এম. আবদুল আলী : অনবদ্য সাহস ও বিরল দেশপ্রেমে বিমূর্ত কালজয়ী প্রশাসক
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা ব্যক্তি, সমাজ ও
রাষ্ট্রীয়-জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে কোনও বিবেচনায় অনবদ্য কৃতিত্বের দাবিদার।
ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রশাসন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক
উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। বাংলাদেশের
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যবৃন্দ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের প্রত্যয়ীকর্মে। স্বাধীনতা ঘোষণার
পরপরই প্রথমেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত বাংলাদেশ প্রশাসন ক্যাডারের
সদস্যদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল দেশের জন্য অকাতরে প্রাণদিতে উৎসুক জনতার
সাহসী স্ফূরণ। জেলাপ্রশাসক, অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক, এসডিও, সহকারী কমিশনার,
ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি পদে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্বপালনে রত প্রশাসন
ক্যাডারের অসংখ্য সদস্য নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত
করেছিলেন, সহায়তা করেছিলেন বিভিন্নভাবে। এজন্য তাঁদের অনেককে চরম নৃশংসতার
সাথে হত্যা করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার জেলাপ্রশাসক শহিদ
শামছুল হক, সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও শহিদ একে শামসুদ্দিন এবং পিরোজপুর
মহকুমার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানসহ অনেকের কথা উল্লেখ করা
যায়। ইতোপূর্বে আমি শহিদ শামছুল হকের বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। আলোচ্য
প্রবন্ধে এমন একজন মহান দেশপ্রেমিকের কথা উল্লেখ করা হবে, যিনি যথোপযুক্ত
প্রচার পেলে দেশপ্রেম ও সাহসের বিমূর্ত প্রতীক হিসাবে সারাবিশ্বে অদ্বিতীয়
হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। এটি এম আবদুল আলীর নয়,
আমাদেরই ব্যর্থতা। জাতি হিসাবে বিশ্বে আমাদের ত্যাগ ও মহিমাকে বর্ণীল
ঐতিহ্যে স্থাপন করতে এমন ব্যর্থতা হতে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
শহিদ
মুক্তিযোদ্ধা এম. আবদুল আলী ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি তৎকালীন
বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মকসেদপুর থানার বালিয়াকান্দি
গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইস্ট পাকিস্তান সিভিল
সার্ভিস (ইপিসিএস)-এর সদস্য হিসাবে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৭০
খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সাব-ডিভিশনাল অফিসার (এসডিও) অর্থাৎ মহকুমা প্রশাসক পদে
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গামাটি মহকুমায় পদায়ন করা হয়। একই সঙ্গে
তিনি মহকুমার প্রধান হাকিমও ছিলেন।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক
ভাষণের পর রাঙ্গামাটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ সর্বদলীয় সংগ্রাম
পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ নিয়মিত মহকুমা মাজিস্ট্রেট আবদুল
আলীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আবদুল আলী মুক্তিকামী মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে
তাদের যুদ্ধ-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। রাঙ্গামাটি জেলা সদরের পুলিশ লাইন ও
স্টেশন ক্লাবে ছাত্র, যুবক ও আমজনতাকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। এছাড়া
তিনি রাঙ্গামাটিতে স্থাপিত উপ-নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের দায়িত্বেও নিয়োজিত
ছিলেন। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম ও অগ্রবর্তী ঘাঁটির সঙ্গে
যোগাযোগরক্ষা করা।
এম আবদুল আলী যুদ্ধের পূর্বাভাস পেয়েই
নিরাপত্তার স্বার্থে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত এলাকায়
দায়িত্বরত অবাঙালী ইপিআর সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজে গিয়ে ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যদের লঞ্চে করে রাঙ্গামাটি
নিয়ে আসেন। ২৫ মার্চের পর তৎকালীন জেলাপ্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত
জেলাপ্রশাসক সেয়দ আব্দুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তৃবৃন্দ মুজিবনগরের উদ্দেশে ভারত চলে যান। তবে সাহসী ও দেশপ্রেমের
অনল আবদুল আলী ভারতে পালিয়ে না-গিয়ে দেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত-থাকার
প্রত্যয়ে ছিলেন দৃপ্ত। তাঁর অভিমত, ‘সবাই যদি পালিয়ে যান, দেশের বাইরে থেকে
যুদ্ধ করার চেষ্টা করেন - তাহলে দেশের ভেতরে যুদ্ধ করবে কে? কে সংঘটিত
করবে মুক্তিযোদ্ধাদের? কে সাহস দেবে সাধারণ জনগণকে?
