Translate

Friday, 1 August 2014

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম : অনাবিল কবির নিপাট মাধুরিমা / ড. মোহাম্মদ আমীন

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম : অনাবিল কবির নিপাট মাধুরিমা

কবি, গীতিকার, সুরকার ও প্রাবন্ধিক ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাগেরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর হাতেখড়ি। তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এইচএসসি ও ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ডিগ্রি পাশ করেন। অতঃপর সহকারী কমিশনার পদে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস
প্রশাসনের সদস্য হিসেবে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন।  ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদসহ তিনটি সংস্থায় সংস্থাপ্রধান হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। সরকারি গুরু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধনায় নিবেদিত। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ১১টি। নিজের লেখা গানের সিডি প্রকাশিত হয়েছে ১০টি। তার অধিকাংশ গানে তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন।
বাগেরহাট মানে বাগানের হাট, আবার অনেকে বলেন বাঘের হাট। প্রবাদ যেটাই সত্য হোক না কেন, বাগ ও বাঘের সম্পর্ক নিবিড় ও গভীর। শ্যামল-ঘন-ছায়ে নিবিড় বনই জঙ্গল এবং এটাই তৎকালীন প্রাকৃতিক বাগান। এমন বাগানই তো বাঘের অনুকূল। এমন নিবিড় সবুজের গভীর ছায়ে কবি ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের বেড়ে ওঠা। বাগেরহাট এখনও অনবদ্য সবুজে মোহময়। বাগানের মনোরম কলহাস্যে প্রথম বসতকাল থেকে এ অঞ্চলটি নুপূর-মগ্ন ছিল - এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাগেরহাটের স্নিগ্ধ পরিবেশের মোহনীয় ছটায় শিশুবেলা থেকে স্নাত কবি ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম। তাই তাঁর কবিতায়, কথায়, লেখা আর অবয়বের বর্তিকায় তা আপ্লুত সৌকর্যে প্রেম-জীবন-অবসান-অবদান আর কুহেলী প্রমুগ্ধতার নিকষ আলেখ্যে ভেসে উঠেছে :
ঘনায় আঁধার দিনের বেলা বাতাসে বাদল নেশা
অরণ্যজুড়ে মধুমর্মর কে বোঝে যে তার ভাষা।।  [কুহেলিকা, সমিল শব্দের তীর]।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম এখন সরকারের সচিব। পরিকল্পনা বিভাগের মতো বিরাট ও স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত। তবে এটি তাঁর গৌণ পরিচয়, প্রকৃত পরিচয় - তিনি বাঙ্‌ময় শব্দবাগে হৃদয়কাড়া কাব্যসমুদ্রে বিলীন আলুথালু বিদিশায় স্বপ্নজয়ী এক চিরন্তন প্রকৃতি। যা ষড়ঋতুর লীলায়
উল্লাস-বিলাস উদ্যান, মগ্নতার কুহরে শৃঙ্গার অনির্বাণ; এখানে সুখ আছে ললাটে, দুঃখও লেফটে পরম মমতায়, নিবিড় ভরসায়। তাঁর পুরো সত্তা প্রকৃতির রহস্যময় বৈচিত্র্যে আবর্তিত স্বপ্ন-কাকণ অভিলাষ। তাই তো তাঁর কণ্ঠে পুরো বিশ্বপ্রকৃতি আনত হয়ে উঠে প্রসূন সুবাসে হাওয়ার দোলায়:
গভীর আধাঁরে হারিয়ে গিয়েছে দিক
এত আলো জ্বলে ছায়াপথে তবু
আঁধার কি মৌলিক? [ অমৃত সূর্য জ্বালো, সমিল শব্দের তীর]

