Translate

Tuesday, 2 April 2013

পদোন্নতি / ড. মোহাম্মদ আমীন

পদোন্নতি
ড. মোহাম্মদ আমীন
হামিদ সাহেবকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান মুখলেস: আসসালামুআলাইকুম। কেমন আছেন স্যার।
হামিদ সাহেব চোখে হাসির রেখা টেনে মাথা দোলান: ভালো। তুমি কেমন আছো।
গদিআঁটা চেয়ারটা হামিদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মুখলেস বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। চকচকে পাদুকাদ্বয়ে গর্বিত মুখাবয়ব। সামনে দাঁড়ানো হামিদ সাহেবের একাংশ যোগ্যতা থাকলেও তিনি দশ বছর আগে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হতেন। পদ মানে পা; এ পদই সব, মস্তক অনর্থক, বোঝা বৈ কিছু নয়। পদের জোরে তিনি এখন সচিব। তাই পদোন্নতি, মানে পদের উন্নতি। মস্তক দিয়ে কিছু হয় না। নইলে হামিদ সাহেবের মতো মস্তকধারী এখনও উপসচিব কেনো?
কেনো মস্তকোন্নতি হয়নি?
পদভাগ্যের গর্বিত অহঙ্কারে আপ্লুত মুখলেস সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কবুতরের মতো নিবিড় গভীরে কেঁপে উঠেন আনন্দে। পদোন্নতির মজাই আলাদা; চকচকে জুতো দিয়ে বাঁকা বিশ্রি পা দুটো ঢেকে রাখার মতো মধুর।
অনুষ্ঠান শুরু হয়নি।
অতিথিরা দর্শক সারিতে বসে। সচিব মুখলেস সাহেবের ব্যবহাওে উপসচিব হামিদ সাহেব খুশি হয়েছেন কিনা বুঝা যায় না। চোখের পাতা ধাবমান গিরগিটির লেজের চেয়ে দ্রুত নড়ছে। এটি খুশির লণ নয়, উপহাসের; কষ্টের নয়, নষ্টের। বাঘ বিড়ালের মতো, পণ্ডিত মুর্খের মতো কিংবা রাজা ভিুকের মতো আচরণ করলে চোখের পাতা এমন কাণ্ড ঘটায়।
আমি স্যার এখন স্বরাষ্ট্র সচিব, কয়েক মাস আগে জয়েন করলাম।
হামিদ: পত্রিকায় দেখেছি।
মুখলেশ: আপনার পোস্টিং কোথায় স্যার?
আমি তোমার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। এ অনুষ্ঠানে তো বাবা অন্য মন্ত্রণালয়ের অফিসারদের ডাকা হয়নি। আন্দাজ দিয়ে হলেও বুঝা নেয়া উচিত, নাকি! তুমি ঠিক আগের মতই বোকা রয়ে গেলে। অথচ সচিব ঠিকই হয়ে গেছো।
আপনাকে তো স্যার মন্ত্রণালয়ে দেখিনি।
তুমি সচিব, আমি উপসচিব। বিরাট মন্ত্রণালয়, না ডাকলে তোমার-আমার দেখা হবার সুযোগ কই?
সচিবের আচরণে হলরুমের সবাই অবাক। পুলিশ সচিবের আচরণে পুলিশ অতিথিদের চোখ ছানাবড়া। এ কেমন সচিব, উপসচিবকে স্যার ডাকেন!
উপসচিব কখন সচিবের বড় হয়ে গেলেন?
