Translate

Wednesday, 13 February 2019

সরকারি স্বীকৃতি নেই জাতীয় কবি নজরুলের / ড. মোহাম্মদ আমীন


ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। চাকুরিতে যোগদানের পর বিভিন্ন মুখে জানতে পারি, কাজী নজরুল ইসলাম
সরকারিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি নন। তিনি কেবল লোকমুখে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং তাঁর ‘জাতীয় কবি’ পদবি ধারণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। এমন অভিযোগ আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব হিসেবে যোগদানের পর নিজ উদ্যোগে প্রকৃত বিষয়টি জানার চেষ্টা করি। চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রযোজ্য সময়ে জারিকৃত গেজেট প্রজ্ঞাপনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখতে থাকি। 
শিক্ষামন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে যোগদানের পর আমার উদ্যোগ আরও সহজ এবং সংগতকারণে আরও বেগবান হয়। রহস্য উন্মোচনের জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত গেজেট বা কোনো প্রজ্ঞাপন আছে কি না তা অনুসন্ধানে ব্রত হই। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয় এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে অগাস্ট তিনি বাংলাদেশেই মারা যান। তাই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি আমি ওই সময়ে প্রকাশিত গেজেটপ্রজ্ঞাপন এবং সরকারি পত্রের মধ্যে সীমবাদ্ধ রাখি। প্রসঙ্গত, এর আগে বা পরে নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হলে তা আমার অনুসন্ধানের বাইরে থেকে যেতে পারে। 
অনুসন্ধানের অনিবার্য পর্যায় হিসেবে আমি, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের মে থেকে শুরু করে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে অগাস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় সবগুলো গেজেট খুঁজে দেখেছি, কিন্তু কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার গেজেট নোটিফিকেশন বা প্রজ্ঞাপন কিংবা অনুরূপ কোনো সরকারি আদেশ পাইনি। সচিবালয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত ওই সময়ের সবগুলো গেজেট খুঁজেছি, কিন্তু প্রত্যাশিত কোনো প্রজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েনি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মাননা এবং অনারারি ডিগ্রি প্রভৃতি প্রদান সংক্রান্ত দলিলও পর্যালোচনা করা হয়।ওখানেও কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়েছে। 
সংস্কৃত মন্ত্রণালয়েও খোঁজ-খবর নিয়েছি, সেখানেও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার বিষয়ে কোনো ডকুমেন্ট রক্ষিত নেই। আর্কাইভ এবং বাংলা একাডেমিতেও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো প্রকার দলিল
ড. মোহাম্মদ আমীন
পাওয়া যায়নি। তবে সংস্কৃত মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমিতে নজরুলকে একুশে পদক প্রদান সংক্রান্ত প্রমাণক পাওয়া গিয়েছে। স্বাধীনতার পর সচিবালয়ে সচিব, অতরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব, উপসচিব এবং সেকশন অফিসার হিসেবে চাকুরি করেছেন এমন অনেকের কাছে নজরুলের ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণার বিষয়টি জানতে চেয়েছি। সিনিয়র-জুনিয়র কোনো অফিসার এ বিষয়ে কোনো গেজেট দেখেননি বলে জানান। তাঁদের অভিমত, কাজী নজরুল ইসলাম মৌখিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কাগজকলমে প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে নন। 
এ বিষয়ে নজরুল ইনস্টিটিটের অস্পষ্টতা আরও বেশি। ইন্সটিটিউটের কয়েকজ জানান, মন্ত্রিপরিষদের একটি বৈঠকে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছিল। কখন প্রশ্নের উত্তরে তারা কেউ দিতে পারেননি। কয়েকজন বলেছেন, সম্ভবত এরশাদের আমলে প্রস্তাবটি পাস হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। আমি ওই সময় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বেশ কয়েকটি সভার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করেও এমন কোনো তথ্য পাইনি। 
মৌখিকভাবে কেউ জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হতে পারেন এবং জনস্বীকৃতিও পেতে পারেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কেবল মৌখিক বিষয় নয়, আনুষ্ঠানিকতা ও সার্বভৌম শক্তির দাপ্তরিক ঘোষণার বিষয়টিও থাকে। অধিকন্তু, জাতীয় কবি ঘোষণার একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সে নীতিমালা অনুযায়ী কাউকে জাতীয় কবি ঘোষণা করতে হলে কিছু প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। কাজী নজরুল ইসলামের বেলায় এসব করা হয়েছে-- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, অন্তত আমি পাইনি। অনেকে বলেন, ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কবি নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু কে করেছে, কোথায় এবং কীভাবে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দূরে থাক, কোনো উত্তরই পাওয়া যায় না। 
আমার লেখা পড়ে অনেক উপহাস করে বলবেন, নজরুলের ‘জাতীয় কবি’ “তাঁর স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। তিনি স্বীকৃতি ছাড়াই আমাদের জাতীয় কবি।” আমিও তাই মনে করি, কিন্তু স্বীকৃতিটা কী এতই দামি কিংবা নজরুল কী এতই ফেলনা যে তা দেওযা যাবে না!, আমরা কী এতই অনুদার! যদিও ‘জাতীয় কবি’ উপাধি নামের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নজরুলের জন্য অনিবার্য নয়, কিন্তু আমরা কতটুকু বোধের পরিচয় দিতে পেরেছি- সে প্রশ্ন করা কি অন্যায় হবে? অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু নামের কী গেজেট নোটিফেকশনে হয়েছে? হয়নি, কারণ ‘বঙ্গবন্ধু’ সরকারিভাবে সময়ে সময়ে জনগণকে প্রদত্ত কোনো পদক বা সম্মাননা নয়, কিন্তু জাতীয় কবি, জাতীয় অধ্যাপক প্রভৃতি সরকারিভাবে জনগণকে সময়ে সময়ে প্রদত্ত সম্মাননা, যা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী অর্পণ করা হয়। যেমন : একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক প্রভৃতি। অধিকন্তু, বঙ্গবন্ধু আর জাতীয় কবি এক নয়, বঙ্গবন্ধু অদ্বিতীয়, কিন্তু জাতীয় কবি একাধিক হতে পারেন।পৃথিবীর অনেক দেশে একাধিক জাতীয় কবি আছেন, আমাদের দেশে যেমন আছেন একাধিক জাতীয় অধ্যাপক।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হলেও সরকারিভাবে ঘোষিত নয়। অবশ্য পরবর্তীকালে সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশও প্রণীত হয়েছে। এটিও স্বীকৃতি, যদিও তা পরোক্ষ। 
নজরুল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি ঘোষিত না হলেও তিনি আমাদের জাতীয় কবি; আকাশ-বাতাসও এটি জানে। জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের পরিচিতি এত ব্যাপক, গভীর, নিবিড় ও হার্দিক যে, এখানে সরকারি স্বীকৃতি সমুদ্রের প্রতি গোষ্পদের জলদানের মতোই তুচ্ছ। আকাশের অসীমতার প্রমাণ দিতে আকাশ লাগে, আকাশ কী দুটো আছে?

Tuesday, 16 October 2018

সংখ্যা নয়, সংগঠিত রূপই শক্তির নিয়ামক / ড. মোহাম্মদ আমীন



মনুষ্য জগতে পথচারীরা সংখ্যায় এককভাবে সর্বাধিক হলেও তারাই বর্তমানে সবচেয়ে অসংগঠিত। অসংগঠিত বলে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়েও অতি দুর্বল এবং দুর্বল বলে চরমভাবে অবহেলিত। এটা প্রমাণ করে যে, শুধু সংখ্যাঘরিষ্ঠতা
শক্তির একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, সংখ্যাকে শক্তিতে পরিণত করতে হলে লক্ষ্যের ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়া অপরিহার্য। তা না হলে এক কোটি চল্লিশ লাখ ইহুদির কাছে একশ ষাট কোটি মুসলিমকে নতজানু হয়ে থাকতে হতো না বছরের পর বছর; পরাজিত হতে হতো না বার বার বিভিন্নভাবে যুগের পর যুগ। মনে রাখতে হবে, সংখ্যা নয়, সংগঠিত রূপই শক্তির নিয়মক। 

আইনানুগ মালিক যদি তার সম্পদের দখলত্ব প্রতিষ্ঠা ও ভোগের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ না-করে তা হলে আইনানুগ অধিকারও ব্যহত হয়ে চলে যেতে পারে স্বার্থান্বেষী কারো অবৈধ দখলে। মনে রাখতে হবে, বেদখলের শঙ্কা হতে স্বার্থ রক্ষার বিধি প্রণীত হয়েছে। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস প্রথমে আবশ্যিকভাবে মালিকপক্ষ হতে সূচিত হতে হয়। নইলে যে কোনো সম্পত্তি অন্যের অধিকারে চলে যেতে পারে। সাধারণত ভোগের সময় বিবেচনা করে দখল ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেওয়া হয়। দখলাধিকার যত বেশি সময় বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা থাকে তা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তত বেশি প্রয়াস উৎসরিত হয়।এজন্য সাধারণ জনগণে সংগঠিত অধিকার প্রতিষ্ঠার নজির খুব বেশি নয়, শক্তও নয়। 

ফুটপাত করা হয় পথচারীদের জন্য। বিধি-নীতি, ব্যবহার ও নজিরগতভাবে ফুটপাতে পথচারীদের একচ্ছত্র স্বার্থ, অধিকার ও দখল থাকার কথা। কিন্তু দখল রাখার জন্য যে পরিমাণ চেষ্টা প্রয়োজন তা প্রতিষ্ঠার জন্য পথচারীদের প্রয়াস থাকে না বলে অধিকার ও দখল দুটোই লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আমাদের জরিপে দেখা গিয়েছে, ঢাকা শহরের এক
কোটি আশি লাখ জনগণ এবং প্রতিদিন প্রায় পঁচাশি লাখ পথচারীর অধিকার দশ হাজারের কমসংখ্যক লোকের কব্জায়। শুধু ঢাকা নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশে এমন চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর চিত্র ভিন্ন। সেখানে পথচারীদের অধিকার রক্ষায় তাদের সরকার এত সচেতন থাকে যে, কোনো অবস্থাকে কোটি জনের অধিকার কটি জনের কব্জায় পতিত হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। 

একজন পথচারী দীর্ঘসময় পথে হাঁটলেও তার প্রতিটি পদক্ষেপ একটি স্থানে খুব কম সময়ের জন্য স্থায়ী থাকে। ফলে পথচারীগণ ওই স্বল্পসময়ের জন্য ওই পদক্ষেপভূমে দখলাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে পরিমাণ প্রয়াসকে নিয়োজিত করা উচিত তা করে না। এটাও ভাবে না যে, একটা একটা পদক্ষেপে রচিত হচ্ছে পুরো পথের উপর তার অধিকার। একটা পদক্ষেপের অধিকারকে অবহেলা করতে গিয়ে তাই সে হারিয়ে ফেলে পুরো পথ। অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তার খেয়াল অবহেলায় পতিত হয়। তাই পথচারীরা পথের অধিকার হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়। 

বিপুল সংখ্যক কিন্তু নিজেদের চারণিক অধিকার সম্পর্কে অসংগঠিত নিরীহ পথচারীর পক্ষে উচ্চকিত আওয়াজ তোলার ন্যুনতম সামর্থ্যও রাখে না।তাই সরকার তাদের চলাচলের জন্য ফুটপাত বানায় একই সঙ্গে সেখানে তাদের
দখলাধিকার ও সাবলীল ভোগ সুরক্ষিত রাখার সর্বপ্রকার উদ্যোগ অক্ষুণ্ন রাখে। কিন্তু অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে সরকারের এই উদ্যোগ নানা কারণে এতই হালকা-আলগা ও স্বার্থগৃধ্নু হয়ে পড়ে যে, নিরীহ পথচারীগণ পথাধিকার হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়। হাজার হাজার পথচারীর আইনানুগ অধিকারকে অবহেলা করে কয়েকজন লোক ফুটপাতে নিজেদের একচ্ছত্র ভোগ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ফুটপাতে গড়ে ওঠে দোকান, নির্মাণসামগ্রী রাখার স্টোর, রাজনীতিক দলের অফিস, গ্যারেজ, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়, ভিক্ষুকাগার, গানাসর আরো কতো কী! 

