Translate

Friday 22 January 2016

কবিয়াল রমেশ শীল / ড. মোহাম্মদ আমীন

কবিয়াল রমেশ শীল

কবিয়াল রমেশ শীল ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখ মোতাবেক ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি উপজেলার গোমদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চন্ডীচরণ শীল। চন্ডীচরণ শীল ছিলেন পেশায় নাপিত ও কবিরাজ। রমেশ শীলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। তাঁর নিজের ভাষায় :
“আমিই বালক, চালক,পালক, আমার আর কেহ নাই। 
মায়ের অলংকার সম্বল আমরা বিক্রি করে খাই ” 
পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের সব দায়িত্ব তাঁর কাধে এসে পড়ে। বাধ্য হয়ে তিনি পিতার পেশায় নেমে পড়েন। কিছুদিন পর ভাগ্যান্বেষণে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) রেঙ্গুন শহরে গমন করেন। সেখানে কর্মচারী হিসেবে একটি দোকানে চাকুরি নেন। ধীরে ধীরে একটি দোকানের মালিক হন। তবের দেশের প্রতি দুর্বার আকর্ষণের কারণে পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে তিনি নরসুন্দর কাজের পাশাপাশি কবিরাজ (গ্রাম্য চিকিৎসক) হিসাবে কাজ শুরু করেন। কবিরাজি করতে করতেই তিনি কবিগানের প্রতি অাকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
কোনরকম অভিজ্ঞতা ছাড়া তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মঞ্চে কবিগান পরিবেশন করেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কবিগান পরিবেশনায় প্রতিদ্বন্দী তিনজন কবিয়ালকে পরাজিত করলে উদ্যোক্তা ও শ্রোতৃবৃন্দের কাছ থেকে তের টাকা সন্মানি লাভ করেন। যা পেশা হিসাবে কবিগানকে বেছে নিতে রমেশ শীলকে অনুপ্রানিত করে।
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে রমেশ শীলের উদ্যোগে কবিগানের ইতিহাসে প্রথম সমিতি গঠিত হয় । সমিতির নাম রাখা হয় ‘রমেশ উদ্বোধন কবি সংঘ’। অশ্লীলতা মুক্ত কবিগান ছিল এ সমিতির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিকে স সংবর্ধনা ও ‘বঙ্গের শ্রেষ্ঠতম কবিয়াল’ উপাধিতে ভুষিত করা হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরাল অবস্থান নেন। এজন্য যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সঙ্গে রমেশ শীলকেও গ্রেফতার করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার তার ‘ভোট রহস্য’ পুস্তিকা বাজেয়াপ্ত করে । ১৯৫৮ খ্রিস্টা্ব্দে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষ জীবনে কবি সাংঘাতিক অর্থ কষ্টে পতিত হন। কবির প্রথম স্ত্রী ছিলেন অপূর্ববালা, এবং দ্বিতীয় স্ত্রী অবলাবালা। এ ঘরে কবির চার পুত্র ও এক কন্যা জন্মলাভ করে।
প্রথম দিকে তিনি প্রথাগত কবিয়ালদের মত পুরাণ ও কিংবদন্তী নির্ভর গান রচনা করতেন। গানের বিষয় ছিল নারী-পুরুষ, সত্য-মিথ্যা, গুরু-শিষ্য, সাধু-গেরস্থ ইত্যাদি। পরবর্তকালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। যুদ্ধ-শান্তি, চাষী-মযুদদার, মহাজন-খাতক, স্বৈরতন্ত্র-গনতন্ত্র, এসব হয়ে যায় কবিগানের উপজীব্য।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে মাঝিরঘাটে দুর্গাপূজা উপলক্ষে কবিগানের আয়োজন করা হয় । প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্রোতার উপস্থিতিতে কবিগান শুরু হয় । প্রধান কবিয়াল ছিলেন তৎকালীন জনপ্রিয় কবিয়াল মোহনবাঁশী ও চিন্তাহরণ । গানের আসরে চিন্তাহরণ অসুস্থ হয়ে পড়েন । এতে শ্রোতারা হট্টগোল শুরু করেন । এ অবস্থায়, আয়োজকরা কবিয়াল দীনবন্ধু মিত্রকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করেন । কিন্তু কবিয়াল দীনবন্ধু মিত্র অনুরোধ গ্রহণ না করে রমেশ শীলকে মঞ্চে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রথমে ভয় পেলেও সাহস করে মঞ্চে উঠে যান রমেশ শীল । মাত্র একুশ বছর বয়সের রমেশ শীলকে প্রতিপক্ষের কবিয়াল মোহনবাঁশি অবজ্ঞা করে বলেছিলেন , "এই পুঁচকের সঙ্গে কি পালা করা যায় ?" প্রত্যুত্তরে রমেশ শীল বলেছিলেন "উৎসব আর ভয় লজ্জা কম নয়।/কে বা হারাতে পারে কারে।/পুঁচকে ছেলে সত্যি মানি শিশু ব্রজ ছিল জ্ঞানী/চেনাজানা হোক না আসরে।" ঐ আসরে তিনি দর্শকদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন , "মা আমার রাজকুমারী চন্ডীচরণ বাপ, আমি হয়রে মানুষের বাচ্চা করবো না রে মাফ।" জীবনের প্রথম আসরে টানা আট ঘণ্টা গেয়েছিলেন কবিগান । ঐ আসরে কেও কাউকে হারাতে পারেনি । অবশেষে আয়োজকদের হস্তক্ষেপে কবিগান বন্ধ হয় সেদিনের মতো । সেদিন থেকেই রমেশ শীলের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ।
