বঙ্কিমচন্দ্র: সাহিত্যকর্ম চাকুরি এবং এসিআর
বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ঊনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য ও
সংগীতের ত্রিদিকপাল। হিরন্ময় জ্যেতিতে সূর্যময় উজ্জ্বল এ তিনি কালজয়ী তারকার সবাই
ছিলেল ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ ইংরেজি শিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বঙ্কিমচন্দ্র
ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। বাগদেবীর সাথে সাথে অন্নদেবী তথা
ব্রিটিশ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরিদাতা ব্রিটিশ সরকারের অধীনে প্রজ্ঞাময়
কলমকে সৃষ্টি আর গোলামির কাজে যুগপৎ ব্যবহার করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অনেক
কালজয়ী দিকপাল ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্র্টে কিংবা আইসিএস অফিসার
হিসেবে চাকরি করেছিলেন। প্রতিভাবান এ সকল ব্যক্তি চাকরি করেছেন, বিদেশি প্রভুর
গোলামি করেছেন সাথে সাথে সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য। তার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন
অন্তর্মনে লুকায়িত নির্বাণ আলেখ্যের আজন্ম লালিক ক্ষোভ।
ব্রিটিশ
সরকারের আমলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আইসিএস ছিল সোনার হরিণের চেয়ে দুর্লভ,
বর্তমান নোবেল পুরষ্কারের চেয়েও সম্মানের। অর্থ-বিত্ত, সৌর্য-বীর্য, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি
কোন কিছুর কমতি ছিল না। যে সকল ব্রিটিশ বাঙ্গালি প্রশাসক সাহিত্যকর্ম করেছেন তারা
এ সবের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হেলায় সব তুচ্ছ করেছেন। আত্মসম্মান, নীতিবোধ,
দেশপ্রেম, সৃজনশীল অহংবোধের নান্দনিক ইতিবোধের কারণে সব সময় ঊর্ধ্বতন র্কতৃপক্ষের
সবগুলো আদেশ-নির্দেশ অন্যান্য চাকরের মতো চোখ বুজে মেনে নিতে পারেননি। একজন
সাহিত্যিক প্রশাসক আর একজন সাহিত্যিক নয় এমন প্রশাসকের মধ্যে থেকে গেছে আকাশ পাতাল
তফাৎ। বঙ্কিমচন্দ্রের সময় পুরো বঙ্গদেশের আরও শ খানেক ডপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
তারা ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, কন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন চাকরের বাইরেও-
সৃজনশীল মানসিকতার অধিকারী ও স্বাাজত্যবোধের প্রবল অহংবোধে অনাবিল সূর্য্য। যারা
দেশপ্রেম আর স্বাজাত্যবোধে উদ্বেল তাদের গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা কঠিন। যার ফলে
প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও এ সকল স্বাধীনচেতা প্রশাসকগণ হয়েছে উপেক্ষিত আর অবহেলা ও
হয়রানির শিকার। পদোন্নতি, পদায়ন আর বদলির ক্ষেত্রে হয়েছে বৈষম্যের শিকার।
শুধু
ব্রিটিশ শাসনামলে নয়, পাকিস্তানি অর্ধগোলামি এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশ আমলেও সাহিত্য
কর্মে নিবেদিত প্রাণ সৃজনশীল প্রশাসকগণকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বাংলা সাহিত্য
কর্মে জড়িত প্রশাসক কর্মকর্তাগণের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম দিকের
এবং প্রথম সারির একজন। তার পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট। পিতার চাকরির জৌলুস, ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদা তিনি দেখেছেন। হয়ত
তাই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি তাকে আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু তিনি পিতার মনে
বিদেশি প্রভুর গোলামির যাতনার ক্ষরণ দেখেননি, দেখলেও বুঝতে পারেননি।
১৮৫৮
খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর।
কলকাতা ইউনিভার্সিটির প্রথম দুই বাঙালি গ্র্যাজুয়েটের একজন ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়। স্বদেশিদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল, শাসকগোষ্ঠীও প্রথম স্বদেশি
গ্র্যাজুয়েট এবং ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে হিসেবে অন্যান্যদের চেয়ে একটু আলাদা চোখে
দেখতেন। চাকরিতে ঢুকার পর তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বেশ প্রশংসা অর্জন করতে শুরু
করেন। তার ইংরেজি ভাষা জ্ঞান, চিন্তা শক্তি, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়নতার
প্রশংসায় ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ পঞ্চমুখ ছিলেন। সাত বছর চাকরি জীবন তিনি বেশ প্রশংসার
সাথে অতিক্রম করেছেন। তবে লেখালেখির সাথে জড়িয়ে পড়ার পর তার সুনামে ভাটা পড়তে শুরু
করে। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমের চাকরিকালীন
সাহিত্য কর্মের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে। উপন্যাসটির কয়েকটি কপি বঙ্কিম তার কয়েকজন
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে উপহারস্বরূপ প্রদান করেন। মহকুমা প্রশাসক বঙ্কিমের
দুর্গেশনন্দিনী হাতে নিয়ে বলেছিলেন: Well, Well writer, writes; but don`t miss
your duty. বঙ্কিমচন্দ্র সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন; তার সাহিত্যকর্ম ঊর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশংসার কিছু নয়। এই এসডিও সাহেব বঙ্কিমকে অত্যন্ত ভাল জানতেন।
তিনি বঙ্কিম সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে লিখেছেন: তিনি যে রকম কর্মদক্ষতার সাথে কাজ
করেন, তা কেবল ইউরোপীয় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে সম্ভব। চাকরি জীবনে বিভিন্ন
রিপোর্টে ওপরিওয়ালারা তাকে দক্ষ, মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন এবং প্রকাশ ক্ষমতায়
অসাধারণ অফিসার হিসেবে মন্তব্য করেছেন।
সাহিত্য
কর্মের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে বঙ্কিমের সুনমা ও প্রশংসা বাড়তে থাকে কিন্তু চাকরি ক্ষেত্রে
তার সুনাম ও দক্ষতার পূর্বতন ধারা ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকে। সৃষ্টশীল কর্ম ও
স্বদেশিগণের নিকট প্রিয় হয়ে উঠার সিঁড়িটি তার কর্মজীবনে অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে
দাঁড়ায়। সাহিত্যিক হিসেবে চাকরির ক্ষেত্রে তার পদোন্নতি ও ক্যারিয়ার ক্রমশ অন্ধকার
হয়ে যাচ্ছিলো। দীর্ঘ চাকরি জীবনে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিরল প্রতিভা, তীক্ষè
দুরদৃষ্টির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের উপরে উঠতে দেয়া হয়নি।
তার প্রতিভা, প্রশংসা আর প্রগাঢ়তার তেজ সহ্য করতে পারেনি সরকার; পারেনি ঊর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষ। ঈর্ষায় জ্বলে জ্বলে ক্ষয় হয়ে যেতেন; আর কিছু না পেরে পদোন্নতিটা বন্ধ
করে দিয়েছিলেন। কপালকু-লা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭৩),
ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), রাধারাণী (১৮৭৫), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী
(১৮৭৭) এবং কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮) প্রভৃতি উপন্যাসের মত কালজয়ী গ্রন্থের বিরল
স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। এ জনপ্রিয়তা
বঙ্কিমচন্দ্রের ওপরিওয়ালাদের মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক বলে
তাকে কোন ভাল জায়গায় পদায়ন করা হয়নি। দুইবার মাত্র তিনি মোটামেটি ভাল পদে পদায়িত
হয়েছিলেন তাও আবার অল্পদিনের জন্য। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি আমলাদের জন্য গঠিত বেতন
কমিশনে বদলি হয়েছিলেন। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ পদায়নটি ছিল বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সহকারী
