Translate

Sunday 31 January 2016

ড. মোহাম্মদ আমীনের চোখে আহমদ ছফা / সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস

 পশ্চিমবঙ্গ হতে ড. মোহাম্মদ আমীনের কাছে লেখা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাসের চিঠি
প্রিয় মোহাম্মদ আমীন সাহেব 
আশা করি ভালো আছেন। আপনার লেখা ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ বইটা পড়লাম। সকাল দশটায় বইটায় একটু চোখ বুলানোর জন্য হাতে নিয়ে বিছানায় বসলাম। হাতে কিছু অন্য কাজও ছিল। কিন্তু অন্য কাজ আর হলো না। দুপুর দুটা নাগাদ বইটা শেষ করে তারপর স্নান করতে গেলাম। কী যে ভালো লাগলো! তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।মনটা যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল।  
বর্ডারের ঝামেলার কথা মনে করে মাত্র দুই সেট বই নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। তার এক সেট আপনাকে দিয়ে দিই। পরে অনেকে বই চেয়েছেন দিতে পারিনি।একবাই বোধহয় ভেবেছিলাম, তাঁকে বই দুটো না দিলেই ভালো হতো। কারণ সাধারণত সরকারি কর্তাব্যক্তিরা বইপত্র তেমন পড়েন না। যত বড় কর্তা হন, বই পড়ার হার তত কমে যায়। এখন বুঝতে পারছি- আমার ওই ছাইটুক না দিলে এই ‘সোনার তাল’ কোনোদিনই হয়তো বা পেতাম না। আহমদ ছফা হয়তো বা আমার অজানাই থেকে যেতেন।  
আমি সাহিত্যের ছাত্র নই। সাহিত্য বুঝি না, সাহিত্যিকদের চিনি না তেমন। এপার বা ওপার বাংলার সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তেমন কোনো পরিচয় নেই। যতদূর মনে পড়ে ওপার বাংলার সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচয় বলতে -ইলিয়াস সাহেবের ‘খোয়াবনামা’, অন্য কোনো এক লেখকের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এমন এক আধটু। আহমদ ছফা সাহেবের সৃষ্টি সাথে পরিচয় না ঘটা তাই আমার ক্ষেত্রে অগৌরবের হলেও অস্বাভাবিক নয়।  
আপনি লিখেছেন ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি পেলাম ‘ আপনার চোখে আহমদ ছফা’।আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! বেনিয়া গোষ্ঠীর কবল থেকে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রাম! উহ্- এ আর এক মহান যুদ্ধের সুতীব্র আহবান। আহমদ ছফার সাহিত্য সৃষ্টির সাথে আমার এখনও পরিচয় ঘটেনি। কিন্তু সেটা কোনো বিষয় নয়। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রনমুক্ত হবার যে দিক্‌নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, তাতেই তাঁর চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।  
‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থ পাঠ করার পর বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আহমদ ছফা একজন বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী চরিত্র। আপনার বইয়ে তাঁর যে তেজ, যে আদর্শ, যে সাহস এবং যে নির্লোভ দৃঢ়তা প্রকাশ হয়েছে তা দলিত মানুষের জন্য  একটি বড় সুখবর। কিন্তু এ বই থেকে পরিষ্কার হলো না - তিনি কোনো স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন কি না; যা একান্তই প্রয়োজন। 
পশ্চিম বাংলায় একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার আন্দোলন শুরু হয়েছে। যা ‘দলিত সাহিত্য আন্দোলন’ নামে পরিচিত। প্রচলিত সাহিত্য বা আনন্দবাজারী সাহিত্যকে তারা ‘ব্রাহ্মন্যবাদী সাহিত্য’ নামে চিহ্নিত করে। দলিত সাহিত্য, ব্রাহ্মন্যবাদী শিল্প-সাহিত্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দলিত, গরিব এবং প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাকে উপজীব্য করে তাদের বিকাশের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করে। দলিত সাহিত্য নিছক কোনো সাহিত্য কর্ম নয়; এটি হলো একটি আন্দোলন-- সময় বদলের সংগ্রাম। তাদের সংগঠন ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’ এবং তাদের মুখপত্র ‘চতুর্থ দুনিয়া’(তৃতীয় বিশ্বে দলিতরা অন্য আর এক জাতের মানুষ)। 
