Translate

Sunday, 24 August 2014

আখতার হামিদ খান সিএসপি / ড. মোহাম্মদ আমীন

আখতার হামিদ খান (১৯১৪-১৯৯৯)

আইসিএস অফিসার আখতার হামিদ খান ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জুলাই ভারতের আগ্রায় এক সম্ভান্ত ও শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সারা বিশ্বে কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিত বার্ড তথা বাংলাদেশে একাডেমি ফর রুরাল ডেভলাপমেন্ট এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর আইসিএস ক্যাডারের সদস্য হিসেবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে সহকারী কমিশনার পদে যোগদান করেন। শিক্ষানবীশ আইসিএস অফিসার হিসেবে তিনি লন্ডনের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে পূর্ববঙ্গে পদায়ন করা হয়। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি পূর্ববঙ্গে অতিবাহিত করেন। পদায়নের প্রারম্ভ থেকে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করতে সক্ষম হন। সরকারি কর্মচারী হলেও তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। তিনি কর্মস্থলের মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ দ্বারা তাড়িত হতেন। সাধারণ জনগণের উপর কোন নির্যাতন, বৈষম্য, অবহেলা সহজে মেনে নিতে পারতেন না। পাকিস্তানের অধিবাসী হয়েও বাংলাদেশেল মানুষের প্রতি ব্রিটিশ শাসকবর্গের অবহেলা, বৈষম্য ও নির্যাতন তাকে ব্যথিত রাখত। 

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মহা মন্বন্তরের সময় ব্রিটিশ শাসকদের উদাসীনতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ তাকে প্রচ-ভাবে মর্মাহত করে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার ক্ষুদ্র ক্ষমতায় শাসকগোষ্ঠীর অবহেলায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে শত শত মানুষের মৃত্যু ও যাতনা সহ্য করতে না পেরে নৃশংস বৈষম্যের প্রতিবাদস্বরূপ চাকরি পরিত্যাগ করে আলীগড় চলে যান। আলীগড় শহরের নিকটবর্তী একটি গ্রামে তিনি ছদ্মবেশে শ্রমিক ও তালাওয়ালা হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। লেভ টলস্টয়ের অনুসরণে আখতার হামিদ খানের এ ব্যতিক্রমী জীবনকর্মমূলক পর্যবেক্ষণ দুই বছর স্থায়ী হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লির জামেয়া মিলিয়াতে তিন বছর শিক্ষকতা করেন। ভারত বিভাগের পর তিনি করাচিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন পর করাচি থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যক্ষের চাকরি নিয়ে পূর্বপাকিস্তান গমন করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

কুমিল্লায় অবস্থান আখতার হামিদ খানের জীবনের একটি অবিস্মরণীয় মাইল ফলক। এখানে থাকাকালীন তিনি কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রামসমূহ ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেন। এখানে তিনি বাংলা ভাষা, বাঙ্গালি ও বাংলার মানুষের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা এবং মনোভাব সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান অর্জন করেন। গ্রামীণ বাংলার তৃণমুল হতে আহরিত জ্ঞান আখতার হামিদ খানের চেতনায় নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার মনে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বিপ্লবী ধারণার উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পল্লী উন্নয়ন সম্পর্কে অধিকতর ধারণা লাভের জন্য আখতার হামিদ খান মিশিগান ইউনিভার্সিটি যান। এক বছর পর সেখান থেকে কুমিল্লা ফিরে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুর‌্যাল ডেভলাপমেন্ট’ সংক্ষেপে বার্ড (ইঅজউ) প্রতিষ্ঠা করেন।
বার্ড শুধু কোন একাডেমি নয়। এটি আখতার হামিদ খানের স্বপ্নমন্দ্রিত বৈপ্লবিক প্রেরণার একটি অনন্য শৈলীসজ্জা। অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন, উৎপাদন, সমতা, ঐক্য, শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সবুজাভ শ্যামলিমা, জীবনবোধ, মানবতাবোধ প্রভৃতিসহ মানব জীবনের প্রত্যেকটি প্রত্যয়ের পরিচ্ছন্ন বিকাশে আইসিএস অফিসার আখতার হামিদ খানের বার্ড একটি মনলোভা বিন্যাসের প্রমুগ্ধ ইতিহাস। বার্ড ধারণা আখতার হামিদ খানকে সারা বিশ্বে উৎপাদনশৈলীর অনিবার্য কিংবদন্তিতে পরিণত করে। একই সাথে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও উজ্জ্বল হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমে লায়ালপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৭২ থেক ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আখতার হামিদ খান ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে যোগদান করে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮-১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিশিগান ইউনিভার্সিটি ছাড়াও তিনি সুইডেনের লুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উড্র উইলসন স্কুল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, হার্ভাড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আখতার হামিদ খান করাচিতে ওরাঙ্গি পাইলট প্রজেক্ট (ওপিপি) প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানের ইতিহাসে আর একটি সমন্বিত সবুজ বিপ্লবের অনবদ্য কিংবদন্তির জন্ম দেন। বর্তমানে ওপিপি এশিয়ার বৃহত্তম ‘এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’ হিসেবে খ্যাত।

আখতার হামিদ খান শুধু আইসিএস অফিসার কিংবা বার্ড মডেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। একাধারে তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী, হৃদয়াকর্ষক প্রাবন্ধিক, যৌক্তিক বিশ্লেষক এবং দুরদর্শী প্রতিবেদক। তিনি শুধু প্রবন্ধ রচনা করেননি, কবিতা ও ভ্রমণ কাহিনীও রচনা করেছেন। তার প্রবন্ধগুলো গল্প-কবিতার চেয়েও অনেক আকর্ষিক ছিল। বাগ্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সহজে মানুষকে আকৃষ্ট করার অদ্ভুদ ক্ষমতা ছিল তার মজ্জাগত। 

ইংরেজি, বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন ভাষায় তার অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন, সমাজ সচেতনতা, সাধারণ মানুষের মানসিক চেতনার সাথে সম্মিলিত প্রয়াস ও উৎপাদনের সম্পর্ক তার প্রবন্ধের মূল উপজীব্য। আখতার হামিদ খানের অধিকাংশ লেখা পল্লীউন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও বিষয়বস্তু, পরিবেশনার ধরণ, বিশ্লেষণ, যুক্তি, ভাষার গাঁথুনি প্রভৃতি বিবেচনায় অনেকগুলো লেখা সাহিত্যমান উত্তীর্ণ হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

সাহিত্য কর্মের উদ্দেশ্য মানব কল্যাণ। তিনি প্রবন্ধে যুক্তি, বিশ্লেষণ, তথ্য, উপাত্ত আর পরিবেশনার কারুকার্যতার মাধ্যমে তার প্রাবন্ধিক চেতনাকে সাধারণ্যে বাহিত করে সমন্বিত উদ্যোগ এবং তদমাধ্যমে স্বীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রয়াস চালান। প্রাবন্ধিকের এ প্রয়াস যখন সফল হয় তখনই প্রবন্ধ অন্তর্নিহিত সফলতার মৌলিক আনন্দে বিদূষিত হয়। প্রবন্ধের এ শর্তটি পর্যালোচনা করলে নিঃসন্দেহে আখতার হামিদ খানের প্রতিটি প্রবন্ধ সার্থক। এ সার্থকতা বার্ড, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি এবং ওপিপি। এছাড়াও তার কীর্তি সম্পর্কে আরও অনেক উদাহরণ টানা যায়। আখতার হামিদ খান পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে শুধু ব্যক্তব্য দিয়ে কিংবা লিখে থেমে থাকেননি একই সাথে তার উপায় বিশ্লেষণ করে জনমনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং কোনরূপ সংশয় ব্যতিরেকে আমরা আখতার হামিদ খানের প্রবন্ধসমূহকে সাহিত্যমান উত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের স্বীকৃতি দিতে পারি। 

রুর‌্যাল ডেভলাপমেন্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান (১৯৬৫), মিশিগান ইউনিভার্সিটি, লাহোর, করাচি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ পৃথিবীর আরও কয়েকটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি এবং প্রকাশনা সংস্থা হতে তার প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও প্রতিবেদন নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। তার অনেকগুলো প্রবন্ধ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ ক্লাশে পড়ানো হয়। তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনীও রচনা করেছেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনীটির নাম ‘টুয়েন্টি উইকস ইন আমেরিকা’। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত আমেরিকা অবস্থানকালীন দিনলিপির উপর ভিত্তি করে গ্রন্থটি রচিত। উর্দুতেও তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। এর নাম ‘সফর-ই- আমেরিকা-কি ডায়েরি’ (১৯৭২)। শুধু প্রবন্ধ কিংবা ভ্রমণ কাহিনী নয়, তিনি কবিতাও লিখেছেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে উর্দুভাষায় ‘চিরাগ আওর কানওয়াল’ শিরোনামে আখতার হামিদ খানের একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। 

বার্ড কর্তৃপক্ষ আখতার হামিদ খানের লেখাগুলোকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্যা ওয়ার্কস অব আখতার হামিদ খান’ শিরোনামে প্রকাশিত করে। পল্লী উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান’ পদকে ভূষিত হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট তিনি র‌্যামন ম্যাগসেসেই পুরষ্কার লাভ করেন। একই বছর মিশিগান ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়া তিনি মরণোত্তর ‘নিশান-ই- ইমতিয়াজ’ (২০০৪) এবং ‘জিন্নাহ এওয়ার্ড’ (২০০১) লাভ করেন। 

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিয়ানা পলিশে আখতার হামিদ খান মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র : বাংলা সাহিত্যে প্রশাসক, ড. মোহাম্মদ আমীন

বানানরঙ্গ / ড. মোহাম্মদ আমীন


বানানরঙ্গ

যিনি খেলেন তিনি ‘খেলোয়াড়’ তা হলে যিনি লিখেন তাকে ‘লেখোয়াড়’ বললে অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা আছে। এমন করলে যিনি জানেন তিনি জানোয়ার, যিনি আনেন তিনি আনোয়ার, যিনি শেখান তিনি শেখায়ার এবং যিনি পোষণ করে তিনি হয়ে যাবেন পোশোয়ার। এককালে পেশোয়ার প্রসিদ্ধ থাকলেও এখন ভয়ঙ্কর। তাই ব্যাকরণের সূত্রগুলো শুধু শিখলে হবে না, কোন সূত্র কোথায়  কীভাবে এবং কতটুক প্রয়োগ করা যাবে সেটিও ভালোভাবে রপ্ত করা আবশ্যক। নিজের ইচ্ছেমতো সূত্র মানার বিপদ নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘মেয়েদের পদবী’ শিরোনামের ছড়াটি পড়লে বিষয়টা  আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

ছোটবেলায় মাদ্রাসা বানান করতাম মাদার গাছে দোয়েলের বাসা, তারে বলে মাদ্রাসা। গোয়াল বানান আরও সহজ - গো এর নিচে আল।  আমার মেয়ের এক বান্ধবীর নাম নাওমা। মেয়েকে যখন খাওয়ার সময় বলি, প্লিজ আর একটু নাও মা। মেয়ে হাসি দিয়ে থালাটা সরিয়ে নেয়। না, আমি নাওমা নেব কেন। মা ছেলেকে দুধ দিয়ে গেছে, গরুর দুধ। আধঘণ্টা হল, এখনও রয়ে গেছে। মা চিৎকার দিল : কীরে খোকা, তোমার দুধ এখনও যে পড়ে আছে? ছেলে বলে উঠে : মা, এগুলো আমার দুধ নয়, গরুর দুধ। আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা গরুর দুধ। এখন খেয়ে নাও। ছেলে তো নাছোরবান্দা : মা, দুধ খাওয়া যায় না,পান করতে হয়।

প্রত্যেক কিছুর পরিচর্যা প্রয়োজন, পরিচর্যা ছাড়া কোন কিছু টিকতে পারে না, ভাষার ক্ষেত্রে বিষয়টি আর কঠিনভাবে সত্য। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পরিচর্যা নেই, অধিকন্তু পরিচর্যার নামে যা করা হচ্ছে তা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো বালখিল্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কিন্তু আমাদের কবিতা, উপন্যাস শতবর্ষ কেন, পঞ্চাশ নয়, দশ বছর পরেও কেউ পড়বে না।’ কারণ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন : ‘বাংলা আজকাল কেউ পড়ে না কি? সবকিছু এখন টেকনোলজি আর ইংরেজি। এ দুটো জিনিস ছাড়া আর কিছুই টিকবে না।’ কথাটা কতটুক সত্য তা একটি পরিসংখ্যান দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথ ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২৬ চৈত্র ‘বঙ্গমাতা’ কবিতাটি লিখেছিলেন। তখন বাংলাভাষী জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। এখন ১৪২১ বঙ্গাব্দ, বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৫ কোটি। জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির সর্বনিম্ন হার হিসাব করলেও ১১৯ বছরে ৫১ কোটি বাংলাভাষী হওয়া উচিত। কিন্তু পাচ্ছি মাত্র ২৫ কোটি। যা স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত সংখ্যার অর্ধেক, এটি সত্যি আশঙ্কাজনক।

বাংলা ভাষা এখন কঠিন অরাজকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূলত বানান এবং ব্যাকরণের জটিলতা- অস্থিরতার মূল কারণ। একই শব্দের বানান বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে লিখছেন। বাংলা যেন নিজের বিয়ে করা বউ। ‘বৌ’ না কি ‘বউ’ এ নিয়েও সংশয়। বৌ যদি বউ হয় তাহলে বৌ এর ঘোমটা কোথায়? ঘোমটা ছাড়া বউ কী বাঙালিরা পছন্দ করবে? কয়েকজন তো আরও বাড়া, বৌ যদি বউ হয় তাহলে চৌমাথায় চউ বসিয়ে চউমাথায় ছেলেরা দোউড়াদোউড়ি করলে আদউ কি আমরা শাসন করতে পারব? অনেক সংবাদপত্র, সাময়িকী, প্রকাশনা সংস্থা, আভিধানিক, বৈয়াকরণ, প-িত, কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছাচারী সন্ত্রাসীর মতো স্ব স্ব ভাষা রীতি প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বানান লিখে যাচ্ছে। সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়ে আচমকা চমকে উঠি। বনের পাশে বনবিভাগের একটা সাইনবোর্ড : সুন্দর বোনের অভ্যন্তরে বন্যপ্রাণী স্বীকার থেকে বিরত থাকুন। হাসতে গিয়েও হাসতে পারলাম না। ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা রাস্তার আইল্যান্ডের আগাছ পরিষ্কার করছিলেন। পাশে একটা সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা - সৌন্দর্য বর্জনের কাজ চলিতেছে। পাসপোর্ট অফিসের পাশে ছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। মন্ত্রীর একান্ত সচিব আমি। যেতে যেতে পাসপোর্ট অফিসে পাশে একটা দোকানের সাইনবোর্ডে চোখ আটকে যায় । দোকানদার লিখেছেন - এখানে পাঁচফুট বানানো হয়। তার নিচের লাইন : আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, পাঁচফুট অফিসের পাশে।

মন্ত্রী মহোদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বাংলায় সারা দেশে সর্বাধিক নম্বর পেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি হেসে একটা গল্প বললেন, আসলে গল্প নয়, সত্য কথা। তাঁর গ্রামের পাশের নদীতে মৎস্য বিভাগের একটা সাইনবোর্ড ছিল। তাতে লেখা হয়েছে : বিশ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করুণ। করুণ বিষয়, কিছু করার নয়।  একটা দোকানের বাথরুমে লেখা দেখলাম : কাষ্ট মার ছাড়া বাথরম ইউস করা যাবে না, আদেশ করমে করতিপক্ষ। চকরিয়ায় একটি যুব সংঘ তাদের অফিস ঘরের সামনের সাইনবোর্ডে লিখেছে -ছাত্রকল্যান উদ্বেগ সংঘ। পাশে একটা চায়ের দোকান, তাতে দেওয়ালে লেখা : গরু দুধ দের চা + ৮ খাব। এ তো গেল কম শিক্ষিত লোকদের কথা। ঢাকা শহরে বেশ কিছুদিন একটা পোস্টার চারিদিক ছেয়ে ফেলেছিল। তাতে লেখা : দেশরত্ন- জননেত্রী শেখ হাসিনার অতন্ত্র প্রহরী বীর মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রাম জেলার কৃতি সন্তান ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
এক কলেজের পাশে একটা ফটোস্ট্যাটের দোকান। দোকানের মুখে টেপ দিয়ে একটি কাগজ সেঁটে লেখা হয়েছে : ছাত্রছাত্রদের ফটোকপি করা হয়। হায়রে ভাষা, কোথায় ছাত্রছাত্রী আর কোথায় ছাত্রছাত্রীদের কাগজপত্র। বলেছিলাম, শধু কী ছাত্রছাত্রীদের ফটোকপি করা হয়? দোকানদার বললেন : না, সব মানুষের ফটোকপি করা হয়। তারপর দিন তিনি আগের লেখা তুলে লিখেছেন -ছাত্রছাত্রী এবং সকল মানুষের ফটোকপি এখানে বড় মেশিনে করা হয়। গাড়িতে আরও মজার জিনিস দেখা যায়। একটা গাড়ির পাশে লেখা - বিধা দেয়া বড় কষ্ঠ। চট্টগ্রামের এক গাড়ির সামনে লেখা - ছলো বন্দু গুরে আসি। সাধে উঠলে জরি মানা, ব্যবহারে ভংশের পরিচয়, রাজনিতির আলু চনা নিষেধ, নিরাপথ দুরত্ব বাজায় রাখুন - আরও কত রকমের লেখা যে পাবলিক বাসগুলোয় দেখেছি তা লিখতে গেলে পুরো একটা বই হয়ে যাবে। এগুলোতে ভুল এবং না-জেনে ভুল। এর চেয়ে মারাত্মক হচ্ছে জেনে ভুল। অনেকে ‘কাহিনী’কে লেখেন কাহিনি, কোত্থেকে এ শব্দটি পেল! পৃথিবীর আর কোথাও মাতৃভাষা নিয়ে এমন জঘন্যবৃত্তি দেখা যায় না। যার প্রতিক্রিয়া বিপদে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও সাধারণ লোকদের।

দুই ভাই একই শ্রেণিতে তবে পাশাপাশি ভিন্ন স্কুলে পড়ে। বাড়িতে শিখেছে ‘গাড়ি’। বড় ভাই তার স্কুলে ‘গাড়ি’ লিখেছে। শিক্ষকটা গাড়িটা মেরামত করে ‘গাড়ী’করে দিলেন। বড় ভাইয়ের মেজাজ খারাপ। বড় ভাইয়ের মেরামত দেখে ছোট ভাই আর ‘গাড়ি’তে নেই, সে এখন ‘গাড়ীতে’। পরদিন সে তার স্কুলে ‘গাড়ী’ লিখে। অবাক হয়ে দেখে তার ‘গাড়ী’ও শিক্ষক মেরামত করে ‘গাড়ি’ করে দিয়েছেন। দুই প্রতিষ্ঠান দুই রীতি, কী করবে ছাত্রছাত্রী! একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রধান অতিথি একজন মন্ত্রী। ব্যানারে লেখা হয়েছে : একশ ফেব্রয়ারী আন্তরজাতিক মার্তৃভাসা দিবস। আগারগাঁও পরিকল্পনা অফিসের ভেতরে নতুন মন্ত্রী সাহেব প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমের ছবি দিয়ে অনেকগুলো বিলবোর্ড লাগিয়েছেন : লেখা পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়। মূর্ধন্য-ণ উধাও। ইসরাইলের প্রতি বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন খুলনা ইমাম সংঘ। সামনে ব্যানার, তাতে লেখা :  - - - ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বিনি য়ামিন নেতা নিয়া হুর ফাঁসি চাই। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে লাশদাফন সামগ্রীর দোকানসমূহের অধিকাংশ প্রায় অভিন্ন ভাষার সাইনবোর্ড : চীর বিদায় এসটুর।

 কোনভাবে বাংলা বানানে শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথসহ অনেকে কম চেষ্টা করেননি। এখনও চেষ্টা অব্যাহত আছে। দেবপ্রসাদ ঘোষ বাংলা বানান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এ নিয়ে দেবপ্রসাদ ঘোষ ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাণান’ শিরোনামের একটি বই প্রকাশ করেন। জনৈক পাঠক বইয়ের ‘বানণ’ দেখে বলেছিলেন : ‘বানান’ বানান কেন ‘বাণান’ লিখলেন? সংস্কৃত ‘বর্ণন’ থেকে শব্দটি এসেছে। তাই ‘বাণান’। আমি ‘বাণান’ লিখব। গুরুদেব তো ‘বানান’ লিখেন। দেবপ্রসাদ ঘোষের সোজা উত্তর : গুরুদেব কী লেখেন সেটি তাঁর ইচ্ছা। তার মানে, তেনারা চেঙ্গিস, বাংলা বানানে নিজেদের ছাড়া আর কাউকে কখনও করে না কুর্নিশ। ঠিক রাজনীতিক সন্ত্রাসের মতো। যেমন দেখা যায় বিখ্যাত এক ভ্রমণ সংস্থার অফিসে :  চিরাডিপ জাবার বেবচতা আছে। যুগা যুগ করুণ। আমড়া আসি আপনার জন্য। আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন : এটা কোন ভাষা? ম্যানেজার বলেছিলেন, আমাদের কর্মচারী তা লিখেছে।

সুনীতি বাবুল লিখতেন, ‘গোরু’, কেন? তাঁর সোজা উত্তর : সংস্কৃত গো থেকে গরু। যেমন - গো + এষণা, গো + অক্ষ = গবাক্ষ। তাই তিনি গোরু লিখেন। বাংলা কি সংস্কৃত? অবশ্যই না। রবীন্দ্রনাথ ‘গো’ বানান দেখে বলেছিলেন : দেন ও-কার, অন্তত গাভির কলেবরটা তো বৃদ্ধি পেল। দেশের গাভিগুলো যেভাবে চিকন হয়ে যাচ্ছে গো। ভাষার বানান নিয়ে আমরা মতৈক্যে পৌঁছতে পারি নি। একটা ভাষার নাম যদি ভাষাভাষী দ্বারা ‘বাঙ্গালা, বাঙ্গলা, বাঙ্গ্লা, বাঙলা, বাঙ্লা, বাংলা- ছয়ভাবে লেখা হয় তা হলে ভাষাটি কত অরাজক অবস্থায় চলছে তা বলাই বাহুল্য। সে দিন আমার এক প-িত বন্ধু বললেন, ছয় পর্যন্ত উঠেছি, চব্বিশভাবে ‘বাংলা’ লেখা সম্ভব। আর বেশি দিন নেই চব্বিশে পৌঁছার। তখন দেখবে সাধের বাঙাল কীভাবে হইয়া যায় কাঙাল। বললাম, গুরুচ-াালী। রাখ তোমার গুরচ-ালী, আমরা সবাই রাজা- কোন্্ চ-ালী? রবীন্দ্রনাথাও কম করেন নি বাংলা ভাষা নিয়ে অবিচার।

বৈয়াকরণ ও কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে কোন  সমন্বয় নেই। দুই মেরুতে দুই দল। ভাষা প্রশাসনের ক্ষেত্রে বৈয়াকরণ হচ্ছে আইন প্রণেতা আর কবি-সাহিত্যিকগণ পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট। বৈয়াকরণ প্রণীত ভাষারীতি যদি কবি-সাহিত্যকগণ মান্য না-করে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানানরীতি প্রয়োগ করেন তা হলে ঐ ভাষা কোনভাবে অরাজকমুক্ত থাকতে পারে না। আমার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে খুব নামী কিন্তু সৃজনশীল নয় এমন এক লেখক-অধ্যাপককে বললাম : আপনার সাহিত্য-কর্মে প্রমিত বানান ও ব্যাকরণ রীতি অনুসরণ করা হয় না। তিনি বললেন : ব্যাকরণ মানে ব্যা-করণ। গাভির কাজ ব্যা করণ, গাভির মতো ব্যা - ব্যা করার সময় আমার নেই। ওটা তাঁরাই করুক।
কারা?
তিনি বললেন : যারা ব্যা-করণ নিয়ে আছে তাঁরা। আমি যা লিখি তা-ই পড়বে পাঠক। আমিই ব্যাকরণ, আমিই ভাষা। ব্য- ব্য করার সময় আমার  নেই।
বাংলা বানানের জটিলতা নিয়ে শুবাচ অনলাইন গ্রুপে প্রায়শ আলোচনা হয়। প্রচুর পোস্ট আসে। অনেকে বলেন, বানান সহজ করা প্রয়োজন। তা ঠিক, কিন্তু তার আগে সবার মতৈক্য প্রয়োজন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ বাংলা বানান সমিতির এত তোড়জোর শেষপর্যন্ত মতৈক্যের অভাবে কার্যকরভাবে চালু করা সম্ভব হয় নি। শুবাচের সক্রিয় সদস্য জহিরের সোজা কথা : ঐকতান যদি ঐক্যতান হয় তা হলে কেন ঐকমত ঐকমত্য হবে না? বৈশিষ্ট্য বানানে য-ফলা বাদ দেওয়া হবে না কেন? প্রশ্নের জবাবে  বিধুভূষণ বলেছিলেন:  ইংরেজরা কেন ডযড়ষবংড়সব  থেকে ড এবং চঃড়ষবসু  থেকে চ বাদ দেয় না? কেন তারা কহরভব বানানে এখনও ক রেখে দিয়েছেন? ইংরেজদের নিজের কোনও অক্ষরই নেই। রোমান অক্ষর দিয়ে লিখছেন, তাদের যদি এত ভাষা-দরদ থাকতে পারে আমাদের বাংলা ভাষার থাকবে না কেন? আমাদের অক্ষর তো ধার করা নয়, সম্পূর্ণ মৌলিক, সম্পূর্ণ নিজস্ব।

ভূরি শব্দের অর্থ অনেক, প্রচুর; যেমন আমরা বলি ভূরিভোজ, ভূরিভোজন। কিন্তু ভুঁড়ি শব্দের অর্থ মোটাপেট। কিন্তু আমরা অনেকে ভূরিভোজ করতে গিয়ে ভুড়িভোজ করে ফেলি। এটা কিন্তু বড় সমস্যার কথা। একজন একদিন লিখলেন, আদালতের জেরায় আমি কোনও কথা শিকার করিনি। ভদ্রলোক বিএ পাশ, তবে তিনি ‘শিকার’ আর ‘স্বীকার’ বানানের অর্থ জানেন না।

বাংলা বানান যে কিছুটা কঠিন তা ঠিক। তবে কঠিনত্বের কারণ যতটা না বাস্তবিক তার চেয়ে বেশি অনুশীলন ও চর্চার অভাব। কোন বাংলাভাষী ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে যে সময়, শ্রম ও নিষ্ঠা দেন তার সামান্য অংশও বাংলার জন্য দেন না। এটা বাংলা বানানের জটিলতার অন্যতম কারণ।

অনেকে ক্ষেত্রে সংস্কৃত হতে আগত বাংলা ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গগত শব্দের প্রবল অভাব অনুভূত হয়। যার স্বামী বিদেশ থাকে এককথায় তাকে বলা হয় - প্রোষিতভতৃকা। যে স্বামী পোষে তাকে বলে পোষিতভতৃকা। আগে শুধু স্বামী বিদেশ থাকত, এখন তো অনেক পুরুষ আছে যাদের স্ত্রী বিদেশ থাকে। আমাদের সোহাগীর মা তো বিদেশ থাকেন, সোহাগীর বাবা দেশে। তাহলে যার স্ত্রী বিদেশ থাকে তাকে কী বলা হবে? একজন শিক্ষক ছাত্রের এমন প্রশ্নে সঙ্কটে পড়ে যান। অজ্ঞতা প্রকাশ করা আদৌ উচিত হবে না। বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন : নারীর উল্টো পুরুষ আর পুরুষের উল্টো নারী। এখানেও তাই হবে। বুঝতে পেরেছ? জ্বি স্যার, বুঝতে পেরেছি। শিক্ষক বললেন, কী হবে তা হলে বল? ছাত্রের সোজা উত্তর ভতৃকাপ্রোষিত।
শিক্ষক হতবাক হয়ে বললেন : ঠিক বলেছ যাদু।
যাদু মানে কিন্তু ম্যাজিক নয়, যাদু আদরের ডাক, শিশুদের আদর করে যাদু ডাকা হয়। শিশুরা যখন যাদুর মতো মুগ্ধকর কাজ করে কোন গুরুজনকে সন্তুষ্ট করতে পারে তখন শিশুরা যাদু হয়ে যায়। অবশ্য শিশুদের যাদু হওয়ার জন্য কাজের চেয়ে আদরটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সতিনের কন্যা শত জাদু দেখালেও যাদু হতে পারে না।

এয়াকুব নবী তার যুবক ছেলে সাইফুলকে বললেন : বাবা গাছে কী ডাকে?
ঘুঘু
কী?
ঘুঘু
কী বললে?
কানে কী মাথা দিয়েছ? কতবার বললাম, আর বলতে পারব না, চুপ করে থাক।
এয়াকুব নবী বললেন : ঠিক এখানে, আজ থেকে বিশ বছর আগে তুমি একই প্রশ্ন করেছিলে আমাকে। আমি ত্রিশ বার উত্তর দেওয়ার পরও তুমি বলেছিল, গু ডাকে? আমি তোমার প্রশ্নে আবেগতাড়িত হয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম : যাদু আমার সব বোঝে, কত সুন্দর করে বলে। আজ তুমি দুইবারে ক্ষেপে গিয়ে একাকার।