নিজে নিজে প্রশ্ন করে আতঁকে উঠেন সিনিয়র সহকারী সচিব জব্বার। আট বছর আগে চাকরিতে ঢুকেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, ইচ্ছা ছিল পুলিশ হবেন। হতে পারতো, মা-বাবার জন্য পারেননি। পরীার হলে ম্যাজিস্ট্রেটের ডিউটি-মতা দেখে পাড়াপড়শিরা সারাণ ম্যাজিস্ট্রেট বন্দনায় মেথে থাকতো। এ রোগ বাহিত হয় শিক পিতা শাহেদ আলীর মনে। প্রাইমারি স্কুলে ম্যাজিস্ট্রেট এলে উপজেলা বস পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকতেন। তিনি দেখেছেন ম্যাজিস্ট্রেটের ইজ্জত, মতা এবং শানশওকত। জন্মের পর থেকে জব্বারকে ম্যাজিস্ট্রেট করার পণ। সাথে ভিড়েছেন মা। 
বিসিএস পরীার আবেদন পূরণ করার সময় পিতা শাহেদ আলী নিজে দাঁড়িয়ে প্রশাসন ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে রাখতে ছেলেকে বাধ্য করেন। প্রতিবাদ করেছিলেন জব্বার।
বাবা, প্রশাসনের সে আগের দিন নেই।
প্রশাসন রাজকীয় ক্যাডার। সরকারের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। হাতি মরলেও লাখ টাকা।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও যোগ দিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারে। ঢুকে বুঝতে পেরেছেন প্রশাসন রাজকীয় ক্যাডার নয়। ীয়মান ক্যাডার। এর ‘কীয়’ আছে; ‘রাজ’ খসে পড়েছে। পাশের বাড়ির মুন্সি মিয়ার ছেলে ইমরান ফরেন ক্যাডারে। জব্বারের দুই বছর জুনিয়র; সে এখন পরিচালক। জব্বার সহকারী পরিচালক। ফরেন ক্যাডারে গেলে জব্বার মহাপরিচালক থাকতো। মানে এ্যামবেসেডার। মাইজ পাড়ার সুমন পুলিশ সুপার। একটা জেলার মা-বাপ। সে ইমরানেরও জুনিয়র। শাহেদ আলী এখন কপাল চাপড়ায়।
শাহেদ আলী বাজারে গেলে সালাম পায় দশটি। ইমরান আর সুমনের বাবা পায় একশ করে দুশো। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। যে দশটি সালাম পায় তাও শিক হিসেবে। ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ হিসেবে নয়। ইমরান পাড়ার বিশজন লোককে বিদেশ নিয়েছে। সুমন ত্রিশ জন যুবককে পুলিশে ঢুকিয়েছে। জব্বার কাউকে চাকরি দেয়া দূরে থাক নিজের ছোট বোনের স্বামী রমজানের বদলিটা পর্যন্ত ঠেকাতে পারেনি। সংসার ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়েছিলো। ব্যর্থ জব্বারকে নিয়ে বোনের কাছে কেটেছে: কেমন ভাই তোমার? বালকাটা ম্যাজিস্ট্রেট; বদলিটা পর্যন্ত টেকাতে পারলে না?
বদলিটা দেখতেন একই ক্যাডারের সিনিয়র জাহাঙ্গীর সাহেব। তার কাছে পাঠিয়েছিলেন রমজানকে। কাজ তো করেননি বরং অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। রমজান অপমানের শোধ নিয়েছে স্ত্রীকে পিঠিয়ে। বোন বাড়ি এসে জব্বারের পায়ে ধরে কেঁদেকেটে একাকার: একটু দেখিয়ে দেন আপনার মতা।
অসহায় জব্বার সুমনের শরণাপন্ন হয়। পুলিশের এসপি, ডাণ্ডার জোর; বলার সাথে সাথে ছোট রমজানের বদলি বাতিল করে দিয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের জব্বারের এক ব্যাচ আগের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন।
আমি তোমার খুব তি করেছি।
জব্বার: পুলিশে গেলে আমি এখন ডিজি, বিভাগের মা-বাপ। এসপি-ডিসি আমার কথায় উঠতো-বসতো। সত্যি, বাবা তুমি আমার বড় তি করে ফেলেছো। গ্রাম্য মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণে এমনটি হয়েছে।
ডিসি বড় না এসপি বড়?
