Translate

Friday 22 January 2016

কবিয়াল করিম বখশ / ড. মোহাম্মদ আমীন

কবিয়াল করিম বখশ

চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের খ্যাতিমান পুরুষ লোককবি-কবিয়াল করিম বখশ ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে চন্দনাইশ উপজেলার বৈলতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মগ্রামটি বর্তমানে ইউনুস মার্কেট নামে পরিচিত। পিতার নাম মুহাম্মদ আবদুল আলী ও মা গোলজান বিবি। গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে তার জন্ম। পরিবারে আর্থিক অনটন ছিল চিরসঙ্গী। তাই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করাটা করিম বখশের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি তার অনুরাগ ছিল প্রবল । তার কণ্ঠ ছিল মধুর। ছোটবেলায় তার গান শুনে সন্দ্বীপ নিবাসী আজগর আলী কবিয়াল তাকে কবিগানে উৎসাহিত করেন ও তালিম দেন। কবিয়াল আজগর আলী সাতকানিয়া থানার চরখাগরিয়া  গ্রামে বসবাস করতেন। 
গানের প্রতি মমতা ও সুরেলা কণ্ঠের জন্য অল্পসময়ের মধ্যে তার বহু ভক্ত সৃষ্টি হয়। তিনি কৃষি ক্ষেতে কাজ করতে করতে ও মাঠে গরু চরানোর সময় গান করতেন। তার গানে মুগ্ধ হতেন নারী-পুরুষ সবাই। এমনই একজন স্বামী নিশ্চলানন্দ অবধূত, সাধুর প্রকৃত নাম ছিল নন্দলাল দাশ। তিনি করিম বখশের গান শুনে নিজপুত্র মনিন্দ্রলাল দাশকে (বৈলতলী-চন্দনাইশ) কবিগান শিখতে অনুপ্রেরণা দেন। এই মনিন্দ্রলাল দাশ পরিবর্তীকালে কবিয়াল করিম বখশের প্রথম ও প্রধান শিষ্যে পরিণত হন। স্বামী নিশ্চলানন্দ ছিলেন আরবি, ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। তার বাড়িতে প্রতিদিন বৈঠক বসত, আর সেখানে কোরআন, গীতা, রামায়ণ, হিন্দু পুরাণ, ত্রিপিটক, মহাভারত প্রভৃতি শাস্ত্রপাঠপূর্বক নানা আলোচনা হতো। করিম বখশ সে বৈঠকে নিয়মিত উপস্থিত হতেন। ফলে করিম বখশ হয়ে ওঠেন একজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। তার স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ, একবার শুনলেই হুবুহু মুখস্থ করে নিতে পারতেন। করিম বখশ শাস্ত্রবিষয়ক কীর্তন, ছড়া ও গান বাধতেন এবং তাৎক্ষণিক সুরারোপ করে উপস্থিত শ্রোতাদের শোনাতে পারতেন। স্বামী নিশ্চলানন্দের কথা কবিয়াল করিম বখশ তার গানে যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন-  
“এক সোনার তৈয়ারী অলংকার - 
কেউ গড়েছে দুল নক্ষত্র, কেউ গড়েছে কণ্ঠহার,কেউ বা পিতা, 
কেউ বা মাতা, কেউ বা বন্ধু, 
কেউ বা ভ্রাতা,সবার মূলে একই কথা নাড়াচাড়া বিধাতার ॥ 
লাল, সাদা, সবুজ, নীলে যদি জল হয় সবাকারহিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ যত, ভেদ-বৈষম্য সেই মত,করিমের মতে সৃষ্টি কৌশল এক স্রষ্টার।” (কবিয়াল পরিচিতি, এস.এম. নুরুল আলম, দৈনিক আজাদী ২০০৫)।
করিম বখশ কবিয়াল জীবনের প্রারম্ভে আর একজন উদীয়মান কবিয়ালের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তার নাম কবিয়াল একরাম আলী। কিন্তু তার অকাল মৃত্যুতে করিম বখশ খুবই মর্মাহত হয়ে পড়েন। তবে শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যান। করিম বখশ যখন কবিগান শুরু করেন সে সময় মুসলমান সমাজ ছিল সঙ্গীতবিরোধী। গান-বাজনাকে  মনে করা হতো কবিরা গুনাহ। করিম বখশকে ধর্মবাজ মোল্লারা সমাজচ্যুত করেন। কিন্তু তিনি এতে ভেঙে পড়েননি। রসিকচন্দ্র নাথ, রমেশচন্দ্র নাথ, সারদা শীল, অবর্ণ শীল, দূর্গা কুমার শীল, ছদু মিয়া প্রমুখদের নিয়ে তিনি একটি কবিয়াল দল গঠন করেন। তার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে প্রগতিশীল মুসলিম যুবকেরাও তাঁর গানের অনুরক্ত হয়ে পড়ে। মোল্লারাই আস্তে আস্তে একঘরে হয়ে পড়তে থাকে। গানের আসরে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। সুরের সঙ্গে নৃত্যকলার নৈপুণ্যেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। জনৈক শিষ্য করিম বখশের প্রশংসা করে লিখেছেন-  
পাঁচালির বুলি যদি আরম্ভ করিত মনে হতো নিঃশ্বাস উনি কভু না ফেলিত। 
অনর্গল বলিতে কভু না আসিত ক্লান্তিপদ উচ্চারণে কভু না থাকিত ভ্রান্তি। 
সংস্কৃত শ্লোকাদিতে পদাদি রচনাশুনিলে আশ্চর্য লোক কি করি বর্ণনা। 
গল্পগুজব যার উপদেশময় শুনিতে উপাদেয় সুললিত হয়।
নৃত্যকলায় বিশারদ বলে মনে হতোভাবের আবেশে যখন নৃত্য আরম্ভিত। 
সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর আকুল করত প্রাণসত্যই সর্বগুণে কবি ছিলেন মহীয়ান ॥(কবিয়াল পরিচিতি, এস.এম. নুরুল আলম, দৈনিক আজাদী ২০০৫) 
স্থানীয় মোল্লা সমাজ ও সমাজপতিদের বিচারে কবিয়াল করিম বখশ সমাজচ্যুত হলে সংসারে তার সংকট দেখা দেয়। তখন বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা  চন্দনাইশের সাতবাড়িয়ার নগরপাড়া গ্রামের মুহুরীহাটি নিবাসী প্রখ্যাত আলেম ফখরে বাংলা মওলানা আবদুল হামিদ ছিলেন চট্টগ্রাম দারুদ উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। তিনি কবিয়াল করিম বখশের সুনাম ও কবি কণ্ঠে হামদ ও নাত শুনে মুগ্ধ হন এবং কবিয়ালকে পুনরায় কবিগান চালিয়ে যাবার অনুমতি দেন ও সমাজপতিদের নিবৃত্ত করেন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে  কবিয়াল ও আপামর মনোযোগের সাথে সঙ্গীতে মগ্ন হন ও একে একে সেকালের সকল প্রতিষ্ঠিত ও গুণী কবিয়ালদের পরাজিত করে নিজেকে বাংলার লোকায়ত বাংলার লোক সমাজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়াল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন।চট্টগ্রামের লোকসঙ্গীত জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়াল করিম বখশ তার জীবনে একবারের জন্যও কোন কবিয়ালের কাছে হারেননি বলে জনসমাজে প্রচলিত আছে। চট্টগ্রমের লোক কবিদের মধ্যে তিনি ‘অপরাজেয় কবিয়াল’ বলে সুপরিচিতি অর্জন করেন। মুসলিম কবিয়ালদের তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তার কবি গানে উৎসাহিত হয়ে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সাংবাদিক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ‘অপরাজেয় লোককবি করিম বখশ’ নামে একটি বই লিখেন। 
দেশবরেণ্য ও অপরাজেয় কবিয়াল করিম বখশ সম্পর্কে তাঁর শিষ্য কবিয়াল মণীন্দ্র দাশ বলেছিলেন-সম্মুখ সমর যখন কবির চলিতজম্ভুক শার্দূলে যেন যুদ্ধ আরম্ভিত। যতসব তদানীন্তন কবিয়ালগণ শার্দূলের কাছেতে জম্ভুক যেমন-পদানত হইয়া করে পরাজয় স্বীকার, তেমনি করিম কাছে দেখি অনিবার। কেহ বলে গায়েবি শক্তিতে করে গান। কেহ বলে সাধুজী করেন শক্তি দান ॥ সৃষ্ট চন্দনাইশ, সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন, ২০০৭। 
