Translate

Sunday, 14 January 2018

ভালোবাসা দিবসের শ্রেষ্ঠ উপহার / শ্রাবন্তী নাহা অথৈ

বইয়ের চেয়ে উত্তম উপহার এবং ভালোবাসার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ আর নেই আর এই দুটির সমন্বয় যদি ঘটানো যায় তাহলে যে কারো জীবন হয়ে ওঠে মধুর এবং ভালোবাসাময় যে জীবনে ভালোবাসা থাকে সে জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে যায় জীবন হয়ে ওঠে স্বর্গীয় প্রাপ্তির চেয়ে প্রত্যাশিত সুখের বিরল উৎস প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া, রুচি-অরুচির ভিন্নতা আছে, আলাদা অনুভূতি আছে, যা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন কিন্তু ভালোবাসা এবং বস্তু হিসেবে বইয়ের ক্ষেত্রে সবার ইচ্ছা অভিন্ন ভালোবাসা পেলে যে খুশি হয় না সে পশুও নয়, জড়; মরা লাশ বই পেয়ে যে আপ্লুত হয় না, সে লাশের চেয়েও অধম তবে বই হতে হবে প্রিয়জনের মনকে নাড়া দেওয়ার মতো অনিন্দ্য আমি এখানে এমন দুটি বই নিয়ে আলোচনা করব, যে বই দুটি আপনার প্রিয়জনকে দিলে এবং আপনার প্রিয়জন আপনাকে দিলে পরস্পরের প্রতি শুধু ভালোবাসা নয়, গভীর কৃতজ্ঞতার নিবিড় আবেশে নতুন একটা জগৎ সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যাবে বহুগুণ বেড়ে যাবে পরস্পর প্রীতি কারণ বই দুটিতে এমন বিষয় আছে, যা ভালোবাসার মূল্য কী এবং কীভাবে, কোথায় কাকে ভালোবাস দিতে হয় এবং কীভাবে তা স্থায়ী করা যায়- সেটিই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের আচরণে তুলে ধরা হয়েছে

তিনে দুয়ে দশ

তিনে দুয়ে দশ. মোহাম্মদ আমীন স্যারের লেখা একটি উপন্যাস যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো বয়সের সিনিয়র, মুরব্বি, গুরুজন বা বয়স্কদের প্রতি কোনো জুনিয়র বা শিশুকিশোর কোনো উপহার দিতে চাইলেতিনে দুয়ে দশউপন্যাসের চেয়ে আর কোনো ভালো
উপহার হতে পারে না। মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, সব পর্যায়ের অগ্রজ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক শিক্ষিকা, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, সিনিয়র নেতা প্রভৃতিসহ যে কোনো মুরব্বি বয়স্ক গুরুজনকে যদি এমন কোনো উপহার দিতে চান, যে উপহার পেলে তিনি খুশি হবেন এবং আপনার প্রতি তার ভালোবাসা, দরদ, মায়ামমতা, স্নেহ, সহানুভূতি, ধৈর্য, বিবেচনাবোধ, সন্তুষ্টি প্রভৃতি বেড়ে যাবে; তাহলে আমি বলব আপনি, তাকে . মোহাম্মদ আমীন স্যারের লেখাতিনে দুয়ে দশউপন্যাসটি উপহার দিন। ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা ভালোবাসা দিয়ে আদায় করা যায় না- এটিই বইটির মূল্য বিষয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত এই বইটি হতে পারে ভালোবাসা দিবস-সহ যে কোনো দিবসে আপনার যে কোনো বয়সের এবং যে কোনো সম্পর্কের প্রিয়জনকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার

তিনে দুয়ে দশ একটি অনবদ্য উপন্যাস। অনবদ্য বলার কারণ আছে। এটি শুধু কথার কথা নয়। নিজের অভিজ্ঞতা হতে লিখিত এই উপন্যাসটি শিশুকিশোর হতে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার জন্য উপযোগী এবং দ্রুত মননশীলতার পরিবর্তনের এক যাদুকরি শক্তি রয়েছে। এই উপন্যাসের কাহিনী বিরল ভালোবাসার অনন্ত মহিমা যেন। যা সবার মনে দাগ কাটতে সক্ষম। শিশু-কিশোরদের মনমানসিকতাকে আদর্শ চেতনায় জাগ্রত করতে হলে বয়স্কদের কী করতে হবে, কেমন হতে হবে তাদের আচরণ, কীভাবে তাদের মূল্য দিতে হবে প্রভৃতি ছাড়াও এই বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষক সমাজের কর্তব্য কী, তা অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনুপম এক গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আবার জ্যেষ্ঠদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য পেতে হলে অনুজদের কী করতে হবে তাও এই উপন্যাসে বাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। এবার বইটিতে কী আছে তা সংক্ষেপে দেখা যাক :

লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন টিউশনি করতেন। ওমর সুলতান নামের তাঁর এক ছাত্র তিনি পড়াতেন। ওমর সুলতান ছিল খুব ডানপিটে, দুষ্ট, বেপরোয়া, যথেচ্ছাচারী, উচ্ছৃঙ্খল বেয়াদব। সে গৃহশিক্ষকের নিকট থেকে প্রতিমাসে বেতনের ৩০% কমিশন নিত। শিক্ষকের সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ়, অশালীন অপমানজনক আচরণ করত। সহপাঠীদের খুব তুচ্ছ ভাবত।বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করত। ওমরের পিতা ছিলেন খুব প্রভাবশালী ছিলেন। তাই স্কুলের শিক্ষক বা স্কুল কমিটি ওমরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করত না। ওমরের এমন অসভ্যতার কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কোনো শিক্ষক তাকে পড়াতে আসত না। এলেও কয়েক দিনের মধ্যে অতীষ্ঠ হয়ে পালিয়ে যেত। আস্তে আস্তে এমন এক অবস্থা উপনীত হয়, ওমর সুলতানকে পড়ানোর জন্যকোনো শিক্ষকই পাওয়া যাচ্ছিল না। স্কুলের শিক্ষক এবং সহপাঠীরাও ওমরকে এড়িয়ে চলত। এভাবে সে খুব একা হয়ে পড়ল। যত এক হয়ে পড়ছে ততই সে বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। মা-বাবার সঙ্গেও সে খারাপ ব্যবহার করত। বাবাকে বাবা ডাকত না। ডাকত ডিআইজি সাহেব।

লেখকের এক বন্ধু, লেখককে ওমরের গৃহশিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব করে। লেখক ওমরের এসব ঘটনা জানতেন না। তাই তিনি রাজি হয়ে যান। কিন্তু ওমরকে পড়াতে গিয়ে প্রথম দিনেই লেখক হতভম্ব হয়ে পড়েন। ওমরের আচরণ খুবই রূঢ়, অশালীন, অভদ্র, অসহনীয় এবং অপমানজনক। ওমরের মা এসে লেখককে কেঁদে কেঁদে ওমরের বিষয়গুলি জানায়। পড়াতে গেলে অন্যান্য শিক্ষকদের মতো লেখকের
কাছ থেকেও ওমর সুলতান বেতনের ৩০% কমিশন চেয়ে বসে। লেখক অপমানিত বোধ করে ওমর সুলতানকে মারতে গিয়েও থেমে যান। তিনি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন- তিনি দেখবেন ওমর সুলতান কতদূর যেতে পারে। তিনি যে কোনোভাবে হোক ওমরকে পরিবর্তন করার তিনি ওমরকে উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় নিয়ে নেন। তাই ওমরের সব অপমান কৌশলে হজম করে নিতে থাকেন। একদিন ওমর, তার শিক্ষক তথা লেখককে তার বালিকা-বান্ধবীর জন্য প্রেমপত্র লিখে দিতে বলে। লেখক তাও হজম করে নিয়ে প্রেমপত্র লিখে দেন। তবে কৌশলে তিনি ওমর সুলতানকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ক্লাসের সবার নিচে ছিল ওমরের স্থান। লেখক তার শিক্ষকের ভার নেওয়ার পর ওমর প্রথম কয়েক মাস আরো বেশি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্য শিক্ষকের মতো লেখক তাকে ছেড়ে চলে যাননি। 

লেখক, ভালোবাসা দিয়ে ওমরকে পরিবর্তনের প্রত্যয়ে আরো দীপ্ত হয়ে ওঠেন। আস্তে আস্তে ওমরের পরিবর্তন আসতে থাকে। পরের বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় ওমর শেষস্থান থেকে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়। কীভবে এক বছরের মধ্যে এমন পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল, তা এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা কিশোর উপন্যাসটি কিশোরদের শুধু আনন্দ দেবে না, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অনুপ্রেরণাও জোগাবে। সর্বোপরি, কিশোরদের সঙ্গে মা-বাবা পরিবেশের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত, কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত আমাদের প্রত্যেকের প্রাত্যহিক, পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রী জীবনে তাও অনবদ্য বাস্তবতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে

লেখকের জীবন থেকে নেওয়া এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পুথিনিলয়। পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলার পুথিনিলয় স্টলে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। মূলত ভালোবাসা কী, কীভাবে ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করা যায়, অতি খারাপকেও ভালো লোকে পরিণত করা যায়, অতি খারাপ ছাত্র বা সন্তানকেও মেধাবী করে দেওয়া যায়; সেটাই এই গ্রন্থে লেখক তার জীবনের একটি ঘটনা দিয়ে উপন্যাসে উপন্যাসে বিধৃত করেছেন। আমি মনে করি, এটি ভালোবাসা দিবসসহ প্রত্যেক দিবসে, বিশেষ করে পিতামাতা মরুব্বিদের প্রতি এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রতি হতে পারে শ্রেষ্ঠ উপহার

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা . মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর একটি গল্প ফেসবুকে
প্রকাশিত হয়। গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফেসবুক ভাইরাল হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেকগুলি চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউশিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহল গল্পের নতুন আস্বাদন পায় যেন। আমি গল্প দুটি পড়ে এতই বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি যে, আমি আপনাদের জন্য এই লেখা লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম। এই বইয়ের ভালোবাসার গল্পগুলি পড়ে আমার মনে গল্প সম্বন্ধে যে ধারণা ছিল, তা পাল্টে গিয়ে নতুন একটা ধারণা সৃষ্টি করল। গল্প শুধু গল্প নয়। জীবন, জীবনটাই গল্প। আর একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারলাম, লিখতে জানলে যে কোনো সাধারণ বিষয়ও অসাধারণ হয়ে উঠে। যেমন পরিবেশনার গুণে সাধারণ খাবার হয়ে ওঠে তৃপ্তির চূড়ান্ত অবগাহন। ভালোবাসা কী এবং ভালোবাসা দিয়ে জীবনকে কীভাবে বদলে দেওয়া যায় তা আমি এই বই পড়ে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। ভালোবাসা জীবনের জন্য অপরিহার্য। যে জীবনে ভালোবাসা নেই সে জীবনে যেন কিছু নেই। এই বইয়ে ভালোবাসার মাধ্যমে জীবনগড়ার প্রতিটি দিক, প্রতিটি ক্ষণ এবং প্রতিটি বিষয় গল্পে গল্পে তুলে আনা হয়েছে। জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখলেও এমন লেখা যায় না, অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরীক্ষণ করতে হয় অনুভবের বাস্তবতায়। স্বপ্নকে টেনে নামাতে হয় জীবেনর কানায়। গল্পসমূহ পড়লে বোঝা যায়, লেখক তাই করেছেন এবং ভালোবাসাকে খুব ভালোভাবে প্রেমময় অনুভবে নিরীক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পসমূহের ভাষা এত সহজ এবং শব্দচয়ন এত
মনোরম যে, পড়লে মন বিগলিত হয়ে যায়। যে কোনো মন তা যতই কঠিন হোক না কেন, নরম হয়ে যায়। গল্পগুলির ভাষা ভালোবাসার মতোই প্রাঞ্জল। গল্পগুলিতে মুগ্ধতা যেন হৃদয়ের আবেগে তাড়িত হয়ে প্রেমে প্রেমে একাকার হয়ে গেছে। অল্পকথায় অনেক বেশি প্রকাশের ক্ষমতা, ছোটো কথায় ভালোবাসার সাহসী প্রকাশ এত ঋদ্ধ যে, গল্প শেষ না করে কোনোভাবে ছাড়া যায় না। এমন অনুভূতির জন্যই হয়তো বইকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ভালোবাসাকে বলা হয়েছে স্বর্গীয়

অসাধারণ ২০টি গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে পাঠক এবং পাঠকের উত্তরসুরী- সবার বিবেক ভালোবাসার মাধুর্যে আনন্দ আর মমতার ঔদার্যে সবার মন বিকশিত হয়ে উঠবে। পরস্পরের প্রতি সৃষ্টি হবে স্নেহপ্রেমপ্রীতি এবং উদার সহানুভূতি। ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে একজন দুষ্ট ছেলেকেও কিংবা অবাধ্য বন্ধুকেও নিজের একান্ত ভালোবাসার অানুগত্যে পরিণত করা যায়, তার কৌশল এই বইয়ে বাস্তব গল্পে বিধৃত করা হয়েছে। বইটি পাবেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। আমি ভালোবাসা দিবসে আপনার প্রিয়জনকে বইটি উপহার দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। কারণ এর চেয়ে ভালো বই ভালোবাসা দিবসের জন্য আর হয় না

Saturday, 13 January 2018

গুরমিত রাম রহিম সিং ও ভারতীয় ধর্মগুরুদের কীর্তিকলাপ / অধ্যাপক রনজিত কুমার মণ্ডল


গুরমিত রাম রহিম সিং ও ভারতীয় ধর্মগুরুদের কীর্তিকলাপ ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গবেষণা গ্রন্থ। দীর্ঘদিন থেকে ভারতে ধর্মগুরুদের নিয়ে অসংখ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে আসছে। তবু কেন ধর্মগুরুদের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রবল বিশ্বাস ও আস্থা কমে না বরং বেড়ে যাচ্ছে তা এই গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য আলোচন। বেশ কিছুদিন যাবত উপমহাদেশের পত্রপত্রিকায় ভারতীয় ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং এর বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগ ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়। প্রায় ছয় কোটি লোকের কাছে ভগবান হিসেবে সম্মানীয় একজন ব্যক্তিকে পত্রিকা রাতারাতি জঘন্য ধর্ষকে পরিণত করে দিয়েছে। তবু তাঁর ভক্তদের কেউ পত্রিকার কথা বিশ্বাস করেনি। বরং তার প্রতি তাদের ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আস্থা আগের চেয়ে দৃঢ় হয়েছে। এর কারণও পুস্তকটিতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।

আসলে গুরমিত কে? লেখকের মতে, বাস্তবতা, কল্পনা, যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, কুশলী অবস্থান,
রহস্যময়তা, প্রতিভা প্রভৃতির সমন্বয়ে তৈরি এক অনবদ্য আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু।গুরমিত অন্যান্য ধর্মগুরুর মতো মুখে সর্বদা স্রষ্টার নাম জপতে জপতে ক্লান্ত হওয়ার মতো সাধারণ কেউ নন। জপমালাও দেখা যায় না তার হাতে। বরং গোলাপি রঙের বাহারি জোব্বা চাপিয়ে মিউজিক ভিডিওর তালে তালে বিস্ময়কর কায়দায় নাচতে ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন। ভক্তবৃন্দ মনে করতেন যেন সত্যিকার ভগবান নেমে এসেছেন ধরায়। এ যেন জীবনের এক উদ্দাম উচ্ছ্বলতা। মানুষ সাধারণত এমন উচ্ছলই থাকতে চায় আজীবন। তার ডেরায় কনসার্ট ছাড়া ধর্মসভাও হতো। যারা যেটি ভালো লাগে। আলোচিত ও সমালোচিত আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং যে কোনো বিবেচনায় বর্তমান বিশ্বের একটি বর্ণময় চরিত্র। মানুষকে আকর্ষিত করার জন্য যত প্রতিভা ও কলাকৌশল আয়ত্তে থাকা আবশ্যক তার সবগুলো গুরমিত রাম রহিমে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লাখ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। যারা তাকে তাদের জীবনের চেয়ে বেশি আপন জানেন, তার জন্য জীবন দিতে পারেন অবলীলায়। সারা বিশ্বে গুরমিত রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত রয়েছে। এসব ভক্ত রাম রহিমের প্রতি এতই বিশ্বস্ত যে, তারা গুরমিতকে ঈশ্বরের দূত বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু কেন? এটাই বইটিতে বর্ণিত হয়েছে।

ভগবান বিশ্বাসী মানুষের কাছে ভগবানের যে প্রভাব, ভক্তদের কাছে রাম রহিমের প্রভব তার চেযেও বেশি। এর প্রমান পাওয়া গিয়েছে সেদিন, যেদিন রাম রহিমকে হরিয়ানার আদালত ১৫ বছরের পুরনো ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে। আদেশ ঘোষণার পর পরই  ভক্তদের ক্ষোভ আর রোষের আগুন জ্বলে ওঠে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিসহ ভারতের আরও বহু এলাকায়। হরিয়ানার পঞ্চকুলা শহর কুরুক্ষেত্রের চেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠে। এর প্রভাব পড়ে উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের বিস্তৃত এলাকায়। ডেরা  সাচা   সৌদা প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের ভক্তরা হরিয়ানার পঞ্চকুলা, সরসিয়াসহ পাঞ্জাবের বহু এলাকা কার্যত অচল করে দেয়। ডেরা  সাচা  সওদা প্রধানের রায়  শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লাখ লাখ নারী-পুরুষ অনুগামীরা পঞ্চকুলাতে সমবেত হয়েছিলেন। রায়দানের আগে যদি ‘গুরুজি’র সামান্য আভাস পাওয়া যায় সে আশায় অনেক ভক্তকে সেদিন আহাজারি করতেও দেখা যায়।  তার এমনভাবে আহাজারি করছিল যেন, তাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আসলেই ভক্তদের কাছে রাম রহিমই ছিল শেষ ভরসাস্থল।

রাম রহিম সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অভিযোগের কারণ, স্বরূপ, অভিযোগ আসলে কতটুকু সত্য, এর পেছনে কোনো স্বার্থ আছে কি না প্রভৃতি এই গ্রন্থে নানা তথ্যপ্রমাণসহ বিধৃত করা হয়েছে। অনেকের মতে, গুরমিতের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা  সন্দেহাতীত নয়। বরং তাকে অপদস্থ করার জন্য অনেক বছর আগে আনা একটি অসমর্থিত অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে কার স্বার্থ ছিল, কী ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে করা হয়েছে এবং কেন তার বিবরণ বইটির অন্যতম বিষয়। লেখক বলেছেন, প্রচলিত ধর্ম, বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ এবং সর্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তার বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্রের কারণ।

সাংবাদিক হত্যা, ধর্ষণ, ডেরার ম্যানেজার খুন, গুম প্রভৃতিসহ অসংখ্য অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ভক্তগণ মনে করেন এই অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। কেন
তার বিরুদ্ধ যড়যন্ত্র? ভক্তদের মতে, ভারতের হরিয়ানা, রাজস্থান ও পাঞ্জাব রাজে জাতপ্রথা দুরীভূত করার ডাক, দলিতদের সামাজিক মর্যদা প্রদানে বদ্ধপরিকর অবস্থান, শিখধর্মের কিছু নীতির বিরোধিতা, দশম শিখ নেতার অনুকরণে পোশাক পরিধান, মাদকদ্রব্য বিরোধী অবস্থান, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন, নারীপাচার রোধ বিরোধী ভূমিকা, ধর্মসংস্কার, নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাএবং উত্তরোত্তর তার ভক্ত সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিরোধী পক্ষের ঈর্ষা-ভয় প্রভৃতি কারণে গুরমিত রাম রহিম সিংহ ইনসানকে হেয় করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল গুরমিতকে পাঞ্জাবে প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ।


গুরুমিত ছাড়াও ভারতীয় আরো কিছু ধর্মগুরুর কীর্তিকলাপ সম্পর্কে গ্রন্থটিতে আলোকপাত করা হয়েছে। এরা হলেন :  আনন্দ মূর্তি আশারাম বাপু আশুতোষ মহারাজ বাবা পরমানন্দ রাধে মা সচ্চিদানন্দ গিরি রামবৃক্ষ যাদব: চন্দ্রস্বামী স্বামী ওমজি সারথি বাবা লাল সাই গুলজার পির নির্মল বাবা ইচ্ছাধারী ভীমানন্দ নারায়ণ সাঁই রামপাল বৃহস্পতি গিরি স্বামী গঙ্গেশানন্দ স্বামী নিত্যানন্দ স্বামী অসীমানন্দ  প্রেমানন্দ স্বামী ভীমানন্দজি মহারাজ স্বামী স্বদাচারী প্রমুখ। লেখক বইটিতে গরমিত রাম রহিম সিং এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে বিশেষ উদ্দ্যেশে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের কারণে ব্যাপকতর করে গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস হিসেবে বিধৃত করে বলেছেন, প্রচলিত শিখ ধর্মের বিরুদ্ধে তার অবস্থান এবং ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় শোষণের পরিবর্তে সমতাভিত্তিক ধর্ম ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক প্রয়াসই ছিল গুরমিতের উদ্দেশ্য। এর মধ্যে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু ভুলভ্রান্তির পরিবর্তে তার কাজে যে আরো কল্যাণকর কিছু ছিল সেগুলি উপেক্ষা করে তাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপদস্থ করা হয়েছে।বইটি পড়লে গুরমিতের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের স্বরূপ এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাঠক নতুন অভিজ্ঞানে ঋদ্ধ হবেন।

বইটির প্রকাশক পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা এবং পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়ের স্টলে। দাম ১৫০ টাকা।

Friday, 12 January 2018

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা / প্রমিতা দাস লাবণী

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর একটি
গল্প ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ফেসবুক ভাইরাল হয়ে  চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেক চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ’ শিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহল গল্পের নতুন আস্বাদন পায় যেন।  আমি গল্প দুটি পড়ে এতই বিমুগ্ধ হয়ে পড়ি যে, অনেক কষ্টে লেখকের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে তাঁর সঙ্গে কথা বলি। বলা যায়, দুটি গল্পেই আমি তাঁর ভক্ত হয়ে যায়। লেখকে অনুরোধ করি, পাণ্ডুলিপিটি পড়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তিনি আমার কথা ফেললেন। আমি ওই পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ পেলাম। মোহিত হলাম লেখকের বদান্যতায়। গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি পড়ে আমার মনে গল্প সম্বন্ধে যে ধারণা ছিল, তা পাল্টে গিয়ে নতুন একটা ধারণা সৃষ্টি করল। গল্প শুধু গল্প নয়। জীবন, জীবনটাই গল্প। আর একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারলাম, লিখতে জানলে যে কোনো সাধারণ বিষয়ও অসাধারণ হয়ে উঠে। যেমন পরিবেশণার গুণে সাধারণ খাবার হয়ে ওঠে তৃপ্তির চূড়ান্ত অবগাহন।

গল্প বাছাইয়ে লেখকের বিচক্ষণতায় মুগ্ধ না হয়ে পারিনি জীবনের প্রতিটি দিকপ্রতিটি ক্ষণ এবং প্রতিটি বিষয় উঠে এসেছে গল্পসমূহে জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখলেও এমন লেখা যায় নাঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরীক্ষণ করতে হয় 
ড. মোহাম্মদ আমীন
অনুভবের বাস্তবতায় স্বপ্নকে টেনে নামাতে হয় জীবেনর কানায় গল্পসমূহ পড়লে বোঝা যায়লেখক তা- করেছেন এবং ভালোভাবে তা করতে সক্ষম হয়েছেন গল্পসমূহের ভাষা এত সহজ এবং শব্দচয়ন এত মনোরম যেগল্পকে যেন মনের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য লেখা হয়েছে তাঁর ভাষা এমনি মুগ্ধকর কিন্তু গল্পগুলিতে মুগ্ধতা যেন হৃদয়ের আবেগে তাড়িত হয়ে প্রেমে প্রেমে একাকার হয়ে গেছে অল্পকথায় অনেক বেশি প্রকাশের ক্ষমতা এত ঋদ্ধ য়েএকটি গল্প শেষ না করে কোনোভাবে ছাড়া যায় না এমন অনুভূতির জন্যই হয়তো বইকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা গল্পগ্রন্থে বিশটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলি হচ্ছে : (১) মাছ কাগজ, (২) মধুরেণ সমপায়েৎ, (৩) হাসমত আলীর উইল, (৪) ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা,   (৫)নটির বাচ্চা, 
প্রমিতা দাস লাবণী
(৬) কন্যা আমার অনন্যা, (৭) আমারও ঘটে হামেশা, (৮) কোটা, (৯) আজব বিয়ে, (১০) খুন, (১১) মাজা মাজা, (১২) বিয়ার পুত্র ও বউ, (১৩) সুসানা ইয়োগানা, (১৪) যে গরবা আঁইয়ে হম, (১৫) উলুবনে মুক্তো, (১৬)এক ধাক্কায় জাহান্নাম, (১৭) অগ্নিকাণ্ড এবং (১৮)বোকা বায়েজিদ, (১৯)অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ এবং (২০) স্যার আমাকে বিয়ে করুন। প্রতিটি গল্প ভিন্ন স্বাদ নিয়ে পাঠকের মনে ভিন্ন আমেজের জোয়ার আনতে সক্ষম। কিশোর হতে সব বয়সের পাঠকের উপযোগী গল্পগ্রন্থটি পড়া শুরু করলে, শেষ না করে উঠে যাওয়া কষ্টকর হবে- এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। অসাধারণ এই গল্পগুলি প্রাত্যহিক জীবনের নানা ভালোমন্দ দিককে হৃদয়গ্রাহী ঘটনার মধ্য দিয়ে অতি প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে।


অসাধারণ কিছু গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে আপনার এবং আপনার উত্তরসুরীসবার বিবেক আনন্দ আর ঔদার্যে বিকশিত হয়ে উঠবে। এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। ভালোবাসা দিয়ে কীভাবে একজন দুষ্ট ছেলেকেও কীভাবে শ্রেষ্ঠ পরিণত করা যায়তার কৌশল এই বইয়ে বাস্তব গল্পে বিধৃত করা হয়েছে। বইটি পাবেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন

Friday, 5 January 2018

সাধারণ জ্ঞান নাকি শিক্ষার অপমান / ড. মোহাম্মদ আমীন

সরকারের উচ্চপদে চাকরি-পরীক্ষায় যারা দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের জ্ঞান এত সাধারণ যে, অসাধারণ প্রশ্ন করার কোনো সামর্থ্য নেই । ছাগল তো আর বাঘের গর্জন দিতে পারে না! তাই তাঁদের প্রশ্নরাশি কেবল সেক্সপিয়রের বাড়ি কোথায়, রবীন্দ্রনাথের পিতামহের নাম ৎকার বোর্ডে যাবার আগে কর্তারা সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে এমন ধরণের কয়েকটি প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষার্থীদের উত্তর জানতে চান। আমি নিজেও অমন করেছি। এর মানে, আমি সাধারণ জ্ঞানকে অবহেলা করতে বলছি না। বলছি, সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নের মধ্যেও যেন মেধা-স্ফুরিত কিছু থাকে। যেন হালকা হয়ে না যায় এবং যুগের সঙ্গে মানানসই হয়।
কী ছিল, লিউনার্দো দ্যা ভিঞ্চির টাকের আয়তন কত, আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট বাম হাতে লিখতেন, কার মোজ সবচেয়ে মোটা -- এমন সব সাধারণ মানের প্রথাগত সস্তা দরের প্রশ্নে ঘুরপাক খায়। সাক্ষা
প্রশ্নকর্তারা সৃজনশীল নয় বলে, সৃজনশীল কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না। যারা অমন প্রশ্ন করার যোগ্যতা রাখেন, তাঁদের ওই দায়িত্বে আসার জন্য যেরূপ তদ্বির বা তোষামুদে-দক্ষতা প্রয়োজন তা থাকে না বললেই চলে। সংগত কারণে চাকরিপ্রার্থীরাও তোতাপাখির মতো ওইসব সাধারণ প্রশ্ন মগজে ঢুকিয়ে পরীক্ষার হলে কিংবা সাক্ষাৎকার বোর্ডে বমির মতো উগড়ে দিয়ে খালি মাথা নিয়ে বের হয়ে আসে। চাকরি হয়ে গেলে আর কী! লেখাপাড়া করার প্রয়োজন হয় না। ফাইলে শুধু ‘দেওয়া যেতে পারে, আলাপ করুন, অনুমোদিত, আরো যাচাই করুন, মতামত নিন’-- এমন কয়টি বাক্য ছাড়া সারা জীবন আর কিছু না লিখলেও শুধু প্রশ্নহীন আনুগত্যের বদৌলতে পদোন্নতি পেয়ে সচিব, সিনিয়র সচিব প্রভৃতি হয়ে যান।
এ অবস্থায়, সরকারের অধিকাংশ উচ্চপদের প্রার্থীরা চাকরির জন্য বিশেষায়িত জ্ঞানের পরিবর্তে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, সাধারণ জ্ঞানের চাপে পড়ে সৃজনশীলতা মরে যায়। তথ্যের ভারে তা হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্তু জ্ঞানের দেখাও পাচ্ছে না। রসায়ন বিজ্ঞান থেকে পাস করে পুলিশ হন, এমবিবিএস পাস করে হন সহকারী কমিশনার। এভাবে মস্তকে সঞ্চিত দীর্ঘদিনের বিশেষ অধীত বিদ্যা হারিয়ে যায় সাধারণ জ্ঞানের পায়ের (পদ) নিচে। অথচ আধুনিক বিশ্বে বিশেষায়িত জ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।
একজন মেধাবী ছাত্র, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পর যতদিন চাকরিতে থাকেন, প্রতিদিন একটু একটু করে মেধা কমতে থাকে। এভাবে কমতে কমতে সব মেধা, ব্যক্তিত্ব এবং উদারতা পদ নামক পায়ের নিচে পিষ্ট হতে থাকে। এমন একসময় আসে, যখন মাথায় আর কিছু থাকে না। সব পায়ের দখলে চলে যায়। মস্তক মগজবিহীন হয়ে যায়। এমন লোকদের মধ্য থেকে আবার কাউকে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়।
- - -



[ সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, চাকরি এবং সৃজনশীলতা’ শিরোনামের প্রবন্ধের কিয়দংশ।]
প্রদায়ক : শ্রাবন্তীনাহা অথৈ।

Tuesday, 19 December 2017

স্যমন্তক/ মুশাররফ খান


প্রসঙ্গ স্যমন্তক ,   
লেখক :  মুশাররফ খান 
প্রদায়ক : প্রমিতা দাস লাবণী 
স্যমন্তক উপন্যাসের মাধ্যাকর্ষণ প্রফেসর রচনা, যিনি লেখকের অনুপম ভালোবাসার শ্যামল ছায়ায়,
মুশাররফ খান
সুনিপুণ নির্মাণ শৈলীর পুর কৌশলে বস্তির দুর্বহ দারিদ্র্য পীড়িত জীবন থেকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বর্নাঢ্য পাদপ্রদীপের নিচে পৌঁছে যাওয়ার এক অসাধারণ অকল্পনীয় দুরূহ ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন। লেখক তাঁর অপরূপ সৃষ্টি শৈলীর নিবেদনে তিলে তিলে নির্মান করেছেন একজন রচনাকে যিনি তুখোর মেধাবী, দুর্বিনীত বাগ্মী, সর্বাঙ্গে চৌকস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার প্রতিভূ, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের সফল 
শিক্ষক। সেই মেয়েই কিনা আবার কখনো জল-কাদার মত নরম, একটুখানি ভালোবাসার কাঙ্গালিনী, শিশুর মতো ছিচকাঁদুনে ক্রাই-বেবি! আবার কখনো তাঁর নির্মাতার শুভ্র পায়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য  নিবেদনের মুগ্ধ পূজারী।
স্যমন্তক উপন্যাসের পরতে পরতে সাজানো মনিমুক্তা হীরা-পান্নার অফুরান ভাণ্ডার। সেখান থেকে অবলীলায় সংগ্রহের ঝাঁপি পূর্ণ করে ঘরে ফিরুন। স্যমন্তকের পাতায় পাতায় জীবনের কত না নিগুঢ় সত্যের অনুপম সম্ভার। স্যমন্তক পাঠ শেষে বোধন ও অভিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে অনুরণনে আপ্লুত হতে হতে মনে হবে বুঝি অনেক কাল পর এক দুর্লভ পঠন-পর্যটনের পরিপূর্ণ প্রাপ্তি ঝুলিতে ভরে ঘরে ফিরছেন। 
স্যমন্তক পড়তে পড়তে মনে হয়েছে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের কিছু খণ্ডচিত্র ছাড়া প্রফেসর রচনাকে বুঝি তেমন পাওয়াই হলো না। স্যমন্তক পাঠকবৃন্দ প্রফেসর রচনাকে আরও বর্ধিত কলেবরে, আরও বিচিত্র পরিসরে পাওয়ার দাবিদার একটু হতেই পারেন। স্যমন্তকের একটা সিকুয়েলের দাবি তাই তারা করতেই পারেন। 
স্যমন্তক রচিয়তার পরিবেশিত প্রতিবেশ এবং কথোপকথন থেকে ধারনা পাই, যাপিত জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গ, কাল যাপনের পরিপ্রেক্ষিতকে তিনি দেখেন নানা দৃষ্টিকোণ, নানা ভাবনা, নানা আলো, নানা
স্যামন্তকের লেখক ড. মোহাম্মদ আমীন
ছন্দের অণুবীক্ষণের নিচে।তার ভাবনায় নিখাদ সত্য কিংবা নির্জলা মিথ্যা - এমন ধ্রুব কিছু নেই। এটা শুধু দেখার কিংবা অনুভবের ভিন্নতার ব্যাপার। যে কোনো অভিদর্শন, বক্তব্য, মন্তব্যকে তিনি অবলীলায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ভিন্ন দিগন্ত, ভিন্ন আঙ্গিক এবং ভিন্ন রঙে ঢঙে দৃঢ় স্তম্ভে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।তিনি আপাত দৃশ্যমান সত্যকে কুশলী মিথ্যের মোড়কে পেশ করার, আর মিথ্যের গায়ে সত্যের চাদর মুড়ে দেওয়ার ভেল্কি জানেন। মিথ্যাকে তিনি জানেন অল্টারনেটিভ ট্রুথ, আর সত্যকে মিথ্যার ক্যামোফ্লাজ।পরিবেশনার এই মুগ্ধকর শৈল্পিক রূপময়তার চমৎকারিত্বে মুগ্ধতায় ভরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকেনা।ভেবে পাই না কোন কামরূপ কামাখ্যা থেকে তিনি শিখে এসেছেন এই সম্মোহনী যাদুবিদ্যা! 
স্যমন্তক কি সত্যের নিরেট পরিসংখ্যান পরিবেশন, নাকি সত্যের উপর ভাব ভাবনা ছন্দ রং তুলির কারুকাজ, লেখককে এই প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য আমার নেই। এখানে এসে আমি শুধু বাল্মিকীর আশ্রয় নিতে পারি। বাল্মিকী বলেছেন : 
“নারদ কহিলা হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি ,  
ঘটে যা তা সব সত্য নহে । 
কবি , তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেন।” 
স্যমন্তকের স্রষ্টা কথকতার নিপুন মাকড়সা। শব্দ ছন্দ ভাব ভাবনার হাটে তিনি ধনী মহাজন।সুনিবিড় নৈপুণ্যে তিনি গড়েছেন স্যমন্তক হেন আঁঠালো ওয়েব, একবার পা দিয়েছেন তো গেলেন আটকে। অতঃপর এক নিঃশ্বাসে প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিরামহীন পর্যটন হবে আপনার অমোঘ নিয়তি। 
স্যমন্তক প্রথম পাঠ আমার টেষ্ট রান। স্যমন্তক আমাকে লোভী করে তুলেছে। স্যমন্তক থেকে আমার আরও মনি মুক্তা আহরণ করা চাই। স্যমন্তকের অতলান্তিক গভীরে ডুব দিতে হবে আমাকে আরও একবার। 
জয়তু স্যমন্তক!

Monday, 4 December 2017

টিউশনি এবং ভালোবাসা / ড. মোহাম্মদ আমীন


           টিউশনি এবং ভালোবাসা         

: একটা টিউশনি করবে?
: কোথায়?
: ষোলশহর।
: ছাত্র না ছাত্রী?
: ছাত্র। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
: ছাত্র পড়াব না।
: বিরাট পুলিশ অফিসারের ছেলে। বাবা ডিআইজি। ভালো বেতন দেবে। ভালো নাস্তা পাবে। আরে এতো বড়ো পুলিশের ঝাড়ুদার হতে পারাও ভাগ্যের। সুপারিশে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। দুদিন পর আইজিপি হবেন।
টিউশনি শুধু টাকা নয়, টাকার চেয়ে বড়ো কিছু। এটি বিসিএস-প্রস্তুতির একটি মোক্ষম কৌশল, টাকা তো আছেই। রাজি হয়ে যাই রাজীবের প্রস্তাবে।
রাজীব বলল : বেতন মাসে আটশ টাকা।
ঊনিশশ ছিয়াশি, সে সময় আটশ অনেক মোটা অঙ্কের টাকা। এত আকর্ষণীয় বেতনের টিউশনিটা রাজীব নিজে না-করে কেন যে আমাকে দিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। কিছু সমস্যা তো আছেই!
: তুমি করছ না কেন?
: আমার সময় নেই।
ডিআইজি সাহেবের ছেলের নাম ওমর। ফর্সা, তবে ধবধবে নয় কিন্তু বেশ মায়াময়। বিশাল বাসা, বারান্দায় দামি ফুলের টব। চারিদিকে সমৃদ্ধির ছড়াছড়ি। রাজীব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ওমর সালাম দিয়ে বলল : স্যার, বিড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত। আমার কথা নয়, আমার ডিআইজি বাবার কথা, ঠিক না?
: ঠিক। কিন্তু বিড়াল কোথায়?
: আছে স্যার, আছে। অনেক বড়ো বিড়াল।
: আমি বিড়াল মারব কেন?
: আপনাকে মারতে হবে না। আমি মারব। একটা কথা বলব?
: বল।
: আগের কথা আগে বলে দেওয়া ভালো। রাখলে আমারও লাভ আপনারও লাভ। নইলে দুজনেরই ক্ষতি। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
: কী কথা বলে ফেল।
ওমর বলল : আপনার বেতনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আপনার বেতন আটশ টাকা। চল্লিশ পার্সেন্টে হয় তিনশ বিশ টাকা। তবে আমাকে তিনশ টাকা দিলেই হবে, বিশ টাকা আপনার বখশিস। কী বলেন স্যার?
প্রথমে মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ইচ্ছে করছিল ঘুরিয়ে একটা চড় দিই। হাত এগিয়ে নিয়েই থামিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক করে ফেলি আমাকে। তারপর সহজ গলায় আদর মেখে বললাম : কম নেবে কেন বাবা?
: এমনি।
: না, আমি পুরো তিনশ বিশ টাকাই দেব।
: তাহলে স্যার ভাংতি দিতে হবে। আমি একশ টাকার নিচে ভাংতি রাখি না।
: তাই হবে।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার আশায় আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মজার হবে টিউশনিটা, দেখি কতদূর যেতে পারে ওমর। মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে আমি একটি খামে করে তিনশ বিশ টাকা ওমরের হাতে তুলে দিই।
ওমর যথাসময়ে টাকা পেয়ে খুশি।
হাসি দিয়ে বলল : স্যার, আপনি খুব ভালো মানুষ।
আমি বললাম : তুমি আমার কাছ থেকে শিখছ আর আমি শিখছি তোমার কাছ থেকে। পরস্পরের বেতন যথাসময়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে শ্রমের মর্যাদা মাসের প্রথমদিকে হাসার সুযোগ পায়।
ওমর বলল : থ্যাংক ইউ স্যার। সব মানুষ যদি আপনার মতো হতো!
চার মাস পর ডিআইজি সাহেব পড়ার রুমে এলেন। এতদিন তাকে একবারও দেখিনি, বেশ গম্ভীর চেহারা, দেখলে সমীহ আসে। চোখের চশমায়, দামটা পুলিশের পোশাকের মতো ঝিলিক মারছে, হাতের ঘড়িতে আরও বেশি।তিনি ওমরের একটি খাতা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন : মাস্টার সাহেব, আপনার বেতন চারশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম।
: কেন স্যার?
আমরা পুলিশের লোক। গুণীর কদর করতে জানি। এ পর্যন্ত কোনো শিক্ষক আমার ছেলের কাছে দুই মাসের বেশি টিকেনি। প্রত্যেকে আমার ছেলেটাকে বকা দিয়েছে, মেরেছে, অশ্রাব্য কথা বলেছে। ছেলে কেবল আপনারই প্রশংসা করেছে। আপনি নাকি অনেক ভালো পড়ান।
তিনি একটা কলম ও একটা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বলেন : এগুলোর আপনার উপহার।
: থ্যাংক ইউ।
কলমটা ছিল সম্ভবত পার্কার। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ওই সময় পার্কার ছিল আমাদের কাছে স্মার্ট ফোনের মতো লোভনীয়।
ডিআইজি সাহেবে চলে যেতে ওমর বলল : স্যার।
: তুমি কী কলম আর ডায়েরি হতেও ভাগ চাইছ?
ওমর হেসে বলল : না স্যার। বস্তুতে আমার আগ্রহ নেই। টাকা হলে সব বস্তু পাওয়া যায়।
: তবে?
: আমার পাওনা এখন চারশ আশি টাকা। আমি আশি টাকা নেব না, একশ টাকা নেব। তার মানে পাঁচশ টাকা।
: ঠিক আছে। খুব বেশি না হলে আমার বেশি দিতে কষ্ট লাগে না। তুমি আমার শিক্ষক, তোমাকে বিশ টাকা বেশি দিতে না-পারলে আমার জ্ঞান অর্জন হবে কীভাবে?
ওমরের হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। কমিশন নিলেও পড়াপাড়ি বেশ ভালোই হচ্ছে।আরও তিন মাস কেটে গেলে। এরমধ্যে, আমার বেতন আরও দুইশ টাকা বেড়ে গেছে। ওমরকে এখন টাকা দিতে কষ্ট হচ্ছে না। জীবনে প্রথম শেখলাম-- দেওয়া- নেওয়ার মাহাত্ম্য। ওমর একটা জীবন্ত স্মার্ট ফোন।
সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ওমরকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ আনমনা মনে হচ্ছে।
বললাম : কী হয়েছে?
: স্যার, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
: কী কাজ?
: একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।
: চিঠি তো লিখেই দিই।গতকালও দিয়েছিলাম।
: স্কুলের চিঠি নয়।
: কোন চিঠি?
: আমার প্রেমিকা; সরি স্যার, বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য।
: কী লিখব?
: আপনার মতো করে আপনি লিখে দেবেন। আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে না- দেখলে বুকটা কেমন মোচড় খায়। ধকধক করে কলিজা, কিছু ভালো লাগে না। সে খুব সুন্দর ইত্যাদি।
চিঠি লিখে দিলাম গভীর ভাষায়, প্রেমের মমতায়।
রাস্তায় এসে ইচ্ছেমতো হাসলাম। ওমর আর রেহাই পাচ্ছে না। বাসে উঠতে গিয়ে দেখি, ফারহাদ। আমার সতীর্থ এমদাদের ছোটো ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। সাবজেক্টটা ঠিক মনে পড়ছে না।
আমাকে সালাম দিয়ে বলল : ভাইজান, আমাকে একটা লজিং দেবেন?
: আমি তো লজিং নিয়ে থাকি না। এমদাদের কাছে অনেকগুলো লজিং আছে। আমাকেও বলেছে, কাউকে পেলে খবর দেওয়ার জন্য। তাকে গিয়ে বলো।
: বলেছিলাম, দেবে না।
: কেন?
: আমাকে আগে শিবিরের সদস্য ফরমে স্বাক্ষর করতে হবে। আমি শিবির করব না, সেও আমাকে লজিং দেবে না। লজিংগুলির মালিক নাকি শিবির।
ফরহাদকে বিদায় করে নিজের রুমে চলে যাই। শুক্রবার বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা কিন্তু যাওয়া হলো না। ওমর খবর পাঠিয়েছে, শুক্রবার তাদের বাড়ি যেতে হবে। তার শুভ জন্মদিন।
কী নিয়ে যাই?
অনেক চিন্তাভাবনা করে ওমরের বান্ধবী নিহা নিশিতাকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লিখি। ওমর চিঠি পড়ে এত খুশি হয় যে, সে মাসের পুরো কমিশনটাই আমাকে ফেরত দিয়ে দিল।
অবাক হয়ে বললাম : ফেরত দিলে যে?
ওমর আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল : আপনার লেখার সম্মানি। স্যার, চিঠিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।
লেখার সম্মানি! আমি চমকে উঠি। লেখার প্রথম আয়, এ তো বিশাল কারবার! তাহলে কেন এতদিন লিখিনি! ওমরের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে পত্রিকায় লেখা শুরু করি। তারপর আস্তে আস্তে লেখা আমার নেশা হয়ে যায়।
যতই গল্প করি, যতই প্রেমপত্র লিখে দিই না কেন, লেখপড়ায় ওমরকে এমন কৌশলে ব্যস্ত রাখি যে, সে ধীরে ধীরে বইয়ে ঝুঁকে পড়ে। তার সব আনন্দ অন্যান্য জায়গা হতে বইয়ের পাতায় এসে ভীড় করতে শুরু করে। আগে তার বাবাকে বলত চকলেটের কথা, এখন বলে বইয়ের কথা। আগে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীতে আলমিরা ছিল ভর্তি; এখন সেখানে ঠাঁই পেয়েছে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিট্রানিকা, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের নানা বই। আমার কাছ থেকে নাম নিয়ে যায় বইয়ের, নিয়ে আসে তার বাবাকে দিয়ে। দেশে না পেলে বিদেশ থেকে। কত দামি দামি বই, আমার কাছে মনে হতো -- সামর্থ্যবানদের ইচ্ছাই প্রাপ্তি।
আরও তিন মাস পর আমার বেতন হয় পনেরশ টাকা। বিশাল অঙ্ক, অনেক সরকারি অফিসারও তখন এত বেতন পেতেন না। এখন ওমরের পাওনা গিয়ে দাঁড়ায় ছয়শ টাকায়।
মাসের শেষদিন ওমরকে ছয়শ টাকা দিতে যাই। লজ্জায় চোখটা নিচু করে ফেলে সে। আগের মতো দ্রুত হাত এগিয়ে দিচ্ছে না : সরি স্যার।
: নাও তোমার টাকা।
: লাগবে না স্যার।
: আরে নাও। আমি অত টাকা দিয়ে কী করব?
: স্যার, একমাসে যতটাকা আপনাকে দিই, আমি একদিনে তার চেয়ে অনেক বেশি দামের চকলেট খাই। একটা চকলেটের দাম একশটাকা, দিনে বিশটা চকলেট আমি একাই খাই। বাবার হুকুমে সুইজারল্যান্ড থেকে আসে। আপনার বেতন মাসে মাত্র দেড় হাজার টাকা।
তারপরও আমি বললাম : নাও।
: লাগবে না স্যার।
: আগে লাগত কেন?
তাস খেলতাম, নিহা নিশাতকে দিতাম। এখন তাস খেলা, সময় নষ্ট মনে হয়। তার পরিবর্তে বই পড়ি। নিহা নিশাতকে যতক্ষণ দিই ততক্ষণ খুশী থাকে, শুধু চায় আর চায়। বই শুধু দিয়ে যায়, কিছুই চায় না।
আমি সাফল্যের হাসি নিয়ে বের হয়ে আসি।
বার্ষিক পরীক্ষার পর ওমরদের বাসায় যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ডিআইজি সাহেব বলেছেন এক মাস পর থেকে আবার পড়ানো শুরু করতে। আমার মতো ভালো মাস্টারকে তিনি ছাড়বেন না। বদলি হলে সেখানে নিয়ে যাবেন।পনের কী বিশদিন পর দেখি আমার মেস-বাসার সামনে একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে। দেখলে বোঝা যায় বড়ো পুলিশ অফিসারের গাড়ি।
হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসি।
ওমর আর তার বাবা গাড়ি হতে নামছেন।
ডিআইজি সাহেব বললেন : মাস্টার সাহেব, আমার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। এর আগে কোনোদিন পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার ছেলেটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এটি আমার কাছে অলৌকিক মনে হয়।
প্রশংসা আমার মনে অদ্ভুত এক আনন্দ বইয়ে দিল।
ডিআইজি সাহেব আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন : আমার ছোট ভাই আমার জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। আপনাকে দিলাম। এটি কোনো বিনিময় নয়, উপহার; ভালোবাসার নিদর্শন।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন এমন উপহার দেননি।
ওমর আমার পায়ে ধরে সালাম করে বলল : স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেনে।
ডিআইজি সাহেব ওমরের এমন আচরণে আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেন : মাস্টার সাহেব, ওমর আমাকেও পাত্তা দিত না। এ পিচ্চি ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল টাকার-ঝুড়ি। আপনি তাকে জানোয়ার থেকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
বললাম : ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
: আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?
: ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
-------------------------------------------------------------------------------------------
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, ‘শেখা সাদির বোকামি’ গল্পগ্রন্থের একটি আত্মচরিতমূলক গল্প।
ঈষৎ সংক্ষেপিত।
[এই গল্পটি নিয়ে একটি কিশোর উপন্যাস লেখা হয়েছে। নাম ‘ তিনে দুয়ে দশ’। প্রকাশক পুথিনিলয়, পাবেন আগামী একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়ের স্টলে।]