মোহাম্মদ আমীন সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্ম / এস এম আবীর চৌধুরী
মোহাম্মদ আমীন
ড. মোহাম্মদ আমীন ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার সৈয়দ মোহাম্মদ পাড়া গ্রামে এক অভিজাত শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ পিরে কামেল ও ইসলামি সংস্কৃতির বিশিষ্ট পুরোধা হযরতুল আল-ামা সৈয়দ মৌলানা নুরুল ইসলাম। মাতার নাম সকিনা খাতুন চৌধুরানী, মাতামহের নাম আবিদুর রহমান এবং মাতামহীর নাম বজলি বেগম চৌধুরানী। পিতামহ প্রখ্যাত আধ্যাত্বিক সাধক পিরে কামেল হযরতুল আল¬ামা মৌলানা সৈয়দ গোলাম শরীফ। যিনি বড় হুজুর নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর প্রথম সন্তান এস এম আবীর চৌধুরী মীম বাংলা সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ লেখক। মাত্র ৮ বছর বয়সে তাঁর লেখা রূপকথার গল্প ‘দুধবুড়ি’ প্রকাশিত হয়। সে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত শিশুশিল্পী।
বাড়িতে পিতামহের কাছে আরবি, উদুৃ ও ফারসি এবং মায়ের কাছে বাংলা শেখার মাধ্যমে মোহাম্মদ আমীনের হাতেখড়ি। অতপর বাড়ির পাশে অবস্থিত দক্ষিণ গাছবাড়ীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। উক্ত বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে গাছবাড়ীয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গেউত্তীর্ণ হয়ে গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজে আইএসসি ক্লাশে ভর্তি হন। উক্ত কলেজ থেকে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে আইএসসি পাশ করে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম শহরে গমন করেন। চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন।
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে বিএ অনার্স ক্লাশে ভর্তি হন এবং পরিসংখ্যানে বিএসসি (অনার্স) ও জনমিতি বিজ্ঞানে থিসিসগ্র“পে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘মাসিক সাধারণ জ্ঞান’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি ছিল তৎকালীন বাংলাদেশে সম্পূর্ণ সাধারণ জ্ঞানের উপর প্রকাশিত প্রথম মাসিক পত্রিকা।
ছাত্রজীবন হতে তাঁর লেখালেখি শুরু। উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন চট্টগ্রাম শহরের কাজী নজরুল ইসলাম রোড হতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বনভূমি পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ছিল স্বাধীনতা। কবিতাটির জন্য চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র তাকে এক হাজার টাকা এবং একটি দামি কলম পুরষ্কার দেন। এ পুরষ্কার তাকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন দৈণিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণ ও দৈনিক নয়াবাংলা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তাঁর লেখাপড়ার খরচের সিংহভাগ লেখালেখি হতে আসতো। অধিকন্তু তিনি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রিলেন্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘এ সমাজ’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্র কমিটি কর্তৃক ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের বছরই তিনি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী কমিশনার হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন। তাঁর প্রথম পোস্টিং ছিল কুড়িগ্রাম। চাকরিতে ঢুকার পরও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। বান্দরবানে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরিকালীন বিধি ও আইন সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি সমস্যায় পড়েন। পার্বত্য চট্টগ্রাম হিলট্র্যক্টস ম্যানুয়াল-১৯০০ অনুযায়ী পরিচালিত। এখানকার আইন দেশের সমতল