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দেশে পরিচালিত জরিপে, উন্নয়নশীল দেশসমূহের বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত জনগণের অধিকার হরণের মহোৎসবই দেখা গেছে। মূলত এসব নিরীহ লোকদের ভোটেই গঠিত হয় সরকার। ফলে সরকারই এদের সংগঠিত রূপ এবং শক্তির আধার হয়ে তাদের পক্ষে কাজ করার কথা, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে তা খুব কমই দেখা যায়। উন্নত এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে সরকার সবক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক নিরীহ এবং অসংগঠিত জনগণের আধিকারিক হিসেবে অনড় থেকে তাদের পক্ষে কাজ করে যায়। ফলে বিস্তৃত হয় সুশাসন, নিশ্চিত হয়ে যায় সবার অধিকার। কিন্তু অনুন্নত ও নামমাত্র গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যায় তার উলটো।

যে দেশের ফুটপাত পথচারীদের নিয়ন্ত্রণের যত বেশি বাইরে সে দেশের জনগণ তত অধিকমাত্রায় বঞ্চিত, লাঞ্ছিত,
ক্ষোভিত, নির্যাতিত, অরক্ষিত এবং অবহেলিত। ওই দেশের সরকার অতিমাত্রায় দুর্বল বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরীহ জণগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার আইনানুগ প্রয়াসকে অবহেলা করে কয়েকজন কায়েমি স্বার্থবাজের বেআইনি অধিকারকেও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যায়। ফলে অসংগঠিত পথচারী হারিয়ে ফেলে তার স্বাচ্ছন্দ্য-হাঁটার চিরন্তন অধিকার। এই দখল ফুটপাত থেকে বিস্তৃত হয়ে নেমে আসে রাজপথে। 

ফলে যানজট আর জানজটে (মানবজট) বেহাল হয়ে যায় প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা। পথচারীগণ হাঁটার জন্য যানপথে নেমে আসতে বাধ্য হয়। লৌহনির্মিত লৌহযানের সঙ্গে নরম মাংসনির্মিত মনুষ্যজানের সংঘর্ষে শুধু বাংলাদেশে নিহত হচ্ছে বছরে সাড়ে ছয় হাজারের অধিক মানুষ।

Monday, 8 October 2018

ভারতে চিকিৎসা কী এবং কেন / ড. মোহাম্মদ আমীন



ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে ভারত গমনের জন্য মেডিকাল ভিসা দেওয়া হয়েছে। রোগী প্রতি তিন লাখ টাকা খরচ ধরলেও ১ লাখ ৩০ হাজার রোগীর চিকিৎসায় বাংলাদেশি ৩৯০০ কোটি টাকা ভারতে চলে গেছে। বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভারত যা আয় করে তার ৫০ ভাগ আসে বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে থাকে। এ অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১.৯৪%। ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস-এর হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর মেডিকেল ট্যুরিজম থেকে ভারত আয় করেছে মোট ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই গেছে ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ কোটি ১৩ লাখ ও ইরাক থেকে ৫ কোটি ডলার আয় করেছে ভারত।

ভারতে কেন বাড়ছে বাংলাদেশি রোগরি সংখ্যা ? বাংলাদেশের স্থানীয় চিকিৎসকের উপর আস্থার অভাব এবং ভুল চিকিৎসার ভয়ে অনিচ্ছা ও আর্থিক অক্ষমতা সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, বলা যায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়। এ দুটি দূর করা গেলে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসার প্রবণতা আশি ভাগ কমে যাবে। 
ভারত হতে চিকিৎসা-ফেরত রোগীদের অভিমত, আস্থাহীনতা ও ভুল চিকিৎসা ছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের হার্দিক আচরণ এবং আন্তরিক দেখভাল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভারত গমনের অন্যতম একটি কারণ। চিকিৎসক ও নার্সদের অমায়িক ব্যবহারের কারণে রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজন আনন্দ, আবেগ আর আস্থায় বিমোহিত হয়ে পড়ে। ফলে মূল চিকিৎসার আগেই ৩০ ভাগ সুস্থ হয়ে যান। একই মানের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পরীক্ষার সঠিক ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একই রোগীর পরীক্ষার একেক ধরনের ফল দিয়ে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার হার অনেক বেশি। ভারতে তা অনেক কম। ভারতে চিকিৎসার নামে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। একই ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা একাধিকবার করানো, রোগীকে সময় কম দেয়া, বাড়তি আয়ের জন্য রোগীকে অতিরিক্ত সময় কেবিন বা বিছানায় রাখার প্রবণতা নেই সেখানে। অধিকন্তু সার্বিক বিবেচনায় চিকিৎসার খরচও কম। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। 
অত্যন্ত প্রশিক্ষিত নার্সদের পেশাদারিত্ব এবং যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি বাংলাদেশিদের মুগ্ধ করে। যে কোন সমস্যা শুধু ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে জানালেই সমাধান হয়ে যায়। ওদের অন্তরিকতা প্রশংসনীয় এবং অত্যন্ত প্রফেশনাল। রোগী এবং রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা যেন সন্তুষ্ট হয়ে যেন পরবর্তীকালে আবার আসে সেই চেষ্টাই সবসময় করে। চিকিৎসা শুরুর সূচনায় এরা যে প্যাকেজ অফার করে সাধারণত তার থেকে এক পয়সাও বেশি দাবি করে না। রোগী এবং প্যাকেজের অর্থ পেলে বাকি সবকিছুর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। ফলে রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন হয় না।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোগীর পরিজনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, চিকিৎসকদের বেতন ব্যবস্থা, তুলনামূলক কম খরচ, প্রযুক্তির সাহায্যে ধাপে ধাপে চিকিৎসার ব্যবস্থা, রোগ চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত ভর্তি না নেওয়া— এই সব কারণে ভারতে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দেশের অনেক চিকিৎসকও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। তাদের অভিমত, হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে কর্মীদের ব্যবহার আরও ভালো হওয়া দরকার। না হলে এখানে যত ভালই পরিকাঠামো গড়ে তোলা হোক না কেন, মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি দেবেন। 
ভারতের চিকিৎসক, নার্স, কর্মী— সবাই রোগীর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করেন। রোগীর কী অবস্থা, সে ব্যাপারে নিয়মিত তথ্য দেন। এ ছাড়া চিকিৎসায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে হবে। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কম রয়েছেন, এমন নয়। তবে তাদের ব্যবহার ভালো নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, কয়েকটি কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকে। প্রথমত. যোগাযোগ ব্যবস্থা; উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় আসতে যত সময় লাগে, ভারত যেতে লাগে তার চেয়ে কম সময়। আমাদের কিছু জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। দক্ষতার অভাবের পাশাপাশি চিকিৎসকদের ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে রোগীবান্ধব নয়। রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতায় ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণেই মূলত বেশি সংখ্যক রোগী ভারতে যাচ্ছে। 
বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হওয়ার প্রবণতার জন্য অনেকে বাংলাদেশের চিকিৎসা-প্রশাসন এবং ডাক্তারগণকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মতে, যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের হর্তকর্তাদেরও আস্থা নেই, যে দেশে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির চিকিৎসার মতো চিকিৎসালয় নেই সেই দেশের চিকিৎসায় কীভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে, সে দেশের চিকিৎসালয়ে কীভাবে সাধারণ মানুষের কার্যকর চিকিৎসা হবে? তাই উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনও চিকিৎসার জন্য ভারত চলে যায়। তাদের অভিমত, ভারতে চিকিৎসা ব্যয় যেমন সস্তা তেমন কার্যকর। ফাও হিসেবে একটা দেশও দেখা হয়ে যায়। থাকে টাকার ব্যবধানও। ভুল চিকিৎসা হয় অনেক ক্ষেত্রে। আর একটা বিষয়, ভারতের ডাক্তারগণ আমাদের দেশের মতো ওষুধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশন ভরিয়ে ফেলে না, দু একটা ওষুধ দেয়।

চিকিৎসার খরচের ধারণা দেওয়ার জন্য একটা বাইপাস অপারেশনের খরচ বিভিন্ন হাসপাতালে কত হতে পারে তা জানা যাক : সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল ও থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাড ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে খরচ প্রায় সমান এবং তা প্রায় ২৭ হাজার ডলার। ভারতের বিভিন্ন ভারতের বিভিন্ন বিখ্যাত হাসপাতালে বাইপাস বা ট্রিটম্যান্ট প্লান এর খরচ ৫০০০ ডলার থেকে ৬৫০০ ডলার। দেশে বাইপাস করায় এমন হাসপাতাল হচ্ছে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এপোলো, ল্যব এইড, নাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, দিনাজপুরের জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এখানে বাইপাস অপারেশন করাতে কেবিনে ৫০০০ ডলার থেকে ৬০০০ ডলার এবং ওয়ার্ডে ৩৭৫০ থেকে ৪০০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে। দেশে কিংবা বিদেশে সব হাসপাতালের বাইপাস অপারেশন এর প্যাকেজ কম বেশী একই (৭ -৯ দিন হাসপাতালে অবস্থান, রোগীর সাথে সার্বক্ষনিক একজন সহযোগীর থাকার সুযোগ খাওয়াসহ, টুইন শেয়ারিং রুম - মানে একরুমে দুই রোগী ইত্যাদি)। এছাড়াও সিংগেল কেবিন রুম আছে, সেক্ষত্রে উপরে বর্ণিত মোট অংকের চেয়ে হাসপাতালভেদে ১০০০-২০০০ ডলার বেশি খরচ পড়ে।

ভারত চিকিৎসার জন্য পাড়ি দেওয়ার আর একটি কারণ হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে কম খরচে চিকিৎসা। একটি ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা হলো। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়স্ক হেনরি কনজ্যাক। পেশায় গীতিকার ও ভিডিও প্রযোজক। ২০০৮ সালের দিকে হঠাৎ তার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জানা গেল তার রক্তে দূষণ দেখা দিয়েছে। এরপর টানা এক মাস এন্টিবায়োটিক নিতে থাকেন তিনি। কিছুদিন পর জানা গেল যে, তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার মিট্রাল ভাল্ব প্রতিস্থাপন করতে হবে। হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। তা-ও আবার সার্জনের ফি বাদ দিয়ে। কনজ্যাকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বয়স ৫০ পেরিয়ে যাওয়ার পর তার স্বাস্থ্য বীমা বাতিল হয়ে যায়। আরেকটি বীমা করার সামর্থ্যও তার ছিল না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খরচ কমাতে রাজি নয়। কনজ্যাকের হাতে তখন দু’টি রাস্তা খোলা। এক. দেউলিয়া হয়ে যাওয়া। দুই. মৃত্যু। কনজ্যাক এই দুই বিকল্প বাদ দিয়ে, তৃতীয় একটি বিকল্প বেছে নিলেন। সেটি হলো, ভারত।
ওই বছরের ২৩শে ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রশান্ত এ্যাপোলো হাসপাতালে সফলভাবে তার অস্ত্রোপাচার সম্পন্ন হয়। ভারতে তিন সপ্তাহের সফর, বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে হাসপাতালের খরচ সহ তার মোট ব্যয় হয় মাত্র ১০ হাজার ডলার। কনজ্যাকের ভাষায়, ভারতে চিকিৎসা করিয়ে তিনি নিজের জীবন ও ব্যবসা দু’টোই বাঁচিয়েছেন। এক সরকারি জরিপ জানা যায়, ব্যয় কম হওয়ার জন্য প্রতিবছর ৩ লাখেরও বেশি আমেরিকান নাগরিক চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন। তাদের বেশির ভাগই আসেন ভারতে।
ভারতে কী ঝামেলা এবং হয়রানি কম হয়? না। ভারতে যাবার জন্য ভিসা-সংগ্রহ থেকে শুরু করে যাতায়াত, অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া, ম্যাডিক্যাল টেস্ট ও রিপোর্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে যথেষ্ট ঝামেলা ছাড়াও প্রচুর হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অধিকন্তু একবার চিকিৎসার জন্য গেলে ফলোআপ হিসেবে আরো অনেক বার ভারত যেতে হয়। তারপরও ভারত-ফেরত রোগীরা বাংলাদেশে এসে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার এতই উচ্ছসিত প্রশংসা করে যে, অনিচ্ছুকরাও দেশে চিকিৎসার কথা বাদ দিয়ে ভারত চলে যায়। কেন এমন প্রশংসা? এর কারণ হচ্ছে আস্থা, বিশ্বাস এবং হার্দিক আচরণ। তবে শুধু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছেন তা নয়। কারণ এমন অনেক প্রভাবশালী রোগী আছেন তারা খুব ভালো ব্যবহার পেয়ে থাকেন। তবু তারা বিদেশ চলে যায়। চিকিৎসার জন্য ভারত যাবার সবচেয়ে বড়ো কারণ স্থানীয় ডাক্তারদের প্রতি চরম অনাস্থা এবং ভুল চিকিৎসার ভয়। 
আমি মনে করি, শুধু ডাক্তার নয়, এজন্য জনগণ এবং সাধারণ রোগীদের দায়ও কম না। বিদেশের প্রতি আমাদের দুর্বলতা একটা অসভ্য বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাজারে গেলে কেবল হাঁসমুরগি ছাড়া প্রত্যেক কিছুতে বিদেশি তমকা খুঁজে বেড়াই। অধিকন্তু ভারতীয় চিকিৎসকদের কৌশল ও প্রচারের কাছেও আমরা মার খাচ্ছি। এ বিষয়ে সরকার ও জনগণের কার্যকর সচেতনতা প্রয়োজন এবং মাথা থেকে এই সচেতনতা শুরু করতে হবে। 

