গুরমিত
রাম রহিম সিং ও ভারতীয় ধর্মগুরুদের কীর্তিকলাপ ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি
গবেষণা গ্রন্থ। দীর্ঘদিন থেকে ভারতে ধর্মগুরুদের নিয়ে অসংখ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে আসছে। তবু কেন ধর্মগুরুদের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রবল বিশ্বাস ও আস্থা কমে না বরং বেড়ে যাচ্ছে তা
এই গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য আলোচন। বেশ কিছুদিন যাবত উপমহাদেশের পত্রপত্রিকায় ভারতীয়
ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং এর বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগ ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়। প্রায় ছয় কোটি লোকের কাছে ভগবান হিসেবে
সম্মানীয় একজন ব্যক্তিকে পত্রিকা রাতারাতি জঘন্য ধর্ষকে পরিণত করে দিয়েছে।
তবু তাঁর ভক্তদের কেউ পত্রিকার কথা বিশ্বাস করেনি। বরং তার প্রতি তাদের ভালোবাসা,
বিশ্বাস ও আস্থা আগের চেয়ে দৃঢ় হয়েছে। এর কারণও পুস্তকটিতে সবিস্তারে বর্ণনা করা
হয়েছে।
আসলে
গুরমিত কে? লেখকের মতে, বাস্তবতা, কল্পনা, যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, কুশলী অবস্থান,
রহস্যময়তা,
প্রতিভা প্রভৃতির সমন্বয়ে তৈরি এক অনবদ্য আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু।গুরমিত অন্যান্য ধর্মগুরুর মতো মুখে সর্বদা স্রষ্টার নাম জপতে জপতে ক্লান্ত
হওয়ার মতো সাধারণ কেউ নন। জপমালাও দেখা যায় না তার হাতে। বরং গোলাপি রঙের বাহারি জোব্বা
চাপিয়ে মিউজিক ভিডিওর তালে তালে বিস্ময়কর কায়দায় নাচতে ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন। ভক্তবৃন্দ
মনে করতেন যেন সত্যিকার ভগবান নেমে এসেছেন ধরায়। এ যেন জীবনের এক উদ্দাম উচ্ছ্বলতা।
মানুষ সাধারণত এমন উচ্ছলই থাকতে চায় আজীবন। তার ডেরায় কনসার্ট ছাড়া ধর্মসভাও হতো। যারা
যেটি ভালো লাগে। আলোচিত ও সমালোচিত আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং যে কোনো
বিবেচনায় বর্তমান বিশ্বের একটি বর্ণময় চরিত্র। মানুষকে আকর্ষিত করার জন্য যত প্রতিভা ও
কলাকৌশল আয়ত্তে থাকা আবশ্যক তার সবগুলো গুরমিত রাম রহিমে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।
হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লাখ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। যারা তাকে তাদের
জীবনের চেয়ে বেশি আপন জানেন, তার জন্য জীবন দিতে পারেন অবলীলায়। সারা বিশ্বে গুরমিত
রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত রয়েছে। এসব ভক্ত রাম রহিমের প্রতি এতই বিশ্বস্ত যে, তারা গুরমিতকে
ঈশ্বরের দূত বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু কেন? এটাই বইটিতে বর্ণিত হয়েছে।
ভগবান বিশ্বাসী মানুষের কাছে ভগবানের যে প্রভাব, ভক্তদের কাছে রাম
রহিমের প্রভব তার চেযেও বেশি। এর প্রমান পাওয়া গিয়েছে সেদিন, যেদিন রাম রহিমকে হরিয়ানার আদালত ১৫ বছরের পুরনো ধর্ষণ
মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে। আদেশ ঘোষণার পর পরই
ভক্তদের ক্ষোভ আর রোষের আগুন জ্বলে ওঠে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিসহ ভারতের
আরও বহু এলাকায়। হরিয়ানার পঞ্চকুলা শহর কুরুক্ষেত্রের চেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠে। এর প্রভাব
পড়ে উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের বিস্তৃত এলাকায়। ডেরা সাচা সৌদা
প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের ভক্তরা হরিয়ানার পঞ্চকুলা, সরসিয়াসহ পাঞ্জাবের বহু এলাকা
কার্যত অচল করে দেয়। ডেরা সাচা সওদা প্রধানের রায় শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লাখ লাখ নারী-পুরুষ
অনুগামীরা পঞ্চকুলাতে সমবেত হয়েছিলেন। রায়দানের আগে যদি ‘গুরুজি’র সামান্য আভাস পাওয়া