কবিয়াল করিম বখশ প্রথম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন চন্দনাইশের হামিশপুর গ্রামের বজলুর রহমান মুনশী বাড়িতে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কবিয়াল কামিনী সরকার। এই লড়াইয়ে জিতে নেন করিম সোনার মেডেল। ক্রমে ক্রমে সকল কবিয়ালকে হারিয়ে করিম বখশ কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে উঠেন। হিন্দু-বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের নানা তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে এবং তিন ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক পাণ্ডিত্যে সমকালীন সময়ে করিম বখশের সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বাইরের সেকালের প্রখ্যাত কবিয়ালদের সাথে কবির লড়াইয়ে তিনি বহুবার অবতীর্ণ হন এবং প্রতিবারই বিজয়ী হন। করিম বখশের যশ, মান, কৃতি ও খ্যাতিতে গৌরবান্বিত এক শিষ্য বলেন-কবিয়াল বাজারে তার বাজে জয়ডঙ্কা,করিম নামেতে সবের মনে জাগে শঙ্কা।কবিয়াল করিম বখশ স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন:হায়রে মুসলিমগণ দিবানিশি কর চিন্তনকি হালে কাটাবে এতদিনতোমাদের সৌভাগ্য রবি অস্তমিত আছে ভাবিব্রিটিশ জাতি করে এক ঘিন।সুপ্ত বীর্য শৌর্য নিয়া জেগে উঠ একযোগ হইয়ালুপ্ত গৌরব উদ্ভারিবার তরেচিত্তরঞ্জন, কাজেম আলী মুহাম্মদ আলী, শওকত আলীডাক দিয়াছে যতীন ব্যারিস্টারে।জাগ হিন্দু-মুসলমান দেশের যত সন্তানকরিম কয় শঙ্কা না করিও।ন্যায় যুদ্ধ করে যাওয়া ক্ষেত্রে ধর্মে স্বর্গ পাওয়াইসলামে কয় ন্যায়ে শহীদ হইও ॥কবিয়াল করিম বখশ ছিলেন সত্যিকারের গণমানুষের কবি, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার মানুষ। তিনি রাজনীতি ও সমাজসচেতন ছিলেন। তবে নিরক্ষর কবিয়াল করিম বখশ এত উচ্চ মানের লোক কবিয়াল হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ মূল্যায়ন পাননি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি। তিনি কোন নির্দিষ্ট দল ও সম্প্রদায়ের গুণকীর্তন করেননি। দলমত নির্বিশেষে সকলের মনের কথা বলেছেন সারাজীবন। সত্যিকার অর্থে কবিয়াল করিম বখশ ছিলেন প্রকৃত অর্থেই গ্রাম বাংলার গণমানুষের কবিয়াল।এই অপরাজেয় কবি মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ২৮ অক্টোবর, ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সাত পুত্র ও দু’কন্যার জনক ছিলেন। তার অনেক শিষ্য ছিলেন। কবিয়া করিম বকস এর জন্ম বিঠের কিছু দক্ষিণা পাশে সঙ্খনদীর কূল ঘিরে একটি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে তাকে চির সমাহিত করা হয়েছিল। মৃত্যু এত বছর পর হলেও এলাকাবাসী ও চট্টগ্রামবাসী কবিয়াল করিম বকস কে ভূলতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার ও মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়। চট্টগ্রাম ও কলকাতা শহরেও তার মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণে আলোচনা সভা হয়। ২০১৩ সালে তার মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রর উদ্যোগে দিন ব্যাপী আলোচনা সভা ও কবি গান অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীয় সাংস্কৃতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে কবিয়াল করিম বকস এর শেষ ঠিকানা কবর কে সঙ্খনদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের নেতৃবৃন্দ। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সামনে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে হয়তো ইতিহাস বিখ্যাত পন্ডিত ও অপরাজয়ের কবি করিম বকস শেষ ঠিকানা হারিয়ে যাবে। জাতি হিসেবে বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধিকার ভাষার প্রাণ পুরুষ এতে করে পরাজয় বরণ করবে। আমাদের লজ্জা ও দুঃখ কন্ঠে বারে বারে আকুতি কবিয়ালের শেষ ঠিকানা কবরটি অন্তত রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসবেন।লেখখ : ডা. বরুণ কুমার আচার্য্য বলাই

No comments:

Post a Comment