Sunday, 7 October 2018

সাবধান : সচেতন হউন / ড. মোহাম্মদ আমীন


মন খারাপ কেন? 
আমার এক সিনিয়র বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম। তার নাম জে চৌধুরী। প্রসঙ্গত, তিনি চট্টগ্রাম থেকে
ঢাকা এসেছেন বড়ো ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে নামিদামি একটা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য।
আমার প্রশ্নের উত্তর তিনি বললেন, গলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত বড়ো ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, গলার নষ্ট অংশ কেটে প্লাস্টিকের গলা লাগিয়ে দিতে হবে। নইলে বেশি দিন বাঁচবে না।
কত দাম হতে পারে? ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলাম।
ডাক্তার বললেন, আমেরিকান লাগালে চার লাখ টাকা এবং ভারতীয় লাগালে সত্তর হাজার টাকা। আমেরিকারটার মেয়াদ পঞ্চাশ বছর এবং ভারতীয়টার মেয়াদ দশ বছর।
বড়ো ভাইয়ের বয়স আশি চলছে। অনেক দিন ধরে অসুস্থ। কথাও বলতে পারছেন না। তার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতীয় পার্টসটাই লাগাব। ডাক্তারকে সেভাবে বলে দেওয়া হলো। প্লাস্টিকের গলা লাগানোর চার দিন পর বড়ো ভাই মারা গেলেন। বিল দিল হাসপাতাল, সব মিলিয়ে পনের লাখ টাকা। প্লাস্টিক গলার দাম ধরেছে চার লাখ। ।
এত টাকা কেন? আমি তো ভারতীয়টা লাগতে বলেছিলাম।
ডাক্তার বললেন, আপনি বললে কী হবে, আপনার বড়ো ভাই বলেছেন, যত টাকাই লাগুক আমেরিকানটা লাগাতে হবে। নইলে লাগাবেন না। আপনাদের সঙ্গে আলাপের কথা বলাতে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন, ওসব কঞ্জুসদের কথা মুখেই আনবেন না।
তারপর কী হলো? আমি আগ্রহসহকারে জানতে চাইলাম।
কোন দেশি পার্টস লাগানো হলে তা পরীক্ষার জন্য অন্য এক হাসপাতালে নিয়ে মৃত বড়ো ভাইয়ের গলায় আবার অপারেশন করা হলো। অপারেশনের পর আমরা বিমূঢ়, তার গলায় কোনো পার্টসই লাগানো হয়নি।ক্ষুব্ধ মনে মামলা করতে গেলাম। পুলিশ প্রাথমিক অনুসন্ধান করে প্রাথমিকভাবে সত্য পেলে মামলা নেবে জানিয়ে ওই হাসপাতালে গেলেন। সাত দিন পর পুলিশ জানাল, ওই হাসপাতালে আমার বড়ো ভাইকে ভর্তিই করা হয়নি।
পরদিন আমি ওই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করলাম। ডাক্তার কিছুক্ষণ পর জানালেন কম্পিউটারে জে চৌধুরী নামের কোনো রোগীর ভর্তি হওয়া সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। অন্য কোনো হাসপাতালে গিয়ে দেখেন।

যেহেতু ঘটনাটি শোনা তাই হাসপাতালের নাম দিলাম না। না দিলেও ধারণা করে নিতে পারেন, ধারণা করতে না পারলেও সতর্ক হতে পারেন। ধারণার চেয়ে সতর্কতা অধিক প্রয়োজনীয়।

Saturday, 6 October 2018

উদ্ভাবনশীলতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ / ড. মোহাম্মদ আমীন


