কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১)
আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ধারার অন্তিম কবি ডাকপ্রশাসক কায়কোবাদ ১৮৫৭
খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁর প্রকৃত নাম কাজেম আলী কোরেশী, কায়কোবাদ তাঁর সাহিত্যিক
ছদ্মনাম। কায়কোবাদের পিতার শাহমত উল্লাহ আল কোরায়শী ওরফে এমদাদ আলী।
শাহামতুল্লাহ ছিলেন জেলা জজ আদালতের একজন আইনজীবী। তাঁর মায়ের নাম
জরিফউন্নেছা খাতুন। তিনি পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। আব্দুল খালেক ও আব্দুল
বারী নামের তাঁর আরও দুই ভাই ছিলেন। আব্দুল খালেক সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট
এবং আব্দুল বারী ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাতালের হাউস সার্জন ছিলেন।
পিতার কর্মস্থল ছিল ঢাকা। কাজেম আলী বাড়িতে মুরুব্বিদের নিকট থেকে আরবি ও
ফারসি ভাষা শিখেন। ছয় বছর বয়স হলে পিতা তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন
মুসলমান সমাজ ইংরেজি অধ্যয়নকে পাপ ও অখ্যাতিকর মনে করতেন। তবে তাঁর পিতা
ছিলেন কিছুটা উদার মনের। পিতা কাজেম আলী কোরেশীকে ঢাকার পগোজ স্কুলে ভর্তি
করে দেন। কিছুদিন এখানে পড়ার পর সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হন। অতঃপর
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ঢাকা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১১ বছর বয়সে তাঁর মা
মারা যান। এর পরের বছর মারা যান পিতা। এতিম কাজেম আলী আগলা গ্রামে ফিরে
আসতে বাধ্য হন। এক বছর গ্রামে অবস্থান করে আবার ঢাকায় এসে ঢাকা মাদ্রাসায়
ভর্তি হন। সেখানে এন্ট্রাস পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তবে এন্ট্রাস পরীক্ষায়
অংশগ্রহণের পূর্বে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নিয়ে আগলায় চলে আসেন।
কায়কোবাদ অত্যন্ত মেধাবী মননশীলতার অধিকারী ছিলেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক
লেখাপড়া তাঁর ভালো লাগত না। তিনি ছিলেন জন্মগতভাবে সৃজনশীল। অতি অল্প বয়সে
তাঁর সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে
তাঁর প্রথম কাব্য ‘বিরহবিলাপ’ প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে তিনি পিতা-মাতার বিয়োগ
ব্যথা প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের জীবনের কষ্টকে পরম সহানুভূতির সাথে তুলে
ধরেছেন। কাব্যটি প্রকাশিত হবার পর সর্বমহলে তিনি প্রশংসিত হন। ফলে তাঁর
উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। তিনি নিয়মিত কবিতা লিখে চলেন। ছাত্রজীবনে লিখিত
কবিতাগুলো সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কুসুম কানন
(১৮৭৩), অশ্র“মালা (১৮৯০৫), মহাশ্মশান (১৯০৪), শিবমন্দির (১৯২২), অমিয়ধারা
(১৯২৩), শ্মশান ভস্ম (১৯২৪) ও মহররম শরীফ (১৯৩২)। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত
কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- প্রেমের ফুল (১৯৭০), প্রেমের বাণী (১৯৭০),
প্রেম-পরিজাত (১৯৭০), মন্দাকিণী-ধারা (১৯৭১) ও গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ
(১৯৭৬) প্রভৃতি কাজেম আলী কোরেশীর বিখ্যাত গ্রন্থ।
‘মহাশ্মশান’
কায়কোবাদের একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এবং একমাত্র সার্থক মহাকাব্য হিসেবে
স্বীকৃত। ৭৯০ পৃষ্ঠাব্যাপী এ মহাকাব্যটি বাংলা সাহিত্যে মুসলিম গৌরব ও
সমকালীন অবস্থার প্রেক্ষপটে উদার দৃষ্টিভঙ্গীর সাহসী পদক্ষেপ। কাব্যে
কায়কোবাদ একদিকে স্বাজাত্যবোধ, দেশপ্রেম ও মুসলিমসমাজের ঐতিহ্য প্রকাশের
পাশপাশি বিশ্বশান্তি ও মানবতার কল্যাণে জাতিধর্ম বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের
সুসসম্পর্ক, পারস্পরিক সহানুভূতি এবং ঐক্য কামনা করেছেন। সম্পূর্ণ
অমিত্রাক্ষর পয়রা ছন্দে রচিত ‘মহাশ্মশান’ শুধু কায়কোবাদের নয়, মুসলিম কবি
রচিত শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবেও স্বীকৃত। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধাবলম্বনে রচিত
এ কাব্যে জয়পরাজয় অপেক্ষা ধ্বংসের ভয়াবহতা অধিক বিধৃত হয়েছে। তাই
মহাকাব্যটির নাম রাখা হয়েছে ‘মহাশ্মশান’। ‘মহাশ্মশান’ কাব্যের জন্য কবি
কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যে মহাকবির সম্মানে অধিষ্ঠিত। তাঁর গীতি কবিতায়
প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও মানব মনের সুপ্ত ইচ্ছা ফুটে
উঠেছে। এ কাব্যের জন্যে তিনি মাইকেল দি সেকেন্ড নামে অভিহিত হন।
পশ্চাৎপদ মুসলিম সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির
ধারায় সামিল করার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করাই ছিল কায়কোবাদের
সাহিত্যকর্মের মুল উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে তিনি তাঁর কাব্যে মুসলমানদের অতীত
ঐতিহ্য, বীরত্ব এবং মাহাত্ম্য সম্পর্কে সচেতন করার সঙ্গে সঙ্গে তা
পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শিক্ষিত, ঐক্যবদ্ধ এবং তেজিয়ান হবার আহ্বান
জানিয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের পুনজাগড়ণের একনিষ্ঠ প্রত্যাশী হলেও তিনি
নিজে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে এ অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয়
ফুটে উঠেছে। তিনি হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জন্য কবিতা রচনা করেছেন।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মুল
অধিবেশনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা কাব্য সাহিত্যে অবদানের
জন্য নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও
‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই ৯৪ বছর
বয়সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে মহাকবি কায়কোবাদ মারা যান। ঢাকার
আজিমপুর গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
No comments:
Post a Comment