যায় সে আশায় অনেক ভক্তকে সেদিন আহাজারি করতেও দেখা যায়। তার এমনভাবে আহাজারি করছিল যেন, তাদের সবকিছু শেষ
হয়ে গেছে। আসলেই ভক্তদের কাছে রাম রহিমই ছিল শেষ ভরসাস্থল।
রাম
রহিম সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অভিযোগের কারণ, স্বরূপ, অভিযোগ আসলে কতটুকু সত্য, এর
পেছনে কোনো স্বার্থ আছে কি না প্রভৃতি এই গ্রন্থে নানা তথ্যপ্রমাণসহ বিধৃত করা
হয়েছে। অনেকের মতে, গুরমিতের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা সন্দেহাতীত নয়। বরং তাকে অপদস্থ করার জন্য অনেক
বছর আগে আনা একটি অসমর্থিত অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে
কার স্বার্থ ছিল, কী ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে করা হয়েছে এবং কেন তার বিবরণ বইটির
অন্যতম বিষয়। লেখক বলেছেন, প্রচলিত ধর্ম, বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ
এবং সর্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তার বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্রের কারণ।
সাংবাদিক
হত্যা, ধর্ষণ, ডেরার ম্যানেজার খুন, গুম প্রভৃতিসহ অসংখ্য অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ভক্তগণ
মনে করেন এই অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। কেন
তার বিরুদ্ধ যড়যন্ত্র?
ভক্তদের মতে, ভারতের হরিয়ানা, রাজস্থান ও পাঞ্জাব রাজে জাতপ্রথা দুরীভূত করার ডাক,
দলিতদের সামাজিক মর্যদা প্রদানে বদ্ধপরিকর অবস্থান, শিখধর্মের কিছু নীতির বিরোধিতা,
দশম শিখ নেতার অনুকরণে পোশাক পরিধান, মাদকদ্রব্য বিরোধী অবস্থান, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন,
নারীপাচার রোধ বিরোধী ভূমিকা, ধর্মসংস্কার, নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাএবং উত্তরোত্তর
তার ভক্ত সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিরোধী পক্ষের ঈর্ষা-ভয় প্রভৃতি কারণে গুরমিত রাম রহিম সিংহ
ইনসানকে হেয় করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল গুরমিতকে পাঞ্জাবে প্রবেশ
নিষিদ্ধকরণ।
গুরুমিত
ছাড়াও ভারতীয় আরো কিছু ধর্মগুরুর কীর্তিকলাপ সম্পর্কে গ্রন্থটিতে আলোকপাত করা
হয়েছে। এরা হলেন : আনন্দ মূর্তি আশারাম বাপু
আশুতোষ মহারাজ বাবা পরমানন্দ রাধে মা সচ্চিদানন্দ গিরি রামবৃক্ষ যাদব: চন্দ্রস্বামী
স্বামী ওমজি সারথি বাবা লাল সাই গুলজার পির নির্মল বাবা ইচ্ছাধারী ভীমানন্দ নারায়ণ
সাঁই রামপাল বৃহস্পতি গিরি স্বামী গঙ্গেশানন্দ স্বামী নিত্যানন্দ স্বামী অসীমানন্দ প্রেমানন্দ স্বামী ভীমানন্দজি মহারাজ স্বামী স্বদাচারী
প্রমুখ। লেখক বইটিতে গরমিত রাম রহিম সিং এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে বিশেষ
উদ্দ্যেশে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের কারণে ব্যাপকতর করে গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল করার
প্রয়াস হিসেবে বিধৃত করে বলেছেন, প্রচলিত শিখ ধর্মের বিরুদ্ধে তার অবস্থান এবং
ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় শোষণের পরিবর্তে সমতাভিত্তিক ধর্ম ও সামাজিক ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক প্রয়াসই ছিল গুরমিতের উদ্দেশ্য। এর মধ্যে কিছু ভুলভ্রান্তি
হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু ভুলভ্রান্তির পরিবর্তে তার কাজে যে আরো কল্যাণকর কিছু ছিল
সেগুলি উপেক্ষা করে তাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপদস্থ করা হয়েছে।বইটি পড়লে গুরমিতের
বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের স্বরূপ এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাঠক নতুন অভিজ্ঞানে
ঋদ্ধ হবেন।
বইটির প্রকাশক পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা এবং পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়ের স্টলে। দাম ১৫০ টাকা।
No comments:
Post a Comment