Translate

Thursday, 24 July 2014

আহমদ ছফা প্রতিবাদের হিমালয় / ড. মোহাম্মদ আমীন


ঊনিশ শ’ সাতাশি, আগস্টের কোনো এক বিকেল।
আমি, কামাল এবং কবি,প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবেত্তা ওহিদুল আলম চৌধুরী গল্প করছিলাম। ওহিদুল আলমের বাসার ছিমছাম পরিবেশে গল্প ক্রমশ জমে জমে আড্ডার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি ছিলেন কবি, সাংবাদিক ও একুশের প্রথম কবিতার লেখক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সহোদর ভাই।
কবি ওহিদুল আলম চৌধুরী
গল্পের উৎকর্ষ আড্ডা, পরিণতিও বলা যায়, ঠিক প্রেমের পর বিয়ের মতো। যদিও প্রেমের মৃত্যু বিয়েতে, তবু মানুষ এটিই চান, জন্মের পর মৃত্যুর মতো অনিবার্য প্রাকৃতিয়তায় বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠছিলেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ ইউনিয়নের নন্দীর হাটে কামালের বাড়ি, ইউনিভার্সিটি সতীর্থ। কামালের অন্য একটি পরিচয় আছে, সে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. ইউনুছের ছোট ভাই। কামালই প্রথম আমাকে কবি ওহিদুল আলমের বাসায় নিয়ে যান, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বর্ষীয়ান কবির সঙ্গে। তারপর আস্তে আস্তে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠে নিবিড় আলেখ্যে।
ষাটোর্ধ প্রবীণ ওহিদুল আলম। তবু বয়সের কোনো ছাপ তাঁর মাঝে দেখিনি। বয়সের ছাপ ছিল শুধু দেহে, মনে তারুণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার আমার মতো যুবককেও ভাসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। তাঁর লেখনী ও ব্যক্তিত্বকে আরও সুঁচালো করে তুলেছিল। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম জগতের সমস্ততারুণ্য ওহিদুল আলমের সঙ্গে কীভাবে এগিয়ে যেত মিছিলে মিছিলে। এমন প্রবীণতম যুবা আমি শুধু আরেকজন দেখেছি, তিনি আহমদ ছফা, আর দেখিনি। তবে আর একজনের কথা শুনেছি, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একাশি বছর বয়সে যে কবিতা লিখেছেন তা আমাদের যুগের আঠারোর পক্ষে সম্ভব হবে কি না সন্দেহ।
আমাকে আর কামালকে পেয়ে কবি ওহিদুল আলম উচ্ছ্বসিত আনন্দে ফোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন। শুনেছিলাম, নবীনদের প্রতি তাঁর স্নেহময়তা বয়সের সকল রেশ ভেঙে একাকার করে দিত। এবার প্রমাণ পেলাম চোখে চোখে। নবীনদের তিনি তাঁর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করার আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠতেন। অবশ্য এর একটা কারণ ছিল এবং সেটি হচ্ছে তরুণদের সঙ্গ প্রবীণদের সময়টাকে বসন্তের জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়ার দুর্লভ সুযোগ।। এ জনই হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ওরে নবীণ ওরে আমার কাঁচা, আধমড়াদের ঘা দিয়ে তুই বাঁচা।
