হঠাৎ এবং বলা
যায় বেশ আকস্মিকভাবেই ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’র সঙ্গে আমার পরিচয়। এটি একটি অনলাইন গ্রুপ।
গ্রুপটির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক এ পরিচয় আমার কাছে নতুন দিগন্তের শুভ সূচনা,
অভিজ্ঞতার নিলয় কেতন। গ্রুপের কার্যক্রম, অ্যাডমিন প্যানেল ও সদস্যদের বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গী
আমার দুটি চোখে অসংখ্য চোখের দ্যোতনা এনে দেয়। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে সৃষ্টির যে
দুরন্ত ইতিহাস ও অতলান্ত নজির গ্রুপটি তুলে ধরেছে- তা অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে আমাকে টেনে
নিয়ে যায় গ্রুপটির গভীর হতে আরও গভীরে। রাতে গ্রুপটির পোস্ট পড়া শুরু করি। পড়তে
পড়তে অনেক রাত হয়ে যায়, অনেক রাত। রাতের খাওয়ার জন্য ডাকছিল, কিন্তু যেতে পারছিলাম
না, উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না গ্রুপ ছেড়ে। গ্রুপের পরতে পরতে জানা-অজানা শিহরিত বিষয়গুলোর
বর্ণীল ছটা আমার খাদ্য ক্ষুধাকে খেয়ে ফেলে নিমিষে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সবাই খেয়েদেয়ে
ঘুমিয়ে পড়ে। আমি পড়তে থাকি আগ্রহের সীমাহীন ভাবালুলতায়। গ্রুপ তবু শেষ হয় না, রাত শেষ
হয়ে যায়। আসলে, এ গ্রুপ শেষ হওয়ার নয়। কখনও শেষ হবে না, এর জন্ম সৃষ্টির জন্য, স্বপ্নের
জন্য, প্রকৃতির লাস্যে সবুজ মাঠে নদীর স্রোতের মতো রূপলী মৎস্যের চঞ্চলতা অবিকল
রাখার জন্য। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ চিরন্তন, শেষ হয় কীভাবে?
বস্তুত অনলাইন
গাটতে গিয়ে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ কথাটি দেখে থমকে গিয়েছিলাম। কারণ ছিল থমকে যাওয়ার।
অনেক বছর আগে আমি হাতিয়ায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন ‘তিলোত্তমা হাতিয়া : ইতিহাস
ও ঐতিহ্য” নামে একটি গ্রন্থ লিখেছিলাম। তাই ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ নামটি আমাকে থামিয়ে
দেয়। তারপর গ্রুপের পেইজগুলো আমাকে পরম আনন্দে উদ্বেল করে রাখে। দেখতে দেখতে এবং
পড়তে পড়তে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। এ কী গ্রুপ? শুধু পেইজ? না এটি শুধু গ্রুপ নয়,
লেখাগুলো শুধু লেখা নয়- জীবনের অভিধানে অনিবার্য মাধুর্য। এটি হাতিয়ার প্রতিভূ এবং
প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবায় থাবায় অপরাজেয় হয়ে উঠা হাতিয়ার মানুষের সংকল্প নিনাদিত
উত্তর পুরুষের উত্তরদ্রোহ; বাংলাদেশের সতের
কোটি মানুষের চেতনা, সার্বিক কল্যাণের লালিত্যে
প্রেমের মাধুরী আর সৃষ্টির সৌকর্ষে দ্রোহের বহ্নিশিখা।
যতটুকু জানতে পারি, মাহবুব, শিবলু,
নিশান, জুয়েল ও সুমন নামের পাঁচজন স্বপ্নাচারী কিন্তু বাস্তববাদী তরুণ প্রকৃত অর্থে
প্রথমে, কোনোরূপ পরিকল্পনা ছাড়াই ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রুপটি গড়ে তুলেছিল। কয়েক
দিনের মধ্যে তাদের আদর্শ, প্রতীতি ও অনিমেষ ঐকান্তিকতার মহৎ মিথষ্ক্রিয়া বিপ্লবের
মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনলাইনের কারণে তা বিদ্যুৎগতিতে চমকে উঠে। ঝঙ্কৃত করে দেয় হাতিয়া,
বাংলাদেশ এবং বিশ্ব। পৃথিবীতে এখন এমন দেশ খুব
কমই আছে, যে দেশে ‘তিলোত্তমা
হাতিয়া’ গ্রুপের সদস্য নেই। এমন সফলতা দেখে গ্রুপের প্রারম্ভিক অ্যাডিমনগণ উৎসাহিত
হয়ে ওঠে। সংগতকারণে তারা নিজেদের আরও নিবেদিত করার প্রেরণা পায়। ফলে ‘তিলোত্তমা
হাতিয়া’কে তারা শুধু গ্রুপে সীমাবদ্ধ না
রেখে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার ও চেতনার শ্বাসত বিকাশের অবিরাম আন্দোলনের যুগোপযোগী
