Translate

Sunday 24 August 2014

চার্লস উইলকিন্স, স্যার / ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যার চার্লস উইলকিন্স (১৭৪৯-১৮৩৬)

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক প্রাচ্য ভাষাবিদ পণ্ডিত, এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং বাংলা ও ফারসি মুদ্রাক্ষরের আধূনিক আকৃতির প্রবর্তক স্যার চার্লস উইলকিন্স ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে সমারসেট অঞ্চলের ফ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষানবীশ কারণিক হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সার্ভিসে যোগদান করেন। উল্লে¬খ্য তদকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সার্ভিসই পরবতীকালে ক্রম পরিবর্তন, বিবর্তন ও সংশোধনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের সিভিল সার্ভিস কাঠামোয় রূপায়িত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারণিক হিসেবে মালদহে বদলি হবার পর চার্লস উইলকিন্সের মনে একটি নতুন ধারণার উদয় ঘটে। উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির প্রতি তিনি তীব্র টান গভীর আগ্রহ অনুভব করেন। বাংলার মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রা তার মনে রেখাপাত করে। তদসাথে এটিও তার মনে উদিত হয় যে, উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসনকে নিরুপদ্রব ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে স্বদেশীদের মর্মে প্রবেশ করতে হবে।

ব্রিটিশ ছিল সুদর সমুদ্রের ওপার থেকে ধেয়ে আসা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতি। উপমহাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ, সামাজিকতা কোন কিছুর সাথে ইংরেজদের মিল ছিল না। ইরেজ সংস্কৃতি সম্পর্কে উপমহাদেশের জনগণের সামান্য ধারণাও ছিল না। এরূপ সম্পুর্ণ ভিন্ন কোন জাতির পক্ষে অন্য কোন জাতির মর্মে প্রবেশ করা দূরহ। তা করতে না পারলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করাও হবে দূরহ। তবে কোন জাতি অন্য কোন জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম ও ভাষার সাথে একাত্মময় সহানুভূতি প্রদর্শনের মাধ্যমে চেতনার মর্মমূলে প্রবেশ করে নিজেদের সংস্কৃতিকে যদি ধীরে ধীরে পরিবাহিত করা যায় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে দূরহ কাজটাও সহজ হয়ে উঠে। এ লক্ষ্যে চার্লস উইলকিন্স নিজের কৌতুহল এবং ভারতীয়দের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে সাধারণ মানুষের মর্মে প্রবেশের তাগিদ অনুভব করেন। এ দ্বিবিধবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সার্ভিসের দুরদর্শী কর্মচারী চার্লস উইলকিন্স মালদহে বদলি হবার পর বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। একাগ্রতার বলে অল্প সময়ের মধ্যে ভাষাসমূহে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হন। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফারসি ও বাংলা ভাষার অনুবাদক হিসেবে রাজস্ব কমিশন এবং তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কোম্পানি প্রেসে নিয়োগ পান। মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ উইলকিন্স কারণিক থেকে প্রশাসক পদে উন্নীত হন।

উপমহাদেশের ইতিহাসে উইলকিন্সই প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক যিনি প্রথম প্রাচ্যদেশীয় রীতিনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। অধিকন্তু তিনিই প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক যিনি সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ইউরোপীয়দের ব্যবহারের জন্য তিনি ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ‘এ গ্রামার অব স্যান্সক্রিট’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এ সময় গভর্নর জেনারেল ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। চার্লস উইলকিন্সের মত তিনিও প্রাচ্যদেশীয় রীতিনীতির প্রতি কৌতুহলী ছিলেন। উপমহাদেশের মানুষের মনে রেখাপাত করার বিষয়ে উভয়ের চিন্তা-চেতনার যথেষ্ট মিল ছিল। ফলে উইলকিন্স তার কার্যক্রমে ওয়ারেন হেস্টিংসের অবারিত সহযোগিতা পেতে শুরু করেন। দুজনের সম্পর্ক অল্প সময়ে গভীর ও নিবিড় হয়ে উঠে। স্থানীয় প-িতগণের সহযোগিতায় উইলকিন্স প্রাচ্য পাণ্ডুলিপি, উৎকীর্ণ শিলালিপি প্রভৃতি সংগ্রহপূর্বক সেগুলোর পাঠোদ্ধার ও অনুবাদের প্রয়াস নেন। তার এ প্রয়াস বিদগ্ধ মহলে আগ্রহের সৃষ্টি করে।

