Translate

Thursday 27 June 2013

বগল তত্ত্বের কেশ মাহাত্ম্য / ড. মোহাম্মদ আমীন

বগল তত্ত্বের কেশ মাহাত্ম্য

নিউ লর্ডস, নিউ লজ।
সাব-অর্ডিনেটরা উদ্বিগ্ন, কেমন হবে নতুন বস। অনুপস্থিত আলাপে বস বলা যায়, ডাকা যায় না; ডাকতে হয় স্যার। বস ডাকের চেয়ে স্যার সম্বোধনে অনেক বেশি আনুগত্য, অনেক বেশি সমীহ। স্যার ডাক শুনলে বাংলাদেশিরা নিজেদের স্যার আইজাক নিউটন ভেবে পুলকিত হয়ে উঠেন। এমন স্যারম্যানিয়া বিশ্বের আর কোন জাতিতে দেখা যায় না।
নতুন বসের নাম হুমায়ুন কবির।
মুখ গোলাকার। গঠন সুঠাম হলেও দেখায় বয়সের চেয়ে অনেক প্রবীণ, বলা যায় ইচড়ে পাকা। জিন্স পড়লে অনেকটা ইংলিশ কার্টুন। তবু জিন্স পড়েন, বুড়ো ড্রাইভার চাহাপ্রু মুখ টিপে হেসে হসে বলেন, হুক স্যার। হুক হুমায়ুন কবিরের সংপে।
চুলগুলো না কালো না সাদা, বিধ্বস্ত পাণ্ডুর; যেন ইউরিয়ার অভাবে সঙ্গীন বোরো ধানের মলিন তে। প্রতিদিন বিকেলে বাসার সামনে ঢোলা একটা হাফ প্যান্ট পড়ে হাটেন। মনে হয় দুঃখ-ভারে নত একটা রোবট ইলেকট্রনিঙ্ ঘৃণায় পৃথিবীকে জ্বালিয়ে দেয়ার নকশা আটছেন। সবার প্রতি হুমায়ুন সাহেবের অবিশ্বাস, সব কিছুতে বিরক্তি, দৃষ্টিমাত্র হতাশা।
গোলাম হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন হুমায়ুন কবিরের ইমিডিয়েট জুনিয়র। জয়েনের পর হতে দুজন তাঁকে অনুণ ঘিরে, ঠিক যেন নারকেলের খোসা; যায় না খাওয়া যায় না চোষা। তাতে কী, পাপোস তো বানানো যায়।
ফল হুমায়ুন সাহেবের বড্ড প্রিয়। ফলের কথা উঠলে ছড়া ছুড়েন-
ফলে আনে বল, কলে আনে জল।
তার মতে বিদ্যুৎ, তাপ, গতি ইত্যাদির মত ফলও একপ্রকার শক্তি। কারণ ফল খেলে শক্তি হয়। তাই ফল দেখলে তার জিবে লালা গড়িয়ে পড়ে, যেন সব ফলই তেঁতুল।
অব্যবহিত পূর্বের কর্মস্থলে হুমায়ুন কবির হুক নামে পরিচিত ছিলেন। হুকের মত সবকিছু টেনে নিতে ওস্তাদ। তাই নাম পায় হুক।
দায়িত্ব নেয়ার দুসপ্তাহের মধ্যে হুক স্যার কম্পাউন্ডের সব গাছে ইনজাংশন জারি করে দেন: কেউ ফল পাড়তে পারবে না, নট এ সিংগেল। গাছের নিচে পড়ে থাকলেও ধরা যাবে না, পচে যাক, গলে যাক।
কেয়ার টেকার ভয়ে ভয়ে সাহস এনে বললেন: বাচ্চা কুড়িয়ে খেতে পারে।
না। পচলে মাটি উর্বর হবে, জৈব সারের অভাবে বাংলাদেশের মাটিতে বেকার যুবকের হাহাকার। খবরদার কাউকে গাছের গোড়ায় আসতে দিও না।
অফিসার্স মেসের বুড়ি বুয়া েেপ তপ্ত আলু। এতদিন আমটা, কাঁঠালটা পেড়ে নিত, সুযোগ পেলে কাপড়ের ফাঁদে দু-চারটা লিচুও। এখন দিনকাল বদলে গেছে।
বুয়া ইনজাংশান বলতে পারে না। বলে, বড় সাহেব গাছে ইনজেকশন দিয়েছেন। ইনকেজকশন দেয়া গাছের ফল স্বাস্থ্যের জন্য তিকর। হুক স্যার যতদিন থাকবেন ততদিন ফল খাওয়া যাবে না। ফল না খেলে কী বাল হয়!
কম কথার মানুষ হুমায়ুন কবির।
সাজ্জাদ সাহেব বলতেন: বিওয়্যার অব দোজ, হু টক লিটল। হুমায়ুন সাহেব কম না, কমের চেয়েও কম। তবে অকাজে পড়লে কথায় কথায় মাথা ঘুড়িয়ে দেন। আলাপচারিতার প্রথমে মনে হয় মিতভাষী কিন্তু মুখ খুললে বুড়ো স্বামীর যুবতী বউয়ের মত গলগল কথায় কান ঝালাপালা করে দেন। কোন মুখরা রমণীও এত মুখর না।
অসীমের বিদায় সংবর্ধনায় হুমায়ুন সাহেবের বক্তৃতা এখনও হাসির খোড়াক।
সভাপতির চেয়ারে বসে হেসে হেসে গম্ভীর গলায় বলেছিলেন: অসীমের বস মহিলা। ঈদ-পার্বনেও কোলাকুলি করা যাবে না। নেহাত পিঠা-পিঠি, দুধের সাধে ঘোল ঢেলে পুষ্টি পাওয়া যায় না। মেয়ে বসের সাথে কী আর বুকা-বুকি করা যায়?
জাভেদ ঢুকতে চোখ কপালে তুলে তাকান মিস্টার হুক: কী চাই? নিশ্চয় গাড়ি! চোখ দেখে আমি কলিজার কোষগুলোও পড়তে পারি।
জ্বী স্যার।
আঁতকে উঠেন হুমায়ুন সাহেব: চল্লিশ কিলো! এত তেল খরচ করা যাবে না। গরিব দেশ, যত কম খরচ করা যায় তত মঙ্গল। কৃচ্ছতার চেয়ে বড় পূণ্য আর নেই। সরকার সাবসিডি দিতে দিতে একশ বিশ বছর বয়সী বুড়োর চেয়ে ন্যুজ হয়ে গেছে। রেহাই দাও।
পরীার ডিউটিতে গাড়ি ছাড়া যাওয়া অসম্ভব না হলেও রিস্কি। বহিষ্কৃত পরীার্থীদের সাথে একই বাসে আসতে হয়। কোন অঘটন ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়। তখন কী হবে?
বসের সাথে তর্ক করা যায় না, প্রচণ্ড ােভ নিয়ে বেরিয়ে আসে জাভেদ।
ব্যাচেলর মেসের জুনিয়র অফিসার জাফর নতুন বউ নিয়ে কয়েক দিনের জন্য মেসে উঠেছেন। শ্বশুড় নব দম্পতিকে দেখতে আসবেন। জাফর সার্কিট হাউজে শ্বশুড়ের জন্য একটা রুম বুক করে রাখে। জাফর মনে মনে খুশি।
দুদিন পর আসেন হুমায়ুন সাহেবের গেস্ট, এক দুই নয়, রীতিমত এক ঝাঁক। গেস্ট আসার পর হুমায়ুন সাহেবের দেশপ্রেম উধাও। এখন তার মিতব্যয়ী তত্ত্বে ধর্মের সমীরণ। পাঁচ-পাঁচটা গাড়ি নিয়ে ত্রিশ জন মেহমান পুরো জেলা নরক-গুলজার করে তুলে।
হুমায়ূনের দরাজ গলা: মেহমানদারি পূণ্যের কাজ, সনাতন ধর্মে অতিথি নারায়ণ। মেহমানদের জন্য এক লিটার খরচ করলে আল্লাহ দশ লিটার দেবেন। সৌদি আরবের লোকেরা অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তাই আল্লাহ তাদের মাটির নিচে তেলের ভাণ্ডার দিয়েছেন।
সবাই চুপ করে থাকেন। কারও কিছু বলার নেই, বস ক্যান নট সে রং।
সন্ধ্যায় জাফরের শ্বশুড় সার্কিট হাউস হতে রিং দেয়: বাবা জাফর আমি এসেছি।
আব্বাজান আপনি কোথায়?
সার্কিট হাউজের বারান্দায় বসে আছি, মশার কামড়ে হাতপিট লাল হয়ে গেছে। পাহাড়ি মশা, ম্যালেরিয়া বুঝি আর ছাড়বে না।
রুমে উঠেন নি? ছয় নম্বর রুম।
উঠতে দেয় নি। ঐ রুমে নাকি তোমাদের বড় স্যারের মেহমানের কাজের ছেলেটা উঠেছে। আমি এখন কোথায় যাব?
টেলিফোনে রুম ক্যান্সেলের সংবাদে জাফর কাঁদো কাঁদো। কেয়ারটেকারকে টেলিফোন করে জাফর। বড় স্যার বলেছেন রুম ক্যান্সেল করতে।
করবেই তো। বসের কুকুরও বস। বসেরা এমনই। এসপি আবুল হোসেন সাহেবের পনের বছর বয়সী ছেলের ভয়ে বাঘা-বাঘা ওসিরাও তটস্থ থাকত। সে অন্য কথা। তা নাহলে বস! বসের পায়ের নখ সাবঅর্ডিনেটদের হাতের নখের বস।
জাফরের বউ রেগে আগুন: মুরোদহীন বলদ, আমার বাপকে অপমান, এমন হতে পারে বলো নি কেন? তোমার সার্কিট হাউজে আমার বাবা মুত্‌তেও আসত না; যদি না তোমার সাথে বিয়ে হত। ফাইভ-স্টার হোটেল ছাড়া আমার বাবা হাগেও না। পাগলের মত ঘুরাঘুরি হতে সার্কিট হাউজের উৎপত্তি। আমার বাপ একদিনের আয় দিয়ে দুটো সার্কিট হাউজ বানাতে পারে। আমার বাবার যদি ম্যালেরিয়া হয় তো তোমার চৌদ্দগুষ্ঠি আমি ছারখার করে ছাড়ব।
বউয়ের গালি হুমায়ুন সাহেব পর্যন্ত পৌঁছায় না। জাফরের শ্বশুড় হোটেলে উঠতে বাধ্য হন। তবে ফাইভ স্টার নয়, এখানকার হোটেলগুলো সব স্টারলেস।
হোটেল না থাকলে মেসের একটা খাটে শ্বশুড়কে জামাই-কন্যা নিয়ে রাত কাটাতে হত।
ইনজাংশানের তিন সপ্তাহ পর হুময়ুন কবির সবগুলো লিচু ট্রাকে ভরে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ব্যাচেলর মেসের বাজার সরকার মোবারকের মাথায় কিছু ঢুকে না: এত খাবে কে? বড় স্যারের সরকারি বাসায় অনেক গাছ, তবু আমাদের গুলোও নিয়ে গেলেন: আমরা খাব কী?
বুয়ার মাথায় হাত: হায় গো এ কেমন অফিসার, একটা ফোস্‌কাও তো রাখলে না আমাদের জন্য। এমন ছোট লোক জন্মে দেখি নি। এমন মিছিকিন কীভাবে বড় সাহেব হয়? এ তো আমার চেয়েও ফকিন্নী!
চুরি করেও লিচু খাবারও উপায় নেই। গুণে কোন্‌ থোকায় কয়টি রেজিস্টরে লিখে রেখেছেন। সপ্তাহে তিনবার চেক হয়। খায় কোন বাপ!