আমি আর কবি বলছিলাম, কামাল শুনছিল। কামাল রসায়ন বিজ্ঞানের ছাত্র। বলে কম শুনে বেশি, সাহিত্যে তার কোনো আগ্রহ ছিল না, দেখিনি কোনোদিন। রসায়নের রস ছাড়া অন্য কোন রস জীবনে প্রয়োজন বলে মনে করত না। ইন্টারমেডিয়েটে আমারও রসায়ন ছিল, কিন্তু এখানে রাসয়নিক পদার্থ ছাড়া আসলেই আর কোনো রস ছিল না। রাসায়নিক পদার্থ যদি রস হয় তাহলে এসিড কী! তবে আমি ছিলাম উল্টো, আমাকে পেলে কামালও আড্ডা পাগল হয়ে উঠত। কথায় বলে, সঙ্গদোষে লোহাও ভাসে।
আমাকে ছাড়া আড্ডা নাকি লবণহীন তরকারির মতো মনে হয়। কামালের বন্ধু সংখ্যা ছিল মাত্র দুজন। তন্মধ্যে আমি আবার অন্যতম। ইদানীং আমার সঙ্গে অধিক মেলামেশা কামালকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির অনুঘটক হিসাবে কাজ করছিল। সাহিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে কামাল বলত, সালফিউরিক এসিডের চেয়ে বড় সাহিত্য আর নেই। 
আমাদের আড্ডার চরম মুহূর্তে কক্ষে ঢুকেন আরেক জন মাঝবয়সী লোক। ওহিদুল আলম পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি কবি ওহিদুল আলমের সন্তান। তিনি ডক্টরেট, নাম এখন ঠিক মনে পড়ছে না, সম্ভবত  ডঃ ইকবাল। টক টকে ফর্সা মুখের যথাস্থানে বুদ্ধি দীপ্ত দুটো গভীর কালো চোখ, পিতার মতোই সবাক পুরো অবয়ব, বাপকা বেটা, ভাতিজাকে জেঠা।
তিনিও আড্ডায় বসে পড়েন আমাদের সঙ্গে। কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখলাম, নিঁখুত একজন যুবক।
তিন প্রজন্মের আলাপ, রিটায়ার্ড শিক্ষক সাহিত্যিক ওহিদুল আলম, শিক্ষক ইকবাল এবং ছাত্র আমীন ও কামাল। আলাপে আলাপে আহমদ ছফার প্রসঙ্গে উঠে আসে। না এসে কোন উপায় নেই। সাহিত্যের আড্ডায় আহমদ ছফার প্রসঙ্গ না এলে ওই আড্ডাকে যাই বলা যাক, অন্তত সাহিত্যের আড্ডা বলা যায় না। বাংলা সাহিত্যে অ ও ক এর মতোই আহমদ ছফা অনিবার্য।
ছফার নাম উঠতে ড. ইকবাল কেমন এক অনিন্দ্য দৃঢ়তায় ঋজু হয়ে উঠেন।  গর্বের এক দরিয়া অহঙ্কার ড. ইকবালের চোখে মুখে দীপ্ত হয়ে ওঠে।
প্রশান্ত দ্যোতিতে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেন তাঁর অবয়ব।
কন্ঠে অনাবিলতার স্বর তুলে বললেন : আহমদ ছফা, আমাদের কমন ছফা ভাই- তিনি তো মানুষ নন, একটি যুগ, একটি মননশীল বিপ্লব, স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি প্রজন্ম; জাগতিক প্রাপ্তি ও অনুভূতির বৈচিত্র্যময় বৈশাল্যের সীমাহীন অবকাশও তাঁর কাছে নস্য। আমরা বলতাম, প্রতিবাদের হিমালয়। কোনো একক মানুষের মনে এত প্রতিবাদ, এত প্রাঞ্জল-শক্তি, এত জ্ঞানময় দীপ্তি এবং দূরদর্শী স্ফুরণ থাকতে পারে, তা ছফা ভাইকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মনে হতো প্রজন্মের পক্ষেও ছফা ভাইয়ের মত সাবলীল সাহসকিতার ভরপুর এমন ভয়ঙ্কর প্রতিবাদী হওয়া সম্ভব নয়। ছফা ভাই অনুক্ষণ সজাগ থাকতেন, অনুক্ষণ থাকতের চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে। সব সময় তাঁর প্রস্তুতি থাকত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায়। কেউ কোনোদিন তাঁকে কোনভাবে ঘায়েল করতে পেরেছে শুনিনি, বরং যারাই তাঁকে ঘায়েল করতে যেতেন বা চাইতেন তাদেরকেই ঘায়েল হয়ে ফিরে আসত, হোক বোদ্ধা কিংবা যোদ্ধা।
