কুমিল্ল জেলার নামকরণ
কুমিল্ল জেলার প্রাচীন নাম ত্রিপুরা। ঋকবেদ গ্রন্থে উল্লেখ আছে; সপ্ত মহাদেশের সম্রাট যযাতির পৌত্র ত্রিপুরা ছিলেন একজন খ্যাতিমান রাজা। যযাতির রাজধানী ছিল এটি। তাই এলাকার নাম হয় ত্রিপুরা। আবার অনেকের মতে তিনপুর তথা ত্রিপুর অর্থাৎ ত্রিনগর হতে এর নাম হয় ত্রিপুর। বলা হয় আলোচ্য ত্রিপুরা এলাকাটি বড় বড় তিনটি বিখ্যাত নগরের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল। তাই এর নাম হয় ত্রিপুরা। রাজমালা গ্রন্থে বলা হয়েছে, তুই প্রা শব্দ হতে ত্রিপুরা শব্দের উদ্ভব। এটি একটি প্রাচীন উপজাতীয় শব্দ। যার অর্থ সমুদ্রমুখী। তুই প্রা পাহাড়িরা টিপরা রূপে উচ্চারণ করতো। এ টিপরা হতে ত্রিপুরা নামের উদ্ভব। কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী ও অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ জনপদ। এর নাম নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত থাকলেও সবগুলোর ঐতিহাসিক ভিত্তি অত্যন্ত জোরালো। সপ্তম শতকে চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ সমতট ভ্রমণ করেন। তিনি তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে কিয়া-মল-ঙ্কিয়া নামক একটি স্থানের কথা উল্লেখ করেন। স্থানটির অবস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, স্থানটি সমতট রাজ্যের পূর্ব-দক্ষিণে সাগর তীরে অবস্থিত। যেটি বর্তমান কুমিল্লা বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে হিউয়েন সাঙ এর সে কিয়-মল-ঙ্কিয়া স্থানটিই বর্তমান কুমিল্লা।
কুমিল্লার অপর নাম কমলাঙ্ক। গবেষকদের মতে, প্রাচীনকালে বর্তমান কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশের সাথে কলিঙ্গ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। এক সময় এটি দ্রাবিড়ভাষাভাষী কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। কলিঙ্গরা এ অঞ্চলটিকে কমালিঙ্ক নামে অভিহিত করেন। এই কমলিঙ্ক নাম হতে বর্তমান কুমিল্লা নামের উৎপত্তি। কলিঙ্গবাসীরা কমলিঙ্ক শব্দ দ্বারা কলিঙ্গকে সংক্ষেপে প্রকাশ করতেন। তবে অনেকে মনে করেন এ ধারণা যথার্থ নয়। এ প্রসঙ্গে প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বিজয়চন্দ্রের বিবরণ প্রণিধানযোগ্য। তারমতে, ভারতবর্ষের পূর্বাংশে কমিল্লা (কুমিল্লা), চট্টল এবং আরাকান নিয়ে দ্রাবিড়দের অধিনে ত্রিকলিঙ্গ নামে একটি উপ-বিভাগ সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাং কমিলা নামটি এখানে পৃথক কোন অঞ্চলের নাম নয়। বরং বর্তমান কুমিল্লাই। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভগচ্চন্দ্র বিশারদ ‘ত্রিপুরা সংবাদ’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এটি সংস্কৃতে লেখা। এ গ্রন্থে কুমিল্লা নামের বিররণ নামের একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে ধন্যমানিক্য ছিলেন ত্রিপুরার রাজা। এ সময় গৌড়াধিপতি হোসেন শাহের সেনা নায়ক ‘কোমিল্ল’ আলোচ্য অঞ্চলটি অধিকার করে নেন। সেনা নায়ক ‘কোমিল্ল’ এর নামানুসারে বর্তমান কুমিল্লা নামের উৎপত্তি মর্মে তিনি বর্ণনা করেছেন।
চৌদ্দ শতকের প্রারম্ভে হযরত শাহ জামালকে ত্বদীয় মামা আহমদ কবির এক মুঠো মাটি দিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশে যাও যেখানকার মাটির সাথে এ মাটির রঙ, গন্ধ ও স্বাদ মিলে যাবে সে স্থান হবে তোমার ধর্মপ্রচার কেন্দ্র। সেখানে নিবাস গেড়ে ধর্মপ্রচার শুরু করবে।’ শাহ জামাল অনেক দেশ, নদীপ্রান্তর ও গ্রামগঞ্জ ঘুরতে ঘুরতে আলোচ্য এলাকার গাজীপুর মহল্লার খিলাতলী নামক স্থানে পৌছেন। তিনি এ স্থানের মাটির সাথে মামার দেয়া মাটির মিল খুজে পেলে আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠেন- কোহমিলা। যার অর্থ প্রত্যাশিত পর্বত। এ কোহমিলা শব্দ হতে কুমিল্লা নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। তবে এটি নিছক প্রবাদ। চৌদ্দশতকের অনেক পূর্ব হতে কুমিল্লা নামের প্রচলন। ব্রিটিশ আমলে কুমিল্লা নামটি শুধু সদর মহকুমা এবং জেলা শহর প্রকাশে ব্যবহার করা হত। জেলার নাম ছিল ত্রিপুরা। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ নাম চালু ছিল। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর হতে কুমিল্লা নামটি ত্রিপুররা পরিবর্তে পুরো জেলার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়।
No comments:
Post a Comment