এস ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১)
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট, প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা এস ওয়াজেদ আলী ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার বড় তাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ বেলায়েত আলী স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে শিলং বসবাস করতেন। মায়ের নাম খাদিজা বেগম। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে শিলং বড় তাজপুর গ্রামের পাঠশালায় এস ওয়াজেদ আলীর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা। বরাবরই তিনি ছিলেন মেধাবী। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শিলং মোখার হাইস্কুল থেকে স্বর্ণপদকসহ এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলীগড় কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএ পাশ করেন। অত:পর তিনি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড গমন করেন এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পুনরায় বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। একই সাথে তিনি ব্যারিস্টারি অধ্যয়নে যুক্ত হন এবং বার এটল ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।তবে দীর্ঘদিন তিনি আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থাকেননি। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তাকে কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বত্রিশ বছর কলকাতার তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি করার পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। এস ওয়াজেদ আলী শিক্ষিত মহলে সুপরিচিত একটি নাম। তবে এ পরিচয় ম্যাজিস্ট্রে হিসেবে নয়, সাহিত্যিক হিসেবে। তিনি সাহিত্যিক না হলে হাজার হাজার ম্যাজিস্ট্রেট,সচিব-মহাসচিবগণের মত মৃত্যুর সাথে সাথে পশুপাখির মত হারিয়ে যেতেন।
এস ওয়াজেদ আলীর জীবন ছিলেন যেমন আকর্ষণীয় তেমন ঘটনাবহুল। অভিভাবকদের ইচ্ছায় তিনি সাত বছর বয়সে আড়াই বছর বয়সী পিতৃব্য-কন্যা আয়েশা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শিশু বয়সের অবুঝ মনের বিবাহ পরিণত জীবনে দাগ কাটতে পারেনি। লন্ডনে থাকাকালীন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নেলি নামের একজন ইংরেজি নাগরিকের সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইংল্যান্ড থেকে দেশে আসার পর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম স্ত্রী আয়েশাকে পরিত্যাগ করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মিসেস নেলি স্বামী ওয়াজেদ আলীকে পরিত্যাগ করে ওয়াজেদ আলীর ছোট ভাই এস শমসের আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে এস ওয়াজেদ আলী এক বার্মিজ কন্যাকে বিয়ে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বিয়ের পর বার্মিজ মহিলার ধর্মান্তরিত নাম মিসেস বদরুন্নেসা।
বৈচিত্র্যময় ও ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী এস ওয়াজেদ আলী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি মননে ছিলেন উদার, বিবেচনায় নৈর্বক্তিক এবং প্রকাশে বিচক্ষণ। সাহিত্য জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার পদচারণা ছিল আলোর মত উজ্জ্বল এবং আকাশের মত বিস্তৃত। সম্পাদক হিসেবেও তার অবদান রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কর্মকালীন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বুলেটিন অব দ্যা ইন্ডিয়ান র্যাশনালিস্টিক সোসাইটি’ নামে একটি ইংরেজি জার্নাল এবং ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ‘গুলিস্তাঁ’ নামের একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে পুরোদস্তর একজন বাঙালি মনের আন্তর্জাতিক মানুষ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল এস ওয়াজেদ আলীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। মননশীল লেখক, সহানুভূতিশীল প্রশাসক এবং জাতীয়তাবাদী হিসেবে তিনি আজীবন দেশের কল্যাণ কামনা করেছেন। ছাত্রজীবন হতে তিনি সাহিত্যকর্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। নীতিবোধ, সত্যাশ্রয়, মানবতাবোধ, ন্যয়বিচার, সমতা, মানবাধিকার, জীবনবোধে চেতনার উন্মেষ ইত্যাদি ছিল তার সাহিত্য রচনার ক্ষেত্র।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা প্রভৃতি শাখায় এস ওয়াজেদ আলীর অভূতপূর্ব দক্ষতা লক্ষ্যণীয়। সংখ্যায় গ্রন্থ সংখ্যা কম হলেও গুণগত মান বিবেচনায় তার প্রত্যেকটি গ্রন্থের এক একটি বাক্য অসংখ্য গ্রন্থের চেয়েও অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। তার লেখার মধ্যে জাতীয়তাবাদের সুর প্রবল আবেগ কিন্তু মোহনীয় মমতায় বিধৃত। তিনি দেশ ও সমাজকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন, আর গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন দেশের মানুষকে। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরদর্শী। গভীর পর্যবেক্ষণ স্বরূপতা দিয়ে বহুদুরের সমাজকে অবলোকন করার দুরন্ত ক্ষমতা এস ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কর্মকে সার্বজনীন করে রেখেছে। দুরদর্শীতার সাথে অনুভূত পর্যবেক্ষণকে মুগ্ধকর সজ্জায় ভাষাবদ্ধ করার ক্ষমতা এস ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কর্মকে সর্বমহলে উপাদেয় করে তুলে। ‘ভবিষ্যতের বাঙ্গালি’ গ্রন্থটি এস ওয়াজেদ আলীর দুরন্ত প্রতিভার দুরদর্শী অবলোকনের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এ গ্রন্থে তিনি হিন্দু ও মুসলিম সমাজের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন জাতি গঠনের বিষয়ে প্রাচুর্য্যময় আলোচনা করেছেন।
প্রাবন্ধিক হিসেব বাংলা সাহিত্যে তার আসন স্থায়ী হয়ে আছে। জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রাতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালি (১৯৪৩), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ, একবালের পয়গাম, মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ প্রভৃতি তার প্রবন্ধ গ্রন্থ। ইসলামের ইতিহাস ও আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯) এস ওয়াজেদ আলীর দুটি ইতিহাসগ্রন্থ। রম্যরচনাতেও তার সাহিত্যিক চেতনার অনাবিল পরিবেশনা লক্ষ্যণীয়। ‘খেয়ালের ফেরদৌস’ তার একটি অসাধারণ ও আকর্ষণীয় রম্যরচনা।
ছোটগল্প রচনাতে এস ওয়াজেদ আলী মুগ্ধকর পরিবেশনায় পারদর্শীতা বহমান নদীর মত ঢেউময়। জীবনদর্শন ও কাব্যিক অনুভূতির মনোজ্ঞতায় তার ছোটগল্পগুলো জীবনবোধে নিবিড় আর চেতনায় সতত গভীর। শোভনীয় নৈকষ্যের চমৎকার ভাষ্যে তিনি নিজের দর্শনকে গল্পের ছাঁচে অনবদ্য বাস্তবতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন। সংগতকারণে তিনি গাল্পিক হিসেবে নিজের মেধার সফল নিবেদনে এক সার্থক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জনে সক্ষম হন। মার্জিত রুচি, পরিচ্ছন্ন রসবোধ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, শালীন সৌন্দর্য্য ও বিমুগ্ধ নাটকীয়তা তার গল্পের অনিবার্য উপাদান। গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), দরবেশের দোয়া (১৯৩১), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪), ভাঙ্গাবাঁশী প্রভৃতি তার গল্পগ্রন্থ। লেখায় তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবীয় আচরণ, নীতিবোধে উৎসরিত জীবন-প্রত্যয় ও প্রেমের শ্বাসত মগ্নতায় আত্মবিলাসের মুগ্ধকর মহিমা রুচিশীল প্রমুগ্ধতায় তুলে ধরেছেন। স্বীয় জীবনানুভূতি ও ভাবাদর্শ তার গল্পের উপজীব্য। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পারিপাশ্বিক অভিজ্ঞতালব্ধ মূল্যায়ন। ‘মাসুকের দরবার’ গল্পগ্রন্থটি এস ওয়াজেদ আলীর বিখ্যাত গল্পসংগ্রহ হিসেবে খ্যাত। সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এ গ্রন্থের গল্পসমূহকে তুর্গেনিভের প্রোজ-পয়েমস গ্রন্থের সাথে তুলনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণ কাহিনী রচনায় প্রশাসকদের অবদান যে কোন বিবেচনায় সবচেয়ে সতত উজ্জ্বল। এর কারণ বিদেশ ভ্রমণে তাদের দাপ্তরিক সুযোগ। এ সুযোগের সাথে মেধার প্রতিফলন ঘটিয়ে অনেক প্রশাসক তাদের ভ্রমণ কাহিনীকে বিশ্বমানে উপনীত করতে সক্ষম হয়েছেন। এসব তালিকায় এস ওয়াজেদ আলীর নাম নিঃসন্দেহে অনবদ্য সমুজ্জ্বলতার দাবিদার। মোটরযোগে রাঁচির সফর (১৯৪৯), পশ্চিম ভারত (১৩৫৫) প্রভৃতি তার ভ্রমণ কাহিনী। গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০) এস ওয়াজেদ আলীর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে তিনি ঐতিহাসিক নিষ্ঠার মাধ্যমে ঘটনাকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। প্রবন্ধ সাহিত্যে এস ওয়াজেদ আলী মার্জিত রুচি ও আভিজাত্যময় রসবোধের মাধ্যমে প্রবন্ধকে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করে গেছেন। তার রচনার উৎকর্ষ ধারক এবং সমৃদ্ধ বিশ্লেষণ বিষয়কে জোরালো ও পরিবেশনাকে বর্ণাট্য করে রাখে।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কর্ম তার জীবন দর্শনের মতই সরল। তিনি জীবনকে কোন কৃত্রিমতা বা ভ-ামির বেড়াজালে আবদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না। যা করার প্রকাশ্যে করেছেন। অনুভূত বিষয়কে কথা আর কাজের মাধ্যমে সর্বসমক্ষে বিধৃত করেছেন। অবদমনের মাধ্যমে নিজের অন্তর্জালাকে নরকজ্বালায় পরিণত করে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের ক্ষণস্থায়ী সময়গুলোর অপচয়কে তিনি নিশ্চিত অপরাধ হিসেবে জানতেন। এ সব ভণ্ডামি হতে বিমুক্ততার সাহস ও উদ্যমী মানসিকতা তার গল্পসমূহ সরল, গতিময় ও নির্ভেজাল জীবনাধারে আদৃত দ্বান্দ্বিক সমাজের আলেখ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ম-িত একজন আদর্শ মানুষ। হিন্দু-মুসলিম সবার কাছে তিনি সমান জনপ্রিয়তার অধিকারী ছিলেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর তিনি কলকাতা এলবার্ট হলে কবি নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং সভাপতি হিসেবে অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। একই বছর তিনি আসাম মুসলিম ছাত্র সমিতির বার্ষিক সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সম্মিলনী সভায় সভাপতিত্ব করেন।
এস ওয়াজেদ আলী বাংলা ভাষার একজন প্রধান গদ্য লেখক। মুসলমান সভ্যতা সম্পর্কে তার প্রচুর লেখা থাকলেও মননে-বরনে তিনি ছিলেন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক ও স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী একজন যথার্থ সাহিত্যিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠা তার সাহিত্যকর্মের মুল উপজীব্য। তিনি মানুষকে ধর্মের সংকীর্ণ সীমানা হতে বের করে বিশাল মানবীয় দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে আমৃত্যু কলম চালিয়েছেন।
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন এস ওয়াজেদ আলী কলকাতায় মারা যান।
No comments:
Post a Comment