সেসময় স্থুল অঙ্গভঙ্গি ও কুরুচিপূর্ণ শব্দযোগে যৌনতার পরিবেশন ছিল কবিগানে আসল আকর্ষণ। রমেশ শীলের শিল্পীত উপস্থাপন ও মার্জিত শব্দচয়ন কবিগানে রুচিশীলতার বিরল দৃষ্টান্ত। দেশাত্মবোধ, দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর, ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলন প্রভৃতি তাঁর গানের ভাষায় জোরালোভাবে ওঠে আসে। যেমন- ‘ব্যবসার ছলে বণিক এল/ ডাকাত সেজে লুট করিল/ মালকোঠার ধন হরে নিল- আমারে সাজায়ে বোকা;/ কৃষক মজদুর একযোগেতে/ হাত মেলালে হাতে হাতে/ শ্বেতাঙ্গ দুষমনের হতে- যাবে জীবন রাখা’। অথবা- ‘দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে/ এখনো লোকে জাগিল না কেনে’। কবির দেশাত্মবোধ ছিল প্রবল – ‘বাংলার জন্য জীবন গেলে হব স্বর্গবাসি/ আমার বাংলার দাবি ঠিক থাকিবে যদিও হয় ফাঁসি’।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত কবিয়াল রমেশ শীল সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তার গণসঙ্গীত দেশের মানুষের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জণগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং নুরুল আমিনকে পূর্ববাংলার গভর্নর বানানো হয়। নুরুল আমীন চট্টগ্রাম এলে জনগণের কাছে লাঞ্চিত হন। এ নিয়ে কবিয়াল রমেশ শীল একটি ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করেন। এ গানটি এতো জনপ্রিয় পেয়েছিল যে তা সাড়াদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এজন্য তাকে একবছর বন্দি রাখা হয়।
রমেশ শীলের রচিত পুস্তকের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাঁর রচিত যেসকল গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় তন্মধ্যে : আশেকমালা, শান্তিভাণ্ডার, নুরে দুনিয়া, দেশের গান, ভোট রহস্য, চট্টল পরিচয়, ভান্ডারে মওলা, জীবন সাথী, মুক্তির দরবার, মানব বন্ধু, চাটগায়ের পল্লীগীতি ১ম ও ২য় ভাগ প্রভৃতি অন্যতম।
এছাড়াও তাঁর প্রনীত পুস্তক তালিকার বাইরে আরও ৮টি পুস্তক পাওয়া যায়। যেমনঃ (১) পাকিস্তান সঙ্গীত (২) দেশ দরদী গানের বই (৩) লোক কল্যাণ (৪) ১৩৬৭ সালের তুফানের কবিতা (৫) এসেক সিরাজিয়া (৬) মহাকাব্য বহি (৭) ১৯৬৩ সালের তুফানের কবিতা (৮) শান্তির কবিতা । অধিকন্তু রমেশ শীল বেদুঈন ছদ্মনামে "বদলতি জমানা" শীর্ষক এবং ঋষিভত্ত ছদ্মনামের "ভণ্ড সাধুর" কবিতা শীর্ষক দুটি পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর অন্যান্য পুস্তকের মধ্যে, নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী সহযোগে "গান্ধী হত্যার কবিতা" অন্যতম। এর বাইরেও রমেশ শীলের প্রায় দেড়শতের অধিক কবিতা রচনা করেছেন।
কবিগানে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক সংর্বদনা পেয়েছেন। তন্মধ্যে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার কেন্দীর কারাগারে সহবন্দীদের আয়োজিত জন্মদিনের সংবর্ধনা, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বুলবুল একাডেমির সংবর্ধনা এবং ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের নাগরিক সংবর্ধনা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ চৈত্র মোতাবেক ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় তিনি মারা যান।
দ্বিতীয় ছবিতে : কবি রমেশ শীলের সঙ্গে কবি জসীম উদ্‌দীন ও সাহিত্যিক আবুল ফজল

No comments:

Post a Comment