মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকাতৃতীয় অধ্যায়প্রশাসন ক্যাডারের অহঙ্কার মুক্তিযোদ্ধা শহিদ এ কে শামসুদ্দিন দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং সাহসের নির্যাস। অত্যন্ত মেধাবী এ ব্যক্তি নিজের ও প্রিয় পরিবার পরিজনের জীবন তুচ্ছ করে দেশের জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও স্বাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এমন উদহারণ সত্যি বিরল। ইচ্ছা করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না-নিয়ে থাকতে পারতেন, তা হলে তাঁকে শহিদ হতে হতো না।১৯৪৩ সালের ২ আগস্ট টাঙ্গাইল শহরে অবস্থিত মাতুলালয়ে এ কে শামসুদ্দিনের জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার গয়হাটা গ্রামে।পিতার নাম আফাজউদ্দিন আহমদ এবং মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। আফাজউদ্দিন আহমদ ডাক ও তার বিভাগে চাকরি করতেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার জ্যেষ্ঠ। তাঁর ডাকনাম খোকা। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ তাঁর মাতামহ।
এ কে শামসুদ্দিন গয়হাটা মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঢাকার নবাবপুর গভ. হাইস্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে ১৭তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর পাকিস্তান সরকারের ইন্টার উইং স্কলারশিপ নিয়ে লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজে রসায়নশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে যান। কৃতিত্বের জন্য বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ‘সায়গল স্কলারশিপ’ অর্জনের বিরল গৌরবে ভূষিত হয়েছিলেন।এ স্কলারশিপ তখন শুধু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। এ কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি বিএসসি (অনার্স)পাস করেন। পরবর্তীকালে এমএসসি পরীক্ষায়ও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন শেষে তিনি প্রথমে আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরি করেন। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। এ পরীক্ষায় তিনি সমগ্র পাকিস্তানে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।একাত্তরে সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) ছিলেন এ কে শামসুদ্দিন। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। সরকারি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের (পরে মুক্তিবাহিনী) সহায়তা করেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের আরিচা ঘাটে উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে তিনি সিরাজগঞ্জ কলেজে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে ট্রেজারিতে-রক্ষিত রাইফেল তুলে দেন। এরপর তাঁর নেতৃত্বে বাঘাবাড়ী ঘাট ও নগরবাড়ী ঘাটে প্রতিরোধযোদ্ধাগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যোদ্ধাদের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর একদল বাঙালি সেনাও ছিল। প্রতিরোধযোদ্ধারা তখন তাঁকে কর্নেল উপাধি দেন। কাশীনাথপুরের ডাব বাগান, বাঘাবাড়ী ঘাট, উল্লাপাড়ার ঘাটিনা সেতুর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাবনা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ শুরু করেন। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন। এ কে শামসুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকালীন সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকাকালে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা পরামর্শ ও অস্ত্র সরবরাহ করেন। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রিজের কাছে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।
একপর্যায়ে সিরাজগঞ্জের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। এ কে শামসুদ্দিন তাঁর অধীনস্থ প্রতিরোধযোদ্ধাদের ভারতের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়ে প্রথমে আত্মগোপন করেন। তাঁরও ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ সময় তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ঢাকার ১০৮ ফকিরাপুলে তাঁদের নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। স্ত্রীকে দেখার জন্য তিনি গোপনে ঢাকায় আসেন। ওই বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৭ মে তাঁকে আটক করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। সেখানে সেনাবাহিনীর মেজর সরফরাজের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য তাঁর ওপর অকথ্য অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের একপর্যায়ে তাঁর শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত টেনেও বের করে নিয়েছিল। বন্দি হওয়ার দু-দিন পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে সেনারা এ কে শামসুদ্দিনকে হত্যা করে।শহিদ হওয়ার পাঁচ মাস পর তাঁর এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ছেলের নাম এ কে এম সালাহউদ্দীন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এবং নাসায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরতএ কে সামসুদ্দিন বনানী সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত এবং সেখানে নামফলক রয়েছে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর গয়হাটা গ্রামে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে শহীদ শামসুদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ কালেক্টরেট ভবন চত্বরের প্রবেশপথে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক শহীদ এ কে শামসুদ্দিন স্মরণে নির্মিত তোরণ ও স্মৃতি কক্ষের উদ্বোধন করা হয়েছে। এর আগে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে তার নামে সিরাজগঞ্জ স্টেডিয়াম ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হল রুমের নামকরণ করা হয়েছিল।সরকারি চাকরীজীবী হয়েও মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শহীদ শামসুদ্দিন দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যে অবদান রেখেছেন তা বাঙালি জাতি আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখবে। সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর প্রভৃতির ন্যায় প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদেরও ছিল মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক, প্রশাসনের মুল হিসাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, তাদের নেতৃত্বে পুরো দেশে জালের মতো বিস্তৃত ও নিবিড় হওয়ার প্রথম উপাদান ও সুযোগ খুঁজে পেয়েছে বাঙালি মায়ের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা। জেলাপ্রধান ও ট্রেজারার হিসাবে জেলাপ্রশাসকগণ বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি কোষাগার হতে অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। তারা মুক্তিযোদ্ধা আর নেতৃবৃন্দকে নানা প্রাসঙ্গিক বিষয় দিয়ে সহায়তা করেছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনও উপায় নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা নিয়ে তেমন আলোচনা দেখা যায় না। এজন্য মূলত প্রশাসন ক্যাডারই দায়ী।
Monday, 15 June 2015
মুক্তিযুদ্ধে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা (তৃতীয় অধ্যায়) / ড. মোহাম্মদ আমীন
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment