Translate

Saturday 23 January 2016

ভাইস চ্যান্সেলরের চোখে ইতিহাসবেত্তা ড.মোহাম্মদ আমীন / প্রফেসর গিয়াসুদ্দিন।

চকরিয়ার বিজ্ঞ উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মোহাম্মদ আমীন চকরিয়া নিয়ে কাজ করছেন। তিনি তখন ডক্টরেট ছিলেন না, করছিলেন।অফিস সময়ের পর তিনি বেরিয়ে পড়তেন কাগজ-কলম নিয়ে রিক্সায় চড়ে কিংবা কোনো সহকর্মীর মোটর সাইকেলে চড়ে। উদ্দেশ্য চকরিয়ার ইতিহাসের সন্ধান। আমরা শিক্ষকদের অনেকে তাঁর এ কাজের ভূয়শী প্রশংসা করতে শুরু করি এবং প্রয়োজনে সকল সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত থাকি। চকরিয়ার ইতিহাস রচিত হলে তা হবে আমাদের জন্য এক বিরাট পাওয়া। তবে অনেকে সমালোচনাও শুরু করেছেন। অন্য জেলার লোক কেন আমাদের উপজেলার ইতিহাস লিখবেন? তিনি ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষক নন- ইতিহাস লেখার জ্ঞান কোথায়! আরও নানা জনের নানা কথা। কেউ কেউ বললেন- বই বিক্রি করে আয় করার ফন্দি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কানে এসব গিয়েছে, তবু তিনি কাজ চালিয়ে গেছেন। ভালো কাজে খারাপ কাজের চেয়ে বেশি বদনাম সইতে হয়। এটি প্রসব যন্ত্রণা। তিনি এগিয়ে যান তাঁর লক্ষ্যে। 
ড. আবদুল করিম (১৯২৮-২০০৭)
জনাব আমীন ছাত্জীরবন হতে লেখালেখিতে জড়িত। আমাদের উপজেলা হতে অল্পদূরে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় তার বাড়ি, তিনি বেশ শিক্ষিত, বনেদি ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। আমি চকরিয়া কলেজের শিক্ষক। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে ইতিহাসের তথ্য নিয়ে আলোচনা হয়, অনেক সময় আমিও তথ্য সংগ্রহে তার সাথে যাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, চকরিয়ার ইতিহাস রচনায় তাকে সহায়তা প্রদান। অনেকে এটি প্রকাশের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমি এ বিষয়ে আলাপ করিনি। একদিন তিনি আমার হাতে একটা পাণ্ডুলিপি দিলেন। চকরিয়ার ইতিহাস। পাণ্ডুলিপি দেখে আমি রীতিমতো হতভম্ব। ইতিহাস রচনা হয়ে গেছে, এখন প্রকাশের পালা। কীভাবে এটি সম্ভব হলো? মনের প্রশ্ন মনে রেখে দিই। তাঁর সম্পর্কে যা শুনেছি, তার অর্ধেক সত্য হলেও এটি তেমন কঠিন নয় জনাব আমীনের কাছে।বিনয়ের সঙ্গে বললাম, যদি অনুমতি দেন তো, আমি বইটি প্রকাশ করব।আমার কথায় তিনি রাজি হলেন।
প্রকাশ হয়ে গেল ‘চকরিয়ার ইতিহাস’। প্রকাশক আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন কন্ট্রকটার। প্রকাশ হওয়ার চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। আলোচনা, সমালোচনা, প্রশংসা- সব। এরপরের ঘটনা আনোয়ার হোসেন কন্ট্রকটারের জবানিতে শোনা যাক : বইটি কেমন হয়েছে জানার জন্য একদিন এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আবদুল করিম সাহেবের কাছে নিয়ে যাই। ড. করিম আবার আমার আত্মীয়। তিনি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর  থেকে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরউপাচার্য পদে নিযুক্ত ছিলেন। জনাব আবদুল করিমের (জন্ম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন)  গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলা বাঁশখালী উপজেলা চাপাছড়িতে ভিন্ন উপজেলা হলেও, ভৌগলিক দিক হতে উভয় উপজেলার অনেক মিল ছিল। একসময় নাকি দুটো উপজেলা অভিন্ন ছিল।যাই হোক, ড. করিম, জনাব মোহাম্মদ আমীনের লেখা ‘চকরিয়ার ইতিহাস’ বইটি পড়তে শুরু করেন। আস্তে আস্তে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি বইয়ে একাগ্র হয়ে পড়েন। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর বই হতে মুখ তুলে বলেন : মোহাম্মদ আমীন কে? 
