Translate

Friday 22 January 2016

জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম / ড. মোহাম্মদ আমীন

জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা-বিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দুর রহমান মায়ের নাম গুলমেহের। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।বাড়ির নিকটবর্তী এক প্রাইমারি স্কুলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের সূচনা। অতঃপর ভর্তি হন পাশের গ্রামের এলাহাবাদ স্কুলে। এখান থেকে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ওই বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন। মেট্রিক পাশ করার পর বড় ভাই আসহাব তাঁকে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করার পর কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মেডিকেল পড়াশোনা ব্যয়বহুল। তবে স্যার আদমজীর দেওয়া মাসিক বৃত্তি লাভের পর তাঁর মেডিকেল পড়ার পথ সুগম হয়। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ডাক্তারি পাস করেন এবং পিএসসি-র ইন্টারভিউ দিয়ে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মেধা তালিকায় শীর্ষে থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়োগ পান। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে লন্ডনের হুইটিংটন হাসপাতালে এমআরসিপি করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে টিডিডি কোর্স করেন।দেশে ফিরে তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে মেডিসিনের লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। সে সময় তাঁকে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদানের সুযোগ দিলেও তিনি লেকচারার থেকে কর্মজীবন শুরু করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান নাফিল্ড স্কলারশিপ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে লন্ডনে কাজ করে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিজি ইনস্টিটিউটে যুগ্ম পরিচালক হন এবং ১৯৬৬ সালে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। সুদীর্ঘ ২৪ বছর পিজি হাসপাতালে প্রফেসর ও পরিচালক হিসেবে কর্মরত থেকে দেশে-বিদেশে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলেন। শধু চিকিৎসক নন, একজন অসাধারণ সংগঠক হিসাবেও তিনি খ্যাত। তিনি যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং প্রতিষ্ঠাতা, ভাইস চ্যান্সেলর, সভাপতি, চেয়ারম্যান, সদস্য, ফেলো, উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন তন্মধ্যে ইসলামিক মেডিকেল মিশন, জনসেবা ফাউন্ডেশন, ইউএসটিসি, আধুনিক (আমরা ধূমপান নিবারণ করি) এবং হামদর্দ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল লন্ডনের হুইটিংটন হাসপাতালে এমআরসিপি কোর্স শুরু হয়৷ মেডিসিনে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে টিডিডি কোর্সে যোগদান করেন ও সে বছর জুনে পরীক্ষা দেন৷ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগে সুপি ডিউটিতে পোস্টিং করা হয়৷ ছয়মাস এভাবে কাজ করার পর মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে মেডিসিনের লেকচারার হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন৷ একই সাথে টিবি ওয়ার্ডের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়োগ পান।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তিনি প্রথম 'নাফিল্ড স্কলারশিপ' পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসাবে বিলাতে কাজ করে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পোস্ট গ্রাজুয়েট চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান৷ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের মেধা, শ্রম ও মনন দিয়ে এমনভাবে গড়ে তোলেন যে এটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
চিকিৎসা জগতের কিংবদন্তী এ খ্যাতিমান শিক্ষক সুদীর্ঘ ২৪ বছর আইপিজিএমআর (পিজি হাসপাতাল)-এর পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসাধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন আইপিজিএমআর-এর ফাউন্ডিং ফাদার ও রূপকার। আইপিজিএমআর বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন করেছিলেন এবং দেশে স্নাতকোত্তর চিকিত্সা ব্যবস্থার পথিকৃৎ। ধূমপান নিবারণের জন্য আধুনিক প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশে প্রথম প্রযুক্তি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন।
তিনি একজন লেখকও ছিলেন। তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে মেডিকেল ডায়াগনসিস অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট, স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু কথা, আইপিজিএমআর এর ইতিহাস, প্রেসক্রিপশন, জীবন স্রোতে, কিছু ভাবনা, প্রশ্ন উত্তরে তামাক ও ধূমপান, ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু টোবাকো কন্ট্রোল ইন বাংলাদেশ দি ম্যান বিহাইন্ড (জব্বার ও ইফতেখার সম্পাদিত) উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম যে সকল সম্মামনা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা পেয়েছেন সেগুলোর মধ্যে : প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডাল (১৯৬৩), সিতারায়ে-ইমতিয়ায, চট্টগ্রাম সমিতি কর্তৃক প্রদত্ত মেরিটেরিয়াস সার্ভিস মেডাল (১৯৮২), বাংলাদেশ সায়েন্স একাডেমী পদক (১৯৮২), রংধনু একাডেমী পদক (১৯৮৬), সমাজ সেবার জন্য দায়েমী পদক (১৯৮৬), ফজলুল হক মেমোরিয়াল পদক (১৯৮৭), ধূমপান বিরোধী আন্দেলনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গোল্ড মেডাল ১৯৯০ ও ১৯৯২, স্নাতকোত্তর চিকিত্সার জন্য ইবনে সিনা পদক (১৯৯৪), সমাজ সেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমাজ সেবা পদক (২০০০), বিসি রায় পদক (ভারত) ২০০১, প্রধানমন্ত্রীর সায়েন্স রাইটার পদক (২০০৫), রয়েল কলেজ অফ ফিজিসিয়নস, এডিনবার্গ কর্তৃক গোল্ড মেডাল (১৯৯৯) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক পদক (২০০৫) এবং চিকিত্সা ও সমাজ বিনির্মাণে তার অসামান্য অবদানের জন্য চন্দনাইশ সমিতি-ঢাকা কর্তৃক গুণীজন সম্বর্ধনা-২০১৩ পদক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশে অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মারা যান।

No comments:

Post a Comment