একই পাবলিক ডিসির সামনে বসে ওসিকে স্যার এবং ডিসিকে ডাকে ভাই। নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি। ম্যাজিস্ট্রেসি চলে যাবার পর ডিসির এব্রিভিয়েশনই চেইঞ্জ হয়ে গেছে বাবা। ডিসি মানে ডেইজ সেলিব্রেটর।
মুখলেস: স্যার, আগামীকাল আমার সাথে দেখা করবেন।
হামিদ: তুমি বসো। আমি পাশের চেয়ারে বসি।
না স্যার, আপনি আমার চেয়ারে বসুন।
মুখলেস হামিদ সাহেবের সহকারী সচিব ছিলেন। পটুয়াখালীতে ডিসি থাকাকালীন মুখলেস ছিলেন হামিদ সাহেবের একান্ত সচিব। এখন সে সচিব; লৌকিক আঘাতের অলৌকিক থাপ্পড়ে ‘একান্ত’ শব্দটা খসে পড়েছে। সারা জীবন দতার সাথে চাকরি করেছেন, জাস্ট অবিডিয়েন্ট সার্ভেন্টের মতো। তারপরও তিনি উপসচিব। মাত্র সাত বছর, সাত বছরের মধ্যে মুখলেস সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সচিব। হামিদ অনড় দ্বীপ, এখনও উপসচিব।
মুখলেস:ভাবী কেমন আছেন স্যার? বাচ্চারা?
মুখলেসের কথায় হামিদ সাহেবের কান নেই। তিনি প্রতিবেশী জাফরের কথা ভাবছেন। তার কয়েক ব্যাচ জুনিয়র। জাফরভাবী সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি। এর কয়েকদিন আগে পদোন্নতি হয়েছে। জাফর পিএসসির মেধায় ব্যাচের সাত নম্বর। তার প্রমোশন হয়নি কিন্তু চারশ ঊনচল্লিশ নম্বরের মোকাব্বির দিব্যি আরামে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্মসচিব।
পদোন্নতির পরদিন জাফরের বউ বাচ্চাদের স্কুল গেটে গাড়ি থেকে নামতে ডাক দেন উৎপল বৌদি: আমার সাহেব যুগ্নসচিব হয়েছেন। আপনার সাহেব নাকি হয়নি? আহারে বেচারা, কত কষ্ট লাগছে। আচ্ছা ভাবী আপনি তো বলতেন, আপনার সাহেব অনেস্ট, অনেক লেখাপড়া জানে, তো প্রমোশনটা হলো না কেন? সরকার দিলো না কেনো? কাজটা সরকার ভালো করেননি। অবশ্য যোগ্যতা না থাকলে সরকার প্রমোশনই বা দেবেন কীভাবে? তাই না ভাবী! মন খারাপ করবেন না, ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
বৌদির কথা শেষ হবার আগে দৌড়ে আসেন নিয়ন। জাফরের ছেলে কালামের বন্ধু। একটা ফুল কালামের হাতে দিতে দিতে বললেন: শুনেছি, তোর বাবা নাকি প্রমোশন পায়নি। আমার বাবা পেয়েছে। মা বলেছেন, যারা ভালো তারাই প্রমোশন পায়। ফুল নেয়, বাবাকে সেলিব্রেট করছি।
চৌদ্দ বছরের বাচ্চার মনটা বাবার সংবাদটা শোনার পর থেকে খারাপ ছিল। নিয়ন এবং আন্টির কথা শুনে রীতিমত কেঁদে দেয়: মা, আব্বুকে প্রমোশনটা এুণি নিয়ে নিতে বলো। নইলে আমি আর স্কুলে আসবো না।
বাচ্চা রেখে বাসায় এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন পদোন্নতি বঞ্চিত জাফরের উপর: প্রমোশন পেলে না কেনো? এমন কী দুই নম্বরি তুমি করেছো?
আমি জানি না।
নিশ্চয় তুমি জানো। আমি আগে থেকে জানতাম তলে তলে তুমি আস্ত শয়তান।
বঞ্চনার কষ্টের সাথে স্ত্রীর কথায় হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তুমুলে উঠে দুজন। মুখোমুখি হতে হাতাহাতি- রক্তারক্তি। তারপর আসেন শ্বশুড়। তিনি মেয়েকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়ি: জাফর আমি জানতাম না, তুমি একজন পশু, অপদার্থ; অযোগ্য এবং অথর্ব। জানলে আমার মেয়ে তোমার হাতে দিতাম না। প্রমোশন না পেলে আমার মেয়ে আর আসবে না। পদোন্নতি নিয়ে জানাবে। আমি নিয়ে আসবো।
স্যার, পটুয়াখালীর কথা মনে আছে? ভাবী আমাকে ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। তাই তাকে আপা ডাকতাম। মুখলেসের কথায় সম্বিৎ আসে হামিদ সাহেবের।
মুখলেস?
