Translate

Saturday 16 November 2013

সার্কিট হাউস বিড়ম্বনা


সার্কিট হাউস বিড়ম্বনা/ ড. মোহাম্মদ আমীন



উনিশ নিরানব্বই।
সন্ধ্যা ছটায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের তিন নম্বর কক্ষে উঠি।
বান্দরবান থেকে টেলিফোনে কক্ষটা রিজার্ভ করেছিলাম। রাত আটটায় ডা: শংকর সাহার এপয়েন্টমেন্ট।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর ডাক্তারের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেই। চেম্বার বেশি দূরে নয়, তবে প্রচণ্ড ভীড়।
যেমন রাস্তায় তেমন চেম্বারে।
চেক-আপ করে সার্কিট হাউজে ফিরতে দশটা বেজে যায়।
রুমের চাবি চাইতে কেয়ার টেকার আমতা আমতা করে বললেন: সরি, চাবি দেয়া যাবে না স্যার ।
কেন?
আপনার কক্ষের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে।
লজ্জা এবং ভয়ে আঁতকে: কী হয়েছে?
কেয়ার টেকার: আগামীকাল এডিসি জেনারেল সাহেবের আত্মীয়ের বিয়ে।
তাতে কী?
বর যাত্রীদের জন্য সার্কিট হাউসের সাধারণ কক্ষগুলো তিনি দখল করে নিয়েছেন।
এত রাতে কোথায় যাব!
আজ মন্ত্রী আসবেন নইলে আমি আপনাকে ভিআইপি রুমে রাখার ব্যবস্থা করতাম।
কেয়ার টেকারের সাহনুভূতিতে মনটা ভরে উঠে।
এডিসি সাহেবকে আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলেননি?
বলেছি।
তিনি কী বলেছেন?
কেয়ার টেকার : আপনি জেনারেল স্যারের সাথে দেখা করেন। পাঁচ নম্বর কক্ষে আছেন।
এডিসি সাহেবের নাম শহীদুল্লাহ মজুমদার। নোয়াখালী বাড়ি, এক মাস হয় চট্টগ্রামে জয়েন করেছেন। এর আগে ছিলেন রাঙ্গামাটি। হাসান সাহেব এনেছেন। রতনে রতন।
শহিদুল্লাহ সাহেব কয়েকজন লোকের সাথে আলাপ করছিলেন।
পরিচয় দিয়ে রাতটা থাকার সুযোগ দিতে অনুরোধ করি।
আমার অনুরোধে তার চোখেমুখে বিরক্তের বন্যা: আপনার স্ত্রী অসুস্থ তাতে আমার কী?
বিনয়ের সাথে বললাম: এত রাতে কোথায় যাবো?
আমার আত্মীয়ের চেয়ে আপনার স্ত্রীর অসুস্থতা বড়ো হতে পারে না।
একটু বুঝার চেষ্টা করুন স্যার।
আপনি যান। আমি গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করছি। ডিস্টার্ব আমার একদম অপছন্দ।
তাঁর কথা যথেষ্ট রুক্ষ তবু সংযত থাকলাম, হাজার হোক সিনিয়র। সাথে বউ না থাকলে চলে যেতাম। চট্টগ্রামে বাড়ি, হোটেল তো আছেই। কিন্তু বউয়ের সামনে এতবড় অপমান মেনে নেয়া যাচ্ছিল না।
আরও বিগলিত হয়ে বললাম: বিয়ে তো আগামীকাল। ভোরে চলে যাবো। এতো রাতে অসুস্থ মহিলা নিয়ে কোথায় যাবো?
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যান, আমার কী? আপনি আমার কাছেই বা কেন এসেছেন?
আপনিই তো চাবি দিতে নিষেধ করেছেন।
তো বেশ করেছি। ঝামেলা করবেন না। চলে যান।
তার কথা শেষ হবার আগে দরজার পেছন হতে নারী কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে।
পেছনে তাকাই, আমার স্ত্রী।
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিলো। তার শরীর কাঁপছে। চোখে-মুখে ক্রোধ, এমনিতে সে সাহসী, এথেলেট ছিল, অধিকন্তু মেয়েলি ভয়ঙ্করতা তো আছেই। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। মনটা শঙ্কায় আঁতকে।
বললাম: তুমি এখানে এলে কেন?
আমার স্ত্রী বললেন: চলে এসো। দরকার হলে ফুটপাতে থাকবো। এই জাহান্নামে নয়।
আর একবার অনুরোধ করে দেখি!
কার কাছে অনুরোধ করবে? মানুষের কাছে মানুষ অনুরোধ করে, জানোয়ারের কাছে নয়। আগামীকালের মেহমানের জন্য যিনি আজকের মেহমানদের চরম অসুবিধা সত্ত্বেও রাত দশটার বের করে দেন তাঁর কাছে অনুরোধ করার চেয়ে কুত্তার কাছে অনুরোধ করা অনেক ভালো, শুয়োরের কাছে অনুরোধ করো। আমি অনেক অমানুষ দেখেছি কিন্তু এমন অমানুষ দেখিনি। দেখতেও পশুর মত লাগছে। ছি! ছি!! জুনিয়র সহকর্মীদের প্রতি যার সাহনুভূতি নেই সে তো হায়েনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। সে কীভাবে অফিসার হয়!
আমার স্ত্রীর কথায় শহিদুল্লাহ সাহেব রাগে কাঁপছেন।
আমার দিকে তাঁকিয়ে কাঁপা গলায় বললেন: আপনার স্ত্রীকে সরে যেতে বলেন। নইলে কিন্তু অসুবিধা হবে।
আমি কিছু বলতে চাইলাম, পারলাম না। মেয়েরা কথা বলতে চাইলে পুরুষদের সুযোগ শুন্য হয়ে যায়।
আমার স্ত্রী আরও সামনে এগিয়ে: সার্কিট হাউস আপনার বাবার সম্পত্তি নয়, সরকারি ভবন। এখানে আপনার মেহমানের চেয়ে আমাদের অধিকার বেশী। সার্কিট হাউসে অবস্থানের নীতিমালা আছে, সেটা পড়ে আসুন। এটা কমিউনিটি সেন্টার নয়,সার্কিট হাউজ।
সরে যান, সরে যান বলছি- চিৎকার করে উঠেন শহিদুল্লাহ মজুমদার।
সরে না গেলে কী করবেন? করাপ্টেড বুচার, নৃশংস হারামি!
আমার স্ত্রীর অগ্নিমূতি শহিদুল্লাহ মজুমদারকে ভয় পাইয়ে দেয়।
তবু গোঁ ছাড়েন না। আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন : আপনার স্ত্রীকে সরিয়ে নিন। নইলে-
নইলে কী করবেন? অসভ্য কোথাকার। বিবেকহীন কুত্তা। হোটেল ভাড়া করে বরযাত্রী রাখার যোগ্যতা অর্জন করার আগে আত্মীয়কে বিয়ে করাচ্ছেন কেনো? মুরোদ নেই যার তার আবার কথা। ভিক্ষেয় বের হলে তো পারতেন। অবৈধভাবে সার্কিট হাউস দখলের মজাটা আমি আজ দেখাবো।
কী করবেন আপনি?
আমার স্ত্রী সেন্ডেল খুলতেই মজুমদার সাহেব আমার পেছনে লুকিয়ে পড়েন।
আমি সেন্ডেলটা নিয়ে নেই।
কাঁদো কাঁদো গলায় শহিদূল্লাহ মজুমদার বললেন: আপনারা যান, আমি চাবি নিয়ে আসছি।
আমি স্ত্রীকে টেনে নিয়ে ওয়েটিং রুমে চলে আসি। সে কাঁদছে। ওয়েটিং রুমে অনেক লোক। বন্দর সমস্যা নিয়ে আলোচনা। দুজন মন্ত্রী আসছেন। এগারটার মধ্যে সার্কিট হাউসে পৌঁছবেন। আধ ঘণ্টা বাকি।
সার্কিট হাউজে থাকব না। মেইন গেইটে শুয়ে থাকবো। দেখি মন্ত্রীরা কীভাবে সার্কিট হাউসে ঢুকেন।
আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি।
তবু রাগ কমে না: ছিঃ! কী চাকুরিতে ঢুকলে তুমি! যেখানে একজন সিনিয়র তার জুনিয়র সহকর্মীর অসুস্থ স্ত্রীকে রাত দশটায় রাস্তায় বের করে দেয়। এ রকম ক্যাডারে চাকুরি করার চেয়ে ফুটপাথে ছোলা বিক্রি অনেক ভালো।
প্লিজ, থামো।
থামবো না। বাইরে তো বড়াই করো, এডমিন ক্যাডার। আমি মন্ত্রীকে বিচার না দিয়ে যাবো না।
মন্ত্রীকে জানালে ঘটনা অনেক বড়ো হয়ে যাবে। পত্রিকায় উঠবে, এমনি এডমিন ক্যাডারের দোষ খুঁজে সবাই। আবার বুঝানোর চেষ্টা করি। এবার মন গলে তার।
মন্ত্রীকে বিচার দেবো না। তবে আবার শহিদুল্লাহ্রর সাথে দেখা করবো।
ঠিক আছে।
এডিসি সাহেব কক্ষের বাইরে পায়চারি করছিলেন। মুখ ফ্যাকাশে। আমার স্ত্রীকে দেখে ভয়ে ভেতর ঢুকে যেতে চাইলেন।
আমার স্ত্রী ডাক দিলেন: দাঁড়ান, কথা আছে।
বলুন ম্যাডাম।
আমরা চলে যাচ্ছি। স্বামীর অনুরোধে ক্ষমা করলাম। নইলে আপনার আত্মীয়ের বিয়ের বারোটা বাজাতাম। অবৈধভাবে সরকারি সম্পদ ব্যবহার এবং আমাদের বৈধ অধিকার কেড়ে নিয়ে যে হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে আপনার প্রতি শুধু নয়, আপনার ক্যাডারের প্রতিও আমার ঘৃণা জমে গেছে। দুর্বল আংটা দিয়ে পুরো চেইনের শক্তি কত তা পরিমাপ করা হয়। আপনার মতো নষ্ট জানোয়ার যতোদিন প্রশাসনে থাকবে ততোদিন এ ক্যাডারের উন্নতি কঠিন।
ধরাপড়া চোরের মতো মুখটা মলিন করে জনাব মজুমদার দাঁড়িয়ে। কোনো কথা নেই, কাঁপছেন।
আমি স্ত্রীর হাত ধরে টানতে থাকি: এসো চলে যাই।
তোমার এডিসি নাকি বিডিসি, তাকে একটা চড় দিতে এসেছিলাম। কিন্তু এমন আবর্জনায় হাত লাগাতে ইচ্ছা করল না।
আমি চোখে ইশারা করতে মজুমদার সাহেব রুমে ঢুকে পড়েন।
বারান্দায় বেশ কিছু লোক। তারা প্রশংসা দৃষ্টিতে আমার স্ত্রী দিকে তাকিয়ে।
রাত পৌনে এগারটার দিকে সার্কিট হাউস থেকে বেরিযে আসি।
গেইট পাড় হতে না হতে সার্কিট হাউসে মন্ত্রীর গাড়িবহর ঢুকে পড়ে।
ঘটনাটি মনে পড়লে আমি এখনো শিউরে উঠি।
যদি আমার স্ত্রী ঐদিন মন্ত্রীকে বিষয়টা জানাত তো মজুমদার সাহেবের কি হত? পত্রপত্রিকায় বিশ্রীভাবে লেখালেখি হত।
এ ঘটনার কয়েক মাস পূর্বে আমার শালীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। শুধু তারিখ নির্ধারণ বাকি ছিল।
হবু স্বামী প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য ছিলেন।
আমার স্ত্রীর কাছে সার্কিট হাউসের ঘটনা শুনে শ্বশুর মশায় বিয়ে ভেঙ্গে দেন।
আমি অনুনয় করেছিলাম।
শ্বশুড় অনড়: এমন ক্যাডারের সদস্যের কাছে মেয়ে দেব না।
আমি চেষ্টা করেছিলাম শালিকার মাধ্যমে রাজি করাতে।
শালিকা বাপের চেয়ে আরও এককাঠি উপরে: প্রয়োজনে রিক্সাওয়ালা বিয়ে করব, তবু প্রশাসন ক্যাডারের কাউকে নয়।
কেন?
এ ক্যাডারে শহিদুল্লাহ মজুমদার আছেন।
অতপর বিয়ে ভেঙ্গে দেন শালিকা।
সার্কিট হাউস দেখলে এখনও আমার ঘটনাটা মনে পড়ে,
মনে পড়ে শহিদুল্লাহ মজুমদারের কথা,
শালীর বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কথা।
স্ত্রীর সামনে আমার লজ্জায় আনত হবার কথা।

1 comment:

  1. চমৎকার চমৎকার চমৎকার।
    আরো ১০০ টা চমৎকার দিতাম যদি মন্ত্রী ও মিডিয়ার কাছে অভিযোগ করে ফালতু লোকটার বারোটা বাজাতেন। এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন - এই লোক তো ভবিষ্যতেও অন্যদের সাথেও একই ব্যবহার করবে .... বিশেষ করে প্রমোশন পেয়ে আরো অনেক উঁচু পোস্টে (ডিসি ইত্যাদি) গিয়ে।

    ReplyDelete