কে দেবে কবিকে এমন প্রশ্নের উত্তর? তবে তিনি প্রশ্নের জন্য অপেক্ষায় সময় ক্ষেপণ করার পাত্র নন। উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন আরও  বেশ জরুরি, তিনি জানেন প্রশ্নই উত্তরের জন্মদাতা, উত্তর প্রশ্নের জন্মদাতা নয়। তাই এ শুধু প্রশ্ন নয় জীবনবোধে উদ্দীপ্ত অসীম এক কাব্যময় সাগরের মহানিনাদ, রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়তায় নজরুলের উল্লাস। রবিঠাকুরই জবাব দিয়েছেন কবির প্রশ্নের :
অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে
অচেনাকে চিনে চিনে ওঠবে জীবন ভরে।

এজন্য কবি আরও উদ্বেল, আরও সাবলীল, আরও উচ্ছ্বল প্রাণময়। হাসিতে তাঁর ছটা, ক্ষোভে দ্বেষ নয়, দেশ- স্নেহ আর মাতৃময়তার বারতা। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর প্রকৃতিপ্রমুগ্ধ মন কাব্যলক্ষীর ঝংকারে বিহ্বল ছিল কিন্তু আবেশ কখনও মাত্রাহীন প্রফুল্লতায় উপছে পড়ে নি। অনেক কবি উচ্ছ্বাসে-আবেগে খেই হারিয়ে ফেলেন। কবিতা তখন অনেকটা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে। না, ভুঁইয়া সফিকুল ইসলাম আবেগে কাঁপলেও খেই হারিয়ে ফেলেন না। তাঁর শেখড় কাব্যদেবীর সৃজনশীল পলির অনেক অনেক গভীরে। তিনি সঞ্চয় করেছেন প্রকৃতির রূপ, অর্জন করেছেন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, গান, সুর, ছন্দ আর দাবাদহের চীৎকার। এভাবে তিনি তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলেছেন কাব্যালয়ের শোভা হয়ে প্রীতিম কমলের বিশাল হিমালয়ে।

ছাত্রজীবন থেকে তাঁর মনে কাব্যভাব ও  লেখনী বিচরণ করেছে। দুএকটা বের হয়ে এলেও নিজের খাতায়
আঁকিবুঁকিতে লেফটে ছিল মায়ের স্নেহমধুর চুম্বনরসের মতো নিদাঘ গরিমায়। প্রকাশ করেন নি। তাঁর প্রথম কাব্য হৃদয়ে প্যালেস্টাইন। পঞ্চাশটি কবিতার এক অনিমেষ সমন্বয় এটি। এ কাব্যটির প্রতিটি পঙ্‌ক্তির প্রতিটি শব্দ যেন রক্তপ্রেমে আকড়-নিগড়ে আগ্নেয়গিরির মতো মহাত্রাসে ফুঁসে উঠা লাভা। এ লাভার তেজ পৃথিবীকে যেন গিলে খাবে - তবু দেশপ্রেমে মগ্ন কবির কত মমতা বাক্যে বাক্যে অনুরণন ব্যাকুলতায় উর্মী হয়ে উঠে :
‘আমি শহিদ প্যালেস্টাইনির রক্তে ওজু করে
সিনাই পাহাড়ে উঠে দাঁড়াব সটান
আর দিগন্ত কাঁপিয়ে দেব ভিন্নস্বরে অন্য এক সাহসী আজান। [ হৃদয়ে প্যালেস্টাইন]

এখানে কবির আজান প্রচলিত কোন আজানকে যেন না বোঝায় সে বিষয়টি সচেতনভাবে বলে দিয়েছেন - ভিন্নস্বরে অন্য এক সাহসী আজান’। এটি কেমন আজান? এ আজান সর্বজনীন মানবতায় উদ্বেল এক অসাম্প্রদায়িক জগতের হাতছানি। এখানে অগ্রযাত্রার ঝংকার আছে কিন্তু লেশমাত্র উগ্রতা নেই। এ আজান সে আজান, যা ধর্মোন্মাদ সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠীর নৃশংস থাবা থেকে মানুষের কমনীয় প্রীতির সুকুমার বৈশাল্য রক্ষায় উজ্জীবিত করবে সবাইকে। তিনি ধর্মের নামে অত্যাচার চান না, চান না রক্ত, হানাহানি, ভেদাভেদ। এ ধর্ম সব কষ্ট আর বৈষম্যের সূতিকাগার. হাহাকারের বন্যা। কবির ভাষায় :
ঐ হাত নিঃস্ব গোধূলির
দিগন্তে দিগন্তে বোনে বন্ধ্যা বীজ
গহন আঁধার
আর লুট করে কৃষকের ধান-দুর্বা-দুধভাত
গোধন সম্পদ। [ঐ হাত, ও কলম, হৃদয়ে প্যালেস্টাইন]

২০০৩ খ্রিস্টাব্দ হতে এ পর্যন্ত ভূঁইয়া শফিকুল ইসলামের লেখা কাব্য সংখ্যা দশ। বলা যায়, দশমণি; প্রতিটি কাব্য যেন এক একটা মণিসমগ্র। নামগুলোও কাব্যময় ছান্দিকতায় পতপত হাতছানি, শুনলে পড়তে ইচ্ছে করে - মন বিভোর হয়ে ওঠে ষোড়শী রমণীর কল্পেচ্ছায়। কাব্যগুলো হচ্ছে : হৃদয়ে প্যালেস্টাইন (২০০৩), বিপন্ন অর্জুন (২০০৭), নির্বাচিত কবিতা [ইংরেজিতে অনূদিত (২২০৯)], নীলপদ্ম ও পাথরের কবিতা (২০১০), বাণী বনের ফুলদল (২০১১), ওই রেখা তুমিই পেরোবে (২০১১), নন্দনবনবাণী (২০১২), উদ্যানর আড়াল থেকে (২০১২), তবু আছে তারা ও জোনাকি (২০১৩) ও ডুবেছে অমৃত সূর্য (২০১৪) প্রভৃতি।

কবিতায় তিনি জীবনের জয়গানে মরণের প্রাণ। লুকোচুরি অভিাসারে সতত মহীয়াণ। দুটোর সহবতে তাঁর কাব্য লাস্যময় চিরন্তনতায় অক্ষয় অক্ষরের বাগবাজার হয়ে উঠে রঙের মতো লালিত্যে, প্রেমের মতো সাহিত্যে, বিরহের মতো প্রার্থনায় আর সংশয়ের মতো মোহনীয় নরকের বিমর্ষ যন্ত্রণায়।
দেখ না কি জীবন-ফুলে আমার বাসর বাঁধা
হৃদয়পুস্প হাতে ধরে অপেক্ষা আর কাঁদা
কেমনে বাঁধব বাসর তোমার
আয়ুর ফুল ফুরালে।। [ প্রেম কাতরতা, সমিল শব্দের তীর, ভূইয়া শফিকুল ইসলাম]

প্রকৃতি, জীবন, প্রেম, মানুষ, উদার গ্রহণময় বিবেক ও শ্বাশত বিশ্বের প্রতীক কবি ভূইয়া শফিকুল ইসলামের কাব্যচর্চার অন্যতম বিষয় প্রেম ও দ্রোহ। তবে তার প্রেম-দ্রোহ সাধারণ বোধে-ভাবে সীমাবদ্ধ কোন জৈবিক লীলা শুধু নয়। তার প্রেম প্রকৃতির অসীমতায় নিপাট, যা দ্রোহে ছড়িয়ে অকুণ্ঠ সাহসের বিরামহীন চলন- শুরু আছে শেষ নেই।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম কবিতা রচনার পাশাপাশি অনেকগুলো গানও চয়ন করেছেন। গানেও তাঁর কাব্যময় পরেশের টুকরো স্মৃতি উল্কার আকস্মিকতায় আকাশকেও হারিয়ে দেয়। গীতিকার নয়,
গানগুলোর সুরকারও তিনি। সুর ও বাণীর মুগ্ধতায় তার গানগুলো অপূর্ব  দ্যোতনায় মুর্ছনা আনে মনে। এ যেন বহুদূও থেকে নেমে আসা সন্ধ্যার অনেকক্ষণ আগে মিঠেকড়া রোদে জেগে থাকা রূপোলি বিকেল। নিঃসঙ্গতার অপেক্ষায় উপেক্ষার যন্ত্রণাও মাঝে মাঝে চয়ন করেন কবি দুঃখবিলাসের পরিশোধনে :
বন্ধু আমি চাই না ভ্রমণ মোহন পেলব পথ
কী লাভ চড়ে দেশে দেশে এমন শোভন রথ [বৃথা ভ্রমণ, সামিল শব্দের তীর]।

ভূঁইয়া শফিকুল ইসলামের কবিতা ও গানকে যেভাবে বিবেচনা করা হোক না কেন, নিঃসন্দেহে তিনি অনবদ্য মগ্নতায় আপ্লুত বিবরে সদাজাগ্রত সৃষ্টির ন্যায় একজন সার্থক কবি।  তাঁর কবিতায় দিব্যমন্দ্রিতায় বর্ষা, ফুলেল হাস্যে বসন্ত, কনকনে লুকোচুরির কুয়াশায় বিকট শীতে হাহাকার তপ্ততা  - কী নেই এখানে? চৈতালীর উদম স্নানে তাঁর কবিতা যখন হেসে উঠে, অদ্ভুত মাদকতায় ভরে ওঠে মন :
আমার সাগর বিশ্বলোকের গুপ্ত চেতনায়
আমার সাগর টানছে আমায় অসীম যাতনায়। [ প্রেমই গতি, সমিল শব্দের তীর]

অনেকে বলেন, আধুনিক কবিতা পড়তে কষ্ট হয়, বুঝতেও। কিন্তু ভূইয়া সফিকুল ইসলামের কবিতা  যেন ঝরঝরে বকুল, অহর্নিশ বিলকুল। প্রতিটি লাইন নিজেই অর্থ হয়ে পাঠক আর স্রোতাকে বলে দেয় :
আমি তো সেই শুদ্ধ কারিগর
দুঃখ ছেনে ইট বানিয়ে
বাঁধি সুখের ঘর। [ সার্থক মৃৎকুঞ্জ]

তাঁর কবিতা নিকষ ছন্দের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, পরিপাট্য আদরে বিমোহিত ভূষণ এখানে আনন্দ আছে, চঞ্চলতাও প্রচুর; তবে রবীন্দ্রকাব্যের মতো ভাবের গভীরতায় নিঝুম এক দূরদর্শীতা হৃদয়মন আর দেহবল্লরীকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য শীতের খেজুর গাছের রসের ন্যায় যেভাবে উন্মুখ হয়ে থাকে তা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে খুব কম কবিদের কবিতায় দেখা যায়।
আমি চলতে চাই না পথে
ঊরফ যেমন অচল-অবশ নিঃস্বর পর্বতে। [ রুদ্র, সমিল শব্দের তীর]

কবি ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের চেতনা যেমন অসাম্প্রদায়িক তেমনি সাহসী অভিযাত্রার সতসিদ্ধ অনুভব। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে সংকীর্ণতা বোধে তিনি সাংঘাতিক ব্যথিত। কবির ভাষায় : ‘ধর্মান্ধের দুর্ভাগ্য হচ্ছে ওরা মানুষের ধর্ম কী তা জানে না। যা ধর্ম নয় তাকে ওরা ধর্ম বলে।’ [ চিরঞ্জীব রবীন্দ্রনাথ, বাংলা একাডেমি বক্তৃতা]। যে ধর্ম নিজেকে ছাড়া অন্যকে অবহেলা করে, বাতিল করে, নিজের ধর্ম স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অন্যের ওপর অত্যাচার চালায় তিনি তেমন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে নিছক সংকীর্ণ স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে ধাবিত এক আদিম উপায় মনে করেন। তিনি সব ধর্মের সহবস্থান ও সহমর্মী দর্শনে বিশ্বাসী।
স্বর্গ হতে আসে মানুষ স্বর্গেরই শিশু
আল্লার সন্তান সবাই ভাই রাম রহিম যিশু।

সত্যস্বরূপ, ভাইয়ের রক্ত ধর্ম নয়, নাস্তিকেরও প্রয়োজন আছে, ধর্ম নিয়ে বড়াই কেন, ধর্মীয় বিবাদ, যুক্তিবিমুখতার কুফল, র্ধমের নামে মিথ্যাচার, রাজাকার, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, সংখ্যালঘুর নির্মম নিয়তি, সংখ্যালঘুর কান্না, ধর্ম বিপন্ন, নির্বোধ আস্ফালন, হামবড়া ইমানদারদের প্রতি, গোঁড়ামির হাতে বিপন্ন বাংলাদেশ, দ্বিমুখী শিক্ষার অভিশাপ, সত্য ছাড়া মুক্তি নেই, রামায়ণ, দূর হোক রক্তোৎসব প্রভৃতি এবং হৃদয়ে প্যালেস্টইন কাব্যসহ বিভিন্ন কাব্যের কবিতায় কবির প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচিন্তা বাস্তবতার আলোকে প্রতিফলিত হয়েছে।

‘রবীন্দ্রনাথ : আশ্রয়ের ছায়াতল’ ভূইয়া সফিকুল ইসলামের লেখা একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মসহ সামগ্রিক বিশ্বকবির জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। প্রাবন্ধিক ভূঁইয়া
সফিকুল ইসলাম এখানে রবীন্দ্রনাথকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনা কীভাবে এবং কেন কালজয়ী স্তরে সমগ্র বিশ্বে স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছে তা অকাট্য যুক্তিসহকারে বিধৃত করেছেন। তাঁরমতে,  রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, বিশ্বসাহিত্যের নিরিখেও কালজয়ী কবি।
‘রবীন্দ্রনাথ মানব সমাজের এক মহান শিক্ষক। মানুষের শুভ প্রেরণার উৎস। মানুষের সর্বংকটে শান্তির এক ছায়াশ্রয়।’

অনেক বাঙালির রবীন্দ্র বিদ্বেষ রয়েছে। লেখক এ বিদ্বেষকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বিদ্বেষপ্রসূত উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথকে জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য প্রশান্তময় অভিধার অনিবার্য আশ্রয় হিসেবে তুলে ধরেছেন। যুক্তিবাদী মানুষ, যাঁরা মিথাশ্রয়ী শাস্ত্রীয় ধর্ম আশ্রয় খুঁজে পান না তাঁদেরও আশ্রয় হতে পারে রবীন্দ্রনাথ। এটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য শাস্ত্রীয় ধর্ম কেন যুক্তিবাদীদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, তাও এ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতের মাধুরীতে বাঙালি জীবন মোহিত, প্লাবিত। মানুষের মহান আবেগকে জাগত কওে এ সংগীত। কত বিচিত্র মাত্রা যে এর! মহাজাগতিক চেতনাও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে। প্রবন্ধসমূহের বিধৃত এ সকল যৌক্তিক বর্ণনা পাঠককে  মহাজগৎ সম্পর্কে নতুন ধারণার মগ্ন করে দেবে। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ  স্রষ্টার কাছে মানুষের আত্মনিবেদনের এক ভাব-রসময় মাধ্যম। যে সকল রবীন্দ্রসংগীতে বিশ্ববিধাতার কাছে মানব মনের চিরন্তন আর্তি প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলোর সরস আলোচনা স্রষ্টার পরশপিয়াসী মানুষকে মুগ্ধ করবে। বিশ্ববিশ্রুত অস্তিত্ববাদী ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সাত্রের নৈতিক দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নৈতিক আদর্শের তুলনামূলক আলোচনা প্রবন্ধ গ্রন্থটিকে সত্যিকার অর্থে অসাধারণ করে তোলেছে।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম বিশ্বপ্রকৃতি ও বিশ্ব মানবের সঙ্গে একাত্ম, যার মধ্যে জাগতিক পরিস্ফুটনের যোজনযোজন দূরত্বেও কামখেলীর মধুর পরশে গভীর স্পন্দন অনুভূত হয়। ফলে তাঁর প্রতিটি কবিতা, প্রতিটি গান, প্রতিটি লাইন আনন্দের অন্তরঙ্গ পরশের নিবিড় কামরসের গভীর আত্মীয়তায় বাঙ্ময় করে সত্তাকে সর্বজনীন সৌন্দর্যে সৃষ্টি অভিমুখে নিয়ে যায়।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের কবিতা অভূতপূর্ব ঐশ্বরিক সংগীতের সদৃশ। এখানে মানবজীবনের বাস্তবতা ও প্রাকৃতিক প্রসারতার সকল অনুভব পুরোপুরি বিদ্যমান। তাই তাঁর কবিতাকে পূর্ণ কবির সার্থক সৃষ্টি বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। তাঁর প্রত্যেকটা কবিতার প্রতিটা লাইন এত মোহনীয় এবং এত সহজ-সরল স্বাভাবিকতায় ভরপুর যে, পাঠকমাত্রই রস আস্বাদন করতে সক্ষম। কবি প্রকৃতির সঙ্গে মিশে প্রকৃতিকে কবিতার ছত্রে ছত্রে পরম আদরে তুলে ধরেছেন বলেই তাঁর কবিতা এত প্রাঞ্জল, এত সর্বজনীন। মূলত মানুষের কল্যাণের জন্যই তাঁর প্রতিটি কবিতার প্রতিটি বাক্য নিবেদিত। এর বাইরে কিছু নেই:
এ আঙুলে আমি রোপন করেছি
মাটিতে সবুজ চারা
আমারই মনের সৃজনের রসে
নেমেছে বৃষ্টিধারা
আমি মাটির গ্রহের মাধুরী বাড়াই
আকাশ তাই প্রসন্ন।। [ ধন্য জীবন]

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখি একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে কবি, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার ভূইয়া সফিকুল ইসলামের চারটি নতুন অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূইঞা, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. রণজিত্ কুমার বিশ্বাস, এনডিসি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আলোচনা ও মোড়ক উন্মোচন শেষে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়
পর্বে ভূইয়া সফিকুল ইসলামের কথা ও সুরে ‘সময় এসেছে সত্য বলার’ এবং ‘ওরা ধর্মের কথা বলে’—গানের কথায় সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী আরিফ, বাসুর সুরে ‘অটল চালক চালাও’ ও ‘নামো সন্ধ্যা ধীরে’— সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী সুমনা বর্মণ, শেখ সাদী খানের সুরে ‘বাল্মীকি তুমি জানতে’ ও ‘হে মহামানব’— সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী তিমির নন্দী, ভূইয়া সফিকুল ইসলামের সুরে ‘বেলা পড়ে আসে রে ভাই’ ও ‘তোমার প্রেমে কাতর আমি’— সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী অনিমা মুক্তি গোমেজ, সঞ্জয় রায়ের সুরে ‘ওগো কিন্নরকণ্ঠী পরান হরা’ ও ‘স্বপ্নে তুমি’—সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী সঞ্জয় রায়, সুনীল চন্দ্র দাসের সুরে ‘আমি পড়েছি কঠিন আঁধারে’ ও ‘কার নূপুরে’—সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী ফেরদৌস আরা এবং সবশেষে ভূইয়া সফিকুল ইসলামের সুরে ‘দয়াল আল্লারে’ ও ‘আল্লাহ আল্লাহ জিকিরের চেয়ে নাই’—সংগীত দুটি পরিবেশন করেন শিল্পী আবু বকর সিদ্দিক। গানগুলোর কথা কথা লিখেছেন ভূইয়া সফিকুল ইসলাম।

কবিতা, সংগীত ও প্রবন্ধের পাশাপাশি বর্তমানে তিনি উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনী লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, অধ্যাত্ম চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা, সময় ও স্বদেশ ভাবনা, প্রেম ও মরমীবাদ তার সাহিত্যকর্মের মূল বিষবস্তু হলেও আধুনিক কবিতার সকল উপাদান, প্রাচীন যুগের কবিতার সকল রস, সারল্যের সকল সহজবোধ্যতা ও মধ্যযুগের সকল ছান্দিক বিমূর্ততায় কবি ভূইয়া সফিকুল ইসলামের কবিতা নান্দনিক প্রহরের অনবদ্য ভূষণ। তাই তিনি আমাদের কাব্যজগতের নতুন ধারার স্রষ্টা; কাব্যস্নিগ্ধে ফুটে ওঠা এক নিপাট মুগ্ধতা।

আধুনিক কবিতার সকল উপাদান, প্রাচীন যুগের কবিতার সকল রস, সারল্যের সকল সহজবোধ্যতা ও মধ্যযুগের সকল ছান্দিক বিমূর্ততায় কবি ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের কবিতা নান্দনিক প্রহরের বিধু-বিধু ভূষণ। তাই তিনি আমাদের কাব্যজগতের নতুন ধারার স্রষ্টা; কাব্যস্নিগ্ধে ফুটে ওঠা এক নিপাট মুগ্ধতা 

যিনি বাক্যেবাক্যে শব্দবাগে জীবনের কথা মর্মর বাস্তবতায় চিত্রের মতো আকর্ষণীয় প্রমুগ্ধতায় তুলে ধরতে সক্ষম তিনি কবি; কিন্তু যাঁর এ উপস্থাপন শুধু চিত্র বা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ না- থেকে কাব্যপ্রেয়সীর কিসমিস অধরে ছন্দের কুহুর-কোড়কে সঙ্গীতের লালায় অপরূপ ঝঙ্কার তুলতে পারেন তিনি কালজয়ী কবি, বিমোহিত স্রষ্টার প্রমোহিত প্রতিদ্বন্দ্বী।  যাঁর  কাব্যে জীবন ও প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ এবং মৃত্যু ও বন্দনার সর্বজনীন সুরের প্রাঞ্জল বীণা ধ্বনিত হয় চকিত বিচ্ছুরণে লীলায় লালীয় বিনোদহাস্যে তিনি কবিরও অধিক; এককথায় ত্রিকালদর্শী ঋষি। কবি ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের কবিতায় এখানে বর্ণিত সকল গুণ বিদ্যমান। নিঃসন্দেহে তিনি কালজয়ী কবি ও ত্রিকালদর্শী ঋষি।

তিনি জীবনকে দেখেছেন, প্রকৃতিকে বুঝেছেন, নিজেকে জানার চেষ্টায় মগ্ন থেকে মগ্নতর হতে হতে আত্মপ্রশ্নে বিলীন হয়ে গেছেন। তাই তিনি এখন আর শুধু কবি নন, কাব্যস্নিগ্ধে নিপাট মুগ্ধতার বিস্ময়কর রূপ। তার নিজস্ব কোন অস্তিত্ব এখন আর নেই, তিনি না ভূঁইাঁ সফিকুল ইসলাম, না সচিব, না কবি  - তিনি কবিতা; বস্তুত সবগুলো সত্তার বিমোহিত সঙ্গমের শৃঙ্গার শীৎকারে জন্ম থেকে বেড়ে উঠা ত্রিকালদর্শী বিশ্ব, তাতে মিশে যাওয়া অবিনশ্বর নিঃস্ব :
যদিও না পাই
ক্ষতি কিছু নাই
হব ধুলি ছাই
তবু তারই নেশায় মন ঢাকা।
তাই তিনি আমাদের কাব্যজগতের নতুন ধারার স্রষ্টা; কাব্যস্নিগ্ধে ফুটে ওঠা এক নিপাট মুগ্ধতা। তার কাব্য আসক্তির অনাসক্ত ভূবনের তিলোত্তম দর্শন ও অবিচলিত যাত্রার হৃর্দিক আবেশ। তাঁর কবিতা পাপ-পূণ্যের বন্ধন পরিহার করে সদা জাগ্রত আলেরার দিশারী হয়ে উঠেছে। এ সদাজাগ্রত কবি ও কবিতা উভয়ে কালের স্রোতে অনাবিল থাকবে অনাদিকাল।

No comments:

Post a Comment