জ্বী স্যার?
তুমি কী সত্যি জানতে না আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব?
জয়েন্ট সেক্রেটারি হবার পর আপনার পদধুলি নিতে গিয়েছিলাম। তখন আপনি ভূমি মন্ত্রণালয়ে। এরপর নানা ব্যস্ততায় আর পিছনে থাকাতে পারিনি। পটুয়াখালী থাকার সময় আপনি আমার যে উপকার করেছেন তা কোনদিন ভুলবো না।
মুখলেসের শ্বশুড় ছিলেন ওসি। কথাবর্তায় পুলিশের চেয়েও জাঁদরেল। চুণ থেকে পান খসলে আগ্নেয়গিরি। ধাক্কা দিয়ে মুখলেসকে বাসা থেকে বের করে দিতেন। অনেক বার সার্কিট হাউজে থেকেছেন। সবাই জানত তার বউয়ের আচরণ। অসহ্য হয়ে একদিন বউয়ের গালে চড় মেরে দেয়। আর যায় কোথা। বউ ফোন করে বাপকে, বাপ এসে সোজা থানায় এবং মামলা। ওসির মেয়ে বাদি, আসামি ম্যাজিস্ট্রেট। পুলিশ সক্রিয় হয়ে উঠে। যৌতুকের সাথে নারী নির্যাতন। অসহায় মুখলেস রাতে গিয়ে হামিদ সাহেবকে ঘটনা জানান। এসপি সাহেবের সাথে আলোচনা করে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে ডেকে মীমাংসা করে দেয়। হামিদ সাহেব উদ্যোগ না নিলে এরেস্ট হয়ে যেতেন মুখলেস। জলে ভেসে যেতো ভবিষ্য সচিব।
সত্যি স্যার, আমি জানতাম না; মুখলেসের কথায় বর্তমানে চলে আসেন হামিদ সাহেব।
একজন সচিব যদি তার মন্ত্রণালয়ে কয়জন অফিসার আছেন না জানেন তো তার সচিব হবার যোগ্যতা কোথায়? এত বড় মন্ত্রণালয় কীভাবে চালাবে?
যোগদানের পরই তো স্যার বিদেশ আর বিদেশ। কত কাজ, কত গুরুত্বপূর্ণ। ছোটখাট বিষয় মনে রেখে লাভ কী?
যে অফিসার ছোটখাট বিষয় মনে রাখতে পারে না সে কীভাবে বড় বিষয়গুলো মনে রাখবে? যে প্যারা মুখস্থ করতে হিমশিম খায় সে কীভাবে রচনা মুখস্ত করবে?
যাই বলুন স্যার, আপনার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়। আপনার কথা মনে পড়লে সার রাত ঘুমোতে পারি না। সততা, দতা, জ্ঞান, বিদ্যা- কী ছিল না আপনার! তারপরও পদোন্নতি হলো না। আমি স্যার আগামী এসএসবির সভায় আপনার কথাটা তুলে ধরবো। বলবো, আপনার পদোন্নতি না হলে আমারটা যেন কেড়ে নেয়।
হামিদ: ভাবী কী তোমাকে আগের মতো এখনও বাসার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে?
ভীষণ লজ্জায় মুখটা কাদামাখা।
কচুরিপানার মত বিদঘুটে করে বললেন: জ্বী না। সচিব হবার পর এমন আর করে না। সারাদিন গাড়ি-বাড়ি আর সভা-সমিতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাসায় আসার সময় পায় না। আপা কেমন আছেন স্যার? তিনি কী আগের মতন আপনাকে ভালোবাসেন?
তুমি সচিব হবার পর সে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেয় না। আমি অথর্ব, অযোগ্য।
কে বললো?
তোমার আপা। নইলে পাঁচ বার সুপারসিটেড হলাম কেনো? বলো বুড়ো বয়সে এখন কোথায় যাই?
হামিদ সাহেবের কথা শেষ হবার আগে মাইকে ঘোষণা আসে: জনাব মুখলেসুর রহমান, সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মহোদয়কে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি।
সচিব থেকে সিনিয়র সচিব!
জব্বার: জ্বী স্যার, এ মাত্র জিও হয়েছে।

No comments:

Post a Comment