আমি আর ওহীদুল আলম পরস্পরের দিকে তাকালাম, কামালও। আহমদ ছফার প্রশংসায় গর্বে আমার লোম কূপ গুলো নাচছিল। আমি তাঁর কাছের মানুষের একজন, গর্ব তো লাগবেই।
ড. ইকবাল বলেই চলছেন, যতটুক মনে পড়ে সময়টা ১৯৭২। প্রথমবারের মতো বিরাটকার একটা সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকায়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন। উভয় বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা সম্মিলিতভাবে কি একটা বড় কিছু করার লক্ষ্যে মিলিত হয়েছিলেন, পুরো মনে পড়ছে না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ হতে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র, বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর বিভিন্ন শ্রেণির কবি-সাহিত্যিকদের পদচারণায় ঢাকার সভাস্থল জমজমাট। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখিয়েদের আগমনে সাধারণ্যেও থৈ থৈ। এত কবি লেখকের সমাগম আর হয়নি, দেখেননি বাংলাদেশের জনগণ কিংবা বোদ্ধারা। তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ আরও বেশি চোখে পড়ছিল। সম্মেলনে একজন খ্যাতিমান কবি সভাপতিত্ব করেছিলেন।
সম্মেলন শেষ করার আগে সভাপতি সাহেব  মাইকে ঘোষণা দিলেন- সময় স্বল্পতার জন্য অনেককে বলার সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। উপস্থিত সুধীবৃন্দ, এজন্য আমরা দুঃখিত। তবু তরুণদের মধ্যে কেউ যদি গঠনমূলক কিছু বলতে চান তো বলতে পারেন। সময় স্বল্পতার জন্য শুধু একজনকে বলার সুযোগ দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তির অনুকূলে আপনাদের সহযোগিতা আমার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সভাপতি স্টেজ হতে শ্রোতা মঞ্চে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন, কেউ যদি হাত তোলেন। 
সবাই চুপ, কে বলবেন! 
যাদের বলার তাঁরা বলে ফেলেছেন। যাদের বলতে দেওয়া হয়নি তাঁদের কারও বলার সাহস বা যোগ্যতা দুটোর কোনটাই নেই।  যেখানে বরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে বলার সুযোগ পাননি কিংবা সাহস পাননি, সেখানে অপ্রস্তুত কারও পক্ষে এত বড় সাহিত্য সম্মেলনে বলার সাহস রাখার বা থাকার কথা নয়। সম্ভবত এ ভেবেই সভাপতি অটো বক্তার চাহিদা থ্রো করেছিলেন। কেউ হাত তুলছেন না দেখে মনে মনে পুলকিত সভাপতি আরেকটু সময় দিয়ে সাহসের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার আগে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়। ভেঙে খান খান করে দেন একজন তরুণ, লিকলিকে ছফা ভাই।
ছফা ভাই শ্রোতা গ্যালারি হতে হাত তুলে চীৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ান। সবার চোখ তাঁর দিকে, তরুণ নয়, যেন লিকলিকে অরুণ, এতক্ষণ কেউ তাঁকে লক্ষ করেননি, কিই বা আছে লক্ষের! দেখতেও সুন্দর না।
আমি বলব, আমি।
ততক্ষণে মঞ্চে ফিস ফিস সাইড টক শুরু হয়ে যায়। একে অপরকে জিজ্ঞাসা করছেন, কে? কে এ লিকলিকে তরুণ?
