Translate

Saturday, 6 October 2018

অণ্ড ডিম্ব ডিম / ড. মোহাম্মদ আমীন



সেমিনারের পর ডিনার। 
ক্যামব্রিজের মেডিংলে হল-এর বিশাল ডাইনিং রুম আলো আর রসনার কোলাকোলি। আমার সামনে প্রফেসর মাসাহিতো ও প্রফেসর নন্দিতা চোপড়া, ডানে প্রফেসর রচনা, বামে ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজের খাদ্য-পুষ্টি বিভাগের প্রফেসর ড. ক্যাথরিনা ক্যাসলার এবং তার পাশে দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর কিচুকি।
কিচুকির বয়স শ ছুঁই ছুঁই করছে। নন্দিতা চোপড়ার ওজন দেড়শ কেজির মতো হবে। আসল দাঁত একটাও নেই, তবে নকল দাঁতের হাসিটা নন্দিতার মোটা শরীরকে প্রত্যুষের মতো নন্দিত করে রাখে। তিনি বলেন, আমি চর্বিনদী। ক্যাথরিনা এবং আমি ছাড়া বাকি সবাই অক্সফোর্ডের শিক্ষক।
আমাদের সামনে নানা উপাদেয় খাবার। আমার চোখ-মন অণ্ড মানে ডিম্বে সমাহিত। এক সময় ডিম্ব দেখলে পৃথিবীর সব রস-লালসা জিহ্বায় এসে ভিড় করত। এখনো করে, তবে খাই না। বয়স বাড়লে নাকি ডিম কম খাওয়া ‍উচিত।
ক্যাথরিনা আমার দিকে ডিমের ডিশটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন প্রফেসর।
“থ্যাংক ইউ”আমি ডিম্বের ডিশটা রচনার দিকে ঠেলে দিয়ে বললাম, আমি খাব না, তুমি নাও।
খাবেন না কেন? ক্যাথরিনা ক্যাসলার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন নয় যেন, পুলিশের জেরা।আমি বললাম, বয়স হয়েছে। ডিম্ব খেলে কোলেস্টরেল বেড়ে যায়।
ডিম্ব খেলে কোলেস্টরল বাড়ে এটা ঠিক, তবে সেটি এইচডিএল- ভালো কোলেস্টরল। শরীরে এইচডিএল যত বাড়বে শরীর তত বেশি চাঙ্গা থাকবে। প্রফেসর, আপনি কি চাঙ্গা থাকতে চান না?
ডিম্ব না কি স্ট্রোকের আশংকাও বাড়িয়ে দেয়?
প্রফেসর ক্যাথরিনা দৃঢ় গলায় বললেন, একদম বাজে কথা। আমার এখন সেভেন্টি থ্রি। প্রতিদিন চারটা করে ডিম খাই। প্রতিদিন ডিম খাবেন তবে কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দেবেন। তাহলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যাবে। তবে ডায়াবেটিকস রোগীদের ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
মাসাহিতো বললেন, আমি কিন্তু প্রতিদিন তিন-চারটা ডিম খাই।
ক্যাথরিনা বললেন, ডিমে রয়েছে ভিটামিন এ, ই, বি৬, বি১২, থিয়ামিন, রিবোফ্লেবিন ফলেট, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম-সহ শরীর-গঠনে সহায়ক আরো নানা উপাদান। মাসাহিতো ম্যাম, আপনি ডিম খান বলেই আপনার চুরাশীয় শরীরকে আটচল্লিশীয় মনে হয়। হাড় শক্তকরণে ক্যালসিয়ামের কোনো বিকল্প নেই। ক্যালসিয়াম শোষণ করার কারণে হাড় মজবুত হয়। শোষণ-কর্মটা করে ভিটামিন-ডি। ডিমে কিন্তু প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি আছে।
কিচুকি বললেন, আমার হয়েছে জ্বালা।
কী হয়েছে? ক্যাথরিনা বললেন।
বয়স যত বাড়ছে স্মৃতিশক্তি তত কমছে। মস্তিষ্কে কোলিনের সরবরাহ কমে গেছে। তাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে সব ভুলে যাই। কী করি বল তো ক্যথরিনা?
ক্যাথরিনা বললেন, স্যার, ডিম্ব কোলিনের ভাণ্ডার। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং স্মৃতিশক্তিটাও সচল রাখে। আপনি ডিম্ব খান না?
কিচুকি চশমটা নামিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, মগজ ঠিক রাখলাম, কিন্তু চোখ? চোখে কম দেখি কেন? তাও কি অণ্ডের অভাব?
হ্যাঁ।
সব অঘটনই অণ্ডের অভাবে ঘটে?
ক্যাথরিনা : অণ্ডে রয়েছে লুটিন, জিজেনন্থিন, ক্যারোটিনয়েড ভিটামিন। এগুলো দৃষ্টিশক্তির মহৌষধ। প্রবীণদের চোখের জটিলতা কমানোর জন্যই প্রকৃতি ডিম নামের ডিম্বাকৃতির গোলকটায় এতগুলো উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছেন। স্যার, আপনার প্রতিদিন কমপক্ষে দুটো অণ্ড খাওয়া উচিত।
আগামীকাল থেকে চারটা করে খাব।
তাহলে আরো ভালো।
রচনা মায়ের খবর কী? প্রফেসর কিচুকি বললেন।
আমি এত ব্যস্ত থাকি যে, খাওয়ার সময়ই পায় না। পর্যাপ্ত প্রোটিন নিতে পারি না।
“আমিও পাই না”, প্রফেসর ক্যাথরিনা বললেন, “ ডিম্ব যেমন সস্তা, তেমনি সহজভক্ষ্য, রান্না না-করেও খেয়ে ফেলা যায়, খেতেও বেশিক্ষণ লাগে না, ছেলেবুড়ো সবাই খেতে পারে সহজে, দাঁতেরও প্রয়োজন নেই। কুসুমটা প্রোটিনের কোহিনুর। এতে প্রোটিনের পরিমাণ মাংসের সমান। প্রতিদিন দুটো করে ডিম্ব খেলে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়।
অণ্ড না কি চর্বি বাড়ায়? নন্দিতা বললেন।
ক্যাথরিনা : মাংসের প্রোটিন চর্বি বাড়ায় কিন্তু ডিম্বের প্রোটিন মাংস বাড়ায়। ডিম্ব অ্যামাইনো অ্যাসিডের সাগর। শরীর যাতে ঠিক মতো প্রোটিনকে কাজে লাগাতে পারে, অ্যামাইনো অ্যাসিড সেটি দেখভাল করে। আমার স্বামী প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধ কেজি মাংস গিলে। গিলিত মাংস যাতে চর্বি হতে না পারে সেজন্য সে মাংস খাওয়ার পর একটা ডিম্ব খেয়ে ফেলে।
কিচুকি বললেন, বুঝেছি।
কী বুঝেছেন?
তোমাদের মতো ব্যস্ত, আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত দরিদ্র, নন্দিতার মতো দন্তহীনদের জন্য ইশ্বর অণ্ড নামের গোলকটায পৃথিবীর সব কিছু ভরে দিয়েছেন।
কিন্তু অণ্ডটা কে সৃষ্টি করল? মাসাহিতো বললেন।
কিচুকি : ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্তই অণ্ড সৃষ্টি করেছেন। আসলে এটাই পৃথিবী। এজন্য পৃথিবীকে বলা হয় ব্রহ্মাণ্ড। মানে ব্রহ্মের অণ্ড।
নন্দিতা : গণিতের শূন্যটাও অণ্ড। এই শূন্য ছাড়া গণিতও অর্থহীন। গণিত অর্থহীন মানে সবকিছু অর্থহীন। কারণ, গণিতই বিজ্ঞানের বাবা।
মা-টা কে? কিচুকি বললেন।
নন্দিতা : অণ্ড।
--------------------------------
সূত্র : আমার লেখা রায়োহরণ উপন্যাসের একটি অধ্যায়।