তাই আবদুল আলী
ভারতে না-গিয়ে রাঙ্গামাটিতে অবস্থান করে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা
ও সংঘটকদের সঙ্গে নানা উপায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে স্বাধীনতা যুদ্ধ করে
যাচ্ছিলেন। তিনি ১৪ এপ্রিল মহালছড়িতে অবস্থানরত মেজর জিয়া, মেজর মীর শওকত
আলি, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন অলি আহম্মদের সঙ্গে দেখা করে
তাদের ভারত যাওয়ার সহযোগিতা করেন। অতঃপর তিনি অস্ত্রসস্ত্রসহ মহালছড়ি থেকে
রাঙ্গামাটির উদ্দেশে রওনা দেন। শরদিন্দু শেখর চাকমা ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে
অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম” গ্রন্থে
লিখেছেন : রাঙ্গামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে
সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালড়ি থেকে রাঙ্গামাটি আসেন। স্পিডবোটে
ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম কালাম, আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন,
সামসুল হক মাস্টার এবং রাঙ্গামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান
আলীর ছেলে ইফতেখার” (পৃষ্ঠা- ২৬)।
“এম. আবদুল আলী: একজন বিস্মৃত
সিভিল সার্ভেন্ট একজন বিস্মৃত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা” প্রবন্ধে নাজমুল ইসলাম
লিখেছেন : অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ১৬ এপ্রিল রাঙ্গামাটির ডিসি বাংলো ঘাটে এসে
ভিরতেই পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তিনি তার বড় ছেলে ইউসুফ হারুনসহ
গ্রেফতার হন। বন্দি করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা জেলাপ্রশাসক এইচ টি ইমামসহ
প্রশাসনের উচ্চপদন্ত কর্মকর্তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু
আবদুল আলী সে বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ,
গোলাবারুদ কোথা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে, কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ
দেওয়া হচ্ছে, কারা কারা আছেন সে সব তথ্য জানার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকে
পাকিস্তানি সৈন্যরা। কিন্তু কোনও তথ্যই দিতে চাইছিলেন না আবদুল আলী। বারবার
চেষ্টা করেও যখন কোনও প্রকার তথ্যই বের করতে পারছিলেন না তখন তার উপর নেমে
আসে অমানুষিক নির্যাতন।”
‘বংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে এইচ টি ইমাম
লিখেছেন : “পাকিস্তানি সেনারা অমানুষিক অত্যাচার করে আলীর উপর, আমার
গতিবিধি এবং কার্যকলাপ জানার জন্য। শহীদ আবদুল আলী নিজের প্রাণ দিয়ে আমাদের
নিরাপত্তা রক্ষা করেছেন” (প্রকাশকাল ২০১২, পৃষ্ঠা-২৫৬)। বন্দি করার পর এম
আবদুল আলীর উপর যে নির্যাতন করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত নৃশংস। এ প্রসঙ্গে
ইয়াসিন রানার লেখা ‘মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় বীর শহীদ এম আবদুল
আলী’ গ্রন্থের বর্ণনা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।“প্রথমে তাকে (এম আবদুল আলী)
ইটভাঙার কাজ দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এরপর তাকে দিয়ে কুলির কাজ করাতে
থাকে। শ্রমিকদের মতই খাটাতো তাকে। ১২ দিনের বন্দি অবস্থায় তার প্রায় পুরো
শরীরই ক্ষত- বিক্ষত করে ফেলা হয়েছিলো। পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের
মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ইট দিয়ে তার দাঁত গুলো ভেঙে দেওয়া
হয়েছিলো। তার হাতের নখগুলো উপরে ফলা হয়েছিলো। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি
হায়েনারা আবদুল আলীর হাতের আঙুলগুলো পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল ( প্রকাশ ২০১৫,
পৃষ্ঠা : ১০)।
শহিদ এম আবদুল আলীর উপর পরিচালিত অমানুষিক নির্যাতনের
আরও লোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় শরদিন্দু শেখর চাকমার মুক্তিযুদ্ধে
পার্বত্য চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে : “এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য
আবদুল আলীকে রাঙ্গামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায়
লবণ দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পেছনে বেঁধে টেনে রাঙ্গামাটির
বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল” (চাকমা ২০০৬,পৃষ্ঠা :২৭)।
১৯৭১
খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল এম আবদুল আলীকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৭১
খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল আবদুল আলীর মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে কেটে বস্তা-ভরে
কাপ্তাই লেকে ফেলে দেওয়া হয়। বন্দি অবস্থায় ১২ দিন তাঁকে একবিন্দু জল
পর্যন্ত পান করতে দেওয়া হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নৃশংসতার হিটলারও হয়তো
করতে পারেনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ এম আবদুল আলীর স্মৃতি রক্ষার্থে
স্বাধীনতার পর মূলত স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে প্রশাসনের সমর্থন ও
সহায়তায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গামাটির রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থিত কায়েদে আজম
মেমোরিয়াল একাডেমির নাম পরিবর্তন করে শহীদ আবদুল আলী একাডেমী করা হয়।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ বাংলাদেশ সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে
সরকারিভাবে আবদুল আলীর আত্মত্যাগের স্বীকৃতি প্রদান করে। সচিব এম. এম.
জামান সাক্ষরিত গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ এম আবদুল আলীর পরিবারের সদস্যদের
প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয় হয়। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত (গেজেট
নম্বরÑ১৫৬/৭, তারিখ : ৬ মার্চ ১৯৭২) বাংলাদেশ গেজেটে লেখা “The government
of Bangladesh announce with profound regret the sad news of the death of
Mr. M. Abdul Ali, former Sub-divisional Officer, Sadar, Chittagong Hill
Tracts, on the 27th April 1971”.
প্রশাসন ক্যাডারের গর্বিত সদস্য
শহিদ আবদুল আলী দেশের জন্য, আমাদের জন্য জীবন দিয়েছেন। আমরা তাঁকে কী
উপযুক্ত সম্মানে বারিত করতে পেরেছি? এমন অকৃতজ্ঞতা কখনও সুফল বয়ে আনে না।
No comments:
Post a Comment