Translate

Sunday 24 August 2014

অমৃতলাল বসু / ড. মোহাম্মদ আমীন

অমৃতলাল বসু (১৮৫৩-১৯২৯)

পুলিশ অফিসার অমৃতলাল বসু ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রাস পাশ করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। দুই বছর ডাক্তারি পড়ার পর কাশি গিয়ে হেমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অধ্যয়ন শুরু করেন। এরপর কলকাতা এসে হেমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। কিছুদিন পর চিকিৎসা ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতা ভাল না লাগায় তা ছেড়ে দিয়ে পোর্টব্লেয়ারে সরকারি চিকিৎসকরূপে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এটিও কিছুদিন পর ছেড়ে দিয়ে পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। কিন্তু থিয়েটারের প্রতি প্রবল আকর্ষণের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নাটক রচনা ও অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। এভাবে আস্তে আস্তে নাটক রচনা ও থিয়েটারে অভিয়ন তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ও নেশা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে অখ্যাত পুলিশ অফিসার অমৃতলাল বসু সেরা অভিনেতা, কুশলী মঞ্চাধ্যক্ষ, রসময় নাট্যকা ও আকর্ষণীয় সংগীত রচয়িতা হিসেবে দেশজোড়া ঈর্ষনীয় খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হন। পুলিশের চাকরি ছেড়ে না দিলে বাংলা সাহিত্য হারাতো রসরাজকে আর অমৃতলাল হারাতেন যশরাজ।
 অমৃতলাল বসু বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কমেডিয়ান এবং রঙ্গরসের বিখ্যাত নাট্যকার। রস রচনার জন্যই তিনি দেশবাসীর কাছে ‘রসরাজ’ নামে পরিচিত। তিনি একাধারে নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার ও কবি। তবে স্বভাবজাত কারণে শিশুবেলা হতে তিনি রঙ্গ-ব্যঙ্গমুলক অংশের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সে জন্য প্রহসন রচনাতে তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। সামাজিক, নৈতিক, রাজনীতিক সমকালীন প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে তিনি রসসৃষ্টি করে গেছেন। পত্রিকার ভাষায়, “নাট্যকার অমৃতলাল, সুখেদুঃখে, হাসিতে কান্নাতে বাঙ্গালীর প্রাণ প্রবাহটিকে সহজ ও সরল করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। সমাজে যেখানে অত্যাচার অবিচার ও যুগযুগান্তরের কুসংস্কার পুঞ্জীভূত হইয়া রহিয়াছে সেখানেই তিনি নির্মম কষাঘাত করিয়াছেন একটা তীব্র শ্লেষের ভিতর দিয়া। কিন্তু সে শ্লেষের ভিতরও হাসির উচ্ছ্বাস। শ্লেষ রচনায় তাহার সমকক্ষ বাংলা কেউ নাই। তিনি বাঙ্গালীকে বাঙ্গালীরূপেই পাইতে চাহিয়াছেন এবং পরানুকরণের ফলে বাঙ্গালী যে কিরূপে জাহান্নামে যাইতেছে তাহাই প্রহসনের ভিতর দিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন।”
 তবে স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতা, সমাজ-সংস্কার, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল কিছুটভ প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাদগামী। প্রগতিশীলতার মন্দের দিকটা তিনি দেখেছেন কিন্তু ভালো দিকটা দেখতে পায়নি। এটি অনেক সমালোচক তার সঙ্কীর্ণতার পরিচায়ক মনে করেন। তবে অনেক সমালোচকের মতে তিনি ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাই দেশীয় উপায়ে প্রগতির পথে যেতে চেয়েছেন।
 অমৃতলাল বসুর প্রথম অভিনীত নাটক দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’। তিনি অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফির আনুকূল্যে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ নীলদর্পণ নাটকে সৈরিন্ধ্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। অভিনয় পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে নাট্যসম্রাট গিরিশিচন্দ্র ঘোষের সাথেও অমৃতলাল বসুর ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে। অমৃতলাল বসুর প্রতিভা দুরদর্শী গিরিশচন্দ্র ঘোষের অনুভবে নাড়া দেয়। তারই আনুকূল্যে অমৃতলাল বসু ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটােেরর ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হন। প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতায় আগমন এবং একজন রাজভক্তের চাটুকারিতাকে ব্যঙ্গ করে রচিত ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ প্রহসনে অভিনয় করার কারণে পুলিশ অমৃতলাল বসুকে গ্রেফতার করে। নাট্যসমাজসহ বাংলার সাধারণ মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ করে। এ ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করে। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙ্গে যায়। এরপর তিনি স্টার থিয়েটারে যোগ দেন এবং দীর্ঘ ২৫ বছর এর সঙ্গে যুক্ত থেকে বাংলা সাহিত্যের নাটক ও অভিনয় জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে যান।
 বাংলা নাট্য সাহিত্যে অমৃতলাল বসু নানা কারণে একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। শান্তি পত্রিকার ভাষায়, “ নাট্যসাহিত্যে অমৃতলালই যুগান্তর আনিয়াছেন। তাঁহারই লেখনী মুখে বাংলার রঙ্গালয়গুলি হাসির জীবন্তপ্রবাহে ভাসিয়া গিয়াছে। অভিনেতা হিসাবে বাংলায় তাহার সমকক্ষ কেহ আছেন কিনা সন্দেহ। চলচ্চিত্রে ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ কৃষ্ণকান্তের ভূমিকায় তাঁহার অভিনয় বাঙ্গালীর স্মৃতিপটে চিরদিন জাগিয়া থাকিবে।” নাটক ও প্রহসন রচনায় তার মত বিচক্ষণ সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি জন্মায়নি। তবে ব্যঙ্গাত্মক ও হাসির নাটক রচনায় তিনি ছিলেন যেমন অসাধারণ তেমনি অতুলনীয়। তার প্রহসনগুলো হাস্যরসের উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গপ্রবাহের অপ্রতিরোধ্য এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার রসানুভূতির অধিগম্য।
 অসাধারণ প্রতিভাবলে তিনি মানুষের হাসির জগতটাকে যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়েছিলেন। কোথায়, কখন কীভাবে মানুষকে রসময় অনুভবে উদ্বেলিত করা যায় তা ছিল তার কাছে নস্যি। অমৃতলাল বসুর প্রহসনের প্রতিটি কথা দর্শকদের প্রবল হাসিতে মাতোয়ার করে দিত। সমকালের আর্থসামাজিক, রাজনীতিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাত্যাহিক জীবনের সাংঘর্ষিক বিষয়াদি নিয়ে তিনি চমৎকার কাহিনী বিন্যাসের মাধ্যমে অপূর্ব ব্যঞ্জনায় প্রহসন রচনা করেছেন। হাসি, রস আর আনন্দ ছিল তার নাটক আর অভিনয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে এ রকম রসময় নাটক বা অভিনয় অনেককে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সম্মুখীন করেছেন। এ কারণে তাকে সমাজের এক শ্রেণির লোকের প্রশংসা এবং অন্য শ্রেণির লোকের নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়। যা তার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য তেমন সুখকর ছিল না।
 রসরাজ মানে রসের রাজ। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত নাটক্যকার অমৃতলাল বসু নাটক ও গান রচনা এবং অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ধারায় অনবদ্য এক রসঘন-আনন্দ ভূবন উপহার দিয়েছেন। তার প্রহসণ ও নাটকে এত বেশি হাস্যরস থাকতো যে, তার নাটক দেখার জন্য লোকজন উপছে পড়তো। ব্যঙ্গ হাস্যাত্মক নাটক রচনা ও অভিনয়ের জন্য তিনি সুধীসমাজে রসরাজ উপাধিতে ভূষিত হন। অমৃতলাল বসু রচিত নাটক, প্রহসন ও নক্সাজাতীয় গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। এগুলোর মধ্যে তিলতর্পণ (১৮৮১), বিবাহবিভ্রাট (১৮৮৪), তরুবালা (১৮৯১), কালাপানি (১৮৯২), বাবু (১৮৯৩), বিমাতা (১৮৯৩), আদর্শ বন্ধু (১৯০০), অবতার (১৯০২), চোরের উপর বাটপাড়ি প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নাটক ছাড়াও তিনি আত্মজীবনী, কবিতা, উপন্যাস ও গল্প লেখিয়ে হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। পুরাতন প্রসঙ্গ, পুরাতন পঞ্জিকা ও ভূবনমোহন নিয়োগী অমৃতলাল বসুর লেখা আত্মস্মৃতিমূলক রচনা।
 কবিতার সাথে সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবেও তিনি সুধীসমাজের দৃষ্টি কেড়েছেন। অধিকন্তু বাগ্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয় দক্ষতার অধিকারী। নাটকের মতো বক্তৃতা দিয়েও তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করতে পারতেন। কলমের মতো তার বদনও ছিল অপূর্ব বাক্যপ্রাত। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি এবং কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী পদকে ভূষিত করে।
 ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই এ মহান নাট্যকার মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যু সংবাদ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘শান্তি’ পত্রিকার একটি সংবাদ এখানে উদ্ধৃত করা হল: রসরা অমৃতলাল বসু আজ ইহলোকে নাই। গত ১৮ আষাঢ় তিনি তাহার শ্যামবাজার ভবনে মানবলীলা সংবরণ করিয়াছেন। এই হতভাধ্য দেশে মরণোম্মুখ জাতিকে অনাবিল হাস্যরসে অভিসিঞ্চিত করিয়াছেন- রসরাজ অমৃতলাল। বাংলা সাহিত্যে তাঁহার দানের পরিমাপ করিবার সময় এখনও আসেনি। মৃত্যুর দুদিন পূর্বে অসুস্থ শরীরেরও তিনি চলচ্চিত্রে ‘বিবাহ বিভ্রাট’ নাটকে অভিনয় করিয়াছেন; দুঃখের বিষয় তিনি উহা শেষ করিতে পারেন নাই।
 বাংলায় রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠাতাগণের মধ্যে অমৃলাল অন্যতম। আমরা অভিনেতাগণকে আজও উপযুক্ত সম্মান করিতে শিখি নাই। তাই অভিনেতারূপে অমৃতবাবু বাঙ্গালীকে অফুরন্ত আনন্দ রসের সন্ধান দিলেও আমরা তাঁহাকে উপযুক্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি দেই নই। - - -তাঁহার তিরোধানে বাঙ্গালী যাহা হারাইল তাহা আর পাইবে না। যে ক্ষতি হইল সে ক্ষতির আর পূরণ হইবে না।

No comments:

Post a Comment