চিরঞ্জীব রবীন্দ্রনাথ/ ভূইয়া সফিকুল ইসলাম
বাংলা একাডেমি আয়োজিত রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবসের অনুষ্ঠানে ভূইয়া সফিকুল ইসলাম |
সবিত্রী পৃথিবী এই, আত্মার এ মর্ত্যনিকেতন
আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলোকে সমীরণে
ভূমিতলে সমুদ্রপর্বতে
কী গুঢ় সংকল্প বহি করিতেছে সূর্য প্রদক্ষিণ
সে রহস্যসূত্র গাঁথা এসেছিল আশি বর্ষ আগে
চলে যাব কয় বর্ষ পরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্মদিনে)
এ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলেন, বোশেখ মাসে, মংপুতে। মৃত্যুর আভাস জীবনে দেখা দিলেও আরো কটি বছর বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল এ কবিতায়। কিন্তু তা আর হলো না। মাস তিনেকের ব্যবধানে, শ্রাবণে এই দিনে, এই ২২ শে শ্রাবণে, কবি চলে গেলেন। কিন্তু কবি যা রেখে গেলেন শিল্পের বিচিত্র পথে, মৃত্যু তাকে বশ করতে পারেনি। পারেনি বলে মৃত্যুর ৭৩ বছর পর, তাঁর অমৃত আত্মার জন্য প্রেম ও পূজার অর্ঘ্য দিতে আমরা এসেছি। বলতে এসেছি, ‘তুমি আমাদের অস্তিত্বের অংশ। এ ভাবেই থাকবে চিরকাল। আমাদের সুখে-দুঃখে, বিরহ-প্রেমে, আনন্দে-শোকে, সংকটে-সংগ্রামে; আমাদের গণজমায়েতে, যুদ্ধে, অভিসারে, বাসর ঘরে, পূজার মন্দিরে , সর্বদা, সর্বত্র।’
চলে যাব কয় বর্ষ পরে। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্মদিনে)
এ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে লিখেছিলেন, বোশেখ মাসে, মংপুতে। মৃত্যুর আভাস জীবনে দেখা দিলেও আরো কটি বছর বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল এ কবিতায়। কিন্তু তা আর হলো না। মাস তিনেকের ব্যবধানে, শ্রাবণে এই দিনে, এই ২২ শে শ্রাবণে, কবি চলে গেলেন। কিন্তু কবি যা রেখে গেলেন শিল্পের বিচিত্র পথে, মৃত্যু তাকে বশ করতে পারেনি। পারেনি বলে মৃত্যুর ৭৩ বছর পর, তাঁর অমৃত আত্মার জন্য প্রেম ও পূজার অর্ঘ্য দিতে আমরা এসেছি। বলতে এসেছি, ‘তুমি আমাদের অস্তিত্বের অংশ। এ ভাবেই থাকবে চিরকাল। আমাদের সুখে-দুঃখে, বিরহ-প্রেমে, আনন্দে-শোকে, সংকটে-সংগ্রামে; আমাদের গণজমায়েতে, যুদ্ধে, অভিসারে, বাসর ঘরে, পূজার মন্দিরে , সর্বদা, সর্বত্র।’
কেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিত্তজুড়ে নিজের অক্ষয় আসন বিছাতে সক্ষম হলেন? এটা কি তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বলে? উত্তর না। এ কথা সত্য পৃথিবীর প্রথম অশ্বেতাঙ্গ সাহিত্যিক হিসেবে শতাধিক বছর আগে তাঁর এই নোবেল জয় বাঙালির জন্য একটি বড় শ্লাঘার বিষয়। সুইডিশ একাডেমি এই অপরিচিত অশ্বেতাঙ্গকে প্রথমে নোবেল পুরস্কারের জন্য আমলেই আনেনি। তালিকায় ছিল টমাস হার্ডি, আনাতোল ফ্রাঁস, পিয়ের লোতি, এমিল ফাগের মতো প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত মুখ। মোট ২৮ জনের তালিকায় আমাদের কবির মতো অপরিচিত মুখ আর ছিল না। তাই প্রথমে তাঁকে আমলে না-নেওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমলে নিতে হলো যখন কমিটির মধ্য থেকেই কবি-সমালোচক হ্যালস্ট্রম আমাদের কবি সম্পর্কে মন্তব্য করলেন,
Ò It
is certain however that no poet in Europe since the death of Goethe in 1832 can
rival Tagore in noble humanity, in unaffected greatness, in classical tranquility” এবং এর পরপরই সে সময়ের প্রভাবশালী সুইডিশ কবি কার্ল হেইডেনস্ট্যাম যখন গীতাঞ্জলি পড়ে বললেন, Ò I was deeply moved when I read them...it was like drinking the water of
a fresh, clear spring.” কিন্তু শুধু নোবেল পুরস্কার জয় করে কোনো সাহিত্যিক একটি জাতির হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকতে পারেন না। ১৯১৩ এর আগে-পরে কত জাতির কত সাহিত্যিকই এ পুরস্কার পেয়েছেন, ক’ জনকে তাঁদের জাতি মনে রেখেছে? ক’ জনের জন্ম-মৃত্যু দিবস জাতির জীবনকে উদ্বেল করে? জাতির স্মৃতি-সত্তায়, মননে-জীবনে, স্থায়ী আসন গড়তেই বা পেরেছেন ক’ জন ? বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ অনন্য। এ ভাগ্য সবার হয় না। তাঁকে ছাড়া বাঙালির নববর্ষ হয় না, বর্ষা-বসন্ত, শরৎ-হেমন্তের পার্বণ জমে না। বাঙালির প্রেম, পূজা, দ্রোহ, সংগ্রাম কিছুই হয় না। তিনি আমাদের ‘সখে ব সখা’, পথের সাথী - সর্ব তৃষ্ণায় শান্তি। দুঃখে তিনি আসেন আমাদের দুঃখ ঘোচাতে, শোকে আসেন অশ্রু মোছাতে, প্রেমে আসেন মধু জোগাতে। তিনি আমাদের মধ্যে মঙ্গল-চিন্তা বপন করেন, সত্য ও সুন্দর চেনান, তিনি আমাদের অমৃতের দিশা দেন। সর্বকালের মনীষীদের মহৎ শিক্ষার নির্যাস খুঁজে পাই তাঁর মধ্যে। তিনি শাাস্ত্রের ঘেরাটোপ এবং শাস্ত্রপাণ্ডাদের নিষ্ঠুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন। আমাদের যুক্তিবাদী মন যখন বন্দি বিহঙ্গের মতো শাস্ত্রের সংকীর্ণ খাঁচায় ছটফট করে, তখন খাঁচার অর্গল খুলে তিনি দেখান আমাদের এক সর্বজনীন আধ্যাত্মিক আকাশ। যে ব্যথা আমার মাঝে গুমরে ফিরে, কিন্তু বাণীরূপ দিতে পারি না প্রকাশের দীনতায়, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমার সেই ব্যথাটিই আশ্চর্য বাণীরূপ লাভ করে আমাকে শিহরিত করে। তাঁর কবিতা-গান শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবি, এ তো আমারই কথা। আমি তাঁর মাঝে আমাকে খুঁজে পাই। সাহানা দেবী যেমন বলেছেন, “অমি তো গেয়েছি আমার নিজের গান, তবে সে সব লিখেছেন বটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
এই হলো সেই গোপন রহস্য যার জন্য রবীন্দ্রনাথ একান্ত আমার, আমাদের। এই বিস্ময়পুরুষকে বাঙলি এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় খুঁজে পায় না। তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা পরিশেষে তাঁর গান গেয়েই আড্ডা শেষ করে। যাঁদের কর্মকা- তিনি সমর্থন করেননি সেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা তাঁর সৃষ্টি ভা-ার থেকে লাভ করতেন বিপ্লবের প্রেরণা। নির্জনবাসে, কারাগারে, জীবন দেওয়া-নেওয়ার দুরূহ বিপ্লবী পথে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গানই ছিল তাঁদের অভয়মন্ত্র। নিশ্চিত ফাঁসির সম্ভাবনা নিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাই বিপ্লবী উল্লাসকর গেয়ে ওঠেন -‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এদেশে’। আর ওই যে কারণে নোবেল কমিটির কঠিন মনের বরফ গলেছিল সে দিনের অপরিচিত রবীন্দ্রনাথের পক্ষে, ‘ গ্যেটের মৃত্যুর পর, সেই ১৮৩২ সালের পর থেকে এমন উদার মহান প্রশান্ত কবিচিত্ত ইউরোপ আর দেখেনি। তাঁর কবিতা যেন পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছঝর্ণাধারার জলপানের আনন্দ’ - সে কারণে তিনি বাঙলির বাইরেও, বিশ্বমানবচিত্তে প্রশান্তিদাতা এক মহামানব হয়েই রয়েছেন। রণাঙ্গনে আসন্ন মৃতু্যূর ছায়াতলে দাঁড়িয়ে তাই ইংরেজ কবি উইলফ্রেড আওয়েন রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সান্ত¦না খুঁজে পান। নোবেল পুরস্কার পাবার পর থেকে পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনুদিত হয়েছেন। পৃথিবীব্যপী অসংখ্য সাহিত্যিক, সাহিত্যপ্রেমিক, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করেছেন।
বিধাতার সৃষ্ট এই অদ্বিতীয় প্রতিভাটির এক বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল। তিনি অনায়াাসে নিজের প্রাণের মধ্যে অন্যের প্রাণের মধ্যে এবং প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারতেন। এজন্য তাঁর এ সাফল্য। নিজের এবং অন্যের প্রাণের মধ্যে প্রবেশের কথা সাহানা দেবীর কথাতেই মেলে, রবীন্দ্রনাথও তা বলে গেছেন এভাবে, ‘অন্যের ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা - ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিলতকলা’। তবে প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে তাঁর প্রবেশ ক্ষমতা দেখলে আরো বিস্মিত হতে হয়। সে আশ্চর্য বিস্ময় লক্ষ করা যায় এ ধরনের গানগুলোতে : ‘শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে’, ‘বলি ও আমার গোলাপবালা’, ‘এসো হে বৈশাখ’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ ইত্যাদি গানে। তাঁর কবিতায়, ছোট গল্পে এবং সাহিত্যের অন্যান্য ধারায়ও তা লক্ষনীয়।