সচিব। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে তাকে এ পদে বদলি করা হয়। এ দুটি পদায়নই ছিল
বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের শ্রেষ্ঠ পদায়ন।
১৮৮২
খ্রিস্টাব্দে আনন্দমঠ উপন্যাস প্রকাশের পর তিনি সরকারের চরম রুদ্ধরোষে পড়েন।
১৮৮১-১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান বিভাগের প্রশাসনিক রিপোর্টে জেলাপ্রশাসক উল্লেখ
করেছেন: বঙ্কিমচন্দ্র অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী। তবে তার দায়িত্বজ্ঞান ও
সারবত্তাহীন সিদ্ধান্ত এবং আগোছালো কাজের ধারায় সংশোধন আনা আবশ্যক।” ১৮৮১
খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে তাকে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সহকারী সচিব পদে বদলি করা
হয়েছিল। আনন্দমঠ উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে ঐ পদটি বিলুপ্ত করে বঙ্কিমচন্দ্রকে এক
ঘণ্টার নোটিশে বদলি করে দেয়া হয়। আকস্মিকভাবে পদটি বিলুপ্ত এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে
বদলির পেছনে তার সাহিত্যকর্ম বিশেষ করে আনন্দমঠ উপন্যাসে স্বাজাত্যবোধ আর
স্বদেশপ্রেমের উচ্ছ্বাস দায়ি ছিল। ১৮৮৩-১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর
বঙ্কিমের সার্ভিস রেকর্ডে লিখেছিলেন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিশ্চিতভাবে একজন
খামখেয়ালি স্বভাবের মানুষ। তাকে যোগ্য অফিসার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সবসময় কড়া
নজরদারি মধ্যে রাখা উচিত।”এর পূর্বে এ কালেক্টর তার সাহিত্য প্রতিভার প্রশংসা
করেছিলেন। কিন্তু রাজসিংহ ও আনন্দমঠ সবকিছু যেন উল্টোপাল্টা করে দেয়। ১৮৮৫-১৮৮৬
খ্রিস্টাব্দে সার্ভিস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, “তিনি একজন সাধারণমানের অফিসার
ছাড়া আর কিছু নন এবং তাকে তার কাজে আরও আগ্রহ দেখানো উচিত।”এরূপ জঘন্য বিরূপ
মন্তব্য থাকার পর কোন অফিসারের পদোন্নতি হবার কথা নয়, হয়ওনি।
১৮৮২
খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে দশ বার
(মতান্তরে নয় বার) হয়রানিমূলক বদলির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ অবস্থায় তার মানসিক
অবস্থা পরাধীন দেশের মতই অস্থির হয়ে উঠেছিল। বিদেশি প্রভুর নিষ্ঠুর যাতনার অসহনীয়
গোলামিত্বের ক্রুরতা সহ্য করতে না পেরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৯২
খ্রিস্টাব্দ সরকারি চাকরিকে ঝাঁটা মেরে বেরিয়ে এসেছিলেন।
ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রকে বিচারিক কার্য সম্পাদন করতে হত। ১৮৫৮
খ্রিস্টাব্দ হতে তিনি বিচার কার্য শুরু করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তার
বিচারকার্য নিয়ে কোন বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেননি। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের পর ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তাগণ তার বিচারিক কার্যেও খুঁত, খামখেয়ালীপনা ও অবহেলা আবিষ্কার করতে শুরু
করেন। তবে এ অবস্থাতে তার সততা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলেননি। গ্যারট নামের এক
ইংরেজ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বস। তিনি লিখেছেন: “মামলার বিচার কাজে
বঙ্কিম অনেক সময় নানারকম অস্বাভাবিক মন্তব্য প্রদান করেন এবং তার রায়গুলো কিছুটা
বাগাড়ম্বরপূর্ণ।” ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের পর চাকরি জীবনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিরন্তর
অবহেলা, বিরূপ মন্তব্য, ঘনঘন বদলি প্রভৃতি কারণে তিনি মানসিকভাবে অনেকটা অস্থির
হয়ে পড়েছিলেন। এ অবস্থায় তার বিচারকার্যে এমন সামান্য ত্রুটি অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বরং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়ার জন্য ইচ্ছামূলকভাবে
এসব করছিলেন।
ঊর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষ তাকে সহ্য করতে পারছিল না। তার যে কোন কাজ তা যত ভালো বা যৌক্তিক হোক না
কেন, খুঁত বের করে নিয়ে চড়াও হতেন। মৌখিক এবং লৈখিক বিরূপ মন্তব্যে বিষিয়ে তুলতে
শুরু করেন বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন। এ সময় বন্ধু শ্রীশ মজুমদারকে লেখা একটি চিঠি
প্রসঙ্গক্রমে প্রনিধানযোগ্য “চাকরি আমার জীবনের অভিশাপ”। এ বাক্যটির দ্বারা সরকারি
চাকরির প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের হতাশা ও সুপ্ত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছে।
১৮৮২
খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আনন্দমঠ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি
অনেক বিরূপ মন্তব্য ছিল। এটি জানাজানি হয়ে গেলে বঙ্কিমের উপর সরকারের খড়গ নেমে
আসে। পরাধীন দেশের পরাধীন জাতির একজন কর্মচারীর এ খড়গ হতে রেহাই পাবার কোন উপায়
ছিল না। অসহায় বঙ্কিম প্রচ- বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি পরবর্তী সংস্করণে
ব্রিটিশ বিরোধি মন্তব্যগুলো পরিবর্তন করেন। সরকারকে বিষয়টি অবহিত করার উদ্দেশ্যে
আনন্দমঠ উপন্যাসের একটি বিজ্ঞাপনে লেখা হয়: “রাজনীতি নয়, ধর্মকথা বলাই লেখকের
উদ্দেশ্য।” সশস্ত্র বিপ্লব অনেক সময়ই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী এবং
ইংরেজরা বাংলাদেশকে অরাজকতা হতে উদ্ধার করেছে- ইত্যাদি বিষয় আনন্দমঠে প্রতিভাত করে
তুলে। প্রথম সংস্করণে বর্ণিত ‘ইংরেজ’, ‘গোরা’, ‘ব্রিটিশ’ ইত্যাদি শব্দগুলোর
পরিবর্তে ‘মুসলমান’, ‘নেড়ে’ ‘যবন’ ইত্যাদি শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়। চাকরি লেখক
স্বত্ত্বার বিকাশের প্রতিবন্ধক। চাকর হতে চাকরি, যারা চাকরি করেন তাদের স্বাধীন
স্বত্ত্বা বলতে কিছু থাকে না, থাকতে পারে না। যত বড় চাকরি, তত বড় গোলামি। একজন
সচিবের অসহায়ত্ব আর গোলামিময় আত্মবিসর্জন দেখে ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ÒMen in
great place are thrice servants: servents of the soverign or state, and
servants of business, so as they have no freedom, neither in their persons, nor
in their actions, nor in there times. It is strange desire to seek power and to
lose liberty; or to seek power over others and to loss power over a man’s self.
আনন্দমঠ
উপন্যাসের জনপ্রিয়তা এবং স্বাজাত্য-প্রেরণায় অভিভূত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিদ্রোহী
ঝাঁসির রাণীকে নিয়ে একটি উপন্যাস নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের
মনোভাবের নিষ্ঠুরতা দেখে চাকরিজীবী বঙ্কিম অগ্রসর হবার সাহস পাননি। চাকরি লেখকের
স্বাধীন স্বত্ত্বাকে বিকশিত হতে দেয় না। ব্রিটিশ বিদ্বেষমূলক বাক্য ও শব্দগুলো বাদ
দেয়ার পরও সন্দেহ নিরসন ও আনুগত্য অর্জনের জন্য তাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে
এবং আনুগত্যের ধারাবাহিক কার্যাদি একনিষ্ঠতার সাথে সম্পন্ন করতে হয়েছে। অবশেষে
ইংরেজগণ তার আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন। ‘লর্ড রিপনের উৎসবের জমা খরচ’ প্রবন্ধে তিনি
লিখেছেন – ‘রাজভক্তি বড়ো বাঞ্ছনীয়’। চাকরি হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি মুক্ত হয়ে
যান। তখন বিদ্ব্যৎমহলে বঙ্কিমের সাহিত্যপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এ অবস্থায় বঙ্কিমের
রাজভক্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তাকে সন্তুষ্ট করাও ব্রিটিশ সরকারের প্রয়োজন ছিল। এ
অবস্থায় সরকার তাকে রায়বাহাদুর ও সিআইই খেতাব দিয়ে তার রাজভক্তিকে আরও ঋণাবদ্ধ করে
দেন।
No comments:
Post a Comment