‘গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স-২০১৮’ এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম উদ্ভাবনশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশ। উদ্ভাবন বিবেচনায় প্রথমে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চিন ও মালয়েশিয়া। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম স্থানে যথাক্রমে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মঙ্গোলিয়া। উদ্ভাবনশীলতা বিবেচনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান এমন কি নেপালের চেয়েও পিছিয়ে। কিন্তু কেন এমন অবস্থা?
প্রথম শ্রেণি থেকে একটা শিশুর মাথায় ও ঘাড়ে বইয়ের যে বোঝা তুলে দেওয়া হয় তা বহন করতে করতে মেধার পঞ্চাশ ভাগ শেষ হয়ে যায়। উচ্চ জিপিএ-সনদ লাভের জন্য শুধু নাম্বারের পেছনে ছুটে। ফলে তাদের সৃজনশীলতা মুখ থুবরে পড়ে থাকে নাম্বারের নিচে। মা বাবারাও চায় না তাদের ছেলে সৃজনশীল হোক, তারা চাই তাদের সন্তান নাম্বারশীল হোক।
বিষয় আর বিষয় এবং বই আর বই মুখস্থ করে শিক্ষার্থীরা সব বিষয়ে ভাসা ভাসা অল্পস্বল্প কিছু হয়তো শিখতে পারে কিন্তু ভালোভাবে কিছুই শিখতে পারে না। সবকিছু শিখতে গিয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে কিছুই শিখতে পারে না। যেমন :
পানি পান করতে গিয়ে নদীতে ডুবে বাতাসের জন্য হাহাকার করা। বিজ্ঞানপ্রধান বিশ্বে সব বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান জানার চেয়ে একটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়াই উদ্ভাবনশীলতার প্রথম সোপান- এ বিষয়টা আমাদের দেশে চরমভাবে অবহেলিত।
সামরিক বাহিনীতে সরকারের ব্যয় বেশি বলে ওখানে ক্যারিয়ার গঠনকে মর্যাদাকর মনে করা হয়। ফলে এইচএসসি পাস করার পর মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা অংশ সামরিক বাহিনীতে ঢুকে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রকৃত মেধাবীদের সিংহভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সৃজনশীল নয়, এরকম প্রশ্ন দিয়ে কাকাতুয়ার মতো মুখস্থবিদ্যার শক্তি যাচাই করা যায়, জিনায়সনেস জানা যায় না। দেড় লাখ
পরীক্ষার্থীর মধ্যে তিন হাজারকে যোগ্য নির্বাচন করা হয়, তাহলে বাকিরা কী অযোগ্য? স্বাভাবিকভাবে বাকি এক লাখ সাতচল্লিশ হাজারে মেধাবী ও জিনিয়াসের সংখ্যা নির্বাচনী পরীক্ষায় যোগ্য-বিবেচিত তিন হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তারা অকার্যকর ভর্তি পরীক্ষার ফাঁদে পড়ে অযোগ্য হয়ে যায়। এদের অনেকে চলে যায় বিদেশে পড়তে এবং অনেকে আর ফিরেই আসে না। ফলে বাংলাদেশের উদ্ভাবনশীলতা বিদেশে গিয়ে লালিত হয় বা গলিত হয়।
বুয়েটের মতো প্রাযুক্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার অবস্থা আরো শোচনীয়। পূর্বের পরীক্ষাসমূহে জিপিএ ফাইভ না পেলে ভর্তির দরখাস্তই করা যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় যারা ভালো নাম্বার পায় কিংবা ভালো নাম্বার পাওয়ার জন্য মেধাবী হিসেবে পরিচিত হয় অথবা যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তাদের মেধাবী বলার চেয়ে মুখস্থবি বলাই সংগত। জিনিয়াসরা সাধারণত বাংলাদেশের মতো মুখস্থবি নির্ভর প্রশ্নপত্রমণ্ডিত প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় টিকে না। তারা সৃজনশীল বলে সৃষ্টির নেশায় এতই বিভোর থাকে যে, কোন দেশের রাজধানী কোথায়, কোন নায়িকার চুলের রং গোলাপি কিংবা রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা উপন্যাসে কয়টি শব্দ আছে-- এসব সাধারণ বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় পায় না। ফলে জিনিয়াস ও মেধাবীদের এক বিরাট অংশ নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ হতে ছিটকে পড়ে। অন্যদিকে যারা চিকিৎসক প্রকৌশলী কিংবা কৃষিবিদ হিসেবে পড়ার সুযোগ পান তাদের সবাই যে মেধাবী এমনটি বলা যায় না।
যে কারণেই হোক না কেন, প্রাযুক্তিক বিদ্যাধারীদের অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে বিষয়ভিত্তিক পেশায় না গিয়ে এমন সব পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়ে যেখানে তাদের প্রাযুক্তিক জ্ঞান এক বিন্দুও কাজে লাগানো যায় না। বলা হয় ক্ষমতার জন্য বা অতিরিক্তি আয়ের জন্য এমন করে থাকে। বুয়েট-ম্যাডিকেলের অনেক ছাত্রকে প্রশাসন, পুলিশ, কর, শুল্ক প্রভৃতি ক্যাডারে চাকুরি করতে দেখা যায়। পদার্থ-রসায়ন থেকে পাস করে পুলিশের ওসি হয়, হাতে লাঠি পায়; পদার্থবিদ হলে তো এটি আর পাবে না। ফলে উদ্ভাবনশীলতা হারিয়ে যায়।
রাজনীতিক অস্থিরতা এবং যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার তাদের কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়নকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে অধিক আগ্রহী। এরূপ উন্নয়ন করতে গিয়ে নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয় দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন। কিন্তু একটি জাতিতে প্রকৃত অর্থে উদ্ভাবনশীল জাতিতে পরিণত করতে হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে যে, পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয় সে বোধ অনেকের থাকলেও দেখানোর সুযোগ হয় না। 
যেসব দেশ উদ্ভাবনশীলতায় এগিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উদ্ভাবন ব্যয় বাড়িয়েছে বলেই উদ্ভাবনশীলতা বেড়েছে। এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনাকে রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা করা হয়নি। উদ্ভাবন ব্যয়ের পরিবর্তে প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবছর প্রতিরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও প্রাশাসনিক খাতে যে ব্যয় করা হয় তার অর্ধেক কমিয়ে উদ্ভাবনে খরচ করা গেলে বাংলাদেশ উদ্ভাবনশীলতায় সিঙ্গাপুরকে পিছিয়ে দিতে পারবে।

