ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলো। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়স্ক হেনরি কনজ্যাক। পেশায় গীতিকার ও ভিডিও প্রযোজক। ২০০৮ সালের দিকে হঠাৎ তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জানা গেল তার রক্তে দূষণ দেখা দিয়েছে। এরপর টানা এক মাস এন্টিবায়োটিক নিতে থাকেন তিনি। কিছুদিন পর জানা গেল যে, তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার মিট্রাল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করতে হবে। হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। তা-ও আবার সার্জনের ফি বাদ দিয়ে। কনজ্যাকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বয়স ৫০ পেরিয়ে যাওয়ার পর তার স্বাস্থ্য বীমা বাতিল হয়ে যায়। আরেকটি বীমা করার সামর্থ্যও তার ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খরচ কমাতে রাজি নয়। কনজ্যাকের হাতে তখন দু’টি রাস্তা খোলা। এক. দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। দুই. মৃত্যু। কনজ্যাক এই দুই বিকল্প বাদ দিয়ে, তৃতীয় একটি বিকল্প বেছে নিলেন। সেটি হলো, ভারত।
ওই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রশান্ত এ্যাপোলো হাসপাতালে সফলভাবে তার অস্ত্রোপাচার সম্পন্ন হয়। ভারতে তিন সপ্তাহের সফর, বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে হাসপাতালের খরচ সহ তার মোট ব্যয় হয় মাত্র ১০ হাজার ডলার। কনজ্যাকের ভাষায়, ভারতে চিকিৎসা করিয়ে তিনি নিজের জীবন ও ব্যবসা দু’টোই বাঁচিয়েছেন। এক সরকারি জরিপ জানা যায়, ব্যয় কম হওয়ার জন্য প্রতিবছর ৩ লাখেরও বেশি আমেরিকান নাগরিক চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন। তাদের বেশির ভাগই আসেন ভারতে।
ভারতে কী ঝামেলা এবং হয়রানি কম হয়? না। ভারতে যাবার জন্য ভিসা-সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাতায়াত, অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া, ম্যাডিক্যাল টেস্ট ও রিপোর্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট ঝামেলা ছাড়াও প্রচুর হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অধিকন্তু একবার চিকিৎসার জন্য গেলে ফলোআপ হিসেবে আরো অনেক বার ভারত যেতে হয়। তারপরও ভারত-ফেরত রোগীরা বাংলাদেশে এসে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার এতই উচ্ছসিত প্রশংসা করে যে, অনিচ্ছুকরাও দেশে চিকিৎসার কথা বাদ দিয়ে ভারত চলে যায়। কেন এমন প্রশংসা? এর কারণ হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস এবং হার্দিক আচরণ। তবে শুধু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছেন তা নয়। কারণ এমন অনেক প্রভাবশালী রোগী আছেন তারা খুব ভালো ব্যবহার পেয়ে থাকেন। তবু তারা বিদেশ চলে যায়। চিকিৎসার জন্য ভারত যাবার সবচেয়ে বড়ো কারণ স্থানীয় ডাক্তারদের প্রতি চরম অনাস্থা এবং ভুল চিকিৎসার ভয়। 
আমি মনে করি, শুধু ডাক্তার নয়, এজন্য জনগণ এবং সাধারণ রোগীদের দায়ও কম না। বিদেশের প্রতি আমাদের দুর্বলতা একটা অসভ্য বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাজারে গেলে কেবল হাঁসমুরগি ছাড়া প্রত্যেক কিছুতে বিদেশি তমকা খুঁজে বেড়াই। অধিকন্তু ভারতীয় চিকিৎসকদের কৌশল ও প্রচারের কাছেও আমরা মার খাচ্ছি। এ বিষয়ে সরকার ও জনগণের কার্যকর সচেতনতা প্রয়োজন এবং মাথা থেকে এই সচেতনতা শুরু করতে হবে। 

No comments:

Post a Comment