রবীন্দ্রনাথ কেন চিরঞ্জীব, কেন তাঁকে ছাড়া ছাড়া আমাদের চলে না, তার কারণ অনেক।
একটি প্রধান কারণ তিনি আনন্দের কবি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছি, ধন্য আমাদের মানবজীবন লাভ।’ এই তমোহর আনন্দের উচ্চারণ তাঁরই:
মোরা আনন্দমাঝে মন আজি করিব সমর্পণ
জয় জয় আনন্দময়।
সকল দৃশ্যে সকল বিশ্বে আনন্দনিকেতন।
জয় জয় আনন্দময়।
আনন্দ চিত্ত-মাঝে আনন্দ সর্বকাজে
আনন্দ সর্বকালে দুঃখে বিপদজালে,
আনন্দ সর্বলোকে মৃত্যুবিরহে শোকে-
জয় জয় আনন্দময় ॥
দুঃখ জয়ের কবিও তিনি। তিনি আমাদের শেখান, ‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে/ বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দাহন করে মারতে হবে’। সোজা কথা। সেরা কথা। অনিবার্য দুঃখ জয়ের জন্য এর চেয়ে সেরা কথা, সোজা কথা আর নেই।
আবার বলেন, ‘আমার আধাঁর ভালো, আলোর কাছে বিকিয়ে দেবে আপনাকে সে।’ এই আঁধার না থাকলে আলো কেনা যায় না, আনন্দও কেনা যায় না। তা হলে দুঃখের চেয়ে সেরা পুঁজি আর কী আছে ? রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন দুঃখের চেয়ে সেরা ধন নেই। যার দুঃখধন নেই, তার মতো হতভাগ্য নেই। দুঃখ শুধু জাগতিক আনন্দকেই অর্থবহ করে না, দুঃখ ছাড়া ঈশ্বরের পরশ পাওয়া যায় না। মৃত্যঞ্জয়ী তাপসকে অশ্রু-উৎস-জ্বলে স্নান করতে হয়। কবি বলেন:
দু:খের বর্ষায় চক্ষের জল যেই নামল
বক্ষের দরজার বন্ধুর রথ সেই থামল ॥
মিলনের পাত্রটি পূর্ণ যে বিচ্ছেদ-বেদনায়
অর্পিনু হাতে তার খেদ নাই আর মোর খেদ নাই ॥
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, যে হৃদয়কে ঈশ্বর ফলবান করতে চান, তাকে তিনি দু:খের হল দ্বারা কর্ষণ করেন, সুতরাং দুঃখকে ভয় করতে নেই। হলধররূপী ঈশ্বরকে ভয় পেলে চলবে না। আমাদের বলতে হবে :
দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে
যেখানে ব্যথা সেখানে তোমায় নিবিড় করে ধরিব হে ॥
গাইতে হবে, ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক/ তবে তাই হোক।’
প্রকৃতপক্ষে দু:খের ধন ছাড়া মানুষের নৈবদ্যের আর কিছু নেই। এ ধন যে একান্ত ব্যক্তি মানুষের - একান্ত আমার। রবীন্দ্রনাথের এ শিক্ষার সাথে পারস্য মনীষী মাওলানা জালালউদ্দীন রুমির শিক্ষার মিল রয়েছে।
ভয় ও অসহায়ত্ববোধ আমদের আত্মবিকাশের পথে এক অন্তর্গত বাধা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভয় জয়ের মন্ত্র শিখিয়েছেন। তিনি আমাদের অমৃতধামের বাসিন্দা করেছেন, যেখানে ভয় বলে কিছু নেই :
‘কী ভয় অমৃতধামে, তুমি মহারাজা - ভয় যায় তব নামে।’
এ জগতে এ সমাজে বিপদের জাল পাতা রয়েছে। বিপদ কখনো দৈবসৃষ্ট কখনো সংসার থেকে সমাগত। কখনো আবার আপনার বিপদ আপনি ডেকে আনি আমরা। তখন বিপদজয়ের জন্য এ গান আমাদের আত্মশক্তির অমর মন্ত্র জোগায়:
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা -
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের আত্ম-উপলব্ধির মন্ত্র শেখান। এ মন্ত্র অন্তর দিয়ে গ্রহণ করলে মানুষ তার পতন ঠেকাতে পারে:
তুমি যতো ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়াছ সোজা।
আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা।
এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও
ভারের বেগেতে চলেছি কোথায়, এ যাত্রা তুমি থামাও ॥
¯্রষ্টা আমাদের যে দুঃখ দেন সে তাঁর দুঃখের দান। এ দান শ্রাবণ ধারার মতো, যা ফুলে ফসলে আমাদের জীবনকে সার্থক করে তোলে। কিন্তু নিজে যে দুঃখ ডেকে আনি মোহের বশ হয়ে, সে দুঃখের পরিণতি ভয়াবহ। সে দুঃখ আমাদের জীবনকে বজ্রসম অঙ্গার করে রেখে যায়।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের মধ্যে সুন্দর ও পূর্ণতার পথের চির-পথিককে জাগিয়ে তোলেন। তিনি বলেন, ‘পশুর আছে বাসা - মানুষের আছে পথ’। তিনি শিখান:
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
এই জানারই সাথে সাথে তোমায় চেনা।
ভালোবাসা মরজগতের মহান এক বৃত্তি। কিন্তু ভালোবাসার ভাষা আমরা ভালো করে প্রকাশ করতে পারি না রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। মরমে প্রকাশের বেদনা এলেও মুখে আসে না। মুখে এলেও তা হয় শ্রীবর্জিত - সে ভাষায় প্রাণের কথা সার্থকভাবে ফোটে না। প্রিয়ার কাছে প্রাণের অস্ফুট চাওয়াটি কীভাবে চাইতে হবে তা যথাসাধ্য আমাদের কানে কানে শিখিয়ে দিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। তখন তাঁর ভাষার মধ্যে দেখি আমাদেরই মনের কথা। আর বিলম্ব না করে, গেয়ে উঠি: “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে”। এ তো এক ধরনের প্রেম প্রকাশের কথা হলো, প্রেমের মর্মভেদী সব ধরনের কথা অপূর্ব সুর-বাণীতে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গানে, কবিতায়। ভালোবাসার বিচিত্র আবেগ যাদুকরি প্রাঞ্জলতায় প্রাণ পেয়েছে তাতে। কটি গান আর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ! প্রেমের ক্ষেত্রে দ্বিধার অবকাশ থাকে। দ্বিধাদীর্ণ হৃদয়ের জলার্দ্র প্রকাশ ঘটেছে এ গানে :
“মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে আজি এ ভরা সাঁঝে,
যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখখানি -
কী কথা ছিল যে মনে ॥
তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে -
আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি,
তুমি আছ দূর ভুবনে ॥
... ... ...
বারেক তোমায় শুধাবারে চাই বিদায় কালে কী বলো নাই,
সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যুথীর গন্ধবেদনে ॥
এই দ্বিধার ব্যথায় আকাশের বকপাঁতি আমাদের বেদনার সাথি হয়ে যায়:
আকাশে উড়িছে বকপাঁতি/ বেদনা আমার তারি সাথি।
প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেম ও আদর্শের দ্বন্দ্বও আমাদের জীবনে আসে। প্রেমের অরূপ অভিকর্ষে প্রেমাস্পদকে বরণেচ্ছায় হৃদয় অস্থির হয়ে ওঠে। কখনো কখনো কোনো আদর্শিক বাধায় প্রিয়াবরণ হয়ে ওঠে না, দুঃসহ কষ্ট বুকে চেপে ফিরিয়ে দিতে হয় তাকে। ক্ষমা করার ইচ্ছাকে আদর্শের ভারী আঙুল দিয়ে গলা টিপে হত্যা করতে হয়। এ-যে কী তীব্র জ্বালা! বজ্রসেনীয় আর্তনাদে সে জ্বালা মর্ম ফুঁড়ে বের হয় :
ক্ষমিতে পারিলাম না যে
ক্ষমো হে মোর দীনতা পাপীজন শরণ প্রভু।
মরিছে তাপে, মরিছে লাজে প্রেমের বলহীনতা-
পাপীজন শরণ প্রভু।
প্রিয়ারে নিতে পারি নি বুকে, প্রেমেরে আমি হেনেছি
পাপীরে দিতে শাস্তি শুধু পাপেরে ডেকে এনেছি।
যে শ্যামা রাজভবনের সমাদর-সম্মান ছেড়ে বজ্রসেনের সঙ্গে পালিয়ে এল, বজ্রসেনের জীবন বাঁচাল - সেই শ্যামার দুর্গতি, আর আদর্শের অভিঘাতে প্রেমকে ফিরিয়ে দেওয়া বজ্রসেনের দুর্গতি আজীবন আমাদের কাঁদাবে। এ ট্র্যাজেডি শাশ্বত মানুষের ।
আবার মানুষের মধ্যে এক অস্থির ভোগবাদী মন রয়েছে। কখনো ললিতলোভন নারীর রূপে তা চঞ্চল হয়ে ওঠে, আবার কখনো, এক সময় যাকে কুরূপা মনে করে, তার মধ্যে সুধার সন্ধান করে। আজ যাকে কুরূপা মনে করে দূরে ঠেলছে, কাল তাকে অনন্যাজ্ঞানে কোলে টানছে, আবার আজকের সুরূপাকে কাল করছে উপেক্ষিতা - হ্যাঁ, এসব মানুষই করছে। প্রেমের ক্ষেত্রে, ভোগের ক্ষেত্রে এ দ্বন্দ্বধারা মানব রক্তেই প্রবাহিত। আর এ কারণেই ‘চিত্রাঙ্গদা’ এক শাশ্বত জীবননাট্য হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথকে কী করে ভুলবে মানুষ!
এই জগতে এসে জীবনকে এত ভালবাসি বলে মৃত্যুকে আমরা ভয় পাই। মৃত্যু জীবনের বর্ণিল দীপশিখাটি নিভিয়ে দেয়। এত যত্নে লালিত এত প্রিয় দেহটি ধুলায় বা আগুনে নিক্ষেপ করে। অস্তিত্ব-মুছে-ফেলা এই মৃত্যুর চেয়ে মর্মান্তিক কষ্টের আর কী আছে ! রবীন্দ্রনাথ আমাদের মৃত্যুভয় হরণের মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন:
কেন রে এ দুয়ারটুকু পার হতে সংশয় ?
জয় অজানার জয়।
এই দিকে তোর ভরসা যত ওই দিকে তোর ভয়।
জয় অজানার হয়।
মরণকে তুই পর করেছিস ভাই
জীবন যে তোর তুচ্ছ হল তাই।
দু দিন দিয়ে ঘেরা ঘরে তাইতে যদি এতই ধরে
চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?
কবিগুরুর এ গান শুনে মনে হয়, তাই তো চিরদিনের আবাসখানা শূন্য হতে যাবে কেন? দুদিনের পার্থিব আবাসটির আকর্ষণ এত তীব্র হলে চিরদিনের অপার্থিব আবাসটি আকর্ষণহীন হবে কেন?
কবি যখন বলেন: ‘মরণকে তুই পর করেছিস ভাই/জীবন যে তোর তুচ্ছ হল তাই’, তখন মনে হয় মরণ তো আমার পর কেউ নয়, বরং জীবনের পরিণতিদাতা। মরণ মহান সারথি হয়ে এই মরজগতের খিড়কি দুয়ার পার করিয়ে আমাদের মহাজীবনে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় পরিতুষ্ট চিত্তে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা যায়। জীবনের শেষ সন্ধ্যায় রাবীন্দ্রিক ভাষা দিয়েই মৃত্যুকে বরণ করার ইচ্ছা হয়: ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছ/ তোমায় করি গো নমস্কার।’ গাইতে ইচ্ছা হয় :
অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে
অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে ॥
জানি জানি আমার চেনা কোনো কালে ফুরাবে না’
চিহ্নহারা পথে আমায় টানবে অচিন ডোরে ॥
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শোকে, স্বজন ও সম্পদ বিনাশে সান্ত¦না দেন। তিনি আমাদের মাঝে চিরঞ্জীব হবেন না কেন? এই পৃথিবীতে এসে আমরা পরম স্বজনকে হারাই, একে একে চলে যান মাতা-পিতা, আপনজন। সম্পদও হারাই নিজের ভুলে, ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে, কখনো বা দৈব দোষে । রবীন্দ্রনাথের এই গানকে সম্বল করে তখন আমরা উঠে দাঁড়াই :
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।
কণাটুকু যদি হারায় তা হলে প্রাণ করে ‘হায় হায়’ ॥
নদীজলসম কেবল বৃথাই প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই,
একে একে তীরে আঘাত করিয়া ঢেউগুলি কোথা ধায় ॥
যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে সব যদি দেই সপিয়া তোমাকে
তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহামহিমায়।
আমাদের যা কিছু গেছে, আর যা কিছু আছে সব যদি তাঁর পায়ে সঁপে দিয়ে নির্ভর হওয়া যায়, তখন আর দুঃখ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বুঝিয়ে বলেছেন :
মরণ রে তোর নয় রে চিরন্তন-
দুয়ার তাহার পেরিয়ে যাবি ছিঁড়বে রে বন্ধন।
এ বেলা তোর যদি ঝড়ে পূজার কুসুম ঝরে পড়ে
যাবার বেলা ভরবে থালায় মালা ও চন্দন।
মানুষের চারদিকে সীমার শৃঙ্খল। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সীমার বাঁধনকাটা বন্ধু। তিনি আমাদের অসীমে আহ্বান করেন। যেখানে বিরহ-বিচ্ছেদ-মৃত্যু বলে কিছু নেই:
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই -
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই ॥
আর আপেক্ষিক অর্থে যদি মৃত্যু থাকেও তাতে কি আসে যায় ? কারণ:
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
এই সান্ত¦না, এই আশ্বাস কে কবে কাকে দিতে পেরেছে ? ধর্ম লোভ দেখায় আর ভয় দেখায়। এতে সান্ত¦না পাই না, আশ্বাসও পাই না, সন্ধান পাই না অমৃতসূর্যের, বরং নিজেকে বড় ছোট মনে হয়। আমি তো অমৃতপুত্র।আপন তাগিদে অমৃত-উৎস খুঁজি। ওই উৎসে আমার পূর্ণতা। তা হলে ভয় আর লোভ দেখানো কেন?
রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনেক অসামান্য প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েনে যা তাঁর প্রিয় বৈদিক ঋষিদের প্রার্থনাও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বৈদিক ঋষি বলেন :
অসতো মা সদ্গময় /তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যার্মামৃতং গময়/অবিরাবীর্ম এধি।
অর্থ : অসত্য হতে আমাকে সত্যে নাও, অন্ধকার হতে নাও আলোকে। মৃত্যু হতে নাও অমৃতলোকে।
রবীন্দ্রনাথ বললেন:
প্রাণ ভারিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি আরো আরো আরো দাও তান ॥
আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ, মোরে করো ত্রাণ ॥
আরো প্রেমে আরো প্রেমে
অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে ॥
জানি জানি আমার চেনা কোনো কালে ফুরাবে না’
চিহ্নহারা পথে আমায় টানবে অচিন ডোরে ॥
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শোকে, স্বজন ও সম্পদ বিনাশে সান্ত¦না দেন। তিনি আমাদের মাঝে চিরঞ্জীব হবেন না কেন? এই পৃথিবীতে এসে আমরা পরম স্বজনকে হারাই, একে একে চলে যান মাতা-পিতা, আপনজন। সম্পদও হারাই নিজের ভুলে, ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে, কখনো বা দৈব দোষে । রবীন্দ্রনাথের এই গানকে সম্বল করে তখন আমরা উঠে দাঁড়াই :
অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়।
কণাটুকু যদি হারায় তা হলে প্রাণ করে ‘হায় হায়’ ॥
নদীজলসম কেবল বৃথাই প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই,
একে একে তীরে আঘাত করিয়া ঢেউগুলি কোথা ধায় ॥
যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে সব যদি দেই সপিয়া তোমাকে
তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহামহিমায়।
আমাদের যা কিছু গেছে, আর যা কিছু আছে সব যদি তাঁর পায়ে সঁপে দিয়ে নির্ভর হওয়া যায়, তখন আর দুঃখ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বুঝিয়ে বলেছেন :
মরণ রে তোর নয় রে চিরন্তন-
দুয়ার তাহার পেরিয়ে যাবি ছিঁড়বে রে বন্ধন।
এ বেলা তোর যদি ঝড়ে পূজার কুসুম ঝরে পড়ে
যাবার বেলা ভরবে থালায় মালা ও চন্দন।
মানুষের চারদিকে সীমার শৃঙ্খল। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সীমার বাঁধনকাটা বন্ধু। তিনি আমাদের অসীমে আহ্বান করেন। যেখানে বিরহ-বিচ্ছেদ-মৃত্যু বলে কিছু নেই:
তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যত দূরে আমি ধাই -
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই ॥
আর আপেক্ষিক অর্থে যদি মৃত্যু থাকেও তাতে কি আসে যায় ? কারণ:
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
এই সান্ত¦না, এই আশ্বাস কে কবে কাকে দিতে পেরেছে ? ধর্ম লোভ দেখায় আর ভয় দেখায়। এতে সান্ত¦না পাই না, আশ্বাসও পাই না, সন্ধান পাই না অমৃতসূর্যের, বরং নিজেকে বড় ছোট মনে হয়। আমি তো অমৃতপুত্র।আপন তাগিদে অমৃত-উৎস খুঁজি। ওই উৎসে আমার পূর্ণতা। তা হলে ভয় আর লোভ দেখানো কেন?
রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনেক অসামান্য প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েনে যা তাঁর প্রিয় বৈদিক ঋষিদের প্রার্থনাও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বৈদিক ঋষি বলেন :
অসতো মা সদ্গময় /তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যার্মামৃতং গময়/অবিরাবীর্ম এধি।
অর্থ : অসত্য হতে আমাকে সত্যে নাও, অন্ধকার হতে নাও আলোকে। মৃত্যু হতে নাও অমৃতলোকে।
রবীন্দ্রনাথ বললেন:
প্রাণ ভারিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।
সুরে সুরে বাঁশি পুরে
তুমি আরো আরো আরো দাও তান ॥
আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ, মোরে করো ত্রাণ ॥
আরো প্রেমে আরো প্রেমে
মোর আমি ডুবে যাক নেমে।
সুধাধারে আপনারে
তুমি আরো আরো আরো করো দান ॥
তাঁর প্রার্থনা আর্য ঋষির সত্য, আলো, অমৃতকে তো বরণ করলই অধিকন্তু তিনি চেয়ে বসলেন মানুষকে মানুষ করার আরো তিন মহামানবীয় উপাদান - প্রাণ, প্রেম আর বেদনা। সুখের পূজারি মানুষগুলো ভারি সীমিত অর্থে প্রেম চায়, বেদনা চায় না কোনো অর্থেই। কিন্তু মানুষের যদি বেদনার অভাব থাকে তাহলে সত্য, আলো, অমৃত, প্রেম কিছুই তার নাগালে আসে না। বেদনাকে বরণ করতে প্রবল প্রাণের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই ‘আরও প্রাণের’ প্রার্থনাও করেছেন।
এই প্রার্থনায় প্রেম, প্রাণ, আলো, অমৃত, বেদনা ছাড়াও আরও একটি অনির্বাণ বস্তুর প্রার্থনা এসে গেছে- যার নাম ‘সুর’। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সুরের এক অপার ভুবনের সন্ধান দেন।
রবীন্দ্রনাথ আজীবনই সুরের কাঙাল ছিলেন। বলেছেন:
তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে
দেবে কি গো বাসা আমায় তারি ধারে?
.....................
আমার নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে
ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে।
আশ্চর্য সরল কাঙালপনা! জগতের যে উৎস হতে সুরের ঝরনাধারা বের হচ্ছে তার পাশে একটু বাসা। যশ, ধন, মান বা অন্য কোনো লাভের আশায় নয়, প্রকৃতির রৌদ্র-ছায়ায় নিভৃতে ফুলের মধ্যে যেমন মধু সঞ্চিত হয়, তেমনি যদি সুরের ধারার পাশে একটু বাসা পাওয়া যায় তবে কবির নীরব বেলাটি সুরের মধুতে ভরে যাবে। কবির কাছে মুক্তি লাভের এক আশ্চর্য পাথেয় সুর। এটাই তাঁর শেষ পারানির কড়ি। সুর সম্পর্কে কবির এক অসামান্য ধারণা ছিল । তিনি মধ্যযুগের ভক্ত কবি কবীরের মতো, তাঁরও বহু পূর্বে খ্রিস্টপূর্বাব্দের পিথাগোরাসের মতো জগৎকে সুরের লীলাক্ষেত্র মনে করতেন। পিথাগোরাসের ধারণা মহাকাশে অগণ্য নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহ অবিশ্রাম চক্রাকারে ঘুর্ণনে এক অন্তহীন সুরের ধারা সর্বজগতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সুরই ‘মিউজিক অব স্ফিয়ার’। বাংলায় বলা যায় ‘গোলকসংগীত’। সাধারণ্যে এটা অশ্রুত বটে তবে সাধনার মাধ্যমে অসাধারণ হতে পারেন যাঁরা, তাঁরা এ গান শুনতে পান। সুরের বিমূর্ত জগতে আত্মমগ্ন সাধকের পক্ষে এ সুর শোনা সম্ভব। আর যাঁর ক্ষেত্রে এটি ঘটবে তিনি লাভ করবেন মুক্তি। যে মুক্তির সঙ্গে শুধু সুফির ফানা, আর বুদ্ধের নির্বাণের তুলনা হতে পারে। প্রাচীন কালের আর্যাবর্তের ঋষিরাও সুরের সাধনা করতেন। তাঁরা পর্বতশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে ‘ওম’ মন্ত্রে আকাশ নিনাদিত করতেন। রবীন্দ্রনাথ এ সকল চিন্তাধারায় সমূহ সিক্ত ছিলেন। তাই বিশ্বপ্লাবী অশ্রুত রাগ-রাগিণীকে তিনি তাঁর জীবনবীণায় বাঁধতে চেয়েছেন। যোগ দিতে চেয়েছেন অদৃশ্য সুরের মহাসভায়।
মধ্যযুগের মহাসাধক অশিক্ষিত হতদরিদ্র কবীর, যিনি জোলার কাজ করে হাটে হাটে দু-খানা কাপড় বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করতেন, তিনি তো চন্দ্র-গ্রহ-তপন-তারা সব কিছুতে সুর ও নৃত্যের লীলা দেখতে পেতেন। তাঁর গানে বলেছেন:
গ্রহ চন্দ্র তপন জ্যোত বরত হৈ
সুরত রাগ নিরত তাল বাজৈ।
তিনি আরো বললেন:
সুধাধারে আপনারে
তুমি আরো আরো আরো করো দান ॥
তাঁর প্রার্থনা আর্য ঋষির সত্য, আলো, অমৃতকে তো বরণ করলই অধিকন্তু তিনি চেয়ে বসলেন মানুষকে মানুষ করার আরো তিন মহামানবীয় উপাদান - প্রাণ, প্রেম আর বেদনা। সুখের পূজারি মানুষগুলো ভারি সীমিত অর্থে প্রেম চায়, বেদনা চায় না কোনো অর্থেই। কিন্তু মানুষের যদি বেদনার অভাব থাকে তাহলে সত্য, আলো, অমৃত, প্রেম কিছুই তার নাগালে আসে না। বেদনাকে বরণ করতে প্রবল প্রাণের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই ‘আরও প্রাণের’ প্রার্থনাও করেছেন।
এই প্রার্থনায় প্রেম, প্রাণ, আলো, অমৃত, বেদনা ছাড়াও আরও একটি অনির্বাণ বস্তুর প্রার্থনা এসে গেছে- যার নাম ‘সুর’। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সুরের এক অপার ভুবনের সন্ধান দেন।
রবীন্দ্রনাথ আজীবনই সুরের কাঙাল ছিলেন। বলেছেন:
তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে
দেবে কি গো বাসা আমায় তারি ধারে?
.....................
আমার নীরব বেলা সেই তোমারি সুরে সুরে
ফুলের ভিতর মধুর মতো উঠবে পুরে।
আশ্চর্য সরল কাঙালপনা! জগতের যে উৎস হতে সুরের ঝরনাধারা বের হচ্ছে তার পাশে একটু বাসা। যশ, ধন, মান বা অন্য কোনো লাভের আশায় নয়, প্রকৃতির রৌদ্র-ছায়ায় নিভৃতে ফুলের মধ্যে যেমন মধু সঞ্চিত হয়, তেমনি যদি সুরের ধারার পাশে একটু বাসা পাওয়া যায় তবে কবির নীরব বেলাটি সুরের মধুতে ভরে যাবে। কবির কাছে মুক্তি লাভের এক আশ্চর্য পাথেয় সুর। এটাই তাঁর শেষ পারানির কড়ি। সুর সম্পর্কে কবির এক অসামান্য ধারণা ছিল । তিনি মধ্যযুগের ভক্ত কবি কবীরের মতো, তাঁরও বহু পূর্বে খ্রিস্টপূর্বাব্দের পিথাগোরাসের মতো জগৎকে সুরের লীলাক্ষেত্র মনে করতেন। পিথাগোরাসের ধারণা মহাকাশে অগণ্য নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহ অবিশ্রাম চক্রাকারে ঘুর্ণনে এক অন্তহীন সুরের ধারা সর্বজগতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সুরই ‘মিউজিক অব স্ফিয়ার’। বাংলায় বলা যায় ‘গোলকসংগীত’। সাধারণ্যে এটা অশ্রুত বটে তবে সাধনার মাধ্যমে অসাধারণ হতে পারেন যাঁরা, তাঁরা এ গান শুনতে পান। সুরের বিমূর্ত জগতে আত্মমগ্ন সাধকের পক্ষে এ সুর শোনা সম্ভব। আর যাঁর ক্ষেত্রে এটি ঘটবে তিনি লাভ করবেন মুক্তি। যে মুক্তির সঙ্গে শুধু সুফির ফানা, আর বুদ্ধের নির্বাণের তুলনা হতে পারে। প্রাচীন কালের আর্যাবর্তের ঋষিরাও সুরের সাধনা করতেন। তাঁরা পর্বতশৃঙ্গে দাঁড়িয়ে ‘ওম’ মন্ত্রে আকাশ নিনাদিত করতেন। রবীন্দ্রনাথ এ সকল চিন্তাধারায় সমূহ সিক্ত ছিলেন। তাই বিশ্বপ্লাবী অশ্রুত রাগ-রাগিণীকে তিনি তাঁর জীবনবীণায় বাঁধতে চেয়েছেন। যোগ দিতে চেয়েছেন অদৃশ্য সুরের মহাসভায়।
মধ্যযুগের মহাসাধক অশিক্ষিত হতদরিদ্র কবীর, যিনি জোলার কাজ করে হাটে হাটে দু-খানা কাপড় বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করতেন, তিনি তো চন্দ্র-গ্রহ-তপন-তারা সব কিছুতে সুর ও নৃত্যের লীলা দেখতে পেতেন। তাঁর গানে বলেছেন:
গ্রহ চন্দ্র তপন জ্যোত বরত হৈ
সুরত রাগ নিরত তাল বাজৈ।
তিনি আরো বললেন:
নৌ বাতিয়া ঘুরত হৈ
রৈন দিন শূন্য মে
কহে কবীর শিউ গগন গাজৈ।
অর্থাৎ চন্দ্র সূর্য গ্রহের আলোয় নিয়ত সুরতাল বাজছে। রাত্রি-দিন সে তালে নিরন্তর নিনাদিত। রাত্রি-দিন এই সুর ও ছন্দে বিশ্বচরাচরে মহাস্বামীর সিংহাসনও নৃত্যচঞ্চল। নিরন্তর এই নৃত্য-সংগীতের আরতি মহাপ্রভুর জন্যই নিবেদিত।
