সরকারি স্বীকৃতি নেই জাতীয় কবি নজরুলের / ড. মোহাম্মদ আমীন
ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। চাকুরিতে যোগদানের পর বিভিন্ন মুখে জানতে পারি, কাজী নজরুল ইসলাম
সরকারিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি নন। তিনি কেবল লোকমুখে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং তাঁর ‘জাতীয় কবি’ পদবি ধারণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। এমন অভিযোগ আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব হিসেবে যোগদানের পর নিজ উদ্যোগে প্রকৃত বিষয়টি জানার চেষ্টা করি। চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রযোজ্য সময়ে জারিকৃত গেজেট প্রজ্ঞাপনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখতে থাকি।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে যোগদানের পর আমার উদ্যোগ আরও সহজ এবং সংগতকারণে আরও বেগবান হয়। রহস্য উন্মোচনের জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত গেজেট বা কোনো প্রজ্ঞাপন আছে কি না তা অনুসন্ধানে ব্রত হই। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয় এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে অগাস্ট তিনি বাংলাদেশেই মারা যান। তাই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি আমি ওই সময়ে প্রকাশিত গেজেটপ্রজ্ঞাপন এবং সরকারি পত্রের মধ্যে সীমবাদ্ধ রাখি। প্রসঙ্গত, এর আগে বা পরে নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হলে তা আমার অনুসন্ধানের বাইরে থেকে যেতে পারে।
অনুসন্ধানের অনিবার্য পর্যায় হিসেবে আমি, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের মে থেকে শুরু করে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে অগাস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় সবগুলো গেজেট খুঁজে দেখেছি, কিন্তু কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার গেজেট নোটিফিকেশন বা প্রজ্ঞাপন কিংবা অনুরূপ কোনো সরকারি আদেশ পাইনি। সচিবালয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত ওই সময়ের সবগুলো গেজেট খুঁজেছি, কিন্তু প্রত্যাশিত কোনো প্রজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েনি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মাননা এবং অনারারি ডিগ্রি প্রভৃতি প্রদান সংক্রান্ত দলিলও পর্যালোচনা করা হয়।ওখানেও কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়েছে।
সংস্কৃত মন্ত্রণালয়েও খোঁজ-খবর নিয়েছি, সেখানেও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার বিষয়ে কোনো ডকুমেন্ট রক্ষিত নেই। আর্কাইভ এবং বাংলা একাডেমিতেও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো প্রকার দলিল
|
ড. মোহাম্মদ আমীন |
পাওয়া যায়নি। তবে সংস্কৃত মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমিতে নজরুলকে একুশে পদক প্রদান সংক্রান্ত প্রমাণক পাওয়া গিয়েছে। স্বাধীনতার পর সচিবালয়ে সচিব, অতরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব, উপসচিব এবং সেকশন অফিসার হিসেবে চাকুরি করেছেন এমন অনেকের কাছে নজরুলের ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণার বিষয়টি জানতে চেয়েছি। সিনিয়র-জুনিয়র কোনো অফিসার এ বিষয়ে কোনো গেজেট দেখেননি বলে জানান। তাঁদের অভিমত, কাজী নজরুল ইসলাম মৌখিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কাগজকলমে প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে নন।
এ বিষয়ে নজরুল ইনস্টিটিটের অস্পষ্টতা আরও বেশি। ইন্সটিটিউটের কয়েকজ জানান, মন্ত্রিপরিষদের একটি বৈঠকে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছিল। কখন প্রশ্নের উত্তরে তারা কেউ দিতে পারেননি। কয়েকজন বলেছেন, সম্ভবত এরশাদের আমলে প্রস্তাবটি পাস হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। আমি ওই সময় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বেশ কয়েকটি সভার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করেও এমন কোনো তথ্য পাইনি।
মৌখিকভাবে কেউ জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হতে পারেন এবং জনস্বীকৃতিও পেতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কেবল মৌখিক বিষয় নয়, আনুষ্ঠানিকতা ও সার্বভৌম শক্তির দাপ্তরিক ঘোষণার বিষয়টিও থাকে। অধিকন্তু, জাতীয় কবি ঘোষণার একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সে নীতিমালা অনুযায়ী কাউকে জাতীয় কবি ঘোষণা করতে হলে কিছু প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। কাজী নজরুল ইসলামের বেলায় এসব করা হয়েছে-- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, অন্তত আমি পাইনি। অনেকে বলেন, ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কবি নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু কে করেছে, কোথায় এবং কীভাবে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দূরে থাক, কোনো উত্তরই পাওয়া যায় না।
আমার লেখা পড়ে অনেক উপহাস করে বলবেন, নজরুলের ‘জাতীয় কবি’ “তাঁর স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। তিনি স্বীকৃতি ছাড়াই আমাদের জাতীয় কবি।” আমিও তাই মনে করি, কিন্তু স্বীকৃতিটা কী এতই দামি কিংবা নজরুল কী এতই ফেলনা যে তা দেওযা যাবে না!, আমরা কী এতই অনুদার! যদিও ‘জাতীয় কবি’ উপাধি নামের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নজরুলের জন্য অনিবার্য নয়, কিন্তু আমরা কতটুকু বোধের পরিচয় দিতে পেরেছি- সে প্রশ্ন করা কি অন্যায় হবে? অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু নামের কী গেজেট নোটিফেকশনে হয়েছে? হয়নি, কারণ ‘বঙ্গবন্ধু’ সরকারিভাবে সময়ে সময়ে জনগণকে প্রদত্ত কোনো পদক বা সম্মাননা নয়, কিন্তু জাতীয় কবি, জাতীয় অধ্যাপক প্রভৃতি সরকারিভাবে জনগণকে সময়ে সময়ে প্রদত্ত সম্মাননা, যা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী অর্পণ করা হয়। যেমন : একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক প্রভৃতি। অধিকন্তু, বঙ্গবন্ধু আর জাতীয় কবি এক নয়, বঙ্গবন্ধু অদ্বিতীয়, কিন্তু জাতীয় কবি একাধিক হতে পারেন।পৃথিবীর অনেক দেশে একাধিক জাতীয় কবি আছেন, আমাদের দেশে যেমন আছেন একাধিক জাতীয় অধ্যাপক।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হলেও সরকারিভাবে ঘোষিত নয়। অবশ্য পরবর্তীকালে সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশও প্রণীত হয়েছে। এটিও স্বীকৃতি, যদিও তা পরোক্ষ।
নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি ঘোষিত না হলেও তিনি আমাদের জাতীয় কবি; আকাশ-বাতাসও এটি জানে। জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের পরিচিতি এত ব্যাপক, গভীর, নিবিড় ও হার্দিক যে, এখানে সরকারি স্বীকৃতি সমুদ্রের প্রতি গোষ্পদের জলদানের মতোই তুচ্ছ। আকাশের অসীমতার প্রমাণ দিতে আকাশ লাগে, আকাশ কী দুটো আছে?
সুন্দর লিখেছেন জনাব।আকাশের অসীমতার প্রমাণ দিতে আকাশ লাগে,আকাশ কি দুটো আছে? এক বাক্যে মূল্যায়ন হয়ে গেছে।
ReplyDelete