চিকামারা
এককালের ‘দেওয়াল লিখন ‘ কথাটি বর্তমানে চিকামারা নামে পরিচিত। দুটো বাগ্ভঙ্গির অর্থ অভিন্ন। ‘চিকামারা’ শব্দটির উৎপত্তি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। তবে ‘দেওয়াল লিখন’ অনেক প্রাচীন একটি পদ্ধতি। আদিম যুগের মানুষদের হাতে এর উৎপত্তি। তারা পাহাড়ের গুহাগাত্রে নানা সংকেত এঁকে সংবাদ আদান-প্রদান করত। ব্রিটিশ আমলে কাগজের অভাবে দেওয়ালে বিভিন্ন স্লোগান লেখা হত। এটা শুধু সরকারি বিরোধীরা করত তা না। সরকারের পক্ষেও স্লোগান লেখা হত। অক্ষর আবিষ্কারের পর পর মূলত দেওয়াল বা পাথরে লিখে সরকারি বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ জনগণের অবহিত করার জন্য জারি করা হত। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেওয়াল লিখন শুরু করে। কিন্তু অল্পসময় পরে পাকিস্তানি শাসকদের বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা গোপনে দেওয়ালে বিভিন্ন স্লোগান লিখে এর প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দেওয়াল লিখন’ কথাটা ‘চিকামারা’ শব্দে প্রতিস্থাপিত হয়। বাংলা ভাষা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের অযৌক্তিক ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেওয়ালে বিভিন্ন স্লোগান ও দাবি-দাওয়া লেখার হার বেড়ে যায়। সর্বদলীয় বাংলা ভাষা পরিষদ এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিগা গাছের ডাল ভেঙ্গে এর আগা থেঁতলিয়ে ব্রাশের ন্যায় তুলি বানাত। নিচে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের মাথাতেও যাতে স্লোগান লেখা যায় সে জন্য কিছু কিছু তুলি ছিল লাঠির মতো লম্বা। সে সব ব্রাশ বা তুলিতে আলকাতরা লাগিয়ে দেওয়ালে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হত। গ্রেফতারের ভয়ে সাধারণত রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে দেওয়ালে এ সকল স্লোগান লেখা হত। তবে সুযোগ হলে দিনের বেলাতেও সাহসী শিক্ষার্থীরা স্লোগান লিখে সটকে পড়তো। জিগা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি ব্রাশে আলকাতার মাধ্যমে লেখা দেওয়াল লিখন সহজে মুছে ফেলা যেত না।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের কোন একদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী জিগা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি লাঠি-আকৃতির লম্বা ব্রাশ দিয়ে দেওয়ালে স্লোগান লিখছিল। এ সময় একদল টহল পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখে শিক্ষার্থীরা ঝোপের আড়ালে আলকাতরার টিন লুকিয়ে লাঠির মতো লম্বা তুলি দিয়ে ঝোপঝাড়ে এলোপাথারি আঘাত করতে শুরু করে। টহল পুলিশ এগিয়ে এসে বলল : এত রাতে তোমরা বাইরে কী করছ?শিক্ষার্থীরা বলল : হলে চিকার জ্বালায় থাকতে পারছি না। এ ঝোপ দিয়ে হলে চিকা ঢুকে। এ জন্য আমরা লাঠি দিয়ে চিকা মারছি।
ইতোমধ্যে কয়েকটা চিকাও মেরে ফেলা হয়। শিক্ষার্থীদের কথায় পুলিশের সন্তুষ্ট না-হয়ে কোনও উপায় ছিল না। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল একতলা এবং অধিকাংশ টিনসেডে ও স্যাঁতস্যঁতে মেঝে। পাশে ছিল ঝোপঝাড়, সেখান থেকে চিকা হলে হানা দিত। শুধু হলে নয়, পুলিশের ব্যারাকেও চিকার উপদ্রব ছিল। পুলিশ দল সন্তুষ্টচিত্তে চলে যায়। শিক্ষার্থীরা এবার দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল চিকামারার ভানে ঝোপঝাড়ে আঘাত করতে থাকে আর এক দল দেওয়াল লিখন শুরু করে।
এরপর থেকে ‘দেওয়াল লিখন’ লিখতে গেলে শিক্ষার্থীরা বলত চিকামারতে যাচ্ছে। এভাবে ‘দেওয়াল লিখন’ বাগ্ভঙ্গিটি ‘চিকামারা’ শব্দে পরিণত হয়। এখন শুধু দেওয়ালে নয়, রাস্তাতেও চিকামারা হয়।
অনেকে মনে করেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে চিকামারা শব্দটির উৎপত্তি। তবে অনেক মনে করেন সম্ভবত ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে শব্দটির উৎপত্তি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এটি আরও প্রচার পায় এবং ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন তো ‘দেওয়াল লিখন’ কথাটি ‘চিকামারা’ শব্দে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
সুন্দর লাগলো তবে তথ্যের অপূর্ণতা রসাস্বাদনে কিছুটা বাধার সৃষ্টি করেছে।
ReplyDeleteএরকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা যদি খুজে পেতাম ভালো হতো
ReplyDelete