হুমায়ুন সাহেব কে এমডি কালাম নামক একজনের অধীনে চাকুরি করেছেন। জুনিয়রগণ কেএমডি গল্পে অস্থির। অবসর পেলে কেএমডি আবুল কালামকে টেনে নিয়ে আসনে:
কেএমডি স্যারের বউটা ছিল কাউয়ার মত কালো। কোথাও শ্রী-এর নামগন্ধও ছিল না। সারা রাত ঝগড়া দিতেন স্বামী-স্ত্রী, রীতিমত যুদ্ধ। একদিন নয়, মাঝে মাঝেও নয়, প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টা। বউ অসুন্দরী ছিল বলে কোন জুনিয়রের সুন্দরী বউ দেখলে ঈর্ষায় পাগল হয়ে যেতেন। জব্বার সাহেব ছিলেন আরও সিরিযাস। বউকে কর্মস্থলে নিতেন না। বউয়ের সাথে রাত কাটানোকে শীতের রাতে বরফ জড়িয়ে ঘুমানোর চেয়েও কষ্টকর মনে করতেন। বউ ছাড়া যে কোন মেয়েতে আপত্তি হত না। ঝাড়ূদার মহিলার সাথেও শুয়েছেন। সরকারি বাসায় এসপি সাহেবকে নিয়ে মদ টানতেন। ইয়াসমিন হত্যা মামলায় দুজনের চাকুরিই খতম। যেমন কর্ম তেমন ফল, দুজনেই রসাতল।
রেজাউল কেএমডি সাহেবের সুন্দরী-প্যাবিয়া সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন না। জয়েন করে যথারীতি বউ নিয়ে স্যারের বাসায় কার্টেসি ভিজিটে যান। রেজাউলের বউ দেখে কেএমডির চোখ চড়ক গাছের মগ ডালে উঠে যায়: সাধের লালসালুর মত তোমার পাছার কাছে দাড়ানো মাগীটা কে রে?
প্রথম প্রশ্নে রেজাউল ঘেমে একাকার। প্রাক্তন শিবির ক্যাডার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আমতা আমতা করে বললেন: আমার ওয়াইফ স্যার?
কেএমডির হুলো বিড়াল টাইপের চোখ দুটো রেজাউলের বউয়ের দিকে তেড়ে যায়। গলা দিয়ে গড়গড় আওয়াজ বের হচ্ছে। নাগ টাইপের লম্বা জিহবা দিয়ে কলা স্টাইলের ঠোট দুটো চুষে বললেন: ওয়াইফ! আমাকে তো আকাশ থেকে ছুড়ে দিলে রেজাউল! ওয়াইফের মুখে লাল লিপাস্টিক কেন? এ রকম লাল কোন ভদ্র মহিলার ঠোঁটে থাকে না।
রেজাউলের বউ লজ্জা-ঘৃণায় মুষড়ে। মহিলা আসলেই ভদ্র। শুনে যাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই, হোয়াট ক্যান নট বি কিউরড্‌ মাস্ট বি ইনডিউরড্‌। তখন যদি বিএনপি-জামায়াত জোট মতায় থাকত তাহলে রেজাউল দেখিয়ে ছাড়ত। ছয়মাস আগে মাহমুদ প্রতিবাদ করেছিলেন। পরদিন কন্যার সাথে অশালীন আচরণ করার অভিযোগ এনে বিভাগীয় মামলা দায়েরের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিলেন। প্রতিবাদি মাহমুদকে প্রচণ্ড হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল।
কেএমডি স্যার মিসেস রেজাউলের দিকে তাকিয়ে এরপর কী বলেছিলেন জান? বলেছিলেন: বিয়ে মানে তো সাবলেট, উভয়ের কষ্ট। না যায় ছাড়া না যায় মারা। সাবলেটের বাসিন্দার সঙ্গে এত মাখামাখি কেন বাপু? বউ তো আমারও আছে, লিপাস্টিক দিলেও দেখা যায় না, অভয়ারণ্যের মত অন্ধকারে ঢেকে থাকে। এমন লাল লিপাস্টিক আর চকমকি বউ নিয়ে এদিকে এসো না, মানুষের মতিগতি ঠিক না, কখন কী করে বসে, আমি কিন্তু এসব ঝামেলা পছন্দ করি না। এমন মেয়ে বিয়ে করবা যাতে কারও চোখ না পড়ে।
সবাই অবাক হয়ে শুনতেন, অবাক চোখ দেখে হুমায়ুন সাহেব পূর্ণিমার জোয়ারে উথলে উঠতেন: কুদ্দুস ছিল সাংঘাতিক চালাক। জয়েন করার আগে কেএমডি স্যারকে পুরো ঠোটস্থ করে আসেন। জয়েনিং লেটার দিয়ে চেয়ারে বসার আগে কেএমডি প্রশ্ন করেন: বউ কোথায়?
কুদ্দুস বলল: পিটিয়ে আধমড়া করে আগের কর্মস্থলে রেখে এসেছি। কেন যে বিয়ে করলাম স্যার! হাসিতে উদ্ভাসিত কেএমডি চেয়ার হতে উঠে কুদ্দুসকে জড়িয়ে ধরেন: এতদিন পর একজন মানুষ পেলাম। বাকিরা সব স্ত্রৈণ।
কেএমডি কোন অফিসারকে ছুটি দিতেন না কিন্তু কুদ্দস মাসের পর মাস অফিসে না আসলেও কোন অভিযোগ হত না। সে এত ধুরন্ধর ছিল যে, একদিন বউকে বোরকা পড়িয়ে কেএমডি স্যারের অফিসে পাঠিয়ে দেন।
অফিসে মেয়ে দেখে কেএমডি হতাবাক: আপনি কী জন্য এসেছেন?
আমি কুদ্দুসের বউ। আমাকে প্রতিদিন মারে, আমি আর পারছি না।
মেকি সান্তনায় কুদ্দুসের বউকে বিদায় করে কেএমডি কুদ্দুসকে খবর দেন।
কুদ্দুস ঢুকার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরেন মহা উল্লাসে: মহাবীর আলেকজান্ডার তোমায় দেখে লজ্জায় মরে যেতেন। আজ হতে তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে। তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।
জগদীশ বাবু ঢুকতে হুমায়ুন সাহেবের কথায় ছেদ পড়ে।
ইতোমধ্যে হুমায়ুন সাহেবকে হোসেনদ্বয় নতুন-রীতি চালুর উপযোগিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: আগের জন লোক চিনতে ভুল করতেন, আপনি স্যার বুদ্ধিমান। নতুনভাবে ওয়ার্ক ডিস্ট্রিবিউশন করুন।
কলিজার হাসিটা গলা পর্যন্ত আসার পর চেপে রেখে হুমায়ুন সাহেব বললেন: কীভাবে বুঝলেন আমি বুদ্ধিমান?