মনে হচ্ছে আহমদ ছফা সৃষ্টি করেছেন একটি স্ফুলিঙ্গ- য দিয়ে দাবানল তৈরি হতে পারে। সে গুরুদায়িত্ব আপনাদের। ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থের মাধ্যমে তা আপনারা অতি সাহসের সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়েছেন । আহমদ ছফাকে অনুসরণ করে যদি একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলন আপনারা গড়ে তুলতে ও বাঁচিয়ে রাখতে না পারেন, তাহলে ছফা একদিন হয়তো বা হারিয়ে যাবেন, তাতে সমাজ বদলের সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। 
আহমদ ছফাকে নিয়ে যিনি লেখেন, সেই লেখার মধ্যে আহমদ ছফার সাথে লেখককেও খুঁজে পাওয়া যায়। লেখকের সত্ত্বায় যদি আহমদ ছফা মিশে না থাকতেন, তাহলে এমন প্রাণবন্ত ছফাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। অসম্ভব ভালো আপনার অনুভূতি, সুউচ্চ আপনার মূল্যবোধ, সুতীক্ষ্ণ আপনার কলম।আহমদ ছফার কথাকে ঠিক আহমদ ছফার মতো অগ্নিস্বরে আপনার কলম দিয়ে বের করেছেন।  
মনে হচ্ছে আপনার বইয়ে কোনো এক জায়গার ‘চৈতন্য দেব’ এর উল্লেখ করেছেন। তিনি নমস্য, তাঁকে নমস্কার জানিয়ে আপনাকে অনুরোধ করব, ‘হরি গুরু চাঁদ’ এর খোঁজ নিন একটু। জন্ম গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে। আমার লেখা বইয়ে ‘গ্রাম বাংলার রেনেসাঁর জনক গুরুচাঁদ ঠাকুর’ শিরোনামে একটা লেখায় তাঁর প্রাথমিক পরিচয় পাবেন। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে আপনার কলমের আঁচড়ে তাঁরা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারবেন। 
আমার জন্ম মশিয়াহাটিতে। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে কেটেছে। তারপর একান্ত অনিচ্ছায় ভারতে বন্দি হয়ে আছি। পালাবার পথ করে উঠতে পারিনি কিন্তু পালাবার ইচ্ছা এখনও শেষ হয়ে যায়নি।মনে হয়, ওই মাটি (বাংলাদেশের) আপনাদের থেকেও আমার বেশি প্রিয়। দীর্ঘ বিরহে প্রেমাকর্ষণ যেন বেড়েই চলেছে। খুব তাড়াতাড়ি ্আবার মশিয়াহাটি (যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার একটি গ্রাম) যাবার ইচ্ছা আছে।  
দেখুন, সাহিত্য, সাহিত্যমূল্য এসব বুঝি না। আমি ‘লিফলেট’ লেখা মানুষ। তাই, মনের কথাগুলো ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারলাম না। আপনার বীরপ্রতীক পিতামহ -- ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি থেকে উদ্ধার করার মতই একটু কষ্ট করে আমার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস যদি বুঝে নেন, কৃতজ্ঞ থাকব।   
আপনার লেখা ‘আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী’ গ্রন্থটা পড়ে আমি নতুন আলোর আগমন টের পাচ্ছি। তাই আপনার মাধ্যমে ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’র একজন কর্মী হিসাবে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ও প্রাগ্রসর প্রজন্মকে আহমদ ছফার মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বতন্ত্র সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে উজ্জীবিত - একটি সার্বজনীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, দলিত মানুষের হাহাকার, বঞ্চিতের চীৎকার। 
ধন্যবাদসহ,
আপনার গুণমুগ্ধ
সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস নতুন পল্লী, মছলন্দপুর উত্তর চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।


No comments:

Post a Comment