কে বলবেন? শক্তি বাবু জানতে চাইলেন।
কে জানি বললেন, আহমদ ছফা।
শিশু সুলভ হাসি দিয়ে ছফা ভাই নিজের আশেপাশে তাকালেন, মঞ্চে বড়দের দিকে নয়, নিজের মতো অখ্যাত তরুণদের দিকে, তাঁর চারিদিকে তরুণ। তিনি বড়দের দিকে তাকান না, বড়রা তাঁর চাহনীতে আড়ষ্ট হয়ে পড়েন। তরুণদের চেয়ে বড় আর কেউ নেই।
ঘাড় বাঁকা করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছফা ভাই মঞ্চের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। উদ্ধত ভঙ্গী, বেয়াদবি নয়, সাহসিকতা, ব্যক্তিত্ব। যেন সাহসের একটি বিশাল হিমালয় হেঁটে আসছে জগতের সমস্ত নিকৃষ্টতাকে মানবীয় আঘাতে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার জন্য।
ছফা ভাইকে দেখে সভাপতির মুখ-চোখ ঝিম খেয়ে যাওয়ার অবস্থা, আমরা সবাই সভাপতির অস্থিরতা বুঝতে পারছিলাম। দূর হতেও বুঝা যাচ্ছিল বরেণ্য কবি কাঁপছেন, রীতিমত দৃষ্টিকটু। কারণ ইতোমধ্যে ছফা ভাই স্পষ্টভাষী যুবক এবং প্রতিবাদী লেখক হিসাবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন।
ছফা ভাইয়ের মতো একজন তরুণ লেখকের প্রতি দেশের প্রধানতম কবির মতো একজন মহরথীর এত ভয় শুধু দৃষ্টিকটু নয়, লজ্জাকরও বটে কিন্তু কিছু করার নেই, আমরা উপলব্ধি করতে না-পারলেও সভাপতি মহোদয় বিপদটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছিলেন। ছফাকে থামান দরকার, নইলে সমস্ত নকশা নীল হয়ে যাবে, ছফার অসাধ্য কিছু নেই।
ছফা ভাই মাইকের কাছে পৌঁছার আগে সভাপতি মাইকের সামনে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় পুনরায় ঘোষণা দিলেন : না, আহমদ ছফা নয়, অন্য কেউ বলতে পারেন। আহমদ ছফাকে বলতে দেওয়া যাবে না, কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা আছে।
কেন? কেন আহমদ ছফা নয়? বগলে লুকানো লাঠিটা বেরিয়ে পড়বে, তাই ভয় পাচ্ছেন বুঝি?
মঞ্চের দিকে যেতে যেতে চীৎকার দিয়ে বলে উঠেন ছফা ভাই। জেদে তাঁর চোখে মুখে আগুনের হলকা। না, তা হয় না। 
সভাপতি আরেকটা ভুল করে বসলেন, ভীমরুলের ছাকে ঢিল ছুড়ে দিলেন।
তরুণরা সমস্বরে চীৎকার দিয়ে বলে উঠেন : ছফা ভাই যাবেন এবং বলবেন, তাকে অবশ্যই বলতে দিতে হবে। ঘোষণার আগে তো ছফা ভাই বলতে পারবেন না, এমন কিছু বলা হয়নি। ছফা ভাই আমাদের তারুণ্যের প্রতীক, তিনি আমাদের পক্ষে বলবেন, আহবান করে পুনরায় প্রত্যাখ্যান আমাদের জন্য অপমানের, আপনার জন্য শঠতা। তারুণ্য অপমানের বিষয় নয়- জয়ের, প্রত্যাশার, সৃষ্টি এবং বিন্যাসের। সাহিত্যের মঞ্চে টেকনিক্যাল সমস্যার স্বরূপ আমরা দেখতে চাই।
তরুণদের সাথে অধিকাংশ শ্রোতা একাত্বতা প্রকাশ করলেন। সবার আগ্রহ ছফার দিকে, বলুন ছফা ভাই, বলুন।
অবস্থা বেগতিক। সভাপতি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। সভাস্থলের চারিদিকে সোরগোল শুরু হয়ে যায়। শ্রোতৃবৃন্দ আহমদ ছফাকে শুনতে চান।
ইতোমধ্যে ছফা ভাই স্টেজে পৌঁছে গিয়েছেন। সভাপতির সরে যাওয়ার অপেক্ষা না করে তাঁর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছোট একটা ভদ্রমানের ধাক্কা দিয়ে স্পিকার স্টিকে হাত রাখলেন। সভাপতি সরে যেতে বাধ্য হলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছফা ভাই মাইকের দখল নিয়ে নেন।
উপস্থিত শ্রোতৃবৃন্দের অধিকাংশই তালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান।
পরে বুঝতে পেরেছি ছফা ভাই ও্দইন বলতে না পারলে পশ্চিমবঙ্গের ইশারা ছাড়া বাংলাদেশে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করার সাহস আমরা আজ পেতাম না। মাইক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাগপাশ হতে ছফা ভাই প্রথমবারের মত স্বাধীন করলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার চেয়ে বিষয়টি কম গৌরবের ছিল না।
আমার ভয় হয় ছফা ভাই যদি কখনও তাঁর মতো কাউকে না রেখে মারা যান তো বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি পশ্চিম বঙ্গের গোলাম হয়ে যাবে।
ছফা ভাই জোর গলায় বলে যাচ্ছেন : আমাকে আজ বলতে দেওয়া না-হলে আমি পুরো প্যান্ডেল জ্বালিয়ে দিতাম, যেমন ভাবে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় মানুষের বাড়ি, মন্দির এবং মসজিদ। বাবু শক্তি, বাবু সুনীল-বুদ্ধ বাংলাদেশ নিয়ে আজ আপনাদের মায়াকান্না দেখে আমার চরম হাসি পাচ্ছে। ছি! শঠতার এত প্রহসন আমি আর দেখিনি। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরা যখন আপনাদের আশেপাশে হাজার হাজার মুসলমানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? কোথায় ছিল আপনাদের মায়াকান্না! যখন আমরা রক্ত দিচ্ছিলাম ভাষার জন্য, তখন কোথায় ছিল আপনাদের আবেগ? আজ আমাদের রক্তে স্বাধীন করা দেশ নিয়ে বক্তব্য ছুড়তে এসেছেন? বাংলােকে আমরা মর্যাদা দিয়েছি, প্লিজ, চলে যান, কথায় ছিড়ে ভিজে না। আপনাদের মতো বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি-সন্ত্রাসী মনোবৃত্তি আমাদের ক্ষতি বই লাভ করতে পারবে না। আপনাদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, পরাধীনই থেকে যেতাম আমরা। যারা আজ আপনাদের লেজুড়বৃত্তি আর তোষামুদের মাধ্যমে ভাষা প্রেমিক সাজার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাঁরা কিন্তু দুদিন আগেও আয়ুব-ইয়াহিয়ার কলম দাস ছিল। আজকের সভাপতি ছিল কোলবেরটর, প্রমাণ চান?
