মুক্তিযুদ্ধ
ও প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা
প্রথম অধ্যায়
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়-জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে কোনও বিবেচনায় অনবদ্য কৃতিত্বের দাবিদার। ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রশাসন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যবৃন্দ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যয়ীকর্মে। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই প্রথমেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত বাংলাদেশ প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল দেশের জন্য অকাতরে প্রাণদিতে উৎসুক জনতার সাহসী স্ফূরণ। জেলাপ্রশাসক, অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক, এসডিও, সহকারী কমিশনার, ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি পদে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বপালনে রত প্রশাসন ক্যাডারের অসংখ্য সদস্য নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করেছিলেন, সহায়তা করেছিলেন বিভিন্নভাবে। এজন্য তাঁদের অনেককে চরম নৃশংসতার সাথে হত্যা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার জেলাপ্রশাসক শহিদ শামছুল হক, সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও শহিদ একে শামসুদ্দিন এবং পিরোজপুর মহকুমার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানসহ অনেকের কথা উল্লেখ করা যায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহিদ
কুমিল্লার তৎকালীন জেলপ্রশাসক শামসুল হক খান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহিদ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের পূর্বে তিনি জেলাপ্রশাসক হিসেবে কুমিল্লা যোগদান করেছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বোখারীর নেতৃত্বে তাঁকে ও পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টা পর তাদের হত্যা করা হয়।
২৫ মার্চের পূর্বে কুল্লার পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন, ড. আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমসিএ, আলী আহমেদ এমসিএ প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে শামসুল হক খান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রিম প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন। ৭ মার্চের পর এবং ২৫ মার্চের পূর্বে কুমিল্লার জেলাপ্রশাসক শামসুল হক খানের নেতৃত্বে এ প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। তার পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের এত উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা এমন সুসংঘটিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেননি। তাই শামসুল হক খান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী হিসেবেও স্বীকৃত।
জেলাপ্রশাসক হিসাবে কুমিল্লা যোগদানের পর থেকে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধে সক্রিয় হয়ে উঠেন। জেলাপ্রশাসক শামসুল হক খানের নির্দেশে কুমিল্লা সেনানিবাসে রেশন ও পরিবহন জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে কুমিল্লা সেনানিবাসের পাকিস্তানি সেনারা তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল। কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে গেলে পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন জেলা প্রশাসকের নির্দেশ ছাড়া স্টোরের চাবি হস্তান্তরে অপারগতা জানান। এ নিয়ে আলোচনার জন্য স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক ডেকে পাঠালে বেসামরিক প্রশাসনের জেলাপ্রধান শামসুল হক খান তাতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর এ আচরণে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ২৫ মার্চ রাতে কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে মেজর আগা ও ক্যাপ্টেন বোখারীর নেতৃত্বে তাঁকে ও পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগের জন্য শহীদ শামসুল হক খানকে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে
"স্বাধীনতা পদক"-এ ভূষিত করা হয়। তাঁর নামে কুমিল্লায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিয়াম মিলনায়তনের ভাষণকক্ষটির নামও তাঁর নামে করা হয়েছে। (ক্রমশ : দ্বিতীয় অধ্যায়)
No comments:
Post a Comment