পাঠশালার প-িত শ্রী লালমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় শিশু সুমনকে ছাত্র স্বীকার করেন না। ছাত্রীর সঙ্গে তাকে বসতে দেন। এ নিয়ে তার বাবা অভিযোগ করেন পরিচালনা কমিটিতে। ডাক পড়ে প-িতের। প-িত জানালেন, ‘সুমন’ শব্দের অর্থ ফুল। এটি স্ত্রীলিঙ্গ-জ্ঞাপক। ‘সুমনা’ শব্দের অর্থ জ্ঞানী/দেবতা; পুংলিঙ্গ-জ্ঞাপক। ছাত্র হতে হলে এবং ছাত্রদের সঙ্গে বসতে হলে তাকে সুমনা হতে হবে। সুমন থাকলে আমি তো তাকে ছাত্রীই বলব। নাম দেখেই তো আমরা শিশুদের লিঙ্গ নির্ধারণ করি। সুমনের নিচে কী তা কি আমি দেখেছি?

বাঁচার ইচ্ছা- জিজীবিষা। কঠিন বানান, হ্রস্ ই-কার দীর্ঘ ঈ-কার এর স্থানবৈপরীত্য নিয়ে গ-গোল না-হওয়াটাই অস্বাভাবিক। নবম শ্রেণির শিপন তার এক সহপাঠীকে বলল : পরীক্ষায় ‘বাঁচার ইচ্ছা’ আসবেই। বড় হিজিবিজি বানান। মনে থাকে না। একটা সূত্র যদি পেতাম। বাবা বলেছেন, মধ্যেরটা দীর্ঘ ঈ-কার। মনে থাকে না। তুমি তো বুদ্ধিমান, কোনও কৌশল জানা আছে?
সহপাঠী বলল : সূত্র তো তোমার প্রশ্নের হিজিবিজি শব্দেই আছে। হিজিবিজি মনে রাখলে জিজীবিষা মনে পড়ে যাবে। পরীক্ষায় সত্যি ‘বাঁচিবার ইচ্ছা’ এসে যায়। ছেলেটি মনের আনন্দে খাতায় লিখে ‘বাঁচিবার ইচ্ছা’-এর এককথায় প্রকাশ ‘হিজীবিষা’।
অন্যের সুখ-সমৃদ্ধি দেখে যে কাতর হয় তাকে এককথায় বলে পরশ্রীকাতর। শিক্ষক নাছিরকে ‘অন্যের সুখ-সমৃদ্ধি দেখে যে কাতর হয়’ তাকে এক কথায় কী বলে জানতে চাইলেন। গত সন্ধ্যায় পঞ্চাশ বার উচ্চারণ করেছে শব্দটি। এখন বলতে পারছে না। সনৎ স্যার বেত উঁচিয়ে এ মারল বলে। বল, অন্যের সুখ দেখে যে কাতর হয় তাকে কী বলে, আবার ধমক মারেন সনৎ স্যার। নাছির  আমতা আমতা করে বলল : স্যার বলছি, পর  . . . মানে পর পাইছি স্যার পাইছি, মানে পরস্ত্রীকাতর।
কী!
পরস্ত্রীকাতর।

বাংলা ভাষায় প্রায়  দেড় লক্ষ শব্দ (ইংরেজিতে সাড়ে চার লক্ষ শব্দ)। এই দেড় লক্ষ শব্দের যদি অর্ধেক শব্দের একাধিক বানান লেখা শুরু হয় তাহলে বাংলাকে কোনভাবে আর বাংলা বলা যাবে না। এক বিসিএস পরীক্ষার্থী লিখেছেন, ‘অতিরক্ত শ্রম দাও, সাফল্য অনিবার্য।’ ‘অতিরক্ত’ মানে তো বেশি রক্ত। বাক্যটির অর্থ হয় বেশি রক্ত শ্রম দাও, সাফল্য অনিবার্য। পরীক্ষার্থী আসলে অতিরিক্ত বলতে চাইছিল কিন্তু বানান জানেন বলে লিখে দিয়েছেন ‘অতিরিক্ত’।

নেছার সাহেব তার শুভ জন্মদিনে শালার কার্ড পেয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। দৌড়ে আসেন বউ : অন্তত আজকের দিনটা শান্ত থাক।
কীভাবে শান্ত থাকি, দেখ কী লিখেছে তোমার ভাই। ঐ দিন দৌড়ে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে অফিসের সবার সামনে আমার মাথা হেট করে দিয়েছিল। আজ আরও জঘন্য কাজ করেছে।
কী লিখেছে?
নেছার সাহেব কার্ডটি তুলে দেন বউয়ের :  দুলা ভাইয়ের শুভজন্ম দিন।
দুলাভাইকে শুভেচ্ছা দিয়েছে, সমস্যা কী?
দুলাভাইকে দেয়নি, দুলা নামের কোন ভাইকে দিয়েছে। শধু তাই নয়, কাউকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে বলা হয় ‘শুভ জন্মদিন’। কিন্তু  সে লিখেছে ‘শুভজন্ম দিন’। এর মানে জান? ‘শুভ জন্মদিন’ বাক্য জন্মদিনের শুভেচ্ছাজ্ঞাপক। কিন্তু ‘শুভজন্ম দিন’ সন্তানসম্ভবা মাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়। যেন তিনি সুন্দরভাবে সন্তান জন্ম দিতে পারেন। আমি কি সন্তানসম্ভাবা? ছি!
বউ বলল : আমার ভাই কিছু লিখলে তুমি ভুল ধরো। আমিও ভুল ধরতে পারি। ‘শুভ জন্মদিন’ শুভেচ্ছাজ্ঞাপক নয়।
তা হলে কী?
এ বাক্য দিয়ে, শুভ নামের একটা ছেলেকে জন্ম দিতে বলা হচ্ছে। শুভ জন্ম দাও।
বউয়ের সঙ্গে কেউ পারেন না, তিনিও পারলেন না। নিচে গাড়ির শব্দ, খাট নিয়ে এসেছে মনে। বারান্দা দিয়ে উঁকি দেন নেছার সাহেব। ট্রাকের গায়ে লেখা - মাহাজন সায়েব কিনচেন গাড়ী, ড্রাইভার সায়েব ছারছেন বারি।