Monday, 21 May 2018

বিশ্বকাপ ফাইনাল / ড. মোহাম্মদ আমীন


আজ স্বপ্ন দেখলাম, স্বপ্ন দেখলাম জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, মূখ্যমন্ত্রীশাসিত রাজ্যে 
প্রতিটি জেলা, বিভাগে
প্রতিটি উপজেলা, স্বয়সম্পূর্ণ জেলায়
প্রতিটি ইউনিয়ন, এক একটি উপজেলায়
প্রতিটি ওয়ার্ড, চেয়ারম্যানের আওতাধীন ইউনিয়নে 
প্রতিটি পাড়া, মেম্বারের অধীন ওয়ার্ডে এবং বিশ্বাস করুন,
প্রতিটি বাড়ি আয়তন অনুপাতে কমিউনিটি সেন্টার, শপিং মল, মাঠ, বিল বা পুকুরে পরিণত হয়েছে। আমাদের গ্রামের বাড়িটা একটু বড়ো। দেখলাম অবাক হয়ে, এটি ফুটবলের মাঠ হয়ে গেছে। এত বড়ো বাড়িতে থাকব কীভাবে? 
হায় হায়!
স্বপ্নরাজ জানাল, আগামী ১৫ই জুলাই, ২০১৮, রোববার রাত ৯টায় মস্কোতে বিশ্বকাপের যে ফাইনাল অনুষ্ঠানের কথা ছিল তা ওখানে হবে না।
কোথায় হবে?
ফুটবল মাঠের মতো বিশাল হয়ে যাওয়া তোমাদের চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে। লোকজন বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার জন্য দলে দলে চট্টগ্রাম যাওয়া শুরু করেছে। তাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২০ কিলোমিটার যানজট। ফাইনালের আগে এই জট কমবে না।
জানতে চাইলাম, ফাইনাল খেলবে কোন দুটি দেশ?
স্বপ্নরাজ বলল, দুই নয়, তিন দেশ একসঙ্গে খেলবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা একত্রে ফাইনাল খেলবে। 
কীভাবে জানলে?
স্বপ্নরাজ বলল, বিশ্বকাপের অনেক বাকি। তারপরও তোমাদের দেশের যুবশক্তি যেভাবে ব্রাআ-ব্রাআ করছে তাতে সারা ফুটবল বিশ্ব ভয় পেয়ে কাঁপছে। তাদের ধারণা বাংলাদেশি এসব লোকেরা পাগল হয়ে গেছে। হুজুগে, অথর্ব, নিষ্কর্মা এবং ঐতিহ্যহীন কিছু কিছু বাংলাদেশি যেভাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে পরপূজকের মতো মস্তক অবনত করে যাচ্ছে তাতে মনে তাদের কোনো দেশ নেই, ভাষা নেই, ঐতিহ্য নেই, স্বকীয়তা নেই, কর্ম নেই, বিবেচনা, বই নেই, সাহিত্য নেই, সংস্কৃতি নেই।
তাহলে তাদের কী আছে?
পরনির্ভরশীল মন। তাদের অর্থহীন চিৎকারে বিশ্বের তাবৎ ফুটবল খেলোয়াড়দের হাত-পা অবশ হয়ে পড়েছে ভয়ে। তাদের কানের পর্দা ফেটে গেছে বাংলাদেশিদের ব্রাআ-ব্রাআ পাগলা চিৎকারে। বাংলাদেশিরা ল্যাটিন আমেরিকার যে দুটি দেশ নিয়ে এমন লজ্জাকর লাফালাফিতে উন্মাদ, বলা যায় সেই দেশদুটির প্রায় কোনো লোকই বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত জানে না। দু-একজন হয়তো দাপ্তরিক প্রয়োজনে জানতে পারে।
স্বপ্নরাজকে বললাম, বাংলাদেশের সঙ্গে যদি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলা হয়, তাহলে বাংলাদেশিরা কেন বাংলাদেশের কথা না বলে ব্রাআ-ব্রাআ করছে?
স্বপ্নরাজ বলল, এদের দেশপ্রেম নেই। এরা মাতৃভাষাটাও ভালো জানে না। 
তাই বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও এদের আচরণ দেশদ্রোহী রাজাকারদের মতো 
ভয়ংকর। মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় তারা ‘পরধনলোভে মত্ত’। বিবেচনাশূন্য এসব বাংলাদেশিরা নিজের দেশের মাটির উপর দণ্ডায়মান ঘরের ছাদে, ভবনের শৃঙ্গে, বৃক্ষের শিখরে বিদেশের পতাকা ওড়ায়। এরা পুরোই ঐতিহ্যহীন, ছি! তোমার লজ্জা করে না এদের দেখে?
এরা ফুটবল প্রেমিক, লজ্জা করবে কেন?
এদের বুকে দেশপ্রেমের চিহ্নমাত্র নেই। তাই নিজের বুকে বিদেশি পতাকা লাগিয়ে গর্বভরে ঘুরে বেড়ায়। নিজের গায়ে বিদেশি নামাঙ্কিত জামা জড়িয়ে ঐতিহ্য ও স্বকীয়হীনতাকে আরো উগ্র করে তোলে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন বিদেশ-বন্দনা দেখা যায় না। যারা নিজের দেশ, ঐতিহ্য আর স্বকীয়তাকে অবহেলা করে অন্য দেশের পূজো-বন্দনায় আনত হয় তাদের দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ হতে পারে না।
ঠিক বলেছে স্বপ্নরাজ।জাতীয় দিবসেও বাংলাদেশিরা এত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে না, বিশ্বকাপে যত বিদেশে পতাকা উত্তোলন করে। এমন হীনম্মন্য জাতি পৃথিবীতে আর নেই।
তাদের বোধোদয় হোক। কামনা করি, যেভাবে তারা বিদেশ-প্রেম ও বিদেশ-বন্দনায় উন্মাদ সেভাবে তারা যেন স্বদেশ-বন্দনায় রত হয়।
তাতে তোমার লাভ? 
আমার প্রশ্নের উত্তরে স্বপ্নরাজ বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট সেই, যে নিজ দেশকে অবহেলা করে নিজের দেশে বসে পরদেশের বন্দনা করে। এরা আমার স্বপ্নকেও কুলষিত করে দিয়েছে। ছি বাঙালি ছি!

Wednesday, 9 May 2018

জীবনান্দ / ড. মোহাম্মদ আমীন


১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তথা বর্তমানে বাংলাদেশর বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার অধিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে চলে আসেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবেও তিনি খ্যাত ছিলেন।
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন বিখ্যাত কবি। আদর্শ ছেলে তার একটি বিখ্যাত কবিতা। ওই কবিতায় তিনি লিখেছেন,
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে।
জীবনানন্দ পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তার ডাকনাম ছিল মিলু। ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তাকে ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। দু’ বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন।
জীবনানন্দ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ওই বছর ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল বর্ষ আবাহন। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয়নি, কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল। তবে ম্যাগাজিনটির বর্ষশেষের নির্ঘন্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয়: শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, বিএ। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগ-সহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রেও অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তার স্মরণে ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম কাব্য ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি দাশগুপ্তের বদলে কেবল দাশ লিখা শুরু করেন।
প্রথম কাব্য প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি সিটি কলেজের চাকরিটি হারান। কলকাতায় তার কোনো কাজ ছিল না। তাই তিনি বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে তিন মাস পর পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় জীবনধারণের জন্যে তিনি টিউশানি করতেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মে তিনি লাবণ্য দেবীর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের পর আর দিল্লি ফিরে যাননি। এরপর প্রায় পাঁচ বছর কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। কিছু দিন ইনসিউরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। এই সময় ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি তাঁর বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ কবিতা রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে 'রূপসী বাংলা' কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ ব্রজমোজন কলেজে ফিরে এসে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
দেশবিভাগের কিছুদিন আগে তিনি বিএম কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর আর পূর্ববঙ্গে ফিরে আসেননি। কলকাতায় তিনি দৈনিক স্বরাজপত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন কয়েক মাস। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে তিনি দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন – মাল্যবান ও সুতীর্থ, তবে আগেরগুলোর মতো ও দুটিও প্রকাশ করেননি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে তাঁর পঞ্চম কাব্য 'সাতটি তারার তিমির' প্রকাশিত হয়। একই মাসে কলকাতায় তার মাতা কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে। ততদিনে জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে 'বনলতা সেন' সিগনেট প্রেস হতে পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ঘোষিত “রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরষ্কার” লাভ করে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা'। বইটি ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের “সাহিত্য একাডেমি” পুরষ্কার লাভ করে।
চাকুরি ও জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু নিগৃহ হতে হয়েছে। একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশের অনুরোধে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন। এ সময় কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশকে কদাচিৎ কাছে দেখা গেছে। তখন তিনি টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একদিন বাসায় এসে বাড়িতে এত লোক দেখে স্ত্রী বলেছিলেন, জীবনানন্দ এত জনপ্রিয় হলো কবে থেকে।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর জীবননান্দ দাশ মারা যান। আসলে তিনি ট্রামের নিচে পড়ে আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।গত এক শত বৎসরে কোলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কেউ মারা যায়নি।
জীবদ্দশায় তিনি তেমন খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। মৃত্যুর অব্যবহিত পর বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতায় শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম একজনে পরিণত হন। তিনি কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। তবে তিনি ঔপন্যাসিকও লিখেছেন। তার লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ১৪ এবং গল্পের সংখ্যা শতাধিক।

উন্নয়নশীল ও অনুন্নত / ড. মোহাম্মদ আমীন


কোনো ভদ্রলোক অপ্রিয় কথা সোজাসুজি বলতে চান না। কিন্তু অপ্রিয় কথাটি যখন না
বললেই নয়, তখন ব্যক্তিত্ব বা মানসম্মান কিছুটা হলেও রক্ষার জন্য একটু ঘুরিয়ে শোভনীয়ভাবে বলেন। ইংরেজিতে শব্দ চয়নের এই কৌশলকে Euphemism বলা হয়। বাংলায় এটি মঞ্জুভাষণ। ‘চাল নেই’ বলাটা লজ্জাকর মনে করেন অনেকে। তাই বলেন, চাল বাড়ন্ত। ভিক্ষকুকে ভিক্ষা দেওয়ার অপারগতা প্রকাশ করা হয়, ‘মাফ করো’ কথা দিয়ে। কিন্তু তাতে ভিক্ষুকের ঝুলিতে কিছু পড়ে না। না-পড়লেও ভিক্ষুক কিছুটা মানসিক তৃপ্তি পায়। সাহেব তার কাছে মাফ চেয়েছেন। সাহেবও খুশি হয়ে যান, শুধু কথা দ্বারা খুশি করা গেল।বেড়াতে গেলেন দার্শনিক। তিনি আবার নেতিবাচক কোনো কথা বলেন না। মিথ্যাও বলেন না। দুর্ভাগ্যবশত তার পাতে পড়ল একটা পচা ডিম। মুখে দিতে গিয়ে গন্ধ পেয়ে রেখে দিলেন বোন প্লেটে। গৃহস্বামী বললেন, ডিমটা কি ভালো না?দার্শনিক বললেন, খুব ভালো। তবে কিছুটা রাসায়নিক পরিবর্তন হয়েছে।কেউ নিজের দুর্বলতা ফলাও করে প্রচার করতে চায় না। যতটুকু সম্ভব ঢেকে রাখতে চায়। কিন্তু যখন প্রকাশ না করে উপায় থাকে না, তখন এমনভাবে প্রচার করে যেন, মানসম্মান কিছুটা হলেও বজায় থাকে। করিম সাহেবের ছেলে ছাত্রজীবনে সব পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ পেয়েছে। অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার ছেলে কোন বিভাগ পেয়েছে। ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছ বলতে পারলে ভালো লাগত কিন্তু ডাহা মিথ্যা তো আর বলা যায় না। হাস্যকর হয়ে যাবে।তাই বলেন, আমার ছেলে জীবনে কখনো ফেল করেনি।সচিবালয়ে এখন কোনো কেরানি নেই। আগের সব প্রধান কেরানি এখন প্রাশাসনিক কর্মকর্তা। সব পিয়ন এক কলমের খোঁচায় ‘অফিস সহায়ক’ নামে বারিত। তহশিলদার পদ বিলুপ্ত, তারা ইউনিয়ন ভুমি সহকারী কমর্কতা। পদের নাম শোভনীয় হয়েছে কিন্তু কাজ একই।গলি আর অ্যাভিনিউ এবং মামলেট আর ডিমভাজির মধ্যে তফাৎ কেবল নামে।
অনুন্নত শব্দটি নেতিবাচক। ইংরেজিতে বলা হয় আন্ডার ডেভেলাপমেন্ট। অর্থাৎ উন্নয়নের নিচে। উন্নয়নশীল শব্দের অর্থ ডেভলাপিং অর্থাৎ উন্নয়নকে ধরার চেষ্টায় রত। ‘আন্ডার ডেভেলাপমেন্ট’ এবং ‘ ডেভেলাপিং’ দুটোর অবস্থানই উন্নয়নের নিচে। উন্নয়নের নিচে কেউ থাকতে চায় না। কিন্তু উন্নয়নের ওপরে ওঠাও সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থানকে অপ্রকাশ্য রাখাও যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নিজের সম্মান রক্ষার্থে কী বলা উচিত? আপনার অবস্থান কোথায়?উন্নয়নের নিচে বলাটা সমীচীন হবে না। মান-সম্মানের ব্যাপার।তাই বলব, উন্নয়নকে ধরার চেষ্টা করছি। মানে উন্নয়নশীল।ডিমভাজা ও মামলেট, তহশিলদার এবং ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, পিয়ন আর অফিস সহায়ক, হেডক্লার্ক এবং প্রাশাসনিক কর্মকর্তা যেমন, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল কথাটাও ঠিক তেমন।

শিশ্ন আকৃতির ফল / ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রকৃতির মতো বৈচিত্র্যময় আর কিছু নেই। বৈচিত্র্যময় বলে তার খেয়ালও বৈচিত্র্র্যময়।
এক ব্রাজিলিয়ান মালি বহু বছর আগে উত্তর ব্রাজিলের প্রত্যন্ত San Jose de Ribamar
এলাকায় এক বিশেষ প্রজাতির প্যাশান ফ্রুট (passion fruit) এর সন্ধান পান। মনুষ্য শিশ্ন-আকৃতির ফ্রুটটি তাকে বিস্মিত করে দেয়। তার চেষ্টায় ফলটির কথা অনেকে জেনে যায়। এরপর এটি দক্ষিণ আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ প্যাশান ফ্রুটটি এখন ব্রাজিল-সহ দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যন্ত বিলাসবহুল হোটেলসমূহে ডেজার্ট থেকে শুরু করে তরকারি, সালাদ এবং ফল হিসেবে খাওয়া হয়। আকার অবিকল শিশ্নের মতো বলে ফলটি তার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি কদর পেয়ে থাকে। আসলে, ব্যতিক্রমে মানুষের আগ্রহ চিরকাল। কথিত হয়, ইভ এই ফলের রসই খেয়েছিলেন। 
ব্রাজিল কৃষি বিভাগের গবেষক Marcelo Cavallari- এর ভাষায়, “এটি যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যকর। দেখলে প্রথমে মাথা ঘুরে যায়। দেশি-বিদেশি সবাই ফলটি আগ্রহ
সহকারে দেখতে চায়। তবে এর চাষাবাদ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল এবং ফলনের হারও অত্যন্ত কম। তাই প্রচুর জনপ্রিয়তা এবং দাম সত্ত্বেও ফলটির ফলন খুব কম। ” কীভাবে ফ্রুটটি এমন আকৃতি পেল তা জানা যায়নি।কৃষিবিদদের ধারণা- প্রকৃতিগতভাবে ফলটি এমন আকার পেয়েছে। 
৫৫ বছর বয়স্ক Brazilian মালি Maria Rodrigues de Aguiar Farias এই প্যাশান
ফ্রুটের বাগান করে অল্প সময়ে বেশ ধনী হয়ে যান। তিনি, তার বাসায় এই ফলের বাগান সৃজন করেন। পারিয়াস, দর্শনার্থীদের অর্থের বিনিময়ে এই প্যাশান ফ্রুটের ছবি তোলার অনুমতি দিয়ে থাকেন। শুধু দেখার জন্য দুই রিয়াল, ছবি তোলার জন্য ১৫ রিয়াল এবং ভিডিও করার জন্য ২০ রিয়াল দিতে হয়। আমি কিন্তু এই ফলটি দেখিনি, ছবি দেখেছি। আবার ব্রাজিল গেলে দেখার চেষ্টা করব।
আপনার কি কেউ দেখেছেন?