বুদ্ধিমানেরা কম কথা বলেন। আপনার পূর্বতন কর্মস্থলগুলোর খবর আমরা জানি, কী চমৎকার সুনাম! আমরা আপনাকে পেয়ে গর্বিত। এত ভাল বস আগে পাই নি।
প্রশংসা শুনলে হুমায়ুন কবির খুশিতে ইশ্বরের ন্যায় উদ্বেল হয়ে উঠেন: আমি বেগমগঞ্জের মত জায়গার চার বছর কাজ করেছি। মানুষ দূরে থাক কাক-পীও আমার গায়ে মল দিতে পারে নি। আমি রাস্তা দিয়ে হাটলে কাক পর্যন্ত হাগা বন্ধ করে দিতেন। তোমরা কীভাবে যে ফিউচার ম্যানেজ করবে বুঝতে পারি না। না জানো কাজ না জানো সাজ। একটা অফিসার যদি ভাল পেতাম, সবকটি জানোয়ার, আমার বিশ বছরের চাকুরি জীবনে একজন ভাল অফিসার পাই নি। সিনিয়রেরা বলদ আর জুনিয়রেরা ভাজা গাই।
মোহাম্মদ হোসেন বললেন: স্যার, মৌখিক পরীার মাধ্যমে যাছাই করে অফিসারদের দায়িত্ব বণ্টন করা যেতে পারে।
গোলাম হোসেন প্রতিবাদ দেন: মৌখিক পরীায় প্রকৃত মেধা যাছাই করা যায় না। মৌখিক ও লিখিত দুটো এক সাথে নিন। কড়া যাছাই, মরাও বাঁচায়।
হুমায়ুন সাহেব শুনছেন আর ছোট ছোট হাসছেন। তার মন প্রথম দিন হতে বিগড়ে, কোন মহিলা অফিসার নেই। রমনীহীন বাড়ির মত পুরো অফিসটা গোয়াল ঘরের মত অসহ্য। এমন নচ্ছার জায়গা আর নেই। মেয়ে অফিসার না থাকলে অফিস ভাল লাগে না। আরাধ্য রমনী, উষ্ণ রাখে ধমনী।
প্রত্যেক অফিসে দুএকটা মহিলা কর্মকর্তা থাকা উচিত। বিপরীত মেরুর আকর্ষণে পুরুষ অফিসারগুলোকে নেড়ি কুত্তার মত অফিসে আটকে রাখা যায়। আইন-ফাইন দিয়ে হবে না।
ইতোমধ্যে হুমায়ুন কবির জুনিয়র অফিসারদের বায়োডাটা কালেকশন করে নিয়েছেন। রেজাল্টের ভিত্তিতে কর্মবণ্টন করা হবে প্রত্যাশায় ব্রিলিয়ান্ট জুনিয়রেরা খুশি, তারা ভাল কাজ পেতে যাচ্ছেন। মেধার মূল্যায়ন হয় না বলে দেশে মেধার বিকাশ হচ্ছে না।
মোহাম্মদহোসেনের উপর চোখ রেখে হুমায়ুন সাহেব বললেন: আমি টেস্ট করব আমার ওয়ে-তে। লিখিত-মৌখিক কোনটা যথার্থ পন্থা নয়। এটা এক ধরণের প্রহসন। প্রহসন নিজের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। আমি নিরাপত্তাকে খুব গুরুত্ব দেই। নিজেকে সত্যিকার অর্থে নিরাপদ রাখার জন্য চারপাশে যোগ্য অফিসারই রাখব। মেয়ে হলে ভাল হত, গাদ্দাফির কাছ হতে আমি এ শিা পেয়েছি। মেয়ে বডিগার্ড নিয়ে বেটা এত প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে আছেন। মেয়েরা বিশ্বস্ত হয়, সংকীর্ণ পরিসরেও বিরক্ত আসে না, বরং চাঙ্গা হয়ে উঠে শরীর। কিন্তু মেয়ে তো নেই। আমি প্র্যাকটিল পরীা নেব।
জগদীশ বললেন: আপনি বলেছিলেন মেয়ে বস ভাল নয়, কোলাকোলি করা যায় না।
মেয়ে বস ভাল না হলেও সাবঅর্ডিনেট বেশ ভাল। বউয়ের চেয়ে শালীর রূপ, ইচ্ছে করে দিতে ডুব।
মোহাম্মদ হোসেন বললেন: এ রকম যোগ্য অফিসার কি স্যার পাওয়া যাবে?
মোহাম্মদ হোসেনকে জুনিয়ররা মদন ডাকেন; আসলেই মদন। ভানে দুনিয়ার সব জানেন কিন্তু জ্ঞানে আলু, কথায় রাজা কাজে ভাজা।
হমায়ুন সাহেব বললেন: বের করে নেব। একজনই এনাফ, নতুবা খালি থাকবে। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। গাই একটা যদি তিনটা দুধ দেয় তো অযথা তিনটা পুষবো কেন? অপব্যয়ী শয়তানের ভাই, আমি ওসবে নাই।
পরদিনই হুমায়ুন সাহেব যাছাই শুরু করেন।
প্রথমে ঢুকেন কবির। স্মার্ট অফিসার। যেমন কথা তেমন কাজ; একসুঁতোও ফাঁক রাখে না। লোকে বলে চোস্ত ম্যান, আইডিয়াল অফিসার।
হুমায়ুন সাহেব চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি ঝরিয়ে বললেন: জামা খোল, বগল দেখাও।
অবিশ্বাস্য চোখে হুমায়ুন কবিরের দিকে তাকিয়ে আদেশ পালন করেন কবির।
চকচকে বগল, কেশের চিহ্নমাত্র নেই। বগলের রোশনাই দেখে হুমায়ুন কবির হতবাক, নাক সিট্‌কে হুলো বিড়ালের আওয়াজ দেন: তুমি কাজ কর কখন? বগলে যদি এত সময় দাও! ঠিক আছে যাও, জামালকে পাঠাও।
জামাল ঢুকামাত্র মোহাম্মদ হোসেন আদেশ দেন: জামা খোল, স্যার বগল দেখবেন।
জামা খুলে জামাল। সাদা জামায় ওয়ানম্যান শো-এর গন্ধ। ছিমছাম অফিসার। পাকা আপেলের মত চকচকে মুখে নিখুত রেখা। হুমায়ুন জামালের বগলে চোখ রাখেন, কেশ আছে তবে চিমটা ছাড়া একটাও ধরা সম্ভব নয়, গতকাল অথবা পরশু পরিস্কার করেছেন। চশমা ছাড়া অত ছোট কেশ দেখা যাচ্ছিল না। হুমায়ুন সাহেব চশমাটা মুছে চোখে লাগান: সপ্তাহে কয়বার বগল কাটো?