উমহাদেশের ইতিহাসে উইলকিন্সই প্রথম ইউরোপীয় প্রাচ্যভাষাবিদ যিনি প্রাচীন ইতিহাস পুননির্মাণের লক্ষ্যে সংস্কৃত লিপির পাঠোদ্ধার করেন। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাল বংশের রাজা নারায়ন পালের (দিনাজপুর জেলা) বাদল-স্তম্ভ লিপির পাঠোদ্ধার করে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করে দেন। সংস্কৃত লিপির পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে উইলকিন্সের প্রথম ও সার্থক প্রয়াস হিসেবে এটি ছিল উপমহাদেশের প্রাচীন লিপি-পাঠ ইতিহাসের মাইল ফলক। এরপর তিনি বিহারের বারাবার পর্বতের গুহায় প্রাপ্ত মৌখরী লিপির মাধ্যমে গুপ্ত শাসনামলের পাঠোদ্ধার করেন। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আর একটি যুগান্তকারী ঘটনার সৃষ্টি করে। তার এ পাঠোদ্ধার পাল ও মৌখরী নামক প্রাচীন দুটি রাজবংশকে আবিষ্কার করে উপমহাদেরে ইতিহাস গবেষণায় নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায়। অধিকন্তু এ আবিষ্কারের ফলে প্রাচ্যের লিপি ও লিপিবিজ্ঞান অধ্যয়নের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জন্য স্যার চার্লস উইলকিন্সকে ‘প্র্যচ্যের লিপি ও লিপিবিজ্ঞানের’ জনক বলা হয়।

বারানাসিতে তিনি সংস্কৃত প-িত কালিনাথের কাছে তিনি উত্তমরূপে সংস্কৃত ভাষা শিখেন। এ সময় উইলকিন্স ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের আনুকূল্যে ইংরেজি ভাষায় মহাভারত অনুবাদ শুরু করেন। তবে এর অনুবাদ তিনি শেষ করতে পারেননি। পরবর্তীকালে তার কিয়দংশ অনুবাদ প্রকাশ হয়েছিল। ইতোপূর্বে বিভিন্ন ব্যক্তি নানা উদ্দেশ্যে বাইবেলসহ খ্রিস্টধর্মের বহু প্রচার পুস্তিকা ইংরেজি ভাষা হতে বাংলা গদ্যে অনুবাদ করলেও উপমহাদেশের সংস্কৃতি বা ধর্মসংশি¬ষ্ট কোনগ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়নি। বিষয়টি ছিল পরস্পরকে গভীরভাবে জানা-বুঝার একটি বিরাট প্রতিবন্ধক। মুসলিম শাসনামলে এ বিষয়টি বড় কঠিন হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল। যার কারণে শাসকগোষ্ঠী ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। প্রাচ্যানুরাগী ওয়ারেন হেস্টিংস এ বিষয়ে একটি দুরদর্শী সিন্ধান্ত নেন। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে ইংরেজিভাষাবাসীদের জ্ঞাত করানোর লক্ষ্যে সংখ্যাঘরিষ্ট জনগণের নিকট অতি পবিত্র হিসেবে পরিচিত ধর্মীয়গ্রন্থ ভগবদগীতা ইংরেজিতে অনুবাদের উদ্যোগ নেন। এ উদ্যোগ সফলকাম করার জন্য তিনি ইংরেজভাষী সংস্কৃতভাষায় দক্ষ প্রাচ্যভাষাবিদ চার্লস উইলকিন্সকে বেছে নেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের সহায়তায় উইলকিন্স ‘ভগবদগীতা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভগবদগীতা ‘ইযধমাধঃ-মববঃধ, ড়ৎ উরধষড়মঁবং ড়ভ কৎববংযহধ ধহফ অৎলড়ড়হ’ নামে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ অনুবাদ একদিকে সংখ্যগুরু হিন্দুসমাজ তাদের ধর্মের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর শ্রদ্ধার নিদর্শন পায় অন্যদিকে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শাসকগোষ্ঠীর পরিচিত হবার দ্বার উন্মোচনের প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ভারতবর্ষে ইঙ্গ-হিন্দু উষ্ণ সম্পর্কের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম। উইলকিন্সের অনুদিত ‘ভগবদগীতা’ ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়।

বাংলা ও ফারসি ভাষায় মুদ্রণের জন্য ছাপাখানা স্থাপনের পথিকৃৎ হিসেবেও উপমহাদেশের ইতিহাসে কোম্পানির প্রশাসক চার্লস উইলকিন্স চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার পূর্বে বাংলা ও ফারসি ভাষায় পুস্তকাদি মুদ্রণের জন্য কোন মুদ্রাক্ষর ছিল না। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলা ও ফারসি মুদ্রাক্ষরের আধুনিক আকৃতি প্রদানেরও পথিকৃৎ। পঞ্চাননের সহযোগিতায় বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি বাংলা ও ফারসি মুদ্রাক্ষরের আধুনিক আকৃতি প্রদান করেন। এ সফলতা বাংলা ও ফারসি ভাষায় পুস্তক মুদ্রণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটায়। উইলকিন্সের এ আবিষ্কারের পর ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বর্ণমালার মুদ্রাক্ষর দ্বারা মুদ্রিত প্রথম বই এন বি হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অব দ্যা বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে উইলকিন্স তার উদ্ভাবনের সফল প্রয়োগ ঘটানোর লক্ষ্যে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পুর্বে উল্লে¬খ করা হয়েছে, উইলকিন্সের বাংলা ও ফারসি মুদ্রাক্ষর উদ্ভাবনের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাসমূহের জন্য তৎকালীন সরকারের কোনো ছাপাখানা ছিল না। উইলকিন্সের ছাপাখানা হতে সরকারের বাংলা ভাষার প্রকাশনাসমূহ মুদ্রণ ও প্রকাশের কাজ শুরু হয়। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘এশিয়াটিক রিসার্চাস’ শিরোনামের একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। যা এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। উল্লেখ্য উইলকিন্স এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠায় উইলিয়ম জোন্সকে সহায়তা করেন।

ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন চার্লস উইলকিন্সের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। হেস্টিংস ভারত থেকে বদলি হয়ে ইংল্যান্ড চলে গেলে ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে উইলকিন্সও ভারত থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সৃজনশীলরা কখনও থেমে থাকতে পারেন না; আমৃত্যু সৃজন করে যান। উইলকিন্সও থেমে থাকতে পারেননি। স্বদেশে বসে তিনি হিতোপদেশ (ফেবলস অব পিলপাই) ও বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ ‘শকুন্তলা’ অনুবাদ করেন। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডন উইলকিন্সকে ফেলো মনোনীত করে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়া হাউস লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হলে যোগ্য বিবেচনায় তাকে এর পরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ লাইব্রেরি পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি এবং বর্তমানে ব্রিটিশ লাইব্রেরি-ওরিয়েন্টিয়াল কালেকশন্স নামে খ্যাত।
১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার চার্লস উইলকিন্স বিখ্যাত হেইলিবারি কলেজের ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পান। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আরও একটি সংস্কৃত ব্যাকরণ প্রকাশ করেন। প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.সি.এল ডিগ্রি প্রদান করে। রাজা চতুর্থ জর্জ খ্যাতিমান প্রাচ্যভাষাবিদ পণ্ডিত উইলকিন্সকে ‘গুয়েলফিক অর্ডার ব্যাজ’ পড়িয়ে সম্মানিত করেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট (knight) উপাধিতে ভূষিত করেন। আমৃত্যু তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির উপদেষ্টা হিসেবে ব্রিটিশ সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করেছেন। একজন প্রশাসক হয়েও তিনি প্রাচ্যবিদ হিসেবে ভারতবর্ষের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহা-ঐতিহ্য বিকাশে যে শ্রম দিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। ইংরেজ হয়েও তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য আসামান্য অবদান রেখেছেন। তার অক্ষর ছাপাখানার রথ বেয়ে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ১৩ মে ক্ষণজন্মা অসাধারণ প্রতিভা ও সৃজনশীল মেধার অধিকারী ভারতপ্রেমিক স্যার চার্লস উইলকিন্স মারা যান।

No comments:

Post a Comment