অণ্ড ডিম্ব ডিম / ড. মোহাম্মদ আমীন



সেমিনারের পর ডিনার। 
ক্যামব্রিজের মেডিংলে হল-এর বিশাল ডাইনিং রুম আলো আর রসনার কোলাকোলি। আমার সামনে প্রফেসর মাসাহিতো ও প্রফেসর নন্দিতা চোপড়া, ডানে প্রফেসর রচনা, বামে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের খাদ্য-পুষ্টি বিভাগের প্রফেসর ড. ক্যাথরিনা ক্যাসলার এবং তার পাশে দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর কিচুকি।
কিচুকির বয়স শ ছুঁই ছুঁই করছে। নন্দিতা চোপড়ার ওজন দেড়শ কেজির মতো হবে। আসল দাঁত একটাও নেই, তবে নকল দাঁতের হাসিটা নন্দিতার মোটা শরীরকে প্রত্যুষের মতো নন্দিত করে রাখে। তিনি বলেন, আমি চর্বিনদী। ক্যাথরিনা এবং আমি ছাড়া বাকি সবাই অক্সফোর্ডের শিক্ষক।
আমাদের সামনে নানা উপাদেয় খাবার। আমার চোখ-মন অণ্ড মানে ডিম্বে সমাহিত। এক সময় ডিম্ব দেখলে পৃথিবীর সব রস-লালসা জিহ্বায় এসে ভিড় করত। এখনো করে, তবে খাই না। বয়স বাড়লে নাকি ডিম কম খাওয়া ‍উচিত।
ক্যাথরিনা আমার দিকে ডিমের ডিশটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন প্রফেসর।
“থ্যাংক ইউ”আমি ডিম্বের ডিশটা রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, আমি খাব না, তুমি নাও।
খাবেন না কেন? ক্যাথরিনা ক্যাসলার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন নয় যেন, পুলিশের জেরা।আমি বললাম, বয়স হয়েছে। ডিম্ব খেলে কোলেস্টরেল বেড়ে যায়।
ডিম্ব খেলে কোলেস্টরল বাড়ে এটা ঠিক, তবে সেটি এইচডিএল- ভালো কোলেস্টরল। শরীরে এইচডিএল যত বাড়বে শরীর তত বেশি চাঙ্গা থাকবে। প্রফেসর, আপনি কি চাঙ্গা থাকতে চান না?
ডিম্ব না কি স্ট্রোকের আশংকাও বাড়িয়ে দেয়?
প্রফেসর ক্যাথরিনা দৃঢ় গলায় বললেন, একদম বাজে কথা। আমার এখন সেভেন্টি থ্রি। প্রতিদিন চারটা করে ডিম খাই। প্রতিদিন ডিম খাবেন তবে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দেবেন। তাহলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যাবে। তবে ডায়াবেটিকস রোগীদের ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
মাসাহিতো বললেন, আমি কিন্তু প্রতিদিন তিন-চারটা ডিম খাই।
ক্যাথরিনা বললেন, ডিমে রয়েছে ভিটামিন এ, ই, বি৬, বি১২, থিয়ামিন, রিবোফ্লেবিন ফলেট, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম-সহ শরীর-গঠনে সহায়ক আরো নানা উপাদান। মাসাহিতো ম্যাম, আপনি ডিম খান বলেই আপনার চুরাশীয় শরীরকে আটচল্লিশীয় মনে হয়। হাড় শক্তকরণে ক্যালসিয়ামের কোনো বিকল্প নেই। ক্যালসিয়াম শোষণ করার কারণে হাড় মজবুত হয়। শোষণ-কর্মটা করে ভিটামিন-ডি। ডিমে কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি আছে।
কিচুকি বললেন, আমার হয়েছে জ্বালা।
কী হয়েছে? ক্যাথরিনা বললেন।
বয়স যত বাড়ছে স্মৃতিশক্তি তত কমছে। মস্তিষ্কে কোলিনের সরবরাহ কমে গেছে। তাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে সব ভুলে যাই। কী করি বল তো ক্যথরিনা?
ক্যাথরিনা বললেন, স্যার, ডিম্ব কোলিনের ভাণ্ডার। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতিশক্তিটাও সচল রাখে। আপনি ডিম্ব খান না?
কিচুকি চশমটা নামিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, মগজ ঠিক রাখলাম, কিন্তু চোখ? চোখে কম দেখি কেন? তাও কি অণ্ডের অভাব?
হ্যাঁ।
সব অঘটনই অণ্ডের অভাবে ঘটে?
ক্যাথরিনা : অণ্ডে রয়েছে লুটিন, জিজেনন্থিন, ক্যারোটিনয়েড ভিটামিন। এগুলো দৃষ্টিশক্তির মহৌষধ। প্রবীণদের চোখের জটিলতা কমানোর জন্যই প্রকৃতি ডিম নামের ডিম্বাকৃতির গোলকটায় এতগুলো উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছেন। স্যার, আপনার প্রতিদিন কমপক্ষে দুটো অণ্ড খাওয়া উচিত।
আগামীকাল থেকে চারটা করে খাব।
তাহলে আরো ভালো।
রচনা মায়ের খবর কী? প্রফেসর কিচুকি বললেন।
আমি এত ব্যস্ত থাকি যে, খাওয়ার সময়ই পায় না। পর্যাপ্ত প্রোটিন নিতে পারি না।
“আমিও পাই না”, প্রফেসর ক্যাথরিনা বললেন, “ ডিম্ব যেমন সস্তা, তেমনি সহজভক্ষ্য, রান্না না-করেও খেয়ে ফেলা যায়, খেতেও বেশিক্ষণ লাগে না, ছেলেবুড়ো সবাই খেতে পারে সহজে, দাঁতেরও প্রয়োজন নেই। কুসুমটা প্রোটিনের কোহিনুর। এতে প্রোটিনের পরিমাণ মাংসের সমান। প্রতিদিন দুটো করে ডিম্ব খেলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
অণ্ড না কি চর্বি বাড়ায়? নন্দিতা বললেন।
ক্যাথরিনা : মাংসের প্রোটিন চর্বি বাড়ায় কিন্তু ডিম্বের প্রোটিন মাংস বাড়ায়। ডিম্ব অ্যামাইনো অ্যাসিডের সাগর। শরীর যাতে ঠিক মতো প্রোটিনকে কাজে লাগাতে পারে, অ্যামাইনো অ্যাসিড সেটি দেখভাল করে। আমার স্বামী প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধ কেজি মাংস গিলে। গিলিত মাংস যাতে চর্বি হতে না পারে সেজন্য সে মাংস খাওয়ার পর একটা ডিম্ব খেয়ে ফেলে।
কিচুকি বললেন, বুঝেছি।
কী বুঝেছেন?
তোমাদের মতো ব্যস্ত, আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত দরিদ্র, নন্দিতার মতো দন্তহীনদের জন্য ইশ্বর অণ্ড নামের গোলকটায পৃথিবীর সব কিছু ভরে দিয়েছেন।
কিন্তু অণ্ডটা কে সৃষ্টি করল? মাসাহিতো বললেন।
কিচুকি : ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্তই অণ্ড সৃষ্টি করেছেন। আসলে এটাই পৃথিবী। এজন্য পৃথিবীকে বলা হয় ব্রহ্মাণ্ড। মানে ব্রহ্মের অণ্ড।
নন্দিতা : গণিতের শূন্যটাও অণ্ড। এই শূন্য ছাড়া গণিতও অর্থহীন। গণিত অর্থহীন মানে সবকিছু অর্থহীন। কারণ, গণিতই বিজ্ঞানের বাবা।
মা-টা কে? কিচুকি বললেন।
নন্দিতা : অণ্ড।
--------------------------------
সূত্র : আমার লেখা রায়োহরণ উপন্যাসের একটি অধ্যায়।

