সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯)
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, পত্রিকা সম্পাদক ও সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁঠালপাড়া গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ছিলেন ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট। পিতা যাদব চট্টোপাধ্যায় গোঁড়া ব্রাহ্মণ হলেও সন্তানদের
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাহিত্যামোদী হিসেবে গড়ে তোলার অনুকূলে
সর্বপ্রকার সহযোগিতা অবারিত রাখেন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট ও সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪)
অগ্রজ। তার ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্রও ছিলেন সাহিত্যিক। চব্বিশ পরগণার এ
পরিবারটি কথাশিল্পী পরিবার হিসেবে খ্যাত ছিল।
পিতার কর্মস্থল
মেদিনীপুরে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা। মেদিনীপুর জেলা
স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করে তিনি হুগলি কলেজে ভর্তি হন।
প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন শেষ করে বর্ধমান কমিশনার অফিসে কেরানি হিসেবে
কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং জ্ঞানমুখী চেতনায়
উদ্দীপ্ত অনুসন্ধিৎসু মনের স্বাধীনচেতা মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ
করলেও নিজ চেষ্টায় ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শন বিদ্যায় বিশেষ
বুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে দইবহমধষ জধুড়ঃং: ঞযবরৎ জরমযঃং ধহফ
খরধনরষরঃবং’ নামক একটি গ্রন্থ লিখে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন এবং ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারের প্রশাসন বিভাগের চাকরিতে নিয়োগ পান। তিনি
সরকারি চাকরি উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করেন। যা তার
অভিজ্ঞতার পরিধি ও চিন্তা চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। চাকরি উপলক্ষে তিনি
কিছুদিন বিহারের পালামৌ এলাকায় অবস্থান করেন। এখানকার অবস্থানের উপর ভিত্তি
করে রচিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাসধর্মী ভ্রমণকাহিনী ‘পালামৌ’। কৃষ্ণনগর
অবস্থানকালীন তার সাথে প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের (১৮৩০-১৮৭৩)
সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে
পদে পদে ব্রিটিশ অফিসারদের বৈষম্য, স্বেচ্ছাচারিতা ও জনস্বার্থ বিরোধি
কর্মকা- তাকে ক্রমশ ক্ষুব্ধ করে তোলে। প্রতিবাদ করেও প্রতিকার করার কোন
উপায় ছিল না। বরং প্রতিবাদ খড়গ হয়ে নেমে আসত। শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এমন আচরণ ছিল নির্জলা অপমান। দিন দিন তার
মন চাকুরির প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণায় ভরে উঠতে থাকে। চাকরি পরিত্যাগের ইচ্ছা
প্রকাশ করলেও আত্মীয়স্বজন তাকে চাকুরিতে থেকে কৌশলে প্রতিবাদ করার এবং
শক্তি সঞ্চয়ের লক্ষ্যে ধীরে ধীরে অগ্রসর হবার উপদেশ দেন। প্রথমে তা তিনি
মানতে রাজি হলেও বৈষম্য আর স্বৈরাচারিতা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়।
ঔপনিবেশিক শাসনের আমলাতান্ত্রিক বৈষম্য আত্মসচেনতাবোধে উদ্বুদ্ধ সঞ্জীব
অচিরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরি ছুড়ে দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদে উৎফুল্ল
হয়ে উঠার পথ খুজে নেন। চাকুরি ছেড়ে দিয়ে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকতা ও
সাহিত্য কর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা মাসিক
পত্রিকা ‘ভ্রমর’ সম্পাদনার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবনের আনুষ্ঠানিক
যাত্রা শুরু হয়। ‘ভ্রমর’ পত্রিকার ১২৮১-১২৮২ বঙ্গাব্দ ও ১২৮০ বঙ্গাব্দের
ভাদ্র আশ্বিন সংখ্যা তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি
বিখ্যাত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সঞ্জীব
চট্টোপাধ্যায়ের মেধা ও মননশীলতা বঙ্গদর্শনকে বিখ্যাত পত্রিকায় পরিণত করে।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সাহিত্য কর্ম ‘পালামৌ (১৮৮০-১৮৮২)’। পালামৌ
একটি ভ্রমণ কাহিনী। এ গ্রন্থে লেখক ছোটনাগপুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, অরণ্যে
নিবাসী মানুষ, জীবজন্তু ও পাখপাখালির বর্ণনা জীবন্ত কিংবদন্তির মতো তুলে
ধরেছেন। পালামৌ গ্রন্থের বর্ণনা এত নিঁখুত, প্রানবন্ত, শক্তিশালী ও নির্জলা
যে, পাঠককে পুস্তক হতে ছোটনাগপুরের অরণ্যে নিয়ে যায়। বাংলা ভাষায় সাহিত্য
পদবাচ্য ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে পালামৌ প্রথম এবং সার্থক গ্রন্থ। পালামৌ
গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ বিখ্যাত,
শাশ্বত ও চিত্তাকর্ষক বাক্যটি ‘পালামৌ’ গ্রন্থটিকে সার্বজনীন খ্যাতিতে
অনবদ্য করে তুলে। বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রত্যেক প্রতিথযশা সমালোচক
গ্রন্থটির উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পালামৌ গ্রন্থ
পড়ে ভ্রমণে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘কণ্ঠমালা’,
১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস ‘জালপ্রতাপ চাঁদ’
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস। রামেশ্বরের অদৃষ্ট (১৮৭৭),
মাধবীলতা (১৮৮৫), দামিনী ইত্যদি তার গল্পগ্রন্থ। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের
অন্যান্য গদ্য সাহিত্যের মধ্যে যাত্রা সমালোচনা (১৮৭৫), সৎকার এবং
বাল্যবিবাহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ঔপনিবেশিক
শাসনের প্রতি তুলনামূলকভাবে সহানুভূতিশীল পরিবারে জন্ম নিলেও স্বদেশিদের
প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্য এবং অপমানমূলক আচরণ কখনও মেনে নিতে পারেননি। যদিও
তার পরিবারের প্রতি ঔপনিবেশিক সরকারও সহানুভূতিশীল ছিল। যারজন্য সঞ্জীব
চটোপাধ্যায়ের পিতা যাদব চট্টোপাধ্যায় এবং অনুজ বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়কেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া
হয়েছিলো। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি সাধারণ মানুষের কথা, স্বাধীনতার
কথা অকপটে বলেছেন। তার গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্রিটিশ
সরকারের বৈষম্য, বাংলার আর্থসামাজিক সচ্ছলতার ভিত ধ্বংসে ঔপনিবেশিক শাসকদের
নিষ্ঠুর পদক্ষেপের কথা ফুটে উঠেছে।
ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিভা ও দুরদৃষ্টি অপরিসীম। তিনি বঙ্গদেশের
ঐতিহাসিক গবেষণার প্রথম দিকের শ্রেষ্ঠ গবেষক হিসেবে স্বীকৃত। তার ঐতিহাসিক
উপন্যাস ‘জাল প্রতাপচাঁদ’ বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস ভা-ারে
শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু, গদ্যরীতি ও
বর্ণনাক্রম যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি আকর্ষণীয়। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত
Bengal Ryots: Their Rights and Liabilities সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটি
বিখ্যাত গবেষণা ও বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে বাংলার কৃষিভিত্তিক
আর্থনীতিক অবস্থা অত্যন্ত রোমহর্ষক কিন্তু বাস্তব তথ্যেরভিত্তিতে তুলে ধরা
হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কীভাবে কৃষকদের শান্তিময় জীবনকে অন্ধকারের
অমানিশায় নিক্ষিপ্ত করেছিলো তাও এ গ্রন্থে তথ্যবহুল চিত্রে বিধৃত করা
হয়েছে।
ছোটগল্পকার হিসেবেও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা
সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্পকার
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(১৮৪৮-১৯২২)। তার প্রথম ছোটগল্পের নাম মধুমতী (১৮৭৩)। এরপর ১৮৭৪
খ্রিস্টাব্দে ‘দামিনী’ ও ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ নামের দুটি ছোটগল্প লিখেন।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুবরন করেন।
No comments:
Post a Comment