Translate

Sunday, 24 August 2014

আখতার হামিদ খান সিএসপি / ড. মোহাম্মদ আমীন

আখতার হামিদ খান (১৯১৪-১৯৯৯)

আইসিএস অফিসার আখতার হামিদ খান ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জুলাই ভারতের আগ্রায় এক সম্ভান্ত ও শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সারা বিশ্বে কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিত বার্ড তথা বাংলাদেশে একাডেমি ফর রুরাল ডেভলাপমেন্ট এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত। তিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর আইসিএস ক্যাডারের সদস্য হিসেবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে সহকারী কমিশনার পদে যোগদান করেন। শিক্ষানবীশ আইসিএস অফিসার হিসেবে তিনি লন্ডনের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য ও ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে পূর্ববঙ্গে পদায়ন করা হয়। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি পূর্ববঙ্গে অতিবাহিত করেন। পদায়নের প্রারম্ভ থেকে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করতে সক্ষম হন। সরকারি কর্মচারী হলেও তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। তিনি কর্মস্থলের মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ দ্বারা তাড়িত হতেন। সাধারণ জনগণের উপর কোন নির্যাতন, বৈষম্য, অবহেলা সহজে মেনে নিতে পারতেন না। পাকিস্তানের অধিবাসী হয়েও বাংলাদেশেল মানুষের প্রতি ব্রিটিশ শাসকবর্গের অবহেলা, বৈষম্য ও নির্যাতন তাকে ব্যথিত রাখত। 

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মহা মন্বন্তরের সময় ব্রিটিশ শাসকদের উদাসীনতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ তাকে প্রচ-ভাবে মর্মাহত করে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার ক্ষুদ্র ক্ষমতায় শাসকগোষ্ঠীর অবহেলায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে শত শত মানুষের মৃত্যু ও যাতনা সহ্য করতে না পেরে নৃশংস বৈষম্যের প্রতিবাদস্বরূপ চাকরি পরিত্যাগ করে আলীগড় চলে যান। আলীগড় শহরের নিকটবর্তী একটি গ্রামে তিনি ছদ্মবেশে শ্রমিক ও তালাওয়ালা হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। লেভ টলস্টয়ের অনুসরণে আখতার হামিদ খানের এ ব্যতিক্রমী জীবনকর্মমূলক পর্যবেক্ষণ দুই বছর স্থায়ী হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লির জামেয়া মিলিয়াতে তিন বছর শিক্ষকতা করেন। ভারত বিভাগের পর তিনি করাচিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন পর করাচি থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যক্ষের চাকরি নিয়ে পূর্বপাকিস্তান গমন করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

কুমিল্লায় অবস্থান আখতার হামিদ খানের জীবনের একটি অবিস্মরণীয় মাইল ফলক। এখানে থাকাকালীন তিনি কুমিল্লার প্রত্যন্ত গ্রামসমূহ ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেন। এখানে তিনি বাংলা ভাষা, বাঙ্গালি ও বাংলার মানুষের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা এবং মনোভাব সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান অর্জন করেন। গ্রামীণ বাংলার তৃণমুল হতে আহরিত জ্ঞান আখতার হামিদ খানের চেতনায় নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার মনে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বিপ্লবী ধারণার উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পল্লী উন্নয়ন সম্পর্কে অধিকতর ধারণা লাভের জন্য আখতার হামিদ খান মিশিগান ইউনিভার্সিটি যান। এক বছর পর সেখান থেকে কুমিল্লা ফিরে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুর‌্যাল ডেভলাপমেন্ট’ সংক্ষেপে বার্ড (ইঅজউ) প্রতিষ্ঠা করেন।
বার্ড শুধু কোন একাডেমি নয়। এটি আখতার হামিদ খানের স্বপ্নমন্দ্রিত বৈপ্লবিক প্রেরণার একটি অনন্য শৈলীসজ্জা। অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন, উৎপাদন, সমতা, ঐক্য, শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সবুজাভ শ্যামলিমা, জীবনবোধ, মানবতাবোধ প্রভৃতিসহ মানব জীবনের প্রত্যেকটি প্রত্যয়ের পরিচ্ছন্ন বিকাশে আইসিএস অফিসার আখতার হামিদ খানের বার্ড একটি মনলোভা বিন্যাসের প্রমুগ্ধ ইতিহাস। বার্ড ধারণা আখতার হামিদ খানকে সারা বিশ্বে উৎপাদনশৈলীর অনিবার্য কিংবদন্তিতে পরিণত করে। একই সাথে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও উজ্জ্বল হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমে লায়ালপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৭২ থেক ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আখতার হামিদ খান ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে যোগদান করে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮-১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিশিগান ইউনিভার্সিটি ছাড়াও তিনি সুইডেনের লুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উড্র উইলসন স্কুল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, হার্ভাড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আখতার হামিদ খান করাচিতে ওরাঙ্গি পাইলট প্রজেক্ট (ওপিপি) প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানের ইতিহাসে আর একটি সমন্বিত সবুজ বিপ্লবের অনবদ্য কিংবদন্তির জন্ম দেন। বর্তমানে ওপিপি এশিয়ার বৃহত্তম ‘এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’ হিসেবে খ্যাত।

আখতার হামিদ খান শুধু আইসিএস অফিসার কিংবা বার্ড মডেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। একাধারে তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী, হৃদয়াকর্ষক প্রাবন্ধিক, যৌক্তিক বিশ্লেষক এবং দুরদর্শী প্রতিবেদক। তিনি শুধু প্রবন্ধ রচনা করেননি, কবিতা ও ভ্রমণ কাহিনীও রচনা করেছেন। তার প্রবন্ধগুলো গল্প-কবিতার চেয়েও অনেক আকর্ষিক ছিল। বাগ্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সহজে মানুষকে আকৃষ্ট করার অদ্ভুদ ক্ষমতা ছিল তার মজ্জাগত। 

ইংরেজি, বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন ভাষায় তার অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন, সমাজ সচেতনতা, সাধারণ মানুষের মানসিক চেতনার সাথে সম্মিলিত প্রয়াস ও উৎপাদনের সম্পর্ক তার প্রবন্ধের মূল উপজীব্য। আখতার হামিদ খানের অধিকাংশ লেখা পল্লীউন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও বিষয়বস্তু, পরিবেশনার ধরণ, বিশ্লেষণ, যুক্তি, ভাষার গাঁথুনি প্রভৃতি বিবেচনায় অনেকগুলো লেখা সাহিত্যমান উত্তীর্ণ হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

সাহিত্য কর্মের উদ্দেশ্য মানব কল্যাণ। তিনি প্রবন্ধে যুক্তি, বিশ্লেষণ, তথ্য, উপাত্ত আর পরিবেশনার কারুকার্যতার মাধ্যমে তার প্রাবন্ধিক চেতনাকে সাধারণ্যে বাহিত করে সমন্বিত উদ্যোগ এবং তদমাধ্যমে স্বীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রয়াস চালান। প্রাবন্ধিকের এ প্রয়াস যখন সফল হয় তখনই প্রবন্ধ অন্তর্নিহিত সফলতার মৌলিক আনন্দে বিদূষিত হয়। প্রবন্ধের এ শর্তটি পর্যালোচনা করলে নিঃসন্দেহে আখতার হামিদ খানের প্রতিটি প্রবন্ধ সার্থক। এ সার্থকতা বার্ড, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি এবং ওপিপি। এছাড়াও তার কীর্তি সম্পর্কে আরও অনেক উদাহরণ টানা যায়। আখতার হামিদ খান পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে শুধু ব্যক্তব্য দিয়ে কিংবা লিখে থেমে থাকেননি একই সাথে তার উপায় বিশ্লেষণ করে জনমনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। সুতরাং কোনরূপ সংশয় ব্যতিরেকে আমরা আখতার হামিদ খানের প্রবন্ধসমূহকে সাহিত্যমান উত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের স্বীকৃতি দিতে পারি। 

রুর‌্যাল ডেভলাপমেন্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান (১৯৬৫), মিশিগান ইউনিভার্সিটি, লাহোর, করাচি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ পৃথিবীর আরও কয়েকটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি এবং প্রকাশনা সংস্থা হতে তার প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও প্রতিবেদন নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। তার অনেকগুলো প্রবন্ধ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ ক্লাশে পড়ানো হয়। তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনীও রচনা করেছেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনীটির নাম ‘টুয়েন্টি উইকস ইন আমেরিকা’। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত আমেরিকা অবস্থানকালীন দিনলিপির উপর ভিত্তি করে গ্রন্থটি রচিত। উর্দুতেও তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। এর নাম ‘সফর-ই- আমেরিকা-কি ডায়েরি’ (১৯৭২)। শুধু প্রবন্ধ কিংবা ভ্রমণ কাহিনী নয়, তিনি কবিতাও লিখেছেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে উর্দুভাষায় ‘চিরাগ আওর কানওয়াল’ শিরোনামে আখতার হামিদ খানের একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। 

বার্ড কর্তৃপক্ষ আখতার হামিদ খানের লেখাগুলোকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্যা ওয়ার্কস অব আখতার হামিদ খান’ শিরোনামে প্রকাশিত করে। পল্লী উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান’ পদকে ভূষিত হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট তিনি র‌্যামন ম্যাগসেসেই পুরষ্কার লাভ করেন। একই বছর মিশিগান ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়া তিনি মরণোত্তর ‘নিশান-ই- ইমতিয়াজ’ (২০০৪) এবং ‘জিন্নাহ এওয়ার্ড’ (২০০১) লাভ করেন। 

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিয়ানা পলিশে আখতার হামিদ খান মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র : বাংলা সাহিত্যে প্রশাসক, ড. মোহাম্মদ আমীন

No comments:

Post a Comment