আমাদের উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট।প্রশাসন ক্যাডারের লোকের পক্ষে কীভাবে এমন তথ্যবহুল ইতিহাস লেখা সম্ভব হলো? এরা তো এত জ্ঞানী ও দূরদর্শী নন। এমন ছেলে কেন অ্যাডমিন ক্যাডারে গেল?প্রশংসা শুনে আমি খুশিতে হাসছি। ড. করিম বলেই যাচ্ছিলেন : আনোয়ার, এ তো অবিশ্বাস্য, আমি তো এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস আর দেখিনি। অ্যাডমিন ক্যাডারেও তাহলে মেধাবীদের কেউ কেউ যায়!ড. করিমের এমন প্রশংসা আমাকে প্রকাশক হিসাবে গর্বে অভিভূত করে দেয়। আবার পড়তে শুরু করেন তিনি। আরও আধঘণ্টা পড়েন, তারপর মুখ তুলে বললেন : ছেলেটাকে ডেকে নিয়ে আসেন, আমি তার কাছ থেকে ইতিহাস লেখার এমন অদ্ভুদ কৌশলটা শিখব।তিনি যে কৌশলে ইতিহাস লিখেছেন, সেটি আয়ত্তে আনা কঠিন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক লেকচার দিয়ে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। মাঠ
পর্যায়ে মাঠে থেকে কাজ করতে করতে তা জানতে হয়। তিনি কী আরও কোনো ইতিহাস লিখেছেন?লিখেছেন। হাতিয়ার ইতিহাস।হাতিয়ার উপর আমি কাজ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু একটা তথ্যও সংগ্রহ করতে পারিনি। এ ছেলে তো বিপ্লব ঘটিয়ে দিল। যত তাড়াতাড়ি পারেন তাকে নিয়ে আসেন।নিয়ে আসব।ইতোমধ্যে চা এসে যায়।চায়ে ভিজিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে ড করিম বললেন: এটি কেবল নামেই ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে এটি শুধু ইতিহাস নয়, বৈচিত্র্যহাস; ভূগোল, জনমিতি, ধর্ম, বিবর্তন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ক্রমবর্ণনা, জনজীবনে সমুদ্রের প্রভাব, শরণার্থী, প্রস্তর যুগ হতে বঙ্গযুগ- সব বিবরণ এমন নির্ভুল তথ্যসহকারে তুলে ধরেছেন, যা আমার পক্ষে এত চমৎকারভাবে সম্ভব হতো না কখনও।ছেলেটিকে নিয়ে আসুন। আমি তার সঙ্গে একটু কথা বলব, আমার শেষ ইতিহাসের কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে।কয়েকটি বিষয়ে আটকে গেছি।
ড. আমীনকে আমি করিম সাহেবের প্রশংসার কথা বলেছিলাম।তিনি খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ড. করিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। কিন্তু আজ-কাল করে যাওয়া হয়নি। শেষপর্যন্ত ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই ড. আবদুল করিম চিরদিনের জন্য আমাদের সাক্ষাতের বাইরে চলে যান। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।                                    
এখন ‘চকরিয়ার ইতিহাস’ বইটির প্রবল চাহিদা। লন্ডন, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, জাপানসহ পৃথিবীর অনেক দেশে চকরিয়ার অনেক লোক আছে। তারা আমাকে ফোন করেন, ফোন করে বইটি পাঠানোর অনুরোধ করেন। আমি গর্ব বোধ করি। এমন সম্মানজনক ও স্থায়ী কাজ আমার পক্ষে আর কখনও করা সম্ভব হবে না। বইটির মাঝে আমি বেঁচে থাকব।বেঁচে থাকবে বইটির লেখক ড. মোহাম্মদ আমীন। যতদিন চকরিয়ার থাকবে, ততদিন আমরা চকরিয়ার স্মৃতি আমাদের কাজে অক্ষয় হয়ে থাকবে। মরণশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে! চকরিয়া আজ পূর্ণ ইতিহাসে ঋদ্ধ, সারাবিশ্বে চকরিয়ার ইতিহাস আমাদের ঐতিহ্যকে আলোর মতো অফুরন্ত জ্ঞানে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই আমি মনে আমার প্রকাশনায় প্রকাশিত ও ড. মোহাম্মদ আমীনের লিখিত চকরিয়ার ইতিহাস চকরিয়াবাসীর ‘ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদা’ অনিবার্য প্রতীক।
-----------------------------------------------------------------------------------------
কৃতজ্ঞতা : ‘চকরিয়া উপজেলার ইতিহাস’- এর লেখক কন্ট্রকটার আনোয়ার হোসেনের লেখা থেকে। 

No comments:

Post a Comment