ম্যালামাইন নন্দিত বিষ / ড. মোহাম্মদ আমীন


খাদ্যগ্রহণের পাত্র হিসেবে যারা যত বেশি ম্যালেমাইনের তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করেন, তাদের মেধা, সৃজনশীলতা, স্থৈর্য এবং দূরদর্শী চিন্তা তত বেশি ব্যহত হয়। এটি একটি জৈব যৌগ। যার গাঠনিক
সংকেত C3H6N6। মেলামাইনের বিষাক্ত কণা খাদ্যের সঙ্গে মিশে শরীরের অন্যান্য অংশের মতো নিউরনেও আঘাত হানে। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে শিশুদের। এভাবে অতিরিক্ত ম্যালামাইনের যথেচ্ছ ব্যবহার উন্নয়নশীল দেশ-সমূহের শিশুদের মেধা ধীরে ধীরে হ্রাস করে দিচ্ছে। আমরা অসচেতন, বলতে গেলে প্রায় অজ্ঞ পিতামাতা নন্দিত হাস্যে আমাদের শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছি এই মারাত্মক বিষ। 
অ্যামোনিয়াম থাইয়োসায়ানাইড থেকে উদ্ভুদ মেলাম ((melam) এবং আমিন (amine) শব্দ থেকে মেলামাইন শব্দের উদ্ভব। শব্দটির উৎস গ্রিক এবং এর অর্থ কালো। এই কালো বলতে বুঝানো হয়েছে মোহনীয় ভয়ঙ্কর। দেখতে সুন্দর হলেও এটি প্রাণীদেহের জন্য মারাত্মক কাল বা ক্ষতিকর।
খাদ্যবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদের অভিমান, ম্যালামাইন ফরমালিনের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। নানা রঙেঢঙে সজ্জিত মেলামাইনের পাত্র দেখে শুধু শিশু নয়, শিশুর প্রপিতামহ পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কত মজা করে ব্যবহার করা হয় ওই সজ্জিত পাত্রপাত্রী। কিছুদিনের মধ্যে রং আর আগের মতো থাকে না। পুরানো বউয়ের গোমড়া মুখের মতো বিমর্ষ হয়ে যায়। কোথায় যায় মেলামাইনের বিষাক্ত কণায় মেশানো ওই রং?
আপনার আমার শরীরে। 
ইউরিয়া ও ফরমালডিহাইডের মিশ্রণে মেলামাইন রেজিন তৈরি হয়। দুটোই সাধারণভাবে প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। তবে, কেউ যদি নিজেকে উদ্ভিদ মনে করেন, সেটি অন্য কথা। এই প্রসঙ্গে ইউরিয়া অল্প আলোচনা আবশ্যক মনে করছি। তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং আ্যমোনিয়ার মিশ্রনকে উচ্চচাপে এবং 130-150 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে ইউরিয়া উৎপাদন করা হয় ইউরিয়ার ৪৫%ই উদ্ভিদের প্রধান পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন । তাই এটি সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।কেউ যদি মনে করেন, ইউরিয়া, উদ্ভিদের মতো মানুষেরও পুষ্টি যোগায়, তাহলে তিনি প্রতিদিন মুড়ির মতো কয়েক মুঠো ইউরিয়া সার চিবোতে পারেন। অনেক দেশে, দুধ বা পুষ্টিকার খাদ্যসমূহে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি দেখানোর জন্য ম্যালামাইন মেশানো হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অষ্টাদশ শতকের পর ম্যালামাইনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানী লোকের বিকাশও কমে গেছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন-এর ( ১৬৪৩ – ১৭২৭) শতবর্ষ পর বিশ্ব পেয়েছে আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯ - ১৯৫৫)। তারপর?
একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, তাপের অনুপস্থিতিতে মেলামাইন-রেজিন সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। তবে তাপের প্রভাবে, তা যতই সামান্য হোক না কেন, ম্যালামাইন পরিবর্তিত হতে শুরু করে, বিশ্লিষ্ট হতে থাকে তার শরীরে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত উপাদান-সমূহ। তাই ওভেনে মেলামাইন-পাত্র দেওয়া উচিত নয়। আমার অনুরোধ- একাজটি করবেন না। কেউ করলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। আমি দিই না কিন্তু বউ দিয়ে দেয়, নিষেধ করলে বলে, অত উপদেশ দিও না। যাই হোক, এটি আমাদের দাম্পত্য বিষয়, আসল কথা হচ্ছে ক্ষতি, মেধাশূন্য ভবিষ্যপ্রজন্ম। আপনি কী চান আপনার শিশুটা মেধাশূন্য হয়ে যাক? আর একটা বিষয়, মেলামাইনের তৈজস বহুল প্রচলিত হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, মেলামাইন মানুষের মানসিক স্থৈর্যকেও স্পর্শকাতর করে তোলে।
তাপের সংস্পর্শে মেলামিন রেজিনের রাসায়নিক উপাদানগুলো আলাদা হয়ে পড়ে, যা বিষাক্ততার জন্য দায়ী। মেলামাইনের পাত্রে পরিবেশিত গরম খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তা ছাড়া কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া এবং কিডনির ক্যান্সারও হতে পারে একই কারণে। তাইওয়ানে মেলামাইন নিয়ে একটি গবেষণা থেকে এই বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পেয়েছিলো বিশ্ববাসী। মেলামাইনের পাত্রে গরম খাবার পরিবেশন করলে উচ্চ তাপমাত্রায় মেলামাইনের কিয়দংশ খাবারে মিশে যায়। আমেরিকায় পরিচালিতক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ম্যালামাইনের তৈরী পাত্র নয়, ম্যালামাইনের তৈরী যে কোনো কিছুই ক্ষতিকর। এমনকি সেটি যদি টেবিল ক্লথও হয়। 
দেশের ৭৭ ভাগ মানুষ সীসাজনিত দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। শহরে এর পরিমাণ শতকরা ৯৭.৭ ভাগ এবং গ্রামে ৯৩.৭ ভাগ। এছাড়া দেশের ৮৮ ভাগ মানুষ কোন না কোনভাবে সীসাজনিত দূষণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত রং থেকে এ সীসা ছড়াচ্ছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। কিন্তু কেন? সিরামিক ও ম্যালামাইনের তৈজসপত্রের প্রচুর ব্যবহারই এর অন্যতম কারণ। ম্যালামাইনের তৈরী রঙ্গিন পাত্র থেকে সীসা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি করছে। 
সীসা খুবই বিষাক্ত পদার্থ। এটি সব সবার জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশুদের জন্য মারাত্মক। সীসাযুক্ত রং সবচেয়ে মারাত্মক এবং আপনি জানেন বা না জানেন এটিই ব্যবহৃত হচ্ছে ম্যালামাইনে।ম্যালামাইনে ব্যবহৃত এই রং খুব সহজে খাদ্যকণার সাথে মিশে যায়। বিশ্বাস হয় না! তা না হলে ম্যালামাইনের পাত্র কেনার কয়েক মাস পর রঙচঙে রং কেন ওঠে যায়। ফলে শিশুরা বিষক্রিয়ার শিকার হয়। এতে মস্তিস্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, আচারণগত সমস্যা দেখা দেয়, শ্রবণে সমস্যা হয়, মাথাব্যথা সব সময় লেগে থাকে, পুরুষ ও মহিলাদের প্রজনন সমস্যা দেখা দেয়, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং স্নায়ুচাপ দেখা দেয়, স্মৃতি শক্তি কমে যায়, ঘুম কমে যায় এবং পেশী ও হাড়ের সংযোগ স্থানে ব্যথা হয়। পঙ্গুত্ব বা অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ায়। 
এজন্য অনেকে মনে করেন, ম্যালামাইন মানে মেলা মাইন।মাইন শব্দের অর্থ বারুদ দ্বারা স্থাপনাদি ভূমিসাৎ করিবার লক্ষ্যে এর নিচে খনন করা সুড়ঙ্গ। সুতরাং ম্যালামাইন আমাদের সমুদয় প্রতিভাকে, প্রাণশক্তি আর চাঞ্চল্যকে ধ্বংস করার একটি মারাত্মক মাইন। 
মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার- একই সঙ্গে বাড়ছে বিষ। খাদ্য, পাত্র, মাটি, বাতাস, শয়ন সবখানে বিষ। এত বিষ চারিদিকে, বিজ্ঞানের বিনাশ ছাড়া বিষমুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। তবে কিছুটা সাবধান থাকা যায়, তাহলে বিষ কিছুটা কম ঘেষতে পারবে। Something is better than nothing.

Friday, 16 March 2018

হকিং-এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম / ড. মোহাম্মদ আমীন



বাঙালি আত্মমর্যাদাহীন জাতি
নিজের ভাই মহাশয়, এই জ্বালা কি প্রাণে সয়!
হকিং এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম।
চতুর্থ প্রয়াণ-দিবসে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্মরণ : --------------
স্টিভেন হকিং নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় লেখালেখি আমার কাছে মনে হয়েছে অতিরঞ্জিত ও হীনম্মন্যতাপূর্ণ। কারণ এর চেয়ে বড়ো বিজ্ঞানী আমাদের ছিল কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমরা এমন করিনি। তাই হকিংকে নিয়ে লেখা আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে এবং হয়। এই বাড়াবাড়ি দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, আসলে বাঙালির কোনো আত্মমর্যাদা নেই। নেই স্বকীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার সামর্থ্য। তারা কেবল নিজেদের অবহেলা করে পরকে মাথায় নিয়ে নাচে। তাই অনেক মেধাবী থাকা সত্ত্বেও আমাদের অবস্থান পাতালের অতলে।

বলছিলাম, হকিং এর চেয়ে অনেক মেধাবী এবং বড়ো বিজ্ঞানী বাংলাদেশে ছিল। তিনি জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম। জন্মকালীন
তাঁর পিতা চাকরিসূত্রে ঝিনাইদহ অবস্থান করছিলেন। বলা হয়, আধুনিক বিশ্বের সাত জন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর নাম নিলেও জামাল নজরুল ইসলামের নাম চলে আসবে।তিনি সারা বিশ্বে জেএন ইসলাম নামে পরিচিত এবং বিজ্ঞানীদের কাছে বাংলাদেশ জেএন ইসলামের দেশ হিসেবে পরিচিত।

জেএন ইসলাম ছিলেন ক্যাম্ব্রিজে হকিং এর রুমমেট, বন্ধু এবং সহকর্মী। প্রায় সার্ধ ডজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেএন ইসলামকে বলা হতো আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম মেধাবী মানুষ। কেন এমন বলা হতো, তার দুটি উদাহরণ দিই। ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি থেকে গণিতে ট্রাইপস পাস করতে লাগে তিন বছর। জেএন ইসলাম তা দুই বছরে শেষ করে বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের পৃথিবী তাবৎ বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কয়েকজন বিখ্যাত বিশ্বতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানী এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের শরণাপন্ন হন। জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে পৃথিবীর মানুষকে আস্বস্ত করে বলেছিলেন, সে রকম কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ একই সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের কোনো ক্ষতি হবে না।

চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় এত ভালো করেছিলেন যে, শিক্ষকৃবন্দ তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে এক শ্রেণি উপরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষক ফাদার গোরে

জেএন ইসলামকে ডাকতেন জীবন্ত কম্পিউটার। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যেখানে কম্পিউটার ও ক্যালকুলেটর নিয়ে কাজ করতেন সেখানে জেএন ইসলাম এগুলি ছাড়া বড়ো বড়ো হিসাব মুহূর্তে করে দিতেন কোনো যন্ত্র ছাড়াই। তিনি বলতেন, কম্পিউটার আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। তবে তিনি কম্পিউটারের সাধারণ প্রয়োজনীয়তা কখনো অস্বীকার করেননি।

একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বতত্ত্ববিদ ও অর্থনীতিবিদ জেএন ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হকিং বলেছিলেন, “জেএন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক।” ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হকিং যেসব বিজ্ঞানীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন, তন্মধ্যে জেএন ইসলাম ছিলেন অন্যতম। কিন্তু বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম রেডিও আবিষ্কার করলেও কৃতিত্ব চলে গিয়ছিল মার্কনির কাছে।ঠিক তেমনটি ঘটেছে জেএন ইসলামেও। স্টিফেন হকিং যদি বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হন, তাহলে জেএন ইসলাম ব্রহ্মাণ্ড খ্যাত হওয়ার মতো যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে এভাবে লেখা হয়নি, যেমনটি লেখা হয়েছে হকিংকে নিয়ে। নিজের ভাই মহাশয়, এই জ্বালা কি প্রাণে সয়? বাঙালিরা এই বোধ থেকে কখন বের হয়ে আসতে পারবে জানি না।

পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণ করতে হয় কিন্তু হকিংয়ের কোনো বর্ণনা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। এজন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাই অনেকে মনে করেন, হকিং যত বড়ো না বিজ্ঞানী তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞানকল্পকাহিনি লেখক। তিনি মেধাবী ছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে বিশ্বব্যাপী যে প্রচার তিনি পেয়েছেন তা ‍শুধু মেধার জন্য নয়, বরং তার অসুস্থতা, অমুসলিম এবং ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার জন্য ঘটেছে। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম নিজ দেশ থেকেও এমন মূল্যায়ন পাননি। প্রচার ছাড়া প্রসার কীভাবে হয়? বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘কৃষ্ণবিবর’ গ্রন্থটি হকিং এর ব্ল্যাকহোল থিউরির অনেক আগেই প্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত। কিন্তু আমরা কেউ তা জানি না। জানলেও তা কেউ প্রচার করেনি।

সারা বিশ্বে বিজ্ঞানী মহলে জেএন ইসলাম জিনিয়াস ইসলাম নামেও পরিচিত ছিলেন। জাপানি প্রফেসর মাসাহিতোর ভাষায়, “ভারতের বিখ্যাত জ্যোর্তিপদার্থ
বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা জে এন ইসলামের সহপাঠী ছিলেন। ফ্রেডরিক হয়েল, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, স্টিভেন হকিং, প্রফেসর আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনমেন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের অন্যতম বন্ধু এবং তাঁর মেধামুগ্ধ সহকর্মী।” মাসাহিতো আরো বলেন, “তাঁদের মুখে আমি অনেক বার জেএন ইসলামের কথা শুনেছি।” তিনি আরো বলেন, “জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লেখা হয়েছে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কিন্তু হকিং এর ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লেখা হয়েছে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। দুটি গ্রন্থ তুলনা করলে নিঃসন্দেহে জেএন ইসলামের বইটি যে কোনো বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ।"

কিন্তু ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম নিয়ে আমরা যে তোলপাড় করেছি, জেএন ইসলামের আল্টিমেট ফেইট নিয়ে এক সহশ্রাংসও করিনি। তখনকার দিনে ইউরোপের বিভিন্ন খ্যাতিমান স্বীকৃত বিজ্ঞান-জর্নালে প্রবন্ধ জমা দেওয়া হতো কোন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী মাধ্যমে সুপারিস-সহ। জামাল নজরুল ইসলামের প্রবন্ধে সুপারিশ দিতেন ফ্রেড হয়েল, স্টিভেন হকিং ওমার্টিন রিজের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে স্টিভেন হকিংকে নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে এক লাইনও লেখা হয়নি।

হকিং তাঁর মূল্যবান গবেষণা সময়ের অধিকাংশই ব্যয় করতেন বাঙালি প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থেকে পারিবারিক বন্ধুত্বে উন্নীত হয়েছিল। হকিং এর জেষ্ঠ ছেলে রবার্ট, কন্যা লুসি
এবং কনিষ্ঠ ছেলে থিমোতি জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গ খুব পছন্দ করতেন। জামাল নজরুল ইসলামের দুই মেয়ে সাদাফ যাস সিদ্দিকি ও নার্গিস ইসলাম ছিলেন তাদের খুব আদরের। সাদাফ যাসের আমন্ত্রণে লুসি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে লিট ফিস্টে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ এসেছিলেন। অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে এলে বন্ধু জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলেন।১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম বাংলাদেশে এলে বিমান বন্দরে নেমে বলেছিলেন, জেএন ইসলামকে খবরদিন। ওই সফরে জেএন ইসলামকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির পক্ষ থেকে তিনি একটা পদকও দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য বয়সে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন হকিং এর সিনিয়র কিন্তু আবদুস সালাম এবং অমর্ত্য সেন-এর জুনিয়র।

ক্যামব্রিজের শিক্ষক প্রফেসর সুসানার ভাষায়, “বিজ্ঞানময়তা বিবেচনায় হকিং এর ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’এর চেয়ে অনেক গুণ কার্যকর এবং বিজ্ঞানানুগ হচ্ছে জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’। বলা হয়, ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। বিজ্ঞানগুরুত্বে যদি এটি হয়ে থাকে, তাহলে জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ একশ কোটি কপি বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি।

কেন? কারণ প্রচার হয়নি। আমরা করিনি। জেএন ইসলাম মুসলিম, জেএন ইসলাম তৃতীয় বিশ্বের লোক। তাই পাশ্চাত্যে যথাগুরুত্ব পায়নি। জেএন ইসলামের দেশের লোকই তাকে তুলে ধরতে পারেনি, অন্য কেন করবে? জেএন ইসলামের লেখা এবং ক্যাম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ বইটাকে বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানের একটি অদ্বিতীয় বই। যেটা নিয়ে অধিকাংশ বাঙালি কিছুই জানে না। নিজের ঘরের কৃতিত্ব যদি ঘরের মানুষ না রাখে তাহলে বাইরের লোকে রাখবে কেন? জেএন ইসলামের ‘দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ ছাড়া আর কোনো বাঙালির বই হিব্রু ভাষায় অনুদিত হয়নি। তার তিনটি বই এবং দুটি আর্টিক্যাল ক্যাম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিস্টনসহ পৃথিবীর শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। অথচ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় কি না আমার জানা নেই। এ হিসেবেও জামাল নজরুল ইসলাম হকিংয়ের চেয়ে অনেক বড়ো বিজ্ঞানী।

জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক। নিজের আয় থেকে অর্থ জমিয়ে অনেক দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৭১
খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন।

সর্বোপরি, বিদেশে সহস্র পাউন্ডের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন।শুধু তাই নয়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের পরামর্শ চাইলে তিনি, জাফর ইকবালকে দ্রুত দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন। দেশে ফিরে নিজের পিতৃভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৩০০০ টাকার বৃত্তিতে কাজ শুরু করেন। ভেবেছিলেন দেশ তাঁকে মূল্যায়ন করতে পারবে, পারলেও করেনি। আমরা বাঙালিরা তাকে ওই তিন হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পরিনি।

তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি বিজ্ঞানী যার ৭টি গ্রন্থ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসে থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যার একাধিক বই হিব্রু ভাষায় অনুদিত হয়েছে।অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক সভায়
আমন্ত্রিত হয়ে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর অংশগ্রহণ করলে, তাকে না কি কেউ চিনতেই পারেননি।অতিরিক্ত সচিব হঠাৎ চিনতে পেরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর দেশে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বিদেশে কেমন হতে পারে সহজে অনুমেয়। পদার্থ বিদ্যায় নোবেল বিজয়ী Weinberg I বলেছিলেন, We are particularly indebted to Jamal Islam, a physicist colleague now living in Bangladesh. For an early draft of his 1977 paper which started us thinking about the remote future. আবদুস সালাম বলেছিলেন, এশিয়া মহাদেশে আমার পরে যদি কেউ নোবেল পুরস্কার পান, তাহলে তিনি হচ্ছেন জামাল নজরুল ইসলাম।

১৯৮৪ থেকে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ত্রিশ বছর জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল এন্ড ফিজিকাল সায়েন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তবে এটাকে বিশ্বামানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে তার চেষ্টা ও স্বপ্ন সফল হয়নি। শত চেষ্টা করেও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ এবং মানসম্পন্ন গবেষকদল সৃষ্টি করতে পারেননি। এই ত্রিশ বছর বাইরে থাকলে বিজ্ঞানের জগতে বিস্ময়কর কিছু দিতে পারতেন। তিনি যদি দেশে না আসতেন তাহলে পৃথিবী অনেক কিছু পেত।
স্বার্থপর জেএন ইসলাম নিজের দেশের জন্য পৃথিবীকে বঞ্চিত করেছেন।

আজ এই মহাবিজ্ঞানীর প্রয়াণ-দিবস। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। চতুর্থ প্রয়াণ দিবসে এই মহাগুণী জনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।