ভূত, মরতে হবে লেখক / অনুসিন্থিয়া জাহান চৌধুরী
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ‘ভূত-অঙ্কের জিরো থিউরি’ গ্রন্থের ভূমিকাটা পড়ুন। বইয়ের এমন ভূমিকা কী আর কখনও পড়েছেন? এমন ব্যতিক্রমী ভূমিকা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ভূমিকাটি তুলে দিলাম।
আমার এক স্যারকে ভূমিকা লেখার জন্য পা-ুলিপিটা পড়তে দিই। স্যার প্রথিতযশা শিক্ষক। নাম বলব? থাক, এমন খ্যাতিমান ব্যক্তির নাম সব ঘটনায় বলা ঠিক না। স্যার ভালো লেখক, ভালো গাল্পিক। ভূতের বইও লিখেছেন ডজন কয়েক। কথা ছিল তিন দিন পর ভূমিকা লিখে ফেরত দেবেন। হাতে একটা সাদা খামে যৎসামান্য সম্মানি দিয়ে চলে আসি। অবসরকালে সামান্য সম্মানিই অনেক।
দুদিন পর ভোরে স্যার্গিন্নী, মানে সারের স্ত্রী ফোন করে বললেন: “পা-ুলিপি পড়ে আপনার স্যার আতঙ্কে বোবা। দুই দিন যাবত বিছানায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে আছেন। নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ। ডাকতে গিয়ে দেখি পেটের উপর আপনার পা-ুলিপিটা নিয়ে আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছেন। মুখের দুপাশে লালার ¯্রােত, চোখ দুটো কোটর হতে বের হয়ে আসার জন্য ছটফট করছে। তেল ঢাললাম, পানি ঢাললাম। কিছুতেই হুশ
ফেরে না। আমার বড় ছেলে বড় ডাক্তার। সে আপনার পা-ুলিপিটা পড়ার জন্য তার কক্ষে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত। ছেলে আমার ঘরের দরজা খোলে না। রাতে খাওয়ার জন্য ডাকতে গিয়ে হতবাক। আমার বিলেত-ফেরত-ডাক্তার-ছেলে পাগলের মতো প্রলাপ বকছে। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম। মুখে কোনো কথা নেই। অনামিকার ইশারায় পা-ুলিপিটা দেখিয়ে দিয়ে পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলল: ভূতভূত অদ্ভুদ, ঘরভূত বাহিরভূত, আমিভূত তুমিভূত, বাবাভূত মাভূত, সবভূত সবভূত। কিছুক্ষণ পর পর হাসছে আর ভূত ভূত করে ভয়ে আতঁকে উঠে নাচছে। বাপ-পুত দুজনেই এখন ভূত।”
ঘণ্টাখানেক পর স্যারের স্ত্রী নিজেই আমার বাসায় এসে পা-ুলিপিটা ফেরত দিতে দিতে বললেন: এমন বই আর দেবেন না। সম্মানিটাও রেখে গেলাম।
আমি বললাম: স্যার তো এর চেয়েও ভয়ঙ্কর বই লিখেছেন।
কিন্তু আপনার ভূত আমার ঘরের সব জিনিস ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ছেলের স্টেথস্কোপ জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিয়েছে। আমার প্রিয় শাড়িগুলো কেটে গোল গোল ফুল বানিয়ে সারা মেঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ সব দেখে আমার নাতির পুতুলটা পর্যন্ত ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল।
এখন উপায়?
আমার একছাত্র ভালো লেখক। সে-ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাকে ফোন করে ডেকে এনে বললাম: পা-ুলিপিটা পড়ে একটা ভূমিকা লিখে দিও। খুশি মনে সে পা-ুলিপিটা বাসায় নিয়ে গেল। পরদিন উস্কুখুস্কো শরীর নিয়ে এসে আমার দু-হাত জড়িয়ে ধরে বলল: স্যার, আমাকে মাপ করে দেবেন।
কী হয়েছে?