মাধ্যমে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়। মূলত পৃথিবীর প্রত্যেক মহৎ আন্দোলনই এভাবে গড়ে
উঠেছে। লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার কৌশল হিসাবে তারা ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বাস্তব জগতের
মিলন ঘটানোর বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ আরও গতি পায়। ভার্চুয়াল
জগত নেমে আসে মাটির ধরায়। এ যেন স্বর্গ হতে মর্ত্যে দেবতার আগমন। গ্রুপের মাধ্যমে
শুরু হয়ে যায় সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাতিয়ার
লোকজন গ্রুপের কর্মকাণ্ডে উজ্জীবিত হয়ে উঠে। দলে দলে যোগ দিতে শরু করে অনলাইনভিত্তিক
গ্রুপ ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’র ছায়ায়। এখন গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছয় লাখ ১০
হাজারের অধিক এবং পরিচালক ২৫। হাতিয়ার
শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পর্যটন, সৌন্দর্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরাই
ছিল গ্রুপের অন্যতম প্রারম্ভিক উদ্দেশ্য। এখন গ্রুপ এ উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়ে গেছে।
নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগিতা গ্রুপটিকে দিন দিন আরও বিকশিত করছে। ‘তিলোত্তমা
হাতিয়া’ এখন শুধু সেবায় আনত নয়, অন্যায়,
অনিয়ম, জুলুম, নির্যাতন প্রভৃতির বিরুদ্ধেও দ্রোহের মতো সোচ্চার। ছবি আর লেখনির
মাধ্যমে তুলে ধরেন সমাজের অবস্থা, নির্ভয় অবলীলায় ছুটে যান যেখানে দলিত হয় মানুষ,
মথিত হয় প্রকৃতি। সবাই উদার উদারতায় ছুটে যান অসহায় মানুষের কল্যাণে, দুর্গতদের
সাহায্যে। হাতিয়াকে হাতিয়ার
মতো লালিত্যে উপস্থাপন করে গ্রুপটি হাতিয়ার সৌন্দর্য ঐতিহ্য ও স্বকীয়তাকে বিশ্বময়
উদ্ভাসিত করে দিয়েছে। প্রাচীনকাল হতে স্বকীয় মর্যাদার অধিকারী, প্রবীণ ও বিগত
হাতিয়াবাসী তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গেছেন- গ্রুপটির ৬ লাখ ১০
হাজার সদস্য ও তাদের কর্মকাণ্ড এটা আবারও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে।
একটা গল্প বলি, না,
গল্প নয় ঘটনা। জনৈক কাউসার কয়েক বছর যাবত কানের সমস্যায় ভুগছিলেন।অপারেশন জরুরী হয়ে পড়েছিল। খবর নিয়ে জানতে পারেন জাতীয় নাক,কান
ও গলা ইনস্টিটিউটের পরিচারক ডাঃ জাহিদুল আলম
হাতিয়ার'ই সন্তান।কিন্তু তিনি কোনভাবেই
পরিচালক সাহেবের সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলেন
না। তখন কাউসার "তিলোত্তমা হাতিয়া"
গ্রুপের সাহায্য চেয়ে পোস্ট করেন। এরপর কী
ঘটেছে তা কাউসারের জবানিতে শোনা যাক : আমার পোস্ট দেখে সেদিন অনেকেই অনেক ভাবে আমার
দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে "তিলোত্তমা হাতিয়া”র অ্যাডমিন
প্যানেল থেকে নিশান ভাই, শিবলু ভাই, জুয়েল ভাই, সাঈফ ভাইসহ অনেকেই। কেউ ঠিকানা দিয়ে,
কেউ ফোন নাম্বার দিয়ে, কেউ রেফারেন্স দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সত্যি বলতে কি আমি
কখনও ভাবতেই পারিনি এই গ্রুপের সদস্যরা এতটা আন্তরিকভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসবেন।” তিলোত্তমা
হাতিয়া গ্রুপের সহায়তায় কাউসারের অপারেশন এমনভাবে সম্পন্ন হয় যেন, গ্রুপের সব অ্যাডমিনই তার
নিকটাত্মীয়। তাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ কাউসারের আবেগময় প্রকাশ : "ফেসবুকের কোটি
কোটি গ্রুপের মধ্যে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ আমার দেখা সবচেয়ে আন্তরিক গ্রুপ"।
কী নেই এ গ্রুপে?
সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, পরিবেশ, নৈতিকতা, সমাজ, পরিবার,
রাষ্ট্র, জাতি, দেশ, মাটি, নদী, প্রাত্যহিক জীবনের স্বাদ-বিস্বাদ, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা,
দলিত মানুষের হাসি-কান্না, শোষক শ্রেণির চরিত্র, রাজনীতির কুটিলতা, লোভীদের হায়েনাপনা,
ভালো মানুষের ভালবাসা, মন্দ লোকের হীনম্মন্যতা- সব আছে। এখানে সবকিছু মিলেমিশে অথচ
অদ্ভুদ কৌশলে পৃথক অবয়বে আপন স্থানে বিপুল আশার বাণী হয়ে ছড়িয়ে, মাতিয়ে, নাড়িয়ে
এবং এগিয়ে। নামে গ্রুপ হলেও ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ প্রকৃতপক্ষে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের
কোলে নির্যাস বৈশ্বিকতার চিরন্তন আলাপ যেন। এটি অতীত হয়ে সুদূর ভবিষ্যতের বিদুর সেতুবন্ধন।
ফলে এর বিদ্যমানতা সর্বত্র - শিল্পের নান্দনিকতা হতে শুরু করে কৃষকের লাঙ্গলে আর কুলবধূর
কলসী হতে দুর্গতদের ভাঙ্গা নীড়ে।
‘তিলোত্তমা
হাতিয়া’র ছয় লাখ দশহাজারের অধিক সদস্য। সংখ্যাটি হাতিয়ার জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
তার মানে বাংলাদেশের শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর একটি বৃহদংশ এ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত।
দেশপ্রেমের দৃঢ়কঠিন অঙ্গীকারে গ্রুপটি অনল প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ঐতিহ্য তাদের
স্তম্ভ হয়ে অনাগত দিনকে স্বপ্নীল মায়ায় প্রশান্তময় করে তুলতে বিভোর। হাতিয়ার প্রতি
তাদের ঐকান্তিক ভালবাসার মৃণ্ময় দায়বদ্ধতা গ্রুপটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। হাতিয়াকে
তারা ভালবাসে প্রাণের চেয়েও, তাদের এ ভালবাসা নিঝুম দ্বীপের হরিণ চকিত আখির তড়িৎ
চাঞ্চল্য হয়ে হাতিয়ার সবুজ প্রান্তরকে অন্তর করে, সারা বাংলাদেশে রক্তিম আবেগের বন্যা
এনে দিয়েছে, উল্লাস বিলাসে। সালাহউদ্দিন আহমেদের ভাষায় :
“এই আমার সবুজ শ্যামল গ্রাম এই আমার বাংলা।
গ্রামের সবুজ-শ্যামল নয়নাভিরাম দৃশ্য না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ি,
ধন্য আমি ধন্য এমন একটি গ্রামে আমার জম্ম.........”
যেদিক
দিয়ে বিবেচনাকেরা হোক না কেন, নিঃসন্দেহে ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ অসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী
একটি অনলাইন গ্রুপ। যে গ্রুপটি অনলাইন হতে মানুষের অন্তরের গভীরতায় স্থান করে নিতে
সক্ষম হয়েছে, সে গ্রুপটির পক্ষে যে কোনো কিছু করা সম্ভব। এটি বাংলাদেশের তরুণ
প্রজন্মের কাছে একটি উদহারণ হয়ে থাকবে। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ ভার্চুয়াল হলেও
কাউসারের চিকিৎসা, দূর্গতদের সাহায্য, অসুস্থদের সেবা, শীতার্তদের বস্ত্রদান
কোনোটাই ভার্চুয়াল নয়। এর প্রতিটি সত্যের মতো নিরেট এবং জীবনের মতো বাস্তব। ভার্চুয়াল
জগতকে বাস্তব জগতে নিয়ে এসে মানুষের সেবা করার এমন জলন্ত প্রমাণ যে গ্রুপটি রাখতে
পারে – সেটি কত কার্যকর একটি গ্রুপ তা সহজে অনুমেয়। আমার জানামতে, বাংলাদেশে এমন
গ্রুপের সংখ্যা খুব কম, নেই বললেই চলে। তাই ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ অনলাইন গ্রুপ মাত্র
নয়; এটি একটি আন্দোলন, একটি বিপ্লব এবং জনপদের প্রাগ্রসর একদল মহীয়ান তরুণের
স্বপ্ন-মঞ্জরির স্বপ্ন-শিরা বেয়ে বাস্তবে নেমে আসা সীমাহীন কল্যাণের দৃঢ় প্রত্যয়।
একটি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আবশ্যক। গ্রুপে অনেক পোস্টে শব্দের বানানে ভুল পরিলক্ষিত হয়। এটি একটি অনেক বড় গ্রুপ। এতবড় একটি গ্রুপের প্রভাব
অনেক বেশি। তাই শব্দের
প্রমিত বানানে আরও গভীরভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আর একটি
বিষয় হচ্ছে পোস্ট। কিছু কিছু পোস্ট ও ছবি গ্রুপে রয়েছে, যা গ্রুপের উদ্দেশ্য, প্রভাব ও বৃহত্তর
পরিসর বিবেচনায় অনুমোদন করা সমীচীন মনে হয়নি। এ বিষয়টির প্রতিও সচেতন থাকা
প্রয়োজন। কারণ, এখানে একটি ভুল বানান কিংবা একটি অপ্রাসঙ্গিক পোস্ট ছয় লক্ষাধিক
মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, তিলোত্তমা হাতিয়া’ এখন একটি প্রচণ্ড
প্রভাবশালী গ্রুপ। তাই তাদেরকে অবশ্যই বানান যাতে ভুল না-হয় এবং পোস্ট যাতে
গ্রুপের মতোই মানসম্মত হয় সেটি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
লেখক পরিচিতি : উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাহিত্যিক, গবেষক, ভাষাবিদ, ইতিহাসবেত্তা ও জীবনীকার।
No comments:
Post a Comment