যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত
যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার বরমা গ্রামে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের স্বনামধন্য আইনজীবী যাত্রামোহন সেন ছিলেন তাঁর পিতা এবং মা বিনোদিনী দেবী ছিলেন খ্যাতিমান চিকিৎসাবিজ্ঞানী, কলকাতা কারমাইকেল আর, জি, কর মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীরের কন্যা। মাসী কুমুদিনী ছিলেন বেথুন কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ।যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেন ভারতবর্ষের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ নেতার অন্যতম। পেশায় তিনি ছিলেন আইনজীবী কিন্তু নেশায় ছিলেন রাজনীতিক।যতীন্দ্রমোহন কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান এবং বিলাতের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাউনিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্নাতক ও পরের বছর আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। বিলাতে থাকাকালীন তিনি খেলাধুলা ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মে জড়িয়ে পড়েন এবং ইন্ডিয়ান মজলিসের বিতর্ক সভা ও ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যতীন্দ্রমোহন ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারি পাস করেন। বিলাতে অবস্থানকালে যতীন্দ্রমোহন পরিচিত হন গ্রে পরিবারের সাথে। এই পরিবারের নেলী গ্রে’র সঙ্গে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট যতীন্দ্রমোহন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।দেশে ফিরে যতীন্দ্রমোহন চট্টগ্রাম জেলা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এক বছর পর তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। এ সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা রিপন ল’ কলেজে অধ্যাপনা করেন। কলকাতা হাইকোর্টে তাঁর সুনাম ও প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ওই বছর চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হয়ে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত দলীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। সে সময় পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সৈন্যদের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সারাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। চট্টগ্রামেও আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। যতীন্দ্রমোহন কলকাতা ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেন তিনি তিন মাসের জন্য আইন পেশা ত্যাগ করবেন এবং চট্টগ্রামে এসে জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করবেন। কিন্তু চট্টগ্রামে এসে আন্দোলনে এতোটাই জড়িয়ে পড়েন যে পুরো দু’বছর তাঁকে পেশার বাইরে থাকতে হয়।১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ বছর বার্মা অয়েল কোম্পানি (চট্টগ্রাম) ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট পরিচালনা করে যতীন্দ্রমোহন গ্রেফতার হন। তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত আন্দোলনে যোগ দেন ও গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। ধর্মঘটী শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য যতীন্দ্রমোহন চল্লিশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। তিনি এ সময় ‘দেশপ্রিয়’ উপাধিতে ভূষিত হন। চট্টগ্রামের মানুষ তাকে ‘মুকুটহীন রাজা’ নামে আখ্যায়িত করেন।১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ থেকে বার্মাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে যতীন্দ্রমোহন রেঙ্গুন যান। সেখানে জনসমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। যতীন্দ্রমোহন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। পরবর্তীকালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করলে যতীন্দ্রমোহন স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন।১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর যতীন্দ্রমোহন স্বরাজ্যদলের অধিনায়ক ও কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পদ গ্রহণ করেন। তিনি পাঁচবার কলকাতা পৌরসভার মেয়র হয়ে মহানগরীর ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। আইন অমান্য আন্দোলনে তিনি কয়েকবার কারাভোগ করেন। ২৫ অক্টোবর আবার গ্রেপ্তার হন জালিয়ানওয়ালাবাগে। ৩০ অক্টোবর দিল্লী কোর্টের বিচারে ৬ মাস করে দু’বারে এক বছর কারাদণ্ড। তিনি দেশবন্ধু পরিচালিত ফরোয়ার্ড পত্রিকার সাথে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং নিজে অ্যাডভান্স নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।যতীন্দ্রমোহন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কিছুদিনের জন্য সস্ত্রীক লন্ডন যান। লন্ডন থেকে ফেরার পথে জাহাজ বোম্বে বন্দরে ভিড়তেই ব্রিটিশ পুলিশ ২০ জানুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহাত্মক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কিছুদিন কলকাতায় বন্দি থাকার পর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন তাঁকে রাঁচীতে স্থানান্তর করা হয়। দেড় বছর ধরে জেলে থেকে যতীন্দ্রমোহনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ব্রিটিশ সরকারের অবহেলা ও উদাসীনতায় একপ্রকার বিনাচিকিৎসা ও হয়রানির মধ্যে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই রাঁচি জেলে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের জীবনাবসান হয়।যাত্রামোহনের মৃত্যুর পর যতীন্দ্রমোহন বরমা ত্রাহি-মেনকা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়কে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন। ১৯৫৩ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম পরিষদ প্রতিবছর দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে। দক্ষিণ কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে ‘দেশপ্রিয় পার্ক’ ও পার্কের অভ্যন্তরে এই দুই কৃতি ব্যক্তিত্বের যুগল মূর্তি। জন্মস্থান চট্টগ্রামের বরমা গ্রামে বাড়ির সামনে স্থাপিত হয়েছে যাত্রামোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তর আবক্ষ মূর্তি।চট্টগ্রামের খ্যাতিমান লোককবি রমেশ শীল তাঁর কবিগানে উচ্চারণ করেছিলেন -‘নবীন সেন-যতীন সেন-সূর্য সেন-এই তিন সেন, চাঁটগাঁয়েরে বাংলাদেশের মাথায় তুলেছেন।’
Friday 22 January 2016
যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত / ড. মোহাম্মদ আমীন
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment