আবদুল গফুর হালী / ড. মোহাম্মদ আমীন
আবদুল গফুর হালী
আবদুল গফুর হালী ১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুস সোবহান এবং মাতার নাম গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের পর ইস্তফা দেন।
নির্দিষ্ট কোনো গুরু নয়, চট্টগ্রামের প্রকৃতি হতে, চট্টগ্রামের মাটি হতে তিনি গান শেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আস্কর আলী পণ্ডিত ও রমেশ শীলের গান থেকে। ছোটবেলা থেকে আস্কর আলী পণ্ডিতের আধ্যাত্মিক ও মরমি গান গফুরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ৬০ বছর ধরে টানা গান লিখেছেন আবদুল গফুর হালী। গানই ছিল তার প্রাণ এবং জীবিকার অন্যতম উপায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান রচনায় এখনও কেউ আবদুল গফুর হালীকে অতিক্রম করতে পারেনি। এজন্য তাঁকে বলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের একচ্ছত্র সম্রাট।আবদুল গফুর হালীর আঞ্চলিক গানের সংখ্যা ১৬০৭, মাইজভান্ডারি গান ১১২০। ‘দুই কুলের সোলতান’, ‘দেখে যারে মাইজভান্ডারে’সহ অসংখ্য গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, কল্যাণী ঘোষ, শিমুল শীল, নয়ন শীল, উমা খান, সঞ্জিত আচার্য, কান্তা নন্দী, শিল্পীরানী, আবদুল মান্নান রানা, সেলিম নিজামী , শিরীন, কল্পনা লালা ও সন্ধ্যারানী দাশসহ আরও অসংখ্য খ্যাতিমান শিল্পী তাঁর গান পরিবেশন করেছেন।
‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি দিওয়ানা’, ‘রসিক তেল কাজলা কোন পাঞ্জাবিঅলা‘, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলগো’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই’,‘অ শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইও’, ‘বানুরে অ বানু আঁই যাইমুব রেঙ্গুম শরত তোঁয়ার লাই আইন্যম কী’ প্রভৃতিসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা আবদুল হালী চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষের কাছে আজীবন বেঁচে থাকবেন। মাইজভাণ্ডারী গান রচনাতেও তিনি সমান দক্ষ। ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে’, ‘কতো খেলা জানরে মাওলা’, ‘মাইজভাণ্ডারে কি ধন আছে’ এবং মোহছেন আউলিয়া গান- ‘চল যাই জিয়ারতে মোহছেন আউলিয়ার দরবারে’, ‘আল্লাহর ফকির মরে যদি’, ইত্যাদিসহ শত শত কালজয়ী গানের রচিয়তা আবদুল গফুর হালী।
তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মেঠো পথের গান’। এ চলচ্চিত্রে লোকশিল্পী আবদুল গফুর হালীর জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে, ছবিটি ৩৯ মিনিটের। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন শৈবাল চৌধুরী। পটিয়ার রশিদাবাদ, চন্দনাইশের জোয়ারা ও দোহাজারী এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ছবির বিভিন্ন অংশের চিত্রায়ণ করা হয়েছে। দেশের নামী-দামি বিভিন্ন শিল্পীদের গান ছবির উল্লেখযোগ্য অংশ। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, কল্যাণী ঘোষ, কল্পনা লালা, সঞ্জিত আচার্য, শিমুল শীল, সেলিম নিজামী, শিরীন, নয়ন শীল প্রমুখ শিল্পীরা এই ছবিতে আবদুল গফুর হালীর জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করছেন।
গফুর হালীর গান মাটির ছোঁয়া আর জনমানুষের মৃন্ময়তা বিমুগ্ধ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সর্বজনীনতা তাঁর গ্রাণের প্রাণ এবং ভক্তি এবং প্রতি লাইনে রয়েছে ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার নিপুণ কারুকাজ। সত্তর ও আশির দশক ছিল আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারি গানের স্বর্ণযুগ। তাঁর লেখা সাড়া জাগানো বেশির ভাগ গান বিভিন্ন শিল্পীর গ্রামোফোন রেকর্ডে বেরিয়েছিল। ওই সময় হালী একটি দারুণ কাজ করেছেন। আর তা হলো আস্কর আলী পণ্ডিতের গান সংগ্রহ করে শেফালী ঘোষসহ বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তুলে দেওয়া। এতে আস্কর আলীকে নতুন করে ফিরে পান শ্রোতারা।তাঁর গান চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে অঞ্চলের গণ্ডী ছাড়িয়ে দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাঁর গান গেয়ে অনেক শিল্পী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শ্যাম-শেফালীর অনেক স্মরণীয় গানের স্রষ্টা আবদুল গফুর হালী। আবদুল গফুর হালীর গান শ্যাম সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করেন গানের জগতে।নিউ মার্কেটে ছোট একটা দোকান ছিল শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের। শ্যাম গানের মানুষ। সে সূত্রে তাঁর দোকানে শিল্পীদের আড্ডা বসে সকাল-সন্ধ্যায়। সে আড্ডায় একদিন যোগ দেন নবীন শিল্পী আবদুল গফুর হালী। প্রথম আলাপ দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। গ্রাম থেকে গান নিয়ে শহরে ছুটে আসেন গফুর। শ্যামের কণ্ঠে তা তুলে দেন। চট্টগ্রাম বেতারে প্রচারিত হয় গানগুলো।১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। বেতার অফিসে একদিন শেফালী ঘোষ আবদুল গফুর হালীর গান গাওয়ার প্রস্তাব দেন। রাজি হলেও ভুলে যান হালী। শেফালী বারবার তাগাদা দেন, আর গফুর ভুলে যান। তখনকার আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুজ্জামানের মাধ্যমে শেফালী ঘোষ, আবদুল গফুর হালীকে আবার অনুরোধ করেন। গফুর বললেন, ‘একটা দ্বৈত গান আছে। সেটা শ্যাম-শেফালীকে দিয়ে গাওয়ানো যায়।’ দুই দিন পর শ্যামসুন্দরের চকবাজারের বাসায় হাজির হন গফুর। সেখান থেকে শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের সাইকেলে চড়ে পৌঁছে যান শেফালীর বাসায়। গান রেকর্ড হয়ে যায় :‘ন যাইও ন যাইও আঁরে ফেলাই বাপের বাড়িত ন যাইও (ছেলে) ন গইরজ্য ন গইরজ্য বাপর বাড়িত যাইতাম মানা ন গইরজ্য (মেয়ে)।’ বেতারে প্রচারের পর আলোড়ন তুলে গানটি। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের নাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।এর আগে মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘নাইয়র গেলে আইস্য তারাতারি’সহ দু-একটা দ্বৈত আঞ্চলিক গান গেয়েছিলেন শ্যাম-শেফালী। কিন্তু ‘নাইয়র’ গানটির দারুণ জনপ্রিয়তা আঞ্চলিক গানে নতুন ধারা সৃষ্টি করল। প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন জুটি—শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ। এই একটি গান গফুরের জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দেয়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান তিনি। সংগীতজীবন শুরু করেছিলেন শিল্পী হিসেবে। খ্যাতিমান হলেন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে।বাংলার লোকসঙ্গীতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বিশেষভাবে অধিষ্ঠিত করেছে। এসব গান কালের সীমা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এবং বেশ আদৃত হচ্ছে। আবদুল গফুর হালী প্রথম মোহছেন আউলিয়াকে নিয়ে গান রচনা করেন। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রথম লোকনাটকের রচিয়তাও আবদুল গফুর হালী।জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষবিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক হানস হারডার ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। পরে শিল্পী কল্যাণী ঘোষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে। তাঁর জীবন ও গান নিয়ে ২০০৪ ডার ফেরুকটে গফুর, স্প্রিখট (পাগলা গফুর, বলে) নামের একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে হালীর ৭৬টি গান অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলোকে আবদুল গফুর হালী রচিত পূর্ববাংলার মরমি গান বলে উল্লেখ করেছেন হানস হারডার। তিনি আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন।আবদুল গফুর হালী ১৯৭০-এর নির্বাচনে গান গেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন। গফুর হালী চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলেন কেরোসিন কিনতে। ফেরার সময় রৌশনহাটে রাজাকারেরা তাঁকে আটক করে। বলল, ‘তুমি নির্বাচনে নেতার বিরুদ্ধে গান করেছ। তোমাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সেদিন তাঁর গানের একজন ভক্তের বদান্যতায় তিনি বেঁচে যান। কালুরঘাটে আরেকবার পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আটক করে। ঘাড়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে। বুদ্ধির জোরে সেদিন তিনি বেঁচে ফিরতে সক্ষম হন। আবদুল গফুর হালী সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি। তবে ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধারা হালীর একটি গান খুব পছন্দ করতেন এবং সেটি হচ্ছে :‘তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাইআঁই বাঙালি, তুই পাঠানতোর দেশে আর আঁর দেশেদুই হাজার মাইল ব্যবধান।’ ‘কোন সাধনে তাঁরে পাওয়া যায়।’ আবদুল গফুর হালীর লেখা ও গাওয়া শেষ গান।আবদুল গফুর হালী ছয়টি আঞ্চলিক নাটক রচনা করেছেন। তন্মধ্যে গুলবাহার গীতিনাট্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চায়িত ও বেতার-টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটকটিতে আস্কর আলী পণ্ডিতের কালজয়ী গান ‘ডালেতে লড়িচড়ি বৈও চাতকি ময়নারে’ সহ অন্যান্য গান অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি আজব সুন্দরী নামেও একটি নাটক রচনা করেছেন। তাঁর নাটকগুলো হলো :১ গুলবাহার২. নীলমণি৩. কুশল্যা পাহাড়৪. চাটগাঁইয়া সুন্দরী৫. সতী মায়মুনা এবং৬. আশেক বন্ধুআবদুল গফুর হালী গীতিকার, সুরকার ও লোকশিল্পী। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী, মুরশিদি, মারফতি প্রভৃতি ধারায় প্রায় আড়াই হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র মেঠোপথের গান। হালী নিজের রচিত অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। এছাড়াও রচনা করেছেন একাধিক আঞ্চলিক নাটক। আস্কর আলী পণ্ডিতের ভাবশিষ্য হালী যদিও নাটক রচনা ও সুর সৃষ্টি করেন। তার গান নিয়ে দুটি গ্রন্থ আছে। তত্ত্ববিধি ও জ্ঞানজ্যোতি।জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষ বিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক হানস হারডার (বর্তমানে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন।এ সময় কল্যাণী ঘোষের সঙ্গে তার পরিচিত হয়। শিল্পী কল্যাণী ঘোষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে। হ্যানস, আবদুল গফুর হালীর জীবন ও গান নিয়ে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ ফেরুকটে গফুর, স্প্রিখট (পাগলা গফুর, বলে)’ নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে হালীর ৭৬টি গান অন্তর্ভুক্ত হয়। হ্যানস হার্ডার গানগুলোকে আবদুল গফুর হালী রচিত পূর্ববাংলার মরমি গান হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন।
No comments:
Post a Comment