একবার।
কোনদিন?
শুক্রবার।
ঠিক আছে, যাও।
জামালের পর আসে মোজাম্মেল। কালো কালো বড় চোখ, সুঠাম গঠন, দেখলে শক্তির আভাস মেলে। সালাম দিয়ে বসার আগে বলে উঠেন মিস্টার হুমায়ুন: জামা না খুলে বগলটা দেখাও। আমার হাতে সময় কম। তোমাদের মত খচ্চরদের জন্য এক সেকেণ্ড সময় নষ্ট করতেও কষ্ট হয়।
ফুলশার্ট, জামা না খুলে বগল দেখানো কষ্টকর, ফটাফট জামাটা খুলে হাত দুটো উপরে তুলে মোজাম্মেল।
বগলের কেশ অনেক ছোট, তবে লম্বায় সব সমান নয়। কাণ্ড দেখে হুমায়ুন মোজাম্মেলকে আরও কাছে আসতে আদেশ করেন।
কী ব্যাপার? বগল কেশের সাইজে এত হেরফের কেন? সবগুলো কী একই দিনে কাটো না? এমন কাণ্ড তো আর দেখি নি।
মোজাম্মেল বললেন: দু-এক টানের বেশি দেই না। অত সময় পাই না। তা ছাড়া একই দিন জন্ম নিলেও সবার সাইজ সমান হবে তা তো চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে না।
তারপর কাশেম এবং আরও কয়েক জন।
হুমায়ুন সাহেবের চেহারা মলিন হতে মলিনতর হতে থাকে। তিনি কি যেন খুজছিলেন, না পেয়ে ক্রমশ হতাশ আর ুব্ধ হয়ে উঠছেন। সবার শেষে আসে সারওয়ার। ছয় ফিট উচু, এংলো ইন্ডিয়ান চেহারা। চাকুরি দুবছরও হয় নি, দেখলে মনে হয় বলদ, কাজেও অমন; শুধু গলদ।
বগল দেখাও, বিরক্তিতে বলে উঠেন হুমায়ুন সাহেব। পারলে লাথি মারেন।
জামা খোলামাত্র ভটকা একটা গন্ধে চারিদিক মুচড়ে উঠে। নাকে হাত রাখে হোসেনদ্বয় বিপদের আশঙ্কায় উসখুস শুরু করে দেন। হুমায়ুন সাহেব গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে চেয়ার হতে লাফ দিয়ে উঠে সারওয়ারের বগলের কাছে গিয়ে গাভীর পেছনে মুখ টেসে ধরা বৃষের মত নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেন। এতণ পর প্রতিীত সুবাস, আহ্‌ কী শান্তি।
বগলের দিকে চোখ দিয়ে হুমায়ুন সাহেব আরও উদ্বেল। সাড়ে নয় ইঞ্চি লম্বা, নিশার চেয়েও গভীর। পুরো বগল ঢাকা, মনে হয় গত তিন বছর তে নিংড়োয় নি। উকুন মাস্ট, ভাল করে খুজলে হার্মিং বার্ডের বাসাও পাওয়া যেতে পারে কয়েকটা।
উদ্ভাসিত স্বরে বলে উঠেন হুমায়ুন সাহেব: ইউ আর রাইট এন্ড পারফেক্ট।
একগাল হাসিতে বগলের গন্ধ ছড়িয়ে বেরিয়ে যায় সারওয়ার।
বগলের মাহাত্ম্য দেখে জগদীশ ছানাবড়া। হোসেনদ্বয় আেেপ মলিন, ইস তাদের যদি অমন বগল থাকত তো এুণি জামা খুলে স্যারকে দেখাতে পারতেন। কেন যে বগলের কেশ কাটলেন। যতদিন হুক স্যার থাকবেন ততদিন বগলের কেশ আর কাটবেন না- মনে মনে হোসেনদ্বয় প্রতিজ্ঞা করে নেন।
গোলাম হোসেন বললেন: আমাদের কাছেও সারওয়ার বেস্ট। তবে আপনি কেন সারওয়ারকে বেস্ট ওয়ান হিসেবে চিহ্নিত করলেন স্যার? আমি জানি গ্রেট ম্যান থিংক্‌স এলাইক।
এটাও বুঝতে পার না? তোমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে চাকুরি করার যোগ্য নও। যোগ্য সিলেক্ট করতে পারা সাফল্যের পূর্ব শর্ত। সারওয়ার কাজের জন্য বগল কাটার সময় পায় নি। সিভিল প্রশাসনে চাকুরেদের বগল কেশহীন থাকতে পারে না। যাদের থাকে না তারা কাজে ফাঁকি দেয়, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যাও, ভাল সেকশন ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো সারাওয়ার এবং মোজাম্মেলকে দেয়ার ব্যবস্থা কর।
বাকিরা?
দেখি, তাদের বগল কতদিন পরিষ্কার থাকে। রুলিং স্টোন ডাজ নট গেদার এনি ময়েশ্চ।
জগদীশ বাবু এতণ হুমায়ুন সাহেবের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। তিনি বিচণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এমন পাগলামো কখনও দেখেন নি। বললেন: সারওয়ার তো লেখা পড়ায় অক্কা। একাডেমিতে দুবার ফেল মারার পর বিশেষ বিবেচনায় পাশ দিয়েছে। তাকে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া কী ঠিক হবে?
আমার জ্ঞানের দরকার নেই, দরকার কাজের। নবীনেরা সৃষ্টিশীল হয়। তোমার রবীন্দ্রন্‌াথই তো বলে গেছেন, “ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা, আধ-মড়াদের ঘা দিয়ে তুই বাঁচা।” তুমি হিন্দু হয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করছ? এমন রাজাকার হিন্দু তো দেখি নি।
মরিয়া হয়ে উঠেন জগদীশ: সরোয়ার যেমন বোকা তেমন অজ্ঞ।
হুমায়ুন বললেন: কেউ চায় না তার বাসার কাজের ছেলেটা চালাক হোক। চালাকেরা ফাঁকিবাজ হয়। কাজের ছেলে হবে হাবাগোবা, যা বলব বোকারা তা-ই করে দেবে বিনাবাক্যে। সারওয়ার তেমন একজন, আমি বগল দেখে বুঝেছি। কম জানে যারা তারা প্রতিবাদি হয় না। তোমরা এমন একটা সার্ভিস কর যেখানে অভিজ্ঞতা নিষ্প্রয়োজন। শুন তাহলে- আমি তখন তোমাদের পোস্টে। নতুন জয়েন করেছে কাদের। বস আমাকে ডেকে কাদেরকে কোন ভাল সেকশন না দেয়ার নির্দেশ দেন। কাদের আমার অনেক দিনের চেনা। বিনা প্রতিবাদে কোন কিছু মেনে নেয়ার ছেলে সে নয়। যেমন দ তেমন পরিপক্ক। স্যারকে বিনয় নিয়ে বলেছিলাম: আমি তাকে চিনি, কাদের খুব ভাল অফিসার।
বস আমার দিকে তাঁকিয়ে বলেছিলেন: হুমায়ুন আমিও তাকে চিনি। প্রতিবাদি, প্রতিবাদি না ছাই, বেয়াদব। কোন কিছু বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয় না, যেটা তার মনমত হবে না সেখানে প্রতিবাদ করবে। তার মত বেয়াদব আমি কম দেখিছি। তবে কঠিন কাজ, যেগুলোতে পাবলিক উত্তেজনা প্রশমন করা প্রয়োজন সেগুলো ঠেকানোর জন্য তাঁকে পাঠিয়ে দিও। সাপ সতিনের ছেলে দিয়ে ধরানোই উত্তম।
একটু থেমে কলিং বেলে চাপ দেন জনাব হুমায়ুন। এখন চোখ জগদীশের দিকে।
বললেন: জুনিয়রেরা ইয়াং-এনার্জিটিক। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো তাদের দিয়ে পরিচালনা করা উচিত।
জগদীশ বাবু মনে মনে আউড়াতে থাকেন: তারা তো আপনার চেয়ে ইয়াং, তাহলে তো আপনার চেয়ারে জুনিয়রদের কাউকে বসানো উচিত। মনের কথা প্রকাশ করা নিরাপদ নয়। তাই তা মনে চেপে রেখে বললেন: অভিজ্ঞতা বলে তো একটা কথা আছে।….
আমাদের ক্যাডারের সদস্যদের দতা-অদতার বিস্তার কিংবা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান কর্তব্য কাজে প্রভাব ফেলে না। চুরির সংজ্ঞা জানেন না এমন কমিশনার আমার আপিল শুনেন, কীভাবে? জানলে তিনি কমিশনার হিসেবে পোস্টিং পেতেন না। অভিজ্ঞতা দিয়ে কী হবে? তরুণ অস্ট্রেলিয়া হতে নগর ব্যবস্থাপনার উপর ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে আসার পর শাল্লায় পোস্টিং পায়। তার গবেষণার বিষয় উল্লেখ করে পোস্টিং পরিবর্তন করার জন্য গেলে সচিব মহোদয় বলেছিলেন: বাপু শাল্লাকে শহর বানিয়ে আস, তারপর দেখব তোমার ডক্টরেটের ঠেলা।
পানির গ্লাসে চুমুক দেয়ার জন্য মিস্টার হুমায়ুন কথা বন্ধ করেন।
এ ফাঁকে জগদ্বীশ বাবু বলে উঠেন: সারওয়ার একটা ভাল ড্রাফটও করতে পারবে না, কাজ চলবে কীভাবে?
পানির গ্লাস পিয়নের হাতে দিয়ে হুমায়ুন সাহেব বললেন: যত সমস্যা সব ভাল ড্রাফটে। ভাল ড্রাফটে চিঠি লিখতে হয় প্রেমিকাকে, বউ বা বসকে নয়। বসকে লিখতে হয় কাজের ড্রাফটে, বউকে ধমকের ড্রাফকে। বসেরা চিঠি পড়েন না, কেরানিরা পড়ে। অফিসারদের কয়জনই বা ভাল ড্রাফট করতে পারে শুনি? যারা পারেন তাদেরকে দিয়ে ড্রাফট লেখানো হয় না, উচিতও না। তুমি লিখলে ঠিক আছে, কিন্তু তোমার বস যদি ভাল ড্রাফট না বুঝেন? যে কেরানি ফাইল শুরু করেন তিনি যদি না বুঝেন! আমার এক কলিগ একবার ছুটির দরখাস্তে লিখেছিলেন ” কেলিকুঞ্চিকাকে নিয়ে দ্বারিকালয়ে যাওয়ার নিমিত্ত ছুটির প্রার্থনা”। কেলিকুঞ্চিকা আর দ্বারিকালয় শব্দের অর্থ বুঝানোর জন্য তাকে সচিবালয় পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আর কোন দিন এমন লিখলে ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং স্টার্ট করার হুমকি দিয়েছিলেন সচিব।
আমরা ঘটনাটা শুনেছি স্যার, হোসেনদ্বয় এক সাথে বলে উঠেন।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন হুমায়ুন কবির: তখন আমি কুমিল্লায়, প্রচন্ড বৃষ্টিতে এলাকা পানির নিচে। ক্যাবিনেট বন্যার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। শাহাদাত লিখলেন, “প্রচন্ড বারিপাতে পথঘাট ডুবে গেছে।” স্যার বারিপাত কেটে লিখে দেন, ‘বাড়িপথ’। নাক সিটকে বলে উঠেন: বারিপাত বলে কোন শব্দ অভিধানে নেই, আছে বাড়িপথ। এমন ভুল আর কর না। প্রতিবাদ করে নি শাহাদাত; বলেছিলেন, “জ্বী স্যার কখনও আপনার সামনে বারিপাত নিয়ে আসব না।”
জগদীশের দিকে চোখ রেখে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন হুমায়ুন কবির: তুমি ঢাকার প্রাক্তন জেলা প্রশাসক আলী সাহেবের বিখ্যাত রংফুল (ডৎড়হমভঁষষ) চিঠিখানা পড়েছো?
