মনুষ্য জগতে পথচারীরা সংখ্যায় এককভাবে সর্বাধিক হলেও তারাই বর্তমানে সবচেয়ে অসংগঠিত। অসংগঠিত বলে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়েও অতি দুর্বল এবং দুর্বল বলে চরমভাবে অবহেলিত। এটা প্রমাণ করে যে, শুধু সংখ্যাঘরিষ্ঠতা
শক্তির একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, সংখ্যাকে শক্তিতে পরিণত করতে হলে লক্ষ্যের ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়া অপরিহার্য। তা না হলে এক কোটি চল্লিশ লাখ ইহুদির কাছে একশ ষাট কোটি মুসলিমকে নতজানু হয়ে থাকতে হতো না বছরের পর বছর; পরাজিত হতে হতো না বার বার বিভিন্নভাবে যুগের পর যুগ। মনে রাখতে হবে, সংখ্যা নয়, সংগঠিত রূপই শক্তির নিয়মক।
আইনানুগ মালিক যদি তার সম্পদের দখলত্ব প্রতিষ্ঠা ও ভোগের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ না-করে তা হলে আইনানুগ অধিকারও ব্যহত হয়ে চলে যেতে পারে স্বার্থান্বেষী কারো অবৈধ দখলে। মনে রাখতে হবে, বেদখলের শঙ্কা হতে স্বার্থ রক্ষার বিধি প্রণীত হয়েছে। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস প্রথমে আবশ্যিকভাবে মালিকপক্ষ হতে সূচিত হতে হয়। নইলে যে কোনো সম্পত্তি অন্যের অধিকারে চলে যেতে পারে। সাধারণত ভোগের সময় বিবেচনা করে দখল ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেওয়া হয়। দখলাধিকার যত বেশি সময় বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা থাকে তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তত বেশি প্রয়াস উৎসরিত হয়।এজন্য সাধারণ জনগণে সংগঠিত অধিকার প্রতিষ্ঠার নজির খুব বেশি নয়, শক্তও নয়।
ফুটপাত করা হয় পথচারীদের জন্য। বিধি-নীতি, ব্যবহার ও নজিরগতভাবে ফুটপাতে পথচারীদের একচ্ছত্র স্বার্থ, অধিকার ও দখল থাকার কথা। কিন্তু দখল রাখার জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা প্রয়োজন তা প্রতিষ্ঠার জন্য পথচারীদের প্রয়াস থাকে না বলে অধিকার ও দখল দুটোই লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আমাদের জরিপে দেখা গিয়েছে, ঢাকা শহরের এক
কোটি আশি লাখ জনগণ এবং প্রতিদিন প্রায় পঁচাশি লাখ পথচারীর অধিকার দশ হাজারের কমসংখ্যক লোকের কব্জায়। শুধু ঢাকা নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে এমন চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর চিত্র ভিন্ন। সেখানে পথচারীদের অধিকার রক্ষায় তাদের সরকার এত সচেতন থাকে যে, কোনো অবস্থাকে কোটি জনের অধিকার কটি জনের কব্জায় পতিত হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না।
একজন পথচারী দীর্ঘসময় পথে হাঁটলেও তার প্রতিটি পদক্ষেপ একটি স্থানে খুব কম সময়ের জন্য স্থায়ী থাকে। ফলে পথচারীগণ ওই স্বল্পসময়ের জন্য ওই পদক্ষেপভূমে দখলাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে পরিমাণ প্রয়াসকে নিয়োজিত করা উচিত তা করে না। এটাও ভাবে না যে, একটা একটা পদক্ষেপে রচিত হচ্ছে পুরো পথের উপর তার অধিকার। একটা পদক্ষেপের অধিকারকে অবহেলা করতে গিয়ে তাই সে হারিয়ে ফেলে পুরো পথ। অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তার খেয়াল অবহেলায় পতিত হয়। তাই পথচারীরা পথের অধিকার হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়।
বিপুল সংখ্যক কিন্তু নিজেদের চারণিক অধিকার সম্পর্কে অসংগঠিত নিরীহ পথচারীর পক্ষে উচ্চকিত আওয়াজ তোলার ন্যুনতম সামর্থ্যও রাখে না।তাই সরকার তাদের চলাচলের জন্য ফুটপাত বানায় একই সঙ্গে সেখানে তাদের
দখলাধিকার ও সাবলীল ভোগ সুরক্ষিত রাখার সর্বপ্রকার উদ্যোগ অক্ষুণ্ন রাখে। কিন্তু অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে সরকারের এই উদ্যোগ নানা কারণে এতই হালকা-আলগা ও স্বার্থগৃধ্নু হয়ে পড়ে যে, নিরীহ পথচারীগণ পথাধিকার হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়। হাজার হাজার পথচারীর আইনানুগ অধিকারকে অবহেলা করে কয়েকজন লোক ফুটপাতে নিজেদের একচ্ছত্র ভোগ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ফুটপাতে গড়ে ওঠে দোকান, নির্মাণসামগ্রী রাখার স্টোর, রাজনীতিক দলের অফিস, গ্যারেজ, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়, ভিক্ষুকাগার, গানাসর আরো কতো কী!
এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দেশে পরিচালিত জরিপে, উন্নয়নশীল দেশসমূহের বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত জনগণের অধিকার হরণের মহোৎসবই দেখা গেছে। মূলত এসব নিরীহ লোকদের ভোটেই গঠিত হয় সরকার। ফলে সরকারই এদের সংগঠিত রূপ এবং শক্তির আধার হয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার কথা, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে তা খুব কমই দেখা যায়। উন্নত এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে সরকার সবক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক নিরীহ এবং অসংগঠিত জনগণের আধিকারিক হিসেবে অনড় থেকে তাদের পক্ষে কাজ করে যায়। ফলে বিস্তৃত হয় সুশাসন, নিশ্চিত হয়ে যায় সবার অধিকার। কিন্তু অনুন্নত ও নামমাত্র গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যায় তার উলটো।
যে দেশের ফুটপাত পথচারীদের নিয়ন্ত্রণের যত বেশি বাইরে সে দেশের জনগণ তত অধিকমাত্রায় বঞ্চিত, লাঞ্ছিত,
ক্ষোভিত, নির্যাতিত, অরক্ষিত এবং অবহেলিত। ওই দেশের সরকার অতিমাত্রায় দুর্বল বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরীহ জণগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনানুগ প্রয়াসকে অবহেলা করে কয়েকজন কায়েমি স্বার্থবাজের বেআইনি অধিকারকেও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যায়। ফলে অসংগঠিত পথচারী হারিয়ে ফেলে তার স্বাচ্ছন্দ্য-হাঁটার চিরন্তন অধিকার। এই দখল ফুটপাত থেকে বিস্তৃত হয়ে নেমে আসে রাজপথে।
ফলে যানজট আর জানজটে (মানবজট) বেহাল হয়ে যায় প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা। পথচারীগণ হাঁটার জন্য যানপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। লৌহনির্মিত লৌহযানের সঙ্গে নরম মাংসনির্মিত মনুষ্যজানের সংঘর্ষে শুধু বাংলাদেশে নিহত হচ্ছে বছরে সাড়ে ছয় হাজারের অধিক মানুষ।