না, না, প্রমাণ চাই না, ছফা ভাই আপনি বলে যান, প্রমাণ আমাদের আছে- শত কন্ঠ চীৎকার দিয়ে ছফা ভাইকে সমর্থন জানান।
সভাপতি ঘেমে একাকার। ছফা ভাইকে বর্তমানে প্রধান বলে কথিত একজন কবি বললেন, নামো, অনেক হয়েছে।
আরও রেগে যান ছফা ভাই। আপনি তো অনেক আগেই নেমে গেছেন, আবার আমাদের নামতে চাইছেন কেন? এত অল্পেই যদি তুষ্ট হয়ে যান তো টাকার জন্য কলম পেষে পেষে কলম শেষ করে দিলেন কেন? কেনই বা কলম যাতে সহজে শেষ হতে না পারে তজ্জন্য কলমের সুন্দরাকৃতিকে লাঠি বানিয়ে ফেললেন না? আমার লজ্জা হয় আপনাদের কবি বলতে।
সেদিন যতক্ষণ পর্যন্ত ছফা ভাই নিজে নিজে থামেননি, ততক্ষন তাঁকে কেউ থামাতে পারেননি, সাহসও করেননি থামাতে, বৃষ্টি-ঝড় আপনি না থামলে কেউ কি থামাতে পারে? প্রকৃতির মতো উদ্দাম এ তরুণকে থামাতে পারার সাহস কারও  ছিল না। শ্রোতাদের সমস্বর সমর্থনে ছফা ভাই বরণ্যে মুগ্ধতার সিক্ত ভালবাসায় ক্রমশ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছিলেন।
আহমদ ছফা আধ ঘন্টা বক্তব্য দিয়েছিলেন। আধ ঘন্টার ওই বক্তব্যটি পুরো সম্মেলনের উদ্দেশ্য এবং ধারণাই পাল্টে দিয়েছিল। আমি মনে করি ছফা ভাইয়ের ওই বক্তব্যটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এড্রেসের চেয়েও অধিক কালজয়ী ভূমিকা রেখেছিল।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আলাপকালে বলছিলেন, পশ্চিম বঙ্গের কবি সাহিত্যিকরা ছফা ভাইয়ের সত্য ভাষণে সাংঘাতিক রুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা  সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনো দিন বাংলাদেশে সাহিত্য সম্মেলনে আসবেন না। অন্তত ছফা বেঁচে থাকতে তো নয়ই। এ সম্মেলনে উভয় বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা ফি বছর সাহিত্য সম্মেলন করার যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তা ছফা ভাইয়ের  আধ ঘন্টার বক্তব্যেই কুপোকাৎ হয়ে গিয়েছিল।
সম্মেলনে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এমন একটি অগ্নি প্রতিভা আবিষ্কার করলেন, যাকে কোন উপমা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। অসম্ভব বড় রকমের রথী-মহারথীদের কীভাবে আধ ঘন্টার মধ্যে অবোধ শিশুর মতো নাকানি চুবানি খাইয়ে দিলেন, তা আজও  বিস্ময়ের বিষয়।
আবু হেনা তো বলেই দিলেন, আমরা কেউ তার একটি প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না, তো জ্ঞান কি আমাদের এতই কম! হঠাৎ আলোর প্রচন্ড ঝলকানিতে আমরা অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম, এতো তেজ সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারও ছিল না সেদিন। আসলে ছফার তুলনা ছফাই।
ওই সম্মেলন বিষয়ে আহমদ শরীফের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার আলাপ হয়েছিল।
ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন, বাংলাদেশের সকল বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্ব ছফার কাছে কেন জানি লুপ্ত হয়ে যেত। আমি এমন কোনো সাহিত্যিক, কবি কিংবা শিক্ষক দেখিনি যিনি ছফার কাছে এলে  বিচলিত না হয়ে স্বাভাবিক থাকতে পেরেছেন। যে কোনো কারণে হোক এটাই ছিল স্বাভাবিক। এমন কি ছফার শিক্ষকরাও ছফার সামনে এলে কেমন জানি গোবেচারার মতো হয়ে পড়তেন। তার সাথে তর্কে পারা কারও সম্ভব ছিল না। ড. শরীফের মন্তব্য দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করেছেন অনেকে।

পরিশেষে ছফা ভাই বলেছিলেন : দেখুন, রথীমহারথীগণ, আমি  প্রত্যেকটি কথা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, স্বাধীনতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার কল্যাণে বলেছি, এতে কেউ যদি আহত হন তো, তা মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর কোনো সদস্য আহত হওয়ার মতোই সুখকর। আপনাদের সবার বোধোদয় হোক-এটাই আমার কামনা।

No comments:

Post a Comment