কোন্‌ চিঠি স্যার?
দুদিন আগে এসেছে।
পড়েছি।
দেখেছো? দশ লাইনে বিশটা ভুল, তো তিনি কীভাবে ঢাকার জেলা প্রশাসক হন? কীভাবে ব্যারিস্টার ডিগ্রি পান? ভাল ড্রাফটার হলে তিনি এট বেস্ট কোন স্কুল কিংবা গ্রামের কলেজের খাতা-পেটা শিক হতেন, এর বেশি না। ড্রাফট পিয়নের কাজ, অফিসারের নয়। আমার পূর্বসুরী হাওলাদার সাহেব ড্রাফটা নিয়ে নাকি সারাদিন লেগে থাকতেন, তোমরাই তো বলেছ। কাজ কিছু হয়েছে? করেছে? পাবলিক ড্রাফট চায় না, কাজ চায়- বুঝলে? আমরা কাজের অফিসার, ড্রাফটের নয়।
জগদীশ বললেন: আপনাকে তো স্যার বাইরের পাবলিক ফাংশানে অনেক সময় বক্তব্য দিতে হবে, তখন কী করবেন?
তখন ভাল ড্রাফটারদের একজনকে দিয়ে লিখিয়ে নেব। ঘি ভাল, কিন্তু সবসময় খাওয়া যায় না; মাঝে মাঝে খেতে হয়। বুড়ো বয়সে তো একদম নিষিদ্ধ, পুরানো ক্যাডারগুলো এখন বুড়ো হয়ে গেছে। ভাল ছেলেরা জয়েন করলে প্রতিদিন ঘি খাওয়ার মত অবস্থা হবে। আজিরদ্দিন স্যার, যিনি কোন স্মার্ট লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও হাটু কাঁপিয়ে পড়ে যেতেন, তিনিও কমিশনার হয়েছিলেন, কীভাবে? ঘি-মাংস আনুষ্ঠানিক, প্রাত্যাহিক নয়। ওসব প্রতিদিন খেতে হলে যে ত্রে প্রয়োজন তা তোমার সার্ভিস নামক বডিতে নেই। ইতোমধ্যে চর্বিতে চর্বিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। অভিযোজিত হওয়ার চেষ্টা কর, নইলে কপালে খারাবি আছে।
জগদীশ বাবু আর যুক্তি খুঁজে পান না।
টেলিফোনে কথা সেরে হুমায়ুন কবির আবার বলতে শুরু করেন: আমি তখন স্থানীয় সরকার বিভাগে। জয়েন্ট সেক্রেটারি মতিন সাহেব একটি কর্মশালায় প্রধান অতিথি। আমি আয়োজনের দায়িত্বে। মতবিনিময়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি মতিন সাহেব বললেন: বাংলাদেশের আয়তন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞ বক্তা অধ্যাপক গফুর সাহেব বললেন: বিষযটা আমাদের জানা নেই, এমন কোন ভূখণ্ডগত পরিবর্তন তো হয় নি, যা দেশের আয়তন বাড়াতে সম। আমরা বিষয়টা বুঝতে পারছি না, অনুগ্রহপূর্বক ব্যাখ্যা করবেন কী?
জয়েন্ট সেক্রটারি সাহেবে বললেন: এরশাদের আমলে বাংলাদেশে কয়টি গ্রাম ছিল?
গফুর সাহেব বললেন: আটষট্টি হাজার।
এখন আমদের গ্রামের সংখ্যা আটাত্তর হাজার দুই শত ঊনচল্লিশ, গতকাল সচিবালয়ে আমার চেম্বারে হিসাবটা ফাইনাল করেছি। আয়তন না বাড়লে গ্রাম কীভাবে বাড়ল?
সভাপতির কানের কাছে মুখ নিয়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি মতিন সাহেব বললেন: দেখো, ভদ্রলোক কত কম জানেন।
সভাপতি আনমনা, চোখমুখ গফুর সাহেবের দিকে। গফুর সাহেবের নেঙ্ট প্রশ্নে উপস্থিত সবার আগ্রহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে: গ্রামের সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু তার সাথে দেশের আয়তন বৃদ্ধির কোন যোগসূত্র নেই।
এবার উপহাসের হাসি হেসে উঠেন জয়েন্ট সেক্রেটারি। তিনি কারও অজ্ঞতা দেখলে এভাবে হাসেন। বললেন: আপনি বিশেষজ্ঞ মানুষ, আমি কী বুঝাবো? আয়তন বেড়েছে বলেই তো গ্রামের সংখ্যা বেড়েছে, না কি? দেশের আয়তন না বাড়লে গ্রামের সংখ্যা কীভাবে বাড়ল? যেমন শরীরের আয়তন বাড়ার সাথে সাথে জামার আয়তন বাড়ে, মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে করে সংখ্য।
প্রধান অতিথির উদাহরণ দেখে বিশেষজ্ঞ বক্তা হতাশ, তিনি এত অজ্ঞতা আশা করেন নি। নিজেকে সংযত রেখে ভদ্রভাবে বললেন: গ্রামের আয়তন কমানো হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রশাসনিক সুবিধার জন্য গ্রামের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আগে যে জেলায় পাঁচশটি গ্রাম ছিল সে জেলায় ছয়শটি করা হয়েছে।
এবার জয়েন্ট সেক্রেটারি সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তার হাসিতে এক চিলতে কালি লেপটে যায়।
ইতোমধ্যে চা এসে যায়। চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার জন্য হুমায়ুন কবির একটু থামেন। তারপর জগদীশ বাবুর দিকে চেয়ে বিজ্ঞের মত বললেন: সেক্রেটারিয়েটে বিডিএস বা বগলদাবা সিস্টেম বলে একটা রীতি প্রচলিত আছে। জান তো?