Monday, 21 May 2018

বিশ্বকাপ ফাইনাল / ড. মোহাম্মদ আমীন


আজ স্বপ্ন দেখলাম, স্বপ্ন দেখলাম জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, মূখ্যমন্ত্রীশাসিত রাজ্যে 
প্রতিটি জেলা, বিভাগে
প্রতিটি উপজেলা, স্বয়সম্পূর্ণ জেলায়
প্রতিটি ইউনিয়ন, এক একটি উপজেলায়
প্রতিটি ওয়ার্ড, চেয়ারম্যানের আওতাধীন ইউনিয়নে 
প্রতিটি পাড়া, মেম্বারের অধীন ওয়ার্ডে এবং বিশ্বাস করুন,
প্রতিটি বাড়ি আয়তন অনুপাতে কমিউনিটি সেন্টার, শপিং মল, মাঠ, বিল বা পুকুরে পরিণত হয়েছে। আমাদের গ্রামের বাড়িটা একটু বড়ো। দেখলাম অবাক হয়ে, এটি ফুটবলের মাঠ হয়ে গেছে। এত বড়ো বাড়িতে থাকব কীভাবে? 
হায় হায়!
স্বপ্নরাজ জানাল, আগামী ১৫ই জুলাই, ২০১৮, রোববার রাত ৯টায় মস্কোতে বিশ্বকাপের যে ফাইনাল অনুষ্ঠানের কথা ছিল তা ওখানে হবে না।
কোথায় হবে?
ফুটবল মাঠের মতো বিশাল হয়ে যাওয়া তোমাদের চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে। লোকজন বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার জন্য দলে দলে চট্টগ্রাম যাওয়া শুরু করেছে। তাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২০ কিলোমিটার যানজট। ফাইনালের আগে এই জট কমবে না।
জানতে চাইলাম, ফাইনাল খেলবে কোন দুটি দেশ?
স্বপ্নরাজ বলল, দুই নয়, তিন দেশ একসঙ্গে খেলবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা একত্রে ফাইনাল খেলবে। 
কীভাবে জানলে?
স্বপ্নরাজ বলল, বিশ্বকাপের অনেক বাকি। তারপরও তোমাদের দেশের যুবশক্তি যেভাবে ব্রাআ-ব্রাআ করছে তাতে সারা ফুটবল বিশ্ব ভয় পেয়ে কাঁপছে। তাদের ধারণা বাংলাদেশি এসব লোকেরা পাগল হয়ে গেছে। হুজুগে, অথর্ব, নিষ্কর্মা এবং ঐতিহ্যহীন কিছু কিছু বাংলাদেশি যেভাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে পরপূজকের মতো মস্তক অবনত করে যাচ্ছে তাতে মনে তাদের কোনো দেশ নেই, ভাষা নেই, ঐতিহ্য নেই, স্বকীয়তা নেই, কর্ম নেই, বিবেচনা, বই নেই, সাহিত্য নেই, সংস্কৃতি নেই।
তাহলে তাদের কী আছে?
পরনির্ভরশীল মন। তাদের অর্থহীন চিৎকারে বিশ্বের তাবৎ ফুটবল খেলোয়াড়দের হাত-পা অবশ হয়ে পড়েছে ভয়ে। তাদের কানের পর্দা ফেটে গেছে বাংলাদেশিদের ব্রাআ-ব্রাআ পাগলা চিৎকারে। বাংলাদেশিরা ল্যাটিন আমেরিকার যে দুটি দেশ নিয়ে এমন লজ্জাকর লাফালাফিতে উন্মাদ, বলা যায় সেই দেশদুটির প্রায় কোনো লোকই বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত জানে না। দু-একজন হয়তো দাপ্তরিক প্রয়োজনে জানতে পারে।
স্বপ্নরাজকে বললাম, বাংলাদেশের সঙ্গে যদি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলা হয়, তাহলে বাংলাদেশিরা কেন বাংলাদেশের কথা না বলে ব্রাআ-ব্রাআ করছে?
স্বপ্নরাজ বলল, এদের দেশপ্রেম নেই। এরা মাতৃভাষাটাও ভালো জানে না। 
তাই বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও এদের আচরণ দেশদ্রোহী রাজাকারদের মতো 
ভয়ংকর। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় তারা ‘পরধনলোভে মত্ত’। বিবেচনাশূন্য এসব বাংলাদেশিরা নিজের দেশের মাটির উপর দণ্ডায়মান ঘরের ছাদে, ভবনের শৃঙ্গে, বৃক্ষের শিখরে বিদেশের পতাকা ওড়ায়। এরা পুরোই ঐতিহ্যহীন, ছি! তোমার লজ্জা করে না এদের দেখে?
এরা ফুটবল প্রেমিক, লজ্জা করবে কেন?
এদের বুকে দেশপ্রেমের চিহ্নমাত্র নেই। তাই নিজের বুকে বিদেশি পতাকা লাগিয়ে গর্বভরে ঘুরে বেড়ায়। নিজের গায়ে বিদেশি নামাঙ্কিত জামা জড়িয়ে ঐতিহ্য ও স্বকীয়হীনতাকে আরো উগ্র করে তোলে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন বিদেশ-বন্দনা দেখা যায় না। যারা নিজের দেশ, ঐতিহ্য আর স্বকীয়তাকে অবহেলা করে অন্য দেশের পূজো-বন্দনায় আনত হয় তাদের দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ হতে পারে না।
ঠিক বলেছে স্বপ্নরাজ।জাতীয় দিবসেও বাংলাদেশিরা এত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না, বিশ্বকাপে যত বিদেশে পতাকা উত্তোলন করে। এমন হীনম্মন্য জাতি পৃথিবীতে আর নেই।
তাদের বোধোদয় হোক। কামনা করি, যেভাবে তারা বিদেশ-প্রেম ও বিদেশ-বন্দনায় উন্মাদ সেভাবে তারা যেন স্বদেশ-বন্দনায় রত হয়।
তাতে তোমার লাভ? 
আমার প্রশ্নের উত্তরে স্বপ্নরাজ বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই, যে নিজ দেশকে অবহেলা করে নিজের দেশে বসে পরদেশের বন্দনা করে। এরা আমার স্বপ্নকেও কুলষিত করে দিয়েছে। ছি বাঙালি ছি!