এত ঝামেলা হতে বাঁচার জন্য সাবিনা বাংলা বানান শিখছে। দাদি বলল, এ বয়সে বাংলা বানান শিখলে পিঠা বানান কখন শিখবে? দু দিন পর বিয়ে। শশুড় বাড়ি গিয়ে করবে টা কী শুনি? পরদিন সাবিনা শিক্ষককে বলল : স্যার, আমি পিঠা বানান শিখব।
শিক্ষক বলল : প-এ  হ্রস্ব-কার ঠ-এ আকার পিঠা।
সাবিনা : এ বানান না স্যার, পিঠা কীভাবে চুলোয় দিয়ে তৈরি করা হয় তা শিখব।
শিক্ষক : এটি স্কুলে নয়, রান্না ঘরে।

গত বছরের ন্যায় এ বছরও একই কা- ঘটিয়েছে ছেলে। বাংলা ছাড়া সব বিষয়ে স্টার। বাবা রেগেমেগে বললেন : বাঙালি হয়ে তুমি বাংলায় মাত্র চল্লিশ পেলে?  ছেলের মা স্বামীকে থামিয়ে দিলে বলল : আমার ছেলের দোষ কী? অন্যান্য বিষয়ের মতো বাংলাটা ইংরেজিতে পড়ালে আমার ছেলে ঠিকই আশি পেয়ে যেত।

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান - এর রচয়িতা / ড. মোহাম্মদ আমীন

বঙ্গবন্ধু

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার,
শেখ মুজিবুর রহমান!
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়,
জয় মুজিবুর রহমান।
উপরে লেখা ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের ছড়াটির রচয়িতা অন্নদাশঙ্কর রায়  (১৯০৪-২০০২)। ছড়াটি অন্নদাশঙ্কর রায় এর বিখ্যাত ছড়াগ্রন্থ ‘শালি ধানের চিঁড়ে’ থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই কবিতাটি রচনা করা হয়েছে। 
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যভাগে কলকাতায় একটা খবর প্রচার হল,  পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হবে। সারা বিশ্বের ন্যায় প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের বুদ্ধিজীবীরাও মর্মাহত।
অবসরপ্রাপ্ত সিএসপি ও খ্যাতিমান কবি অন্নদাশঙ্কর রায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে খবরটি পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন।  তখন তাঁর বয়স সত্তর। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা গড়ের মাঠে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ডাক দেন। বক্তব্য দেওয়ার জন্য অন্নদাশঙ্কর রায়কে আমন্ত্রণ জানান হয়। সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি বাসা থেকে রওয়ান দেন। কিন্তু চারিদিকে লোকের এত প্রচণ্ড ভিড় ছিল যে তিনি সভামঞ্চে পৌঁছতে পারেননি। বাসায় ফিরে তিনি ছড়াটি লিখেছিলেন।
২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর অন্নদাশংকর রায় মৃত্যুবরণ করেন।

Saturday, 23 August 2014

‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতাটি কখন লেখা হয়েছিল / ড. মোহাম্মদ আমীন

বঙ্গবন্ধু

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার,
শেখ মুজিবুর রহমান!
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়,
জয় মুজিবুর রহমান।
উপরে লেখা ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের ছড়াটির রচয়িতা অন্নদাশঙ্কর রায়  (১৯০৪-২০০২)। ছড়াটি অন্নদাশঙ্কর রায় এর বিখ্যাত ছড়াগ্রন্থ ‘শালি ধানের চিঁড়ে’ থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই কবিতাটি রচনা করা হয়েছে। 
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যভাগে কলকাতায় একটা খবর প্রচার হল,  পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হবে। সারা বিশ্বের ন্যায় প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের বুদ্ধিজীবীরাও মর্মাহত।
অবসরপ্রাপ্ত সিএসপি ও খ্যাতিমান কবি অন্নদাশঙ্কর রায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে খবরটি পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন।  তখন তাঁর বয়স সত্তর। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা গড়ের মাঠে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ডাক দেন। বক্তব্য দেওয়ার জন্য অন্নদাশঙ্কর রায়কে আমন্ত্রণ জানান হয়। সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি বাসা থেকে রওয়ান দেন। কিন্তু চারিদিকে লোকের এত প্রচণ্ড ভিড় ছিল যে তিনি সভামঞ্চে পৌঁছতে পারেননি। বাসায় ফিরে তিনি ছড়াটি লিখেছিলেন।
২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর অন্নদাশংকর রায় মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ২০০২।  

তাঁর মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ২০০২।  

তাঁর মৃত্যু ২৮ অক্টোবর ২০০২।  

বঙ্গবন্ধু / ড. মোহাম্মদ আমীন

বঙ্গবন্ধু

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার,
শেখ মুজিবুর রহমান!
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়,
জয় মুজিবুর রহমান।
উপরে লেখা ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের ছড়াটির রচয়িতা অন্নদাশঙ্কর রায়। ছড়াটি অন্নদাশঙ্করের বিখ্যাত ছড়াগ্রন্থ ‘শালি ধানের চিঁড়ে’ থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই কবিতাটি রচনা করা হয়েছে। 
জুলাই মাসের মধ্যভাগে কলকাতায় একটা খবর প্রচার হল,  পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা
করবে। অবসরপ্রাপ্ত সিএসপি ও খ্যাতিমান কবি অন্নদাশঙ্কর রায় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে খবরটি পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন।  তখন তাঁর বয়স সত্তর। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা গড়ের মাঠে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ডাক দেন। বক্তব্য দেওয়ার জন্য অন্নদাশঙ্কর রায়কে আমন্ত্রণ জানান হয়। সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি বাসা থেকে রওয়ান দেন। কিন্তু চারিদিকে লোকের এত প্রচণ্ড ভিড় ছিল যে তিনি সভামঞ্চে পৌঁছতে পারেননি। বাসায় ফিরে তিনি ছড়াটি লিখেছিলেন।

Friday, 22 August 2014

কাকতালীয় কৌতুক / ড. মোহাম্মদ আমীন





কাকতালীয় কৌতুক

ছাত্র : কাকতালীয় মানে কী স্যার?
শিক্ষক :  কার্যকরণহীন দুটি ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া। এটি একটি বাগধারা। কাক ও তাল থেকে এটির উৎপত্তি।
ছাত্র :  কাক ও তাল কেন স্যার?
শিক্ষক :  একটি কাক তাল গাছে বসল এবং বসামাত্র টুপ করে একটা তাল মাটিতে পড়ে গেল। কাকটি না-বসলেও তালটি পড়ত, হয়তো তালটি না-পড়লেও কাকটি বসত। কাকের মতো ছোট একটা পাখির তাল গাছে বসার সঙ্গে তাল-পড়ার কোনও যোগসূত্র ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে তালের পতন ও কাকের বসা দুটো একসঙ্গে ঘটে গেল। এটাই কাকতালীয়।  এবার তুমি কাকতালীয় ঘটনার একটাএকটা উদাহরণ দাও।
 ছাত্র  : আমার বাবার বিয়ে হল, সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের বিয়েও! এমন কাকতালীয় আর দেখিনি স্যার, আপনি দেখেছেন?
শিক্ষক : দেখেছি।
ছাত্র : কোথায়?
শিক্ষক : তুমি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন পুরুষ বাবা এবং একজন মহিলা মা হয়ে গেল।


শোন নদী কোথায় / ড. মোহাম্মদ আমীন

শোন নদীর কাহিনী

‘নদী-স্বপ্ন’ বুদ্ধদেব বসুর একটি বিখ্যাত কবিতা। এ কবিতার দুটো লাইন :
“আমারে চেনো না? আমি যে কানাই, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।”
দ্বিতীয় সারিতে কবি তিনটা নদীর নাম বলেছেন। মেঘনা ও পদ্মা কোথায় তা অনেকের জানা কিন্তু ‘শোন’ নামের নদীটা কোথায় তা অনেকে জানেন না। দেখা যাক এটি কোথায় :

ভারতের মধ্যপ্রদেশের অনুপপুর জেলার অমরকন্টক একটি  প্রাচীন শহর। এখানে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। অমরকণ্টকের আরেক নাম তীর্থরাজ। এখানে পর্বত বিন্ধ্য ও পর্বত সাতপুরা বিখ্যাত মৈকাল পর্বতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মহাকবি

শোন নদীর উৎসস্থল

কালিদাসের রচনায় অমরকন্টককে "অমরকূট" বা যে পাহাড়ের শৃঙ্গের বিনাশ হয় না কিংবা "আম্রকূট" বা যে পাহাড়ের চূড়া আমগাছের প্রাচুর্য্যে সমৃদ্ধ- বলা হয়েছে। এ অমরকন্টকের মৈকাল পর্বত  ‘নর্মদা’ এবং ‘শোন’ নদীর উৎপত্তি স্থল। নর্মদা নদীকে বলা হয় মৈকালকন্যা। শোন নদীর আর এক নাম শোনমুডা। ছোটবেলা থেকে যে মান্ধাতার কথা আমরা শুনে আসছি সে পৌরাণিক সূর্যবংশীয় রাজা মান্ধাতা আনুমানিক ৬০০০ বছর পূর্বে অমরকন্টকের নিকটবর্তী ঋক পর্বতের গায়ে রাজত্ব করতেন। কথিত হয়, মান্ধাতার পুত্র পুরুক্তসার-এর রাণী নদী নর্মদার নামকরণ করেছিলেন ।

শোনমুডা বা শোন নদীর উৎসমুখকে অমরকন্টকের স্বর্গ বলা হয়। ব্রহ্মার বরপুত্র শোন একটি অসাধারণ নদ। প্রকৃতির অনবদ্য বৈচিত্রের নিরূপম খেয়াল এর অন্যতম আকর্ষণ। অমরকণ্টক শহরের পাশে অবস্থিত একটি হনুমান মন্দিরের গায়ে শোনমুডা বা শোন নদীর উৎপত্তিস্থল। এখান থেকে অতি শীর্ণকায় শোন পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা এগিয়ে তারপর   প্রেসিপিসের ওপর দিয়ে পাহাড় থেকে লাফ মেরে নীচের উপত্যকায় জলপ্রপাত হয়ে উত্তাল গতিতে বের হয়ে উত্তর দিকে সুদূর গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বেরিয়ে গেছে।

নর্মদা ও শোন এর উৎপত্তিস্থল এবং জলপ্রবাহ এত নিকটে যে, দুটি প্রবাহ স্বাভাবিকভবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবার কথা। কিন্তু এখানে প্রকৃতি দুটি জলপ্রবাহকে দুটি ভিন্নপথে ভিন্ন নামে প্রবলবেগে নিজ নিজ পথে সব স্বকীয়তা বজায় রেখে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সৃষ্টি হতে আপন লক্ষ্যে।  নর্মদা আরব সাগরের দিকে আর শোন উত্তরদিকে গঙ্গার মধ্যে দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত। এত নিকটে তবু কারও সঙ্গে কারও যোগ নেই। প্রকৃতির এ ভৌগোলিক খেয়ালকে পুরাণে এক  বেদনাদায়ক কাহিনীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হযেছে। পুরাণে বলা হয়েছে, নর্মদার সঙ্গে শোনের বিবাহ নাকি কোনও কারণে ভেঙে যায়। তাই আযুগ ধরে নর্মদা ও শোন একে অপর থেকে এভাবে মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে ।