Translate

Saturday 23 January 2016

বরিশাল ও বরিশাল জেলার নামকরণ / ড.মোহাম্মদ আমীন


মোঘল আমলের পূর্বে বাকলা নামকরণের পূর্বে এলাকার নাম ছিল ‘চন্দ্রদ্বীপ’। চন্দ্রদ্বীপ নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে আলোচ্য এলাকার চন্দ্রকলার মতো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতো বলে এর নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। আবার অনেকে বলেন, জনপদটির আকৃতি চাঁদের ন্যায় ছিল বলে নাম চন্দ্রদ্বীপ। দনুজমর্দন দেব তার গুরু চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর কৃপায় রাজ্য লাভ করেন। তাই তিনি এর নাম রাখেন চন্দ্রদ্বীপ। আবার অনেকের মতে, রাজা চন্দ্রবর্মার নামানুসারে নামকরণ হয় চন্দ্রদ্বীপ। অনেকে ধারণা, মহাদেবের কপালে চন্দ্রের  কারণে নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত চন্দ্রগোমিনের নাম থেকে এ জনপদের নাম চন্দ্রদ্বীপ হয়েছে বলেও অনেকের অভিমত। তবে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, চন্দ্রভন্ড্র নামক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নামানুসারে এলাকাটির নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। 
মোঘল শাসনামলে আলোচ্য এলাকার নাম হয় ‘বাকলা’। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী ও র‌্যালফ ফিচের বিবরণে বাকলা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এবার বাকলা নামের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করা যাক। বাকেরগঞ্জের প্রাচীন নাম বাকলা। বাঙ্গালার পরিবর্তিত রূপ বাকলা। প্রাগৈতিহাসিক আমলে বাকেরগঞ্জের উত্তরাংশে বাঙ জাতিগোষ্ঠীভূক্ত লোক বাস করতো। বাঙ শব্দ চিনা বা তিব্বতীয় গোষ্ঠী হতে আগত। প্রাচীনকালে বাকলা জলাভূমি ছিল। বাঙ জাতির লোকেরা তিন হাজার বছর পূর্বে জলাভূমি আবাদ করে বসতি স্থাপন করতো এবং বন্যা ও লোনা পানি হতে রক্ষার জন্য আইল বা আল দিতো। বাঙ জাতির নামের সাথে আল যুক্ত হয়ে হয় বাঙাল। বাঙাল জাতির আদি বাসস্থান বরিশাল। এদের একটা গোষ্ঠীকে চন্দ্রভণ্ড্র বলা হতো। চন্দ্রভণ্ড্র হতে বাকলার অপর নাম চন্দ্রদ্বীপ। বাকলা ছিল এর লোকায়ত নাম এবং চন্দ্রদ্বীপ ছিল রাজনীতিক নাম। ‘বাকলা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ শস্য ব্যবসায়ী। আলোচ্য এলাকাটি ছিল ধনধান্য ও শস্যে ভরপুর । তাই এখানে প্রচুর বাকলা বা শস্য ব্যবসায়ীর আগমন ঘটত। তাই এলাকার নাম হয় বাকল। অনেকের মতে বাকাল এক প্রজাতির সাপ। এ বাকাল হতে বাকলা নামের উৎপত্তি। আবার কারও কারও মতে গাছের বাকল হতে বাকলা নামের উদ্ভব। আলোচ্য এলাকাটি ছিল আবার কারো মতে, বাকাল নামক এক ধরে নর সাপের নাম থেকে ‘বাকলা’ নামের উদ্ভব। মধ্যযুগের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপূরাণ বা মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে বাকলা নামের উল্লেখ আছে। অবশ্য মোগল আমলে বাকলা ইসমাইলপুর নামেও অভিহিত হতো।

নবাব আলীবর্দি খার আমলে আগা বাকের খান বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের বুজর্গ উমেদপুর পরগণার জমিদারি লাভ করে। আগা বাকের ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে সুগন্ধার শাখা নদী খয়রাবাদ নদীর তীরে নিজ নামে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন নাম দেন বাকেরগঞ্জ। বাকেরগঞ্জ বন্দরের গুরুত্বের কারণে বাকলা তার পূর্ব গৌরব ও পরিচিতি হারিয়ে ফেলে এবং পুরো এলাকা বাকেরগঞ্জ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
বরিশাল নামকরণ নিয়ে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে।বাকলা অঞ্চল লবণ উৎপাদন ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবসার জন্য প্রাচীনকাল হতে বিখ্যাত ছিল।শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি ছিল গিরদে বন্দর। গিরদে অর্থ একটি নির্দিষ্ট এলাকা। গিরদে ছিল বরিশালের প্রাচীন একটি নাম। এখানে লবণের বড় বড় গোলা ছিল। গিরদে ছিল দক্ষিণ বাংলার লবণ শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি। ইউরোপীয় বণিকগণ গিরদে বন্দরকে বড়িশল্ট বলতে। অনেকে মনে করেন, বড়িশল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নাম ধারণ করে। আবার অনেকের মতে, এখানকার লবণের দানাগুলো বড় ছিল। তাই ইংরেজগণ এখানকার লবণকে বড়িশল্ট বলতেন। যা হতে বরিশাল নামের উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীনকালে বরিশালে বড় বড় শাল বৃক্ষ ছিল। তাদের মতে বড়শাল বৃক্ষ হতে এলাকার নাম হয় বরিশাল। বরিশাল নামের আর একট কিংবদন্তি বেরি নামের এক পর্তুগিজ যুবক ও শেলি নামের এক পর্তুগিজ কন্যার নামের সাথে সম্পৃক্ত। বেরী নামের এ যুবক শেলীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বেরি আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় ‘বেরিশেলী’ যুগল নাম তখন লোকের মুখে মুখে। ‘বেরীশেলী’ই পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়। কারো কারো মতে, শঅল অর্থ গৃহ, বরিশালে বড় বড় গৃহ নির্মিত হয় বলে এর নাম বড়শাল বা বরিশাল। আলোচ্য এলাকাটি একসময় ঘন জঙ্গলে আচ্ছন্ন ছিল। জঙ্গল পরিষ্কার করে এ জনপদের পত্তন হয়। জঙ্গলে প্রচুর বাঘ ছিল। স্থানীয় লোকজনের কাছে বাঘ বড় শিয়াল নামে পরিচিত ছিল এবং এর আঞ্চলিক উচ্চারণ ছিল বশিয়াল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে ‘বশিয়াল’ অর্থ বাঘ নির্দেশ করেছেন। কথিত হয়, এ বশিয়াল বা বড় শিয়াল থেকে বরিশাল নামের উদ্ভব। আবার অনেকের ধারণা, বুকরি চাল নামক এক প্রকার মোট জাতের চাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভ। এক সময় আলোচ্য এলাকায় প্রচুর বুকরি চাল উৎপন্ন হতো। কথিত হয়, এ বুকরি চাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভব। অন্য একটি প্রবাদমতে, বরিষার কাল বা বর্ষাকাল হতে বরিশাল নামের উদ্ভব। ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ‘বাংলাদেশের জেলা উপজেলা ও নদ নদীর নামকরণের ইতিহাস’ গ্রন্থে আরও বিস্তারিত আছে। 

No comments:

Post a Comment