রবীন্দ্রনাথে এসে কবীর-পিথাগোরাস একাকার হয়ে যান। মহাজগতকে তখন তিনি বিশ্ববীণার সঙ্গে তুলনা করে গেয়ে ওঠেন:
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।
এই বিশ্ববীণার সঙ্গে কবি নিজের বীণাটি একাত্ম করতে একাগ্রচিত্তে সাধনা করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি কিছুটা সফলও হয়েছেন। না হলে তিনি মানবহৃদয়ে সুরের ইন্দ্রজাল বুনলেন কী করে! যদিও কবি তা স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন বিশ্বহৃদয় পারাবারে রাগ-রাগিণীর জাল ফেলতে তাঁর অনেক বেলা কেটে গেছে। কিন্তু সাফল্য লাভ করা যায়নি। এ কাজ কঠিন। জগৎ জুড়ে প্রবাহিত এই সুরে সুর মেলাতে তিনি অক্ষম। তাঁর ক্ষুদ্র ভঙ্গুর একতারাটি এই গানের বেদনা বইতে পারে না। একতারাটি বাঁধা নৈকট্যের কাঙাল সুরে। বাঁশিটি অনেক দূরে বাজছে। সেখানে পৌঁছা যায় না। গানের লীলার সেই কিনারে সবাই যোগ দিতে পারে না।
তারপরও প্রত্যয় ছাড়েননি তিনি। বিশ্বতানের এই ধ্রুবপদ তিনি জীবনে মেলাবেন:
কহে কবীর শিউ গগন গাজৈ।
অর্থাৎ চন্দ্র সূর্য গ্রহের আলোয় নিয়ত সুরতাল বাজছে। রাত্রি-দিন সে তালে নিরন্তর নিনাদিত। রাত্রি-দিন এই সুর ও ছন্দে বিশ্বচরাচরে মহাস্বামীর সিংহাসনও নৃত্যচঞ্চল। নিরন্তর এই নৃত্য-সংগীতের আরতি মহাপ্রভুর জন্যই নিবেদিত।
রবীন্দ্রনাথে এসে কবীর-পিথাগোরাস একাকার হয়ে যান। মহাজগতকে তখন তিনি বিশ্ববীণার সঙ্গে তুলনা করে গেয়ে ওঠেন:
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে
স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে
নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।
এই বিশ্ববীণার সঙ্গে কবি নিজের বীণাটি একাত্ম করতে একাগ্রচিত্তে সাধনা করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি কিছুটা সফলও হয়েছেন। না হলে তিনি মানবহৃদয়ে সুরের ইন্দ্রজাল বুনলেন কী করে! যদিও কবি তা স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন বিশ্বহৃদয় পারাবারে রাগ-রাগিণীর জাল ফেলতে তাঁর অনেক বেলা কেটে গেছে। কিন্তু সাফল্য লাভ করা যায়নি। এ কাজ কঠিন। জগৎ জুড়ে প্রবাহিত এই সুরে সুর মেলাতে তিনি অক্ষম। তাঁর ক্ষুদ্র ভঙ্গুর একতারাটি এই গানের বেদনা বইতে পারে না। একতারাটি বাঁধা নৈকট্যের কাঙাল সুরে। বাঁশিটি অনেক দূরে বাজছে। সেখানে পৌঁছা যায় না। গানের লীলার সেই কিনারে সবাই যোগ দিতে পারে না।
তারপরও প্রত্যয় ছাড়েননি তিনি। বিশ্বতানের এই ধ্রুবপদ তিনি জীবনে মেলাবেন:
যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে
মিলাব তাই জীবনগানে ॥
এ জন্য আকাশের বিমল নীল, রাতের তারা, ঊষার গীতভাষার সঙ্গে হৃদয় মেলাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপ্রকৃতির এ সুরতানটি কিছুটা ধরে ফেলেছিলেন। তাঁর কথায়ই তা জানা যায়:
তোমার ফাগুন দিনের বকুল চাঁপা, শ্রাবণ দিনের কেয়া,
তাই দেখে তো শুনি তোমার কেমন সে তান দে’য়া ॥
রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে সক্রেটিসের মতো সত্যে নিবেদিত হতে শেখান। প্রাচ্য অনেক মহান ধর্মগুরু পেয়েছে সত্য, তবে একজন সক্রেটিস পায়নি - এটি আমাদের প্রাচ্যবাসীর দুর্ভাগ্য। তাই জ্ঞান ও সত্যের জন্য আমরা হাতে হেমলক নিতে পারি না। আমরা যাজ্ঞবল্ক্যের রক্তচক্ষুর মুখে গার্গীর মতো নীরব শাস্ত্রশাসন মেনে নিয়েছি। তবে আমরা সক্রেটিসকে না পেলেও তাঁর সমগোত্রীয় রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন সক্রেটিসের মতো সত্যের সপক্ষে আর কুসংস্কারের বিপক্ষে সদা-সোচ্চার। সত্যের জন্য সক্রেটিসের মতো তাঁকে জীবন দিতে হয়নি বটে তবে শাস্ত্রধারী পুরোহিত পাণ্ডার রক্তচক্ষু তাঁকে সইতে হয়েছে।
[স্বদেশের কুসংস্কার তাঁকে কতটা বিচলিত করত জীবনের প্রান্তিক পর্বে তাঁর পারস্য-ভ্রমণের একটি কাহিনী থেকে তা জানা যায়। তিনি পারস্যের মরমি কবি হাফেজের কবরের কাছে যেয়ে দেখতে পান অনেকে চোখ বুজে হাফেজের কাব্যের পাতা খুলছিলেন মনোবাঞ্ছনা পূরণের ইঙ্গিত পেতে। পারস্যদেশে সাধারণের বিশ্বাস এই যে, কোন একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাফেজ এর কাব্য খুললে যে কবিতাটি বেরোবে তার থেকে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় করা যায়। কবি তাই ইচ্ছা করলেন: ‘ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়’। (আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ চোখ বুজে যে কবিতাটি বের করেছিলেন তার একটি অংশের অর্থ এ রকম:“ স্বর্গদ্বার খুলে যাবে আর সেই সঙ্গে খুলবে সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি... অহঙ্কৃত ধার্মিক নামধারীদের জন্যে যদি তা বন্ধই থাকে তবে ভরসা রেখ মনে। ঈশ্বরের নিমিত্ত তা যাবে খুলে।” (রবীন্দ্রসমগ্র- একাদশ খ-)]
সক্রেটিসের এক অনুসারী দার্শনিক স্পিনোজা (১৫৩২-১৬৭৭) বলেছিলেন সত্য নিষ্ঠুর বটে, তবে তাঁকে ভালোবাসা যায় (ঞৎঁঃয রং পৎঁবষ নঁঃ রঃ পধহ নব ষড়াবফ) সত্যপ্রীতির জন্য স্বজন ও স্বধর্মের লোকদের নির্যাতনে জমিদারের ছেলে হয়েও সমাজচ্যুত হয়ে অনাত্মীয়ের আশ্রয়ে সামান্য চশমা পালিশের কাজ করে দিন গুজরান করতে হয়েছে তাঁকে। আর মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে নিঃসঙ্গ মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে। সক্রেটিসের আর এক উত্তরসূরি আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাঁর অগ্রজ স্পিনোজার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েই ঘোষণা করে গেছেন:
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
সত্যের প্রতি তাঁর প্রত্যয় যে কতটা বলীয়ান তা বোঝা যায় এ গানটি থেকে:
মোরা সত্যের প’রে মন আজি করিব সমর্পণ।
জয় জয় সত্যের জয়।
মিলাব তাই জীবনগানে ॥
এ জন্য আকাশের বিমল নীল, রাতের তারা, ঊষার গীতভাষার সঙ্গে হৃদয় মেলাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপ্রকৃতির এ সুরতানটি কিছুটা ধরে ফেলেছিলেন। তাঁর কথায়ই তা জানা যায়:
তোমার ফাগুন দিনের বকুল চাঁপা, শ্রাবণ দিনের কেয়া,
তাই দেখে তো শুনি তোমার কেমন সে তান দে’য়া ॥
রবীন্দ্রনাথ আমাদেরকে সক্রেটিসের মতো সত্যে নিবেদিত হতে শেখান। প্রাচ্য অনেক মহান ধর্মগুরু পেয়েছে সত্য, তবে একজন সক্রেটিস পায়নি - এটি আমাদের প্রাচ্যবাসীর দুর্ভাগ্য। তাই জ্ঞান ও সত্যের জন্য আমরা হাতে হেমলক নিতে পারি না। আমরা যাজ্ঞবল্ক্যের রক্তচক্ষুর মুখে গার্গীর মতো নীরব শাস্ত্রশাসন মেনে নিয়েছি। তবে আমরা সক্রেটিসকে না পেলেও তাঁর সমগোত্রীয় রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন সক্রেটিসের মতো সত্যের সপক্ষে আর কুসংস্কারের বিপক্ষে সদা-সোচ্চার। সত্যের জন্য সক্রেটিসের মতো তাঁকে জীবন দিতে হয়নি বটে তবে শাস্ত্রধারী পুরোহিত পাণ্ডার রক্তচক্ষু তাঁকে সইতে হয়েছে।
[স্বদেশের কুসংস্কার তাঁকে কতটা বিচলিত করত জীবনের প্রান্তিক পর্বে তাঁর পারস্য-ভ্রমণের একটি কাহিনী থেকে তা জানা যায়। তিনি পারস্যের মরমি কবি হাফেজের কবরের কাছে যেয়ে দেখতে পান অনেকে চোখ বুজে হাফেজের কাব্যের পাতা খুলছিলেন মনোবাঞ্ছনা পূরণের ইঙ্গিত পেতে। পারস্যদেশে সাধারণের বিশ্বাস এই যে, কোন একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাফেজ এর কাব্য খুললে যে কবিতাটি বেরোবে তার থেকে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় করা যায়। কবি তাই ইচ্ছা করলেন: ‘ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়’। (আশ্চর্য ঘটনা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ চোখ বুজে যে কবিতাটি বের করেছিলেন তার একটি অংশের অর্থ এ রকম:“ স্বর্গদ্বার খুলে যাবে আর সেই সঙ্গে খুলবে সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি... অহঙ্কৃত ধার্মিক নামধারীদের জন্যে যদি তা বন্ধই থাকে তবে ভরসা রেখ মনে। ঈশ্বরের নিমিত্ত তা যাবে খুলে।” (রবীন্দ্রসমগ্র- একাদশ খ-)]
সক্রেটিসের এক অনুসারী দার্শনিক স্পিনোজা (১৫৩২-১৬৭৭) বলেছিলেন সত্য নিষ্ঠুর বটে, তবে তাঁকে ভালোবাসা যায় (ঞৎঁঃয রং পৎঁবষ নঁঃ রঃ পধহ নব ষড়াবফ) সত্যপ্রীতির জন্য স্বজন ও স্বধর্মের লোকদের নির্যাতনে জমিদারের ছেলে হয়েও সমাজচ্যুত হয়ে অনাত্মীয়ের আশ্রয়ে সামান্য চশমা পালিশের কাজ করে দিন গুজরান করতে হয়েছে তাঁকে। আর মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে নিঃসঙ্গ মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে। সক্রেটিসের আর এক উত্তরসূরি আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাঁর অগ্রজ স্পিনোজার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েই ঘোষণা করে গেছেন:
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
সত্যের প্রতি তাঁর প্রত্যয় যে কতটা বলীয়ান তা বোঝা যায় এ গানটি থেকে:
মোরা সত্যের প’রে মন আজি করিব সমর্পণ।
জয় জয় সত্যের জয়।
মোরা বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য, খুঁজিব সত্যধন।
জয় জয় সত্যের জয়।
যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু মিথ্যাচিন্তা নয়।
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যাকর্ম নয়।
যদি দ- সহিতে হয় তবু মিথ্যাবাক্য নয়।
জয় জয় সত্যের জয়।
মানুষের মধ্যে বাস করেন আর এক মহামানব। অন্যান্য প্রাণীর মতো তাঁর জীবন ক্ষুণ্নিবৃত্তি আর যৌনকর্মের পরিসরে বাঁধা নয়। মানুষের ভেতরকার মানুষ আকাশ ছুঁতে চান। মানুষটি যেনতেন করে পার্থিব সমৃদ্ধি আনতে চাইলেও ভেতরের মহামানবটি মিথ্যা আর যেনতেন উপায়ের সঙ্গে আপোস করে চলতে চান না। তিনি সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করতে প্রস্তুত কঠিন দুঃখের তপস্যায়। প্রচলিত দেব-দেবীর অন্ধ-বিশ্বাস যা সত্যকে বুঝার ও খোঁজার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক রূপে পথ রোধ করে দাঁড়ায়, তা গুড়িয়ে এগিয়ে চলেন এই সত্যসন্ধ মহামানব। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সক্রেটিসের মিল আছে। রবীন্দ্রদর্পণে সক্রেটিসের মুখ দেখা যায়।
আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতার শেষ নেই। আজকের কৃষিব্যাংক, সমবায়চিন্তা, ক্ষুদ্র ঋণ- এসবের পথিকৃৎ তিনি। কে আছে পৃথিবীতে নোবেল পুরস্কারের অর্থ কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দেন ঋণ হিসেবে, যে ঋণ আর ফেরত আসেনি। আজকাল অনেক কৃষকদরদির কথা শুনা যায়। তাঁরা যদি রবীন্দ্রনাথের মতো কৃষকদের ভালোবাসতেন তা হলে দেশের চেহারা অন্যরকম হতো। ছেলে ও জামাতাকে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা শিখতে। কৃষকের প্রতি এ তাঁর কত বড় দায়বদ্ধতা তা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভেবে দেখা উচিত।
ধর্মান্ধদের তা-বে যখন প্রার্থনাগৃহসহ আমাদের ভাইদের খণ্ডিত দেহ উড়ে যেতে দেখি তখন রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভূত হয়। ধর্মান্ধদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে ওরা মানুষের ধর্ম কি তা জানে না। যা ধর্ম নয় তাকে ওরা ধর্ম বলে। ওরা মানুষের রক্তের মধ্যে বেহেশতের হুর-গেল্মান, অপ্সরী-কিন্নরীর সুঘ্রাণ পায়। নিজ গোষ্ঠি, সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের বাইরে কোথাও সত্য দেখে না, ধর্ম দেখে না। যে ধর্ম মানুষের কল্যাণ করতে এসেছিল ওদের হাতে পড়ে সে ধর্ম মানুষের বিনাশের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যে ধর্মের কাজ ছিল মানুষের মানুষের মিলনসাধন, সে ধর্ম দিয়েই ওরা মানুষের মিলনের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। পরস্পরের মধ্যে স্থাপন করছে বিভেদের প্রাচীর। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এ সব মূর্খ মানষের চেয়ে নাস্তিকও ভালো। নাস্তিক শাস্ত্র মানে না বটে কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধির আলো জ্বেলে মানুষের কল্যাণ করে’। এই উগ্র ধর্মোন্মাদ সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠীর হাত থেকে মানব-সমাজকে রক্ষা করতে রবীন্দ্রনাথের আজ বড় বেশি প্রয়োজন। শুধু নাস্তিকের প্রশংসা নয়, মূর্খরা ধর্মের নামে মানব-নির্যাতনের যে কারাগার নির্মাণ করেছে, সে কারা ভেঙে ফেলার দু:সাহসী ডাকও দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ:
ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।
রবীন্দ্রনাথের এই ডাক কোটি কণ্ঠে ছড়িয়ে দিতে পারলে ধর্মরাহুর গ্রাস থেকে আমরা মুক্তি পাব।
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি প্রয়োজন কোনো দিনই ফুরাবে না। যুক্তিবাদী মানুষদের তিনি আধ্যাত্মিক আশ্রয় দেন। শাস্ত্রীয় ধর্মের অযৌক্তিকতা ও মিথে যুক্তিবাদীরা বিশ্বাস করতে পারেন না। তীর্থের নামে কোনো বিশেষ দিনে, বিশেষ কোনো নদীর বিশেষ স্থানে লক্ষ লক্ষ লোক মিলে স্নান করলে নিজের ও পূর্বপুরুষের পাপমুক্তি ঘটবে- এ ধরনের বিশ্বাস যুক্তিবাদীর পক্ষে মেনে নেওয়া একেবারে অসম্ভব। যুক্তিবাদী এমন সত্যে বিশ্বাস করে যা সর্বসত্যে মেলে। কিন্তু শাস্ত্রীয় ধর্মের সব কথা সর্বসত্যে মেলে না। তাই যুক্তিবাদী তা মানতে পারে না। এ অবস্থায় শাস্ত্রীয় ধর্মে তাদের আশ্রয় থাকে না। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে আশ্রয় দেন। কেনোরকম আপ্তবাক্য দ্বারা মানুষের যুক্তিবুদ্ধিকে আড়ষ্ট না-করে রবীন্দ্রনাথ প্রবল ঈশ্বর প্রেমের কাব্য-সাহিত্য রচনা করেছেন। সেগুলো তাই হয়েছে মানুষের জন্য সর্বজনীন আধ্যাত্মিক ছায়াতল। কথায় কথায় নরকের ভীতি প্রদর্শন আর স্বর্গ-সুখের লোভ রবীন্দ্রধর্মে নেই। তবে যে ভাগ্যবান রবীন্দ্রধর্মের সরস ছায়াতলের সন্ধান পায় সে মধুর ছায়া সে আর এ জীবনে ছাড়ে না।
রবীন্দ্রধর্মে এমন কিছু মধু আছে, ধার্মিক তো বটে, যে ধর্ম মানে না, সেও সে মধু পান করতে চায়। রবীন্দ্রভক্ত আবু সয়ীদ আইয়ুব বা শান্তিনিকেতনের স্থপতি হিসেবে খ্যাত সুরেন করের জবানিতে এই মধুর কথা বলা আছে। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি সম্পর্কে আইয়ুব বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিস্বরূপ ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে আমার মনের প্রতিটি কক্ষে প্রবল প্রতিরোধ, সেই ঈশ্বর প্রেমে আদ্যোপান্ত অনুরঞ্জিত কাব্যকে হৃদয়ে স্থান দিতে আমার একটুও বাধে না।’ সুরেন কর শেষ বয়সে থাকতেন দুর্গাপুরে, ছেলের কাছে। বৃদ্ধরা তাঁকে গীতা পাঠের উপদেশ দিলে তিনি বলতেন, ‘আমি গুরুদেবকে ছুঁয়েছি, তাঁর কবিতা পড়েছি, আমার আর কিছু পড়ার প্রয়োজন নেই।’ রবীন্দ্রধর্মে স্রষ্টা আর মানুষের মধ্যে দাস-প্রভুর কোনো চুক্তি হয়নি। সে ধর্ম প্রেমের ধর্ম। সেখানে স্রষ্টাকে না-হলে মানুষের জীবন যেমন ব্যর্থ, মানুষকে না পেলে স্রষ্টার প্রেমও তেমনি মিছে হয়ে যায় :
তাই তোমার আনন্দ অমার ’পর
জয় জয় সত্যের জয়।
যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু মিথ্যাচিন্তা নয়।
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যাকর্ম নয়।
যদি দ- সহিতে হয় তবু মিথ্যাবাক্য নয়।
জয় জয় সত্যের জয়।
মানুষের মধ্যে বাস করেন আর এক মহামানব। অন্যান্য প্রাণীর মতো তাঁর জীবন ক্ষুণ্নিবৃত্তি আর যৌনকর্মের পরিসরে বাঁধা নয়। মানুষের ভেতরকার মানুষ আকাশ ছুঁতে চান। মানুষটি যেনতেন করে পার্থিব সমৃদ্ধি আনতে চাইলেও ভেতরের মহামানবটি মিথ্যা আর যেনতেন উপায়ের সঙ্গে আপোস করে চলতে চান না। তিনি সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করতে প্রস্তুত কঠিন দুঃখের তপস্যায়। প্রচলিত দেব-দেবীর অন্ধ-বিশ্বাস যা সত্যকে বুঝার ও খোঁজার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক রূপে পথ রোধ করে দাঁড়ায়, তা গুড়িয়ে এগিয়ে চলেন এই সত্যসন্ধ মহামানব। এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সক্রেটিসের মিল আছে। রবীন্দ্রদর্পণে সক্রেটিসের মুখ দেখা যায়।
আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতার শেষ নেই। আজকের কৃষিব্যাংক, সমবায়চিন্তা, ক্ষুদ্র ঋণ- এসবের পথিকৃৎ তিনি। কে আছে পৃথিবীতে নোবেল পুরস্কারের অর্থ কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দেন ঋণ হিসেবে, যে ঋণ আর ফেরত আসেনি। আজকাল অনেক কৃষকদরদির কথা শুনা যায়। তাঁরা যদি রবীন্দ্রনাথের মতো কৃষকদের ভালোবাসতেন তা হলে দেশের চেহারা অন্যরকম হতো। ছেলে ও জামাতাকে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা শিখতে। কৃষকের প্রতি এ তাঁর কত বড় দায়বদ্ধতা তা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ভেবে দেখা উচিত।
ধর্মান্ধদের তা-বে যখন প্রার্থনাগৃহসহ আমাদের ভাইদের খণ্ডিত দেহ উড়ে যেতে দেখি তখন রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভূত হয়। ধর্মান্ধদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে ওরা মানুষের ধর্ম কি তা জানে না। যা ধর্ম নয় তাকে ওরা ধর্ম বলে। ওরা মানুষের রক্তের মধ্যে বেহেশতের হুর-গেল্মান, অপ্সরী-কিন্নরীর সুঘ্রাণ পায়। নিজ গোষ্ঠি, সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের বাইরে কোথাও সত্য দেখে না, ধর্ম দেখে না। যে ধর্ম মানুষের কল্যাণ করতে এসেছিল ওদের হাতে পড়ে সে ধর্ম মানুষের বিনাশের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যে ধর্মের কাজ ছিল মানুষের মানুষের মিলনসাধন, সে ধর্ম দিয়েই ওরা মানুষের মিলনের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। পরস্পরের মধ্যে স্থাপন করছে বিভেদের প্রাচীর। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এ সব মূর্খ মানষের চেয়ে নাস্তিকও ভালো। নাস্তিক শাস্ত্র মানে না বটে কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধির আলো জ্বেলে মানুষের কল্যাণ করে’। এই উগ্র ধর্মোন্মাদ সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠীর হাত থেকে মানব-সমাজকে রক্ষা করতে রবীন্দ্রনাথের আজ বড় বেশি প্রয়োজন। শুধু নাস্তিকের প্রশংসা নয়, মূর্খরা ধর্মের নামে মানব-নির্যাতনের যে কারাগার নির্মাণ করেছে, সে কারা ভেঙে ফেলার দু:সাহসী ডাকও দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ:
ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।
রবীন্দ্রনাথের এই ডাক কোটি কণ্ঠে ছড়িয়ে দিতে পারলে ধর্মরাহুর গ্রাস থেকে আমরা মুক্তি পাব।
রবীন্দ্রনাথের আরেকটি প্রয়োজন কোনো দিনই ফুরাবে না। যুক্তিবাদী মানুষদের তিনি আধ্যাত্মিক আশ্রয় দেন। শাস্ত্রীয় ধর্মের অযৌক্তিকতা ও মিথে যুক্তিবাদীরা বিশ্বাস করতে পারেন না। তীর্থের নামে কোনো বিশেষ দিনে, বিশেষ কোনো নদীর বিশেষ স্থানে লক্ষ লক্ষ লোক মিলে স্নান করলে নিজের ও পূর্বপুরুষের পাপমুক্তি ঘটবে- এ ধরনের বিশ্বাস যুক্তিবাদীর পক্ষে মেনে নেওয়া একেবারে অসম্ভব। যুক্তিবাদী এমন সত্যে বিশ্বাস করে যা সর্বসত্যে মেলে। কিন্তু শাস্ত্রীয় ধর্মের সব কথা সর্বসত্যে মেলে না। তাই যুক্তিবাদী তা মানতে পারে না। এ অবস্থায় শাস্ত্রীয় ধর্মে তাদের আশ্রয় থাকে না। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে আশ্রয় দেন। কেনোরকম আপ্তবাক্য দ্বারা মানুষের যুক্তিবুদ্ধিকে আড়ষ্ট না-করে রবীন্দ্রনাথ প্রবল ঈশ্বর প্রেমের কাব্য-সাহিত্য রচনা করেছেন। সেগুলো তাই হয়েছে মানুষের জন্য সর্বজনীন আধ্যাত্মিক ছায়াতল। কথায় কথায় নরকের ভীতি প্রদর্শন আর স্বর্গ-সুখের লোভ রবীন্দ্রধর্মে নেই। তবে যে ভাগ্যবান রবীন্দ্রধর্মের সরস ছায়াতলের সন্ধান পায় সে মধুর ছায়া সে আর এ জীবনে ছাড়ে না।
রবীন্দ্রধর্মে এমন কিছু মধু আছে, ধার্মিক তো বটে, যে ধর্ম মানে না, সেও সে মধু পান করতে চায়। রবীন্দ্রভক্ত আবু সয়ীদ আইয়ুব বা শান্তিনিকেতনের স্থপতি হিসেবে খ্যাত সুরেন করের জবানিতে এই মধুর কথা বলা আছে। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি সম্পর্কে আইয়ুব বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিস্বরূপ ঈশ্বরকে গ্রহণ করতে আমার মনের প্রতিটি কক্ষে প্রবল প্রতিরোধ, সেই ঈশ্বর প্রেমে আদ্যোপান্ত অনুরঞ্জিত কাব্যকে হৃদয়ে স্থান দিতে আমার একটুও বাধে না।’ সুরেন কর শেষ বয়সে থাকতেন দুর্গাপুরে, ছেলের কাছে। বৃদ্ধরা তাঁকে গীতা পাঠের উপদেশ দিলে তিনি বলতেন, ‘আমি গুরুদেবকে ছুঁয়েছি, তাঁর কবিতা পড়েছি, আমার আর কিছু পড়ার প্রয়োজন নেই।’ রবীন্দ্রধর্মে স্রষ্টা আর মানুষের মধ্যে দাস-প্রভুর কোনো চুক্তি হয়নি। সে ধর্ম প্রেমের ধর্ম। সেখানে স্রষ্টাকে না-হলে মানুষের জীবন যেমন ব্যর্থ, মানুষকে না পেলে স্রষ্টার প্রেমও তেমনি মিছে হয়ে যায় :
তাই তোমার আনন্দ অমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নীচে -
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হবে যে মিছে ॥
মানুষের সঙ্গে যুগলসম্মিলনেই সেখানে স্রষ্টার পূর্ণপ্রকাশ চরিতার্থ হয়। অর্থাৎ পূর্ণতা শুধু একা মানুষের নয়, একা স্রষ্টারও নয় - উভয়েরই। তাঁর মতে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। আমরা রাজা না-হলে, সেই মহারাজের (বিশ্ববিধাতার) কদর বুঝব কী করে? তাঁর সাথে আত্মিক লেন-দেন হবে কী করে? এ ধর্মের বাণী বিপ্লবী।
আমি রবীন্দ্রধর্ম বলেছি। হয়তো রবীন্দ্রনাথ থাকলে আমার কথায় আপত্তি জানাতেন। নিজেকে তিনি প্রেরিত পুরুষ দাবি করেননি। প্রেরিত পুরুষ না হয়েও অবশ্য ধর্ম প্রবর্তক হওয়া যায়, যেমন গৌতম বুদ্ধ হয়েছিলেন, হয়েছিলেন রাজা রামমোহনও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ধর্ম প্রবর্তক হতে চাননি। যা কিছু মানবধর্ম তাকেই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন তিনি। আর এগুলো সন্ধান করেছেন পরমনীতির মাধ্যমে। পরমসত্তা সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভের জন্য অন্তহীন প্রয়াস চালিয়েছেন আজীবন। এ তো ধর্মেরই কাজ। তাহলে তাঁর রেখে যাওয়া জীবন দর্শনকে আমরা ধর্ম বলবো না কেন? জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু- এসবের কষ্ট লাঘবের উপায় বলে দেওয়ার জন্য যদি গৌতম বুদ্ধের বাণী ধর্ম হতে পারে তাহলে রবীন্দ্রনাথের বাণী কেন ধর্ম হবে না? তিনি কোনো সর্বজনীন রিচুয়াল রেখে যাননি- এজন্য?
সর্বজনীন রিচুয়াল না থাকায় তাঁর ধর্মবোধ এবং ঈশ্বর আরাধনার রীতি সাবজেক্টিভ হয়েছে এ কথা সত্য এবং এ জন্য বিপিন চন্দ্র পালের মতো বিখ্যাত বক্তা রবীন্দ্রনাথের কাব্যভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কঠোর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মহৎ আইডিয়া যা সত্যকে জানার পথ রচনা করে, সাবজেক্টিভ হলেও তা ধর্ম হবে না কেন? ম্যাক্সমুলার বলেছেন, “Religion is subjective faculty for the apprehension of mankind.” ম্যাক্সমুলারের মতে যদি সারবত্তা থাকে তাহলে রবীন্দ্রনাথ সত্যকে অন্তরের উপলব্ধির জন্য পরমতত্ত্ব ও পরমসত্তা সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভার্থে ব্যক্তিসত্তাকে যে রোমান্টিক চলার পথটি দেখিয়ে দেন তা ধর্ম হবে না কেন?
মানুষের সঙ্গে যুগলসম্মিলনেই সেখানে স্রষ্টার পূর্ণপ্রকাশ চরিতার্থ হয়। অর্থাৎ পূর্ণতা শুধু একা মানুষের নয়, একা স্রষ্টারও নয় - উভয়েরই। তাঁর মতে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। আমরা রাজা না-হলে, সেই মহারাজের (বিশ্ববিধাতার) কদর বুঝব কী করে? তাঁর সাথে আত্মিক লেন-দেন হবে কী করে? এ ধর্মের বাণী বিপ্লবী।
আমি রবীন্দ্রধর্ম বলেছি। হয়তো রবীন্দ্রনাথ থাকলে আমার কথায় আপত্তি জানাতেন। নিজেকে তিনি প্রেরিত পুরুষ দাবি করেননি। প্রেরিত পুরুষ না হয়েও অবশ্য ধর্ম প্রবর্তক হওয়া যায়, যেমন গৌতম বুদ্ধ হয়েছিলেন, হয়েছিলেন রাজা রামমোহনও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ধর্ম প্রবর্তক হতে চাননি। যা কিছু মানবধর্ম তাকেই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন তিনি। আর এগুলো সন্ধান করেছেন পরমনীতির মাধ্যমে। পরমসত্তা সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভের জন্য অন্তহীন প্রয়াস চালিয়েছেন আজীবন। এ তো ধর্মেরই কাজ। তাহলে তাঁর রেখে যাওয়া জীবন দর্শনকে আমরা ধর্ম বলবো না কেন? জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু- এসবের কষ্ট লাঘবের উপায় বলে দেওয়ার জন্য যদি গৌতম বুদ্ধের বাণী ধর্ম হতে পারে তাহলে রবীন্দ্রনাথের বাণী কেন ধর্ম হবে না? তিনি কোনো সর্বজনীন রিচুয়াল রেখে যাননি- এজন্য?
সর্বজনীন রিচুয়াল না থাকায় তাঁর ধর্মবোধ এবং ঈশ্বর আরাধনার রীতি সাবজেক্টিভ হয়েছে এ কথা সত্য এবং এ জন্য বিপিন চন্দ্র পালের মতো বিখ্যাত বক্তা রবীন্দ্রনাথের কাব্যভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কঠোর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মহৎ আইডিয়া যা সত্যকে জানার পথ রচনা করে, সাবজেক্টিভ হলেও তা ধর্ম হবে না কেন? ম্যাক্সমুলার বলেছেন, “Religion is subjective faculty for the apprehension of mankind.” ম্যাক্সমুলারের মতে যদি সারবত্তা থাকে তাহলে রবীন্দ্রনাথ সত্যকে অন্তরের উপলব্ধির জন্য পরমতত্ত্ব ও পরমসত্তা সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভার্থে ব্যক্তিসত্তাকে যে রোমান্টিক চলার পথটি দেখিয়ে দেন তা ধর্ম হবে না কেন?
ধর্মে পরমসত্তার প্রেম-পরশ পেতে, করুণা পেতে প্রার্থনার রেওয়াজ আছে। রবীন্দ্রনাথ যে প্রার্থনাসংগীত রেখে গেছেন তা যে কোনো ধর্মীয় প্রার্থনার সমকক্ষ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও উজ্জ্বল। তাছাড়া অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও করুণার বাণীতে পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ। তাহলে তাঁর বাণী ধর্ম হিসেবে বিবেচনা হবে না কেন? এর উত্তর হতে পারে, তিনি কোনো ধর্ম প্রবর্তক হতে চাননি বলে। তিনি তাঁর বাণীকে অন্যান্য ধর্মপ্রচারকের মতো রিচুয়ালাইজড বা রেজিমেন্টেড করেননি বলে। তিনি কোনো সংঘও গড়ে তোলেননি, বুদ্ধ যেমন করেছিলেন। এ জন্য তাঁর অমর বাণী ধর্মের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কাজ তাঁর উত্তরাধিকারের। আমরা এ কাজ করব। তবে নতুন কোনো ধর্ম হিসেবে নয়। মানুষকে মানুষ করতে, মানুষের মধ্যে সত্যের পথিককে জাগাতে, শুভবোধ জাগাতে। তাহলে সর্ব ধর্মের মানুষই প্রকৃত ধার্মিক হয়ে উঠবে। তারা নিজের ভিতরে এক মহামানবকে উপলব্ধি করবে।
রবীন্দ্রনাথ মানুষকে বিবেকের বিনাশ থেকে রক্ষা করেন। ফরাসি দার্শনিক জাঁপল সার্ত্র (১৯০৫-১৯৮০) যে বিবেকের বিনাশকে
Ôspiritual
suicide’ অভিধায় অভিহিত করেছিলেন। মানুষ যখন স্বীয় লোভ বা ভয়ের বশবর্তী হয়ে বিবেক ও সততা বিসর্জন দিয়ে অকর্তব্য করে, তখন সে বিবেক-বিনাশের অপরাধে অপরাধী হয়ে পড়ে। লালসা-পঙ্কিল কাপুরুষের তালিকায় তার নাম উঠে যায়। সে সত্যের শত্রু, বিবেকের শত্রু, মানবতার শত্রু। সে অস্তিত্বশীল মানুষের কেউ নয়, স্রোতের তৃণ। তার চাকচিক্যময় বাহ্যিক দেহাবয়ব থাকলেও আসলে সে মৃতবিবেক, এক জড় পদার্থ। মানুষ যাতে লোভ-ভয়-মোহ আর মিথ্যায় তলিয়ে অস্তিত্বহীন অমানুষ না হয়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথ সে শিক্ষা মানুষকে দিয়েছেন:
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।
দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচারঘরে ॥
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
যদি পাপ মনে করি অবিচার কাহারো ’পরে,
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ, ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম বিমুখ,
পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণিকতরে -
... ... ...
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
রবীন্দ্রনাথ মানবসমাজের এক মহান শিক্ষক। মানুষের শুভ প্রেরণার উৎস। মানুষের সর্বসংকটে এক শান্তির ছায়াশ্রয়।
শিক্ষাহীন, স্বপ্নহীন এক পরাধীন প্রান্তিক ভূখণ্ডে জন্ম নিয়ে অনেক বড় মাপের মানুষ হয়েছিলেন তিনি। জীবদ্দশাতেই তাঁর ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর সর্বত্র। পৃথিবীর মানুষের জন্য তিনি রেখে গেছেন স্বপ্ন-কল্পনা-প্রেম-প্রাণ-সুর-আলো ও শুভ চেতনার একগুচ্ছ চাবি। এ চাবি কখনো পুরনো হবে না। কোনো দীনতার রেশ নেই তাতে। পুরনো জেনে তাঁকে অবহেলা করা যাবে না কখনো।
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।
দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচারঘরে ॥
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
যদি পাপ মনে করি অবিচার কাহারো ’পরে,
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ, ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম বিমুখ,
পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণিকতরে -
... ... ...
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে ॥
রবীন্দ্রনাথ মানবসমাজের এক মহান শিক্ষক। মানুষের শুভ প্রেরণার উৎস। মানুষের সর্বসংকটে এক শান্তির ছায়াশ্রয়।
শিক্ষাহীন, স্বপ্নহীন এক পরাধীন প্রান্তিক ভূখণ্ডে জন্ম নিয়ে অনেক বড় মাপের মানুষ হয়েছিলেন তিনি। জীবদ্দশাতেই তাঁর ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর সর্বত্র। পৃথিবীর মানুষের জন্য তিনি রেখে গেছেন স্বপ্ন-কল্পনা-প্রেম-প্রাণ-সুর-আলো ও শুভ চেতনার একগুচ্ছ চাবি। এ চাবি কখনো পুরনো হবে না। কোনো দীনতার রেশ নেই তাতে। পুরনো জেনে তাঁকে অবহেলা করা যাবে না কখনো।
[ রবীন্দ্রনাথের ৭৩তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ৬ আগস্ট, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে পঠিত।]
No comments:
Post a Comment