মুক্তিযুদ্ধে
প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। । পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখেই শুরু হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সংগঠন ও সমন্বয়ে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী দেশ ভারত ও সেনাবাহিনী সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরূদ্ধতা যুদ্ধের রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। মুজিবনগর সরকার গঠনের পরপরই প্রশাসন ক্যাডারের
সদস্যগণ সরকারে কাজ করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করেন। দেশের অভ্যন্তরে
তারা মুজিবনগর সরকারকে জনপ্রিয় করে তুলেন এবং জনগণকে সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও
তৎসঙ্গে আস্থাশীল করে। অধিকন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যবর্গ
মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সপক্ষ শক্তির ন্যায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জনমত আদায়ে সচেষ্ট
হয়ে উঠেন। হাজার হাজার প্রশাসক জীবনের ভয় তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুক্তিযু্দ্ধকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং লে কর্নেল আবদুর রবকে চিফ অফ স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ রূপে নিযুক্ত করে সমগ্র বাংলাদেশকে১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ঐসব সেক্টরকে আবার সেক্টর কমান্ডারগ তাদের নিজ নিজ সুবিধা মত সাব সেক্টরে ভাগ করে নিয়েছিলেন। এছাড়াও কর্নেল ওসমানী তিনটি ব্রিগেড আকারের ফোর্স গঠন করেছিলেন যেগুলোর নামকরণ করা হয় তাদের অধিনায়কদের নামের অদ্যাংশ দিয়ে ( এস ফোর্স, কে ফোর্স, জেড ফোর্স)প্রভৃতি। এ সকল সেক্টর ও সাব-সেক্টরের সঙ্গে
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দায়িত্ব পালনে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যবর্গ গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর সার্বিক দায়িত্বে ছিল। এ সময় প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন আবদুস সামাদ। উপসচিব
ছিলেন আকবর আলি খান ও এম এ ইমাম। সহকারী সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন নূরুল
ইসলাম চৌধুরী ও এম এইচ সিদ্দিকী।
ক্যাবিনেট ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রধান সচিব ছিলেন রুহুল কুদ্দুস। তার
অধিনে সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান এবং কেবিনেট সচিব
ছিলেন এইচ
টি
ইমাম। উপ-সচিবগন ছিলেন কামাল উদ্দিন আহম্মদ, তৌফিক এলাহী চৌধুরী, দীপক কুমার চৌধুরী, ওলিউল ইসলাম। সহকারী সচিব
ছিলেন বজলুর রহমান , নরেশ চন্দ্র রায়, মতিউর
রহমান, এম এ আউয়াল, আবু
তালেব, মোহাম্মদ হেদায়েত উল্ল্যা, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও শাহ মতিউর রহমান।
যুদ্ধকালীন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহ থেকে
প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার ইত্যাদি কাজ শৃঙ্খলার সাথে
পরিচালনা
করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ এ সময় (১) বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব; (২) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে
সংগৃহীত সম্পদের হিসাব
প্রস্তুত; (৩)বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন; (৪) আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন; (৫) রাজস্ব ও শুল্ক আদায় এবং (৬)আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করে সরকারকে একটি শক্ত ভিতে দাঁড় করিয়ে দেন। যা সার
বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল
খোলা হয়েছিল। এই ফান্ডে ভারত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং
বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ
জমা হতো। সরকার
স্বাধীন বাংলাদেশের যে স্মারক ডাকটিকিট বের
করেছিলেন তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতে
বিভিন্ন শহরে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের টিকেট
থেকে প্রাপ্ত ৩লক্ষ
টাকা সরকারি ট্রেজারিতে জমা করেন। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ এ সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালেন করে।
প্রারম্ভে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো এই
স্বরাষ্ট্র,
ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধিও
তেমন ব্যপক ছিল না। পাকিস্তান বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাটের কারণে সাধারণ মানুষেরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পরে এবং সীমান্তের পাড়ে আশ্রয় নিতে থাকে। এ সময় ত্রাণ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে এবং দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারনে এ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে পুলিশ প্রশাসন গঠন ও একে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া
হয়। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ এ কাজে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে
আছে।
এ সময় স্বরাষ্ট্র,ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন এম এ খালেক। উপসচিব
ছিলেন খসরুজ্জামান চৌধুরী এবং সহকারী সচিব জ্ঞানরঞ্জন সাহা ও গোলাম আকবর। খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন অর্থ, শিল্প ও
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। মন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন সাফাত হোসেন। সহকারী সচিব
ছিলেন মাখন চন্দ্র মাঝি, শামসুদ্দিন হায়দার, ক্ষিতিশ চন্দ্র কুন্ডু, এ কে এম হেফারত উল্লাহ, আলি করি, মোঃ ইদ্রিস আলি , জগন্নাথ দে, এ কে আনোয়ার হক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের কাজকর্ম সম্পন্ন করা হত।
একজন রিলিফ কমিশনারের অধীনে এই বিভাগ সংগঠিত ছিল।
তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করা হত।
আবেদনপত্র ছিল বিভিন্ন ধরনের। এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা
হত। শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকদেরই ত্রাণ সুবিধা দেয়া হতো।
যুদ্ধকালীন
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা এ বিভাগের প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা দুইই ছিল
অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকেই যুদ্ধের প্রয়োজনেই সীমান্তের কাছাকাছি অনেক জায়গায় সামরিক হাসপাতাল গড়ে
উঠে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে, বিশেষ করে ত্রিপুরা-কুমিল্লা সীমান্ত বরাবর ফিল্ড
হাসপাতাল স্থাপন করেন। এছাড়া বেসরকারি খাতে বাংলাদেশের সকল শ্রেণির নাগরিকদের চিকিৎসা-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়
এবং তা বাস্তবায়ন করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নুরুউদ্দিন আহমদের
অধিনে দায়িত্ব পালন করেছেন উপ-সচিব শহিদুল ইসলাম।
পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান কাজ ছিল বহির্বিশ্বে জনমত গড়ে তোলা এনং যথাসম্ভব বন্ধু রাষ্ট্রদের থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চালানো। যদিও বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় ও তার কর্মী ছিল তথাপি পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রায় সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত
হতো। গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্বসূমূহ যথাযথভাবে পালনে করেছেন প্রশাসন ক্যাডার। মুজিবনগর
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব
ছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী। মন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী।
No comments:
Post a Comment