সাহিত্য প্রতিভা/ড. মোহাম্মদ আমীন
একরামুদ্দীন (১৮৭২-১৯৪০)
সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সমালোচক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার
একরামুদ্দীন ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার কুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিএ
পাশ করে তিনি সেটেলমেন্ট বিভাগে কানুনগো পদে চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে
ডেপুটি সাব-ম্যাজিস্ট্রেট পদোন্নতি পান। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাব-ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন। সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রের
ন্যায় সমালোচনা সাহিত্যেও প্রশাসকগণ গুরুত্বপূূর্ণ অবদান রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে
বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪), বরদাচরন মিত্র (১৮৬২-১৯১৫) প্রমুখ খ্যাতিমান
প্রশাসক-সাহিত্য-সমালোচকের পর যে নামটি আলোময় ছন্দে সামনে এসে দাঁড়ায় তিনি
একরামুদ্দীন।
মূলত: সমালোচক হিসেবে সাহিত্য জগতে তার আগমন। সমালোচনা সাহিত্য রচনায় তিনি রুচিশীল দৃষ্টিভঙ্গী, বিচক্ষণ ব্যাখ্যা এবং গভীর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় দিয়েছেন। ‘বিসর্জন নাটকে রবীন্দ্র প্রতিভার স্বীকৃতি’ একরামুদ্দীনের প্রথম গ্রন্থ। এটি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয় কিন্তু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ‘রবীন্দ্র প্রতিভা’ নামে প্রকাশিত হয়। এটি একরামুদ্দীনের বহুল আলোচিত দার্শনিক চিন্তাপুষ্ট ও অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন একটি অসাধারণ সমালোচনা গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ কাব্যনাট্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা এবং মননশীলতা নিয়ে রচিত ‘রবীন্দ্র প্রতিভা’ বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা প্রবন্ধের ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত। এ গ্রন্থের জন্য তিনি ‘মুসলিম-রবীন্দ্র’ সমালোচকের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত। ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে বঙ্কিমচন্দ্র’ একরামুদ্দীনের দ্বিতীয় সমালোচনামূলক গ্রন্থ। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এ সমালোচনা গ্রন্থটি বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ভা-ারে অনুপম অলঙ্কারের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। বঙ্কিমের চিন্তাচেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গীকে কৃষ্ণকান্তের উইলের ক্যানভাসের মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত যুক্তনিষ্ঠ বিবরণে বিধৃত করেছেন। একরামুদ্দীন ‘মেঘনাদ ও বৃত্রসংহার’ নামের একটি বিখ্যাত সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুন-চৈত্র ও জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে লেখকের সাহিত্য প্রতিভা, চিন্তাশীল মন, নিগুঢ় অর্ন্তদৃষ্টির তীব্র প্রখরতা আরও স্পষ্ঠ হয়ে উঠে। এ প্রবন্ধে তার একটি উক্তি এখনও সমালোচক ও বোদ্ধা মহলের স্মরণে জ্বল জ্বল করে- “মাইকেলকে রবীন্দ্রনাথের সহিত তুলনা করিয়া কে বড়ো কে ছোট যাহারা মীমাংসা করিতে চাহেন তাহার ভ্রান্ত, উভয়ের প্রকৃতি, অধিকার ও কর্তব্য বিভিন্ন এবং ঊভয়েই আত্মঅধিকারে সম্রাট।”
সমালোচনা সাহিত্যে ব্যাপক সুনাম অর্জন করলেও ‘রবীন্দ্র
প্রতিভা’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থদ্বয়ের পর তিনি আর কোন
সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেননি। এরপর তিনি গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনায় মনোনিবেশ
করেন। ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘কাঁচ ও মণি’ একরামুদ্দীনের প্রথম বিখ্যাত ও
সার্থক উপন্যাস। মাসিক সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস
হিসেবে এটির ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরীসীম। নগর জীবনের পটভূমিকায় সমাজসমস্যামূলক
উপন্যাস রচনায় মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে একরামুদ্দীন প্রথম স্বার্থক ঔপন্যাসিক।
একরামুদ্দীনের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নতুন মা’ রচনামাধুর্য্য,
ভাষাকুসুমতা, পরিণতি ও সাবলীলতার মাঝে নাটকীয় ঢেউ উপন্যাসটিকে চিন্তশীল পাঠকের
মননশীল সঙ্গীর মর্যাদায় বারিত করে। এ উপন্যাসে গভীর অর্ন্তদৃষ্টির সাথে
বর্হিদৃষ্টির প্রপাত র্মমরতা একরামুদ্দীনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে আরও উজ্জ্বল করে
তুলেছে। সমালোচকের বিশ্লেষণে জীবনধর্মী বিবরণ ও মনস্তত্ত্বিক উপমায় উপন্যাস দুটি
এককালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। একরামুদ্দীনের লেখা ‘জীবনপণ’ নামের একটি উপন্যাস
‘সওগাত পত্রিকায়’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সমালোচকদের মতে, এ উপন্যাসে
অঙ্কিত জীবন বিষয়ে লেখকের অভিজ্ঞতা কোন বাস্তবভিত্তিক তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল
না।
শুধু উপন্যাস কিংবা সমালোচনা নয়; ব্যঙ্গ-কথা, গল্প, প্রবন্ধ ও
রস-রচনাতেও তিনি সুদক্ষ ছিলেন। প্রহসন রচনায় একরামুদ্দীনের নির্মল রসবোধ তার
স্বকীয় ব্যক্তিত্বের অনুপম প্রকাশ। ‘অনধিকার প্রবেশ’ একরামুদ্দীনের একটি বিখ্যাত
ব্যঙ্গনাট্য বা সামাজিক প্রহসন। ‘চাঁদ মিয়ার খাতা’ তার লেখা একটি জনপ্রিয় রম্য
রচনা। এটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
বাংলা কথা সাহিত্যে রসময় কিন্তু নির্মল আঙ্গিকে বাস্তব চরিত্র চিত্রণে তিনি বিপুল
দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্য তিনি তৎকালীন সাহিত্য জগতে ‘মুসলিম প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়’ হিসেবে খ্যাতি পান।
উপন্যাস রচনায় বঙ্কিমের অনুসারী হলেও বাক্য ও শব্দ সজ্জায় একরামুদ্দীনের
আলাদা একটি ভঙ্গী ছিল। তবে সমালোচনা চেতনায় একরামুদ্দীনের প্রতিভা, মেধা, বিশ্লেষণ
ক্ষমতা আর মৌলিকত্ব পুরোপুরি অনবদ্য, নিজস্বতায় অপ্রতিরোধ্য। যদিও অনেকে তার
সমালোচনায় বার্টান্ড রাসেলের অর্ন্তদৃষ্টি খুজে পান। রম্য রচনায় তার পরিচয় যেমন
স্বতন্ত্র তেমন মাধুর্য্যময়। এক্ষেত্রে একরামুদ্দীন হাসির অন্তরালে বেদনার ক্ষোভে
আহত বাণীর মুর্ছনায় গভীর অনুভবকারীগণের মনে একটা আলাদা আবেদন সৃষ্টি করতে পারেন।
৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর
একরামুদ্দীন বীরভূমে মৃত্যুবরন করেন।
No comments:
Post a Comment