অঞ্চলের আইন হতে ভিন্ন। কিন্তু আইন ও বিধিগুলো ছিল সব ইংরেজিতে এবং এগুলো বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত। তাই প্রয়োজনের সময় প্রশাসক ও বিচারকদের আইনগত জটিলতায় পড়তে হতো। প্রশাসনকে এ অবস্থা হতে রক্ষার করার লক্ষ্যে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত সকল বিধিগুলো বাংলায় অনুবাদ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আইন শিরোনামে একটি আইন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। প্রকাশ ছিলেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ। গ্রন্থটি তিন পার্বত্য জেলায় এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো যে, প্রকাশের তিন মাসের মধ্যে ত্রিশ হাজার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। এরপর আরও বিশ হাজার কপি বিক্রি হয়। পঞ্চাশ হাজার কপি বই বিক্রি করে তিনি একটা মোটা অঙ্কের অর্থ সঞ্চয় করতে সক্ষম হন। চাকরি জীবনের অর্থকষ্ট ও টানাটানি অনেকটা দূরীভূত হয়। এ সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি লেখালেখিতে আরও নিবিড় ও একাত্ম হয়ে যান।
চাকরিতে থাকাকালীন তিনি সরকারের অনুমতি নিয়ে এলএলবি ক্লাশে ভর্তি হন এবং গোল্ডেন এ প্লাস নিয়ে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ- ওয়ার ক্রাইম: ন্যাশনাল-ইন্টারন্যাশনাল ডেভলাপমেনট এন্ড লিগ্যাল প্র্যাকটিস। উল্লেখ্য ওয়ার ক্রাইমের উপর বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার থাকাকালীন তিনি ভেদরগঞ্জ শিশুমঞ্চ নামের উন্নতমানের একটি শিশু শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার থাকাকালীন তিনি মহালছড়ি শিশুমঞ্চ নামের আর একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
ছোটগল্প, রম্য রচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ইতিহাস, জীবনীগ্রন্থ ও ছড়াসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর সতত বিচরণ থাকলেও তিনি মূলত একজন গবেষক হিসেবে পরিচিত। Relation Between Magistrate and Police, Meet
Bandarban. Roles of Extra Judiciary Organs to ensure effective judiciary system, বাংলা বানানে ভুল: কারণ ও প্রতিকার, এক নজরে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা আন্দোলন, সহজ বাংলা উচ্চারণ, আহমদ ছফার চোখে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, বাংলা সাহিত্যের অ আ ক খ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা, বন মামলা দায়ের ও পরিচালনার কৌশল, ম্যাজিস্ট্রেসি ও আদেশনামা, জামিন তত্ত্ব ও রায়, বাংলা বানান ও শব্দ চয়ন, ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ, মামলা ও আইনি হয়রানি হতে নি®কৃতির উপায়, তুচ্ছ হলেও উচ্চ, অভয়নগর প্রোফাইল, বাংলা বানানে ভুল কারণ ও প্রতিকার, জেলা, উপজেলা ও নদনদীর নামকরণের ইতিহাস, আন্তর্জাতিক দিবস, কক্সবাজারের প্রতিষ্ঠাতা হিরাম কক্স, বাংলা সাহিত্যে প্রশাসকের ভূমিকা, বাংলা সাহিত্যে পুলিশের অবদান, বিড়ম্বনা, অফিস আদালতে বাংলা লেখার নিয়ম, রঙ্গরসে বাংলা বানান, বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন, বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস, শুদ্ধ বানান চর্চা ইত্যাদি ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা গ্রন্থ।
জনাব মোহাম্মদ আমীনের প্রথম উপন্যাস জল দুনিয়ার মানুষ। এটি তিনি অভয়নগর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার থাকাকালীন যশোর জেলার অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনা জেলার দীঘলীয়া উপজেলাব্যাপী প্রতিক্রিয়ারত ভবদহ এলাকার জলবন্দি মানুষের জীবনের প্রাত্যহিককর্মকাণ্ড, সমস্যা, সুখ-দুঃখ ও সম্ভাবনা নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে রচনা করেন। নন্দিত কান্না ও নিন্দিত হাসি জনাব আমীনের একটি গবেষণামূলক উপন্যাসধর্মী রচনা। এ গ্রন্থটি রচনার জন্য তিনি দুই মাস ভিক্ষুক সেজে ভিক্ষাবৃত্তি করেছেন। এ গ্রন্থের জন্য তিনি আইইআই পুরষ্কার লাভ করেন। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বহ্নিবিবুক্ষ’। বহ্নিবিবুক্ষ উপন্যাসে দাম্পত্য জীবনের দ্বন্দ্ব ও বিবাহিত জীবনের স্বরূপ উন্মোচণ করা হয়েছে। তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘স্বপ্ন জড়ানো পাহাড়’। এটি পাবর্ত্য এলাকার পাহাড়ি-বাঙ্গালি সম্পর্ক এবং ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয়ের উপর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত। রাজকীয় জীবন ও শারমেয় মরণ ড. আমীনের লেখা একটি রম্য উপন্যাস। এ উপন্যাসে বিবাহিত ও অবিবাহিত জীবনের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো বিস্তৃত হয়েছে।
রমণীয় পাঁচালী তাঁর প্রথম রম্য রচনা। তাঁর লেখা অন্যান্য রম্যরচনাগুলো হচ্ছে নন্দলালের তীর্থযাত্রা, উল্টোদেশে নন্দঘোষ, গদাই বাবুর তীর্থযাত্রা, নিমকহারাম রাজকুমারী, খরগোশ ও খচ্ছপ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। খরগোশ ও খচ্ছপ গ্রন্থে কল্পিত ইসপের দৌড় প্রতিযোগিতায় যেখানে খরগোশকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানে ড. আমীনের গ্রন্থে খরগোশকে জয়ী করা হয়েছে এবং কচ্ছপ কারচুপির মাধ্যমে জিতেছে বলে তাঁর হাতপা ভেঙ্গে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থ ‘মানুষই সেরা’ হাসতে হাসতে বাংলা শেখা, টাকা ছোট পয়সা বড়, ছোটদের আন্তর্জাতিক দিবস ও ছোটদের বাংলা উচ্চারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আঞ্চলিক ইতিহাসের উপর জনাব আমীনের ঝোঁক লেখালেখির প্রথম হতে লক্ষ্যণীয়। হাতিয়ায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ ‘তিলোত্তমা হাতিয়া: ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ প্রকাশিত হয়। বইটির জন্য ড. আমীন হাতিয়া জনকল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম ও হাতিয়া শিক্ষা ও গবেষণা সমিতি কর্তৃক পুরষ্কারে ভূষিত হয়। তাঁর অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থের মধ্যে অভয়নগরের ইতিহাস, চকোরিয়ার ইতিহাস, ভেদরগঞ্জের ইতিহাস এবং জেলা, উপজেলা ও নদনদীর নামকরণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জীবনীগ্রন্থ রচনাতেও তিনি সমানভাবে সফল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতির পিতা, জর্জ ওয়াশিংটন হতে বারাক ওবামা, নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক; ১৯০১-২০১১। প্রথমোক্ত গ্রন্থে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতির পিতার জীবনী, জাতির পিতা হিসেবে তাদের বেড়ে উঠা ইত্যাদি পরিবেশিত।
বহ্নিবিবুক্ষ ও পাহাড় বরন তাঁর জনপ্রিয় দুটি উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস নারীপুরুষ ও স্বামীস্ত্রীর স্বরূপ বিবর্ধনে সংসারের প্রকৃত অবস্থার জীবন্ত কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় গ্রন্থের প্লট পাবর্ত্য এলাকা। লেখক পার্বত্য এলাকায় চাকরি করেছেন। অধিকন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সন্তু লারমার বড় ভাই মানবেন্দ্র লারমার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। যা চট্টগ্রামের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সে ভিত্তিতে তিনি এ উপন্যাসে পাহাড়ি বাঙ্গালি সম্পর্ক, পার্বত্য এলাকায় কর্মরত অফিসারগণের প্রতি সাধারণ্যের দৃষ্টিভঙ্গী ।
ড. আমীন বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস সমিতি, আইএআরএইচ প্রভৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য। তিনি এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।
No comments:
Post a Comment