জানি স্যার।
বগলে কেশ না থাকলে ফাইলের ঘষায় ঘা হয়ে যেতে পারে। তাই বগলে লম্বা কেশর প্রয়োজন, দিস ইস স্পেশাল ফোম। সিংহের কেশর আর সরকারি অফিসারদের বগল কেশ, দুটোই সমান গুরুত্বের অধিকারী। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বাঘের মত হতে হয়। হোক সে পুলিশ, কাস্টম, ইনকাম ট্যাঙ্, ম্যাজিস্ট্রেট—।
কিন্তু গন্ধ?
হুমায়ুন সাহেব জগদীশের প্রশ্নে বোকা বনে যান: জগদীশ, তুমি উপসচিব মর্যাদার অফিসারা কিন্তু যোগ্যতা দেখে আমি হতাশ। শাসক অফিসারদের শুধু বাঘ হলে চলে না। এট দ্যা সেইম টাইম শিয়ালের মত ধুর্ত হতে হয়। কুকুর তাড়ালে শিয়াল দৌড় দেয় কিন্তু দৌড়ে পারে না, ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে গন্ধ ছেড়ে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে। এজন্য বগলে গন্ধ প্রয়োজন। গন্ধু ছুড়ে সাধারণ লোকদের যত দূরে রাখা যায় তত ভাল। আর যারা তোমার আশেপাশে থাকে, আসবে তারাও কিন্তু তোমার মত গন্ধময় রাঘব বোয়াল। গন্ধের ভয়ে কুকুর কাছে ঘেষতে পারবে না। এজন্যই সরোয়ারের বগল কেশ এত লম্বা।
হুমায়ুন সাহেব বলে চলছেন: ঊর্ধ্বতন বসরা অদ ও কমজ্ঞানী বলে জুনিয়র দদের ভয় পান। আজিজ স্যার বলেছিলেন: সরকারি চাকুরিতে অধিক মেধাবীরা অডম্যান। তারা কাকের দলে কোকিলের মত অবাঞ্চিত।
জ্ঞানী হলে অসুবিধাটা কী? জানতে চান জগদীশ বাবু।
জ্ঞানীকে ট্যাকল করতে হলে অধিকতর জ্ঞানী হওয়া প্রয়োজন। তোমাকে ট্যাকল করতে হলে আমার তোমার চেয়ে অধিক মেধা প্রয়োজন, অতএব তুমি যাও। যে দেশে কাতেব-অজিরের মত লোক কমিশনার হন সে দেশের অফিসারদের বুঝতে তোমার বাকি থাকার কথা নয়।
এবার সবার বগল কেশ লম্বা করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
কাশেমকে দেখলে তেলে বেগুনে চিংচাং করে উঠেন হুমায়ুন।
প্রতি মাসের দ্বিতীয় সোমবার ঘাট হতে পিকআপ ভর্তি মাছ আর ফলমূল নিয়ে আসেন হুমায়ুন কবির। এটি ব্রিটিশ আমল হতে প্রচলিত রেওয়াজ। তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু গণ্ডগোল বাঁধায় কাশেম। হুমায়ুন সাহেবের বিভাগীয় কনফারেন্স মাসের দ্বিতীয় সোমবার পড়ে যায়।
এ সুযোগে কাশেম পিক-আপ নিয়ে সোজা নদী ঘাটে। হুমায়ুন কবির যেভাবে আনেন ঠিক সেভাবে নিয়ে আসেন মাছ আর ফলমুল।
কনফারেন্স হতে এসে কাশেমের কথা শুনে হুমায়ুন কবির েেপ ইটের জলন্ত ভাটা: কেন ওখানে গিয়েছিলে?
মাছ আনতে।
পয়সা দিয়েছ?
না।
কীভাবে এনেছ?
আপনি যেভাবে আনেন। পয়সা দিতে চেয়েছিলাম নেয় নি। বললেন: বড় স্যারের জন্য আমরা প্রতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাখি। বড় সাহেব এবার যান নি। আপনি নিয়ে যান।
ভাবলাম মাছগুলো অযথা নষ্ট হয়ে যাবে নিয়ে আসি।
আমি যা করি তুমি তো করতে পার না।
কেন?
প্রচণ্ড ধমকে বলে উঠেন হুমায়ুন: তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে যা করতে পার তোমার সন্তান তা কি পারবে? ডু হোয়াট আই সে, নট হোয়াট আই ডু। মায়ের সাথে মায়ের মত ব্যবহার কর বউয়ের সাথে বউ। যাও, যা যা এনেছো সব নিয়ে এসো।
কাশেম নিজের ভুল বুঝতে পারে: সরি স্যার, আমি এভাবে ভাবি নি।
ভাবতে হবে। সেক্রেটারি সাহেবের নেঙ্ট বক্তৃতার কথা মনে পড়ে?
জ্বী।
কী বলেছেন?
তিনি কারও কাছ হতে একটি টাকা কখনও ঘুষ খান নি, যত বড় এসাইনমেন্ট হোক বিনা ঘুষে রিলিজ করে দিয়েছেন, সরকারি ট্যাঙ্ ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কাউকে দেন নি। কোথাও গেলে এক পয়সার জিনিসও গ্রহণ করেন না, মরে গেলেও। সারা জীবন বেতনের পয়সা দিয়ে সংসার চালিয়েছেন।
তারপর?
আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে- অবৈধভাবে কিছু নেয়ার আগে যেন তাঁর মুত্যু হয়।
তারপর?
য়াওয়ার সময় এক ট্রাক ফার্নিসার আর দু পিক-আপ দামি উপহার নিজ হাতে তুলে দিতে হল আপনাকে।
দাম দিয়েছেন?
না, বরং প্রতিমাসে পাঠাতে হয়।
স্যাারের কয়টা বাড়ি?
দুটো, একটা বারিধারায় আর একটি গুলশানে।
বেতনের টাকা দিয়ে তা সম্ভব?
না।
কী বুঝলে?
মাছগুলো যত তাড়াতাড়ি আপনাকে ফেরত দেয়া যায় ততই মঙ্গল।

No comments:

Post a Comment