ছাত্র বলল: পা-ুলিপি পড়ে ভয়ে আমার পোয়াতি বধূ মেঘের মতো চীৎকার দিয়ে উঠে। তার মাথার চুলসমগ্র স্ট্যাচু অব লিবার্টির মাথার কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে। দৌড়ে আসে আমার মা। দেখেÑ পা-ুলিপি থেকে লাখলাখ ভূত, কোটিকোটি প্রেত, মিলিয়ন মিলিয়ন রাক্ষস, বিলিয়ন বিলিয়ন খোক্ষস, লাল-নীল পরি আর ঢলঢলে জিন মশালনৃত্য করছে। ভয়ে আমার মা পা-ুলিপিটা বালতির পানিতে ডুবিয়ে ছিড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলে।
এত কষ্টের পা-ুলিপির এমন করুণ পরিণতির কথা শুনে আমিও ভয়ে কাঁপতে শুরু করি। ভূত-প্রেতদের পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। এটি তারা সহ্য করবে না। দেখি তাদের উদ্ধার করা যায় কি না।
বললাম: তুমি বালতিটা এক্ষুণি নিয়ে আস।
ছাত্র বলল: আমি গিয়ে দেখি, বালতির পানিতে লাখ লাখ ভূতের কোটি কোটি বাচ্চা সাঁতার কাটছে। ভয়ে বালতির পানি, ছেড়া-পা-ুলিপিসহ সিটি কর্পোরেশনের নালায় ঢেলে দিয়েছি।
আমি বললাম: হায়! হায়! তুমি কী করলে? আমার বইয়ের ভূতেরা তো শহরের সব ম্যানহোলের ঢাকনা ভেঙে বের হয়ে আসবে। রাক্ষস-খোক্ষসরা রাস্তাঘাট উপড়ে ফেলবে, চাদাবাজি করবে, খুনা-খারাবি করবে। প্রেতাত্মারা নানারূপ ধারণ করে দুর্ঘটনা ঘটাবে। তারা শহরের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে চুরমার করে দেবে। যানজট আর জলজটে শহর বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
ছাত্র বলল: অমন অকা- শুরু হয়ে গিয়েছে। পুরো শহরের ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা, রাস্তা ভাঙা, যানজট আর জলজটে শহর থমকে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, শুরু হয়েছে ভীষণ চাদবাজি। এখন কী করব স্যার? পুলিশ জানতে পারলে তো আমাকে ছাড়বে না।
হতাশ হয়ে বললাম: আমি তো কোনো উপায় দেখছি না। আচ্ছা, তুমি যাও। দেখি কী করতে পারি।
আমার অপরূণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। কী আর করা, আবার লেখা শুরু করলাম। যতটুকু মনে আসছিল সবভূতকে আগের বইয়ের মতো এটাতেও ঢুকানোর চেষ্টা করি। যদি ক্ষতি কমান যায়। কিন্তু মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল, সব আনতে পেরেছি কিনা জানি না। লেখা শেষ করার পর ঘুমোতে গেলাম।
গভীর রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে ভাবলাম, ছাত্রের মা আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। সে যদি পা-ুলিপিটা নষ্ট না-করত, তো বইটা প্রকাশ হতো। তখন হাজার হাজার পাঠকের অবস্থা কী হতো? আমার স্যারের মতো হতো। ছাত্রের বউয়ের মতো হতো। পাঠক পাগল হয়ে যেত। আমার একশ বছর জেল হতো। আসলে, ভূত যা করে ভালোর জন্যই করে। ভূতকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে ছাত্রকে ল্যান্ডফেনে রিং দিলাম: আবার নতুন একটা বই লিখেছি। তুমি একটা ভূমিকা লিখে দাও।
ছাত্র বলল: আপনার পায়ে পড়ি স্যার। আমি আর কোনো ভূমিকা লিখব না। যদি প্রয়োজন হয় টাকা দিয়ে অন্য কারও ভূমিকা নিয়ে আসব। আপনি বরং ভূমিকার বদলে কী ঘটনা ঘটেছে তাই লিখে দিন। লিখে দিন, আপনার বইয়ের ভূতেরা কি কা- ঘটিয়েছে।
বললাম: আমি লিখলে কেউ তো বিশ্বাস করবে না। তুমিই না-হয় কী হয়েছে ঘটনাটা লিখে দাও।
লাইন কেটে যায়। আবার রিং করি, যায় না। আনরিচএবল। তাহলে এতক্ষণ কীভাবে গেল? এ তো আর মোবাইল নয় যে চার্জ চলে যাবে। স্যারের কথা মনে পড়ছে। আমার পা-ুলিপির জন্য স্যারের সংসারে এত বিপদ। দেখে আসা উচিত। সকাল সকাল স্যারের বাসায় যাই। স্যার দিব্যি চেয়ারে বসে লিখছেন। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন: তোমার ভূতের বইটার সে-রকম একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছি। পছন্দ হয়েছে?
আমার মস্তকে যুদ্ধ খেলে গেল। যদি বলি পাইনি, তো কেমন দেখায়!
নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললাম: ভাবী কোথায়?
স্যার বললেন: গত ছয়মাস হতে ছেলের সঙ্গে লন্ডনে।
আপনার ছেলে দেশে নেই!
তুমি জানো না? সে তো পাঁচ বছর যাবত লন্ডনে বসবাস করছে।
আমি পাগল হবার যোগাড়। স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে ছাত্রকে রিং করলাম: তুমি একটু আমার বাসায় এস। কিছু জরুরি কথা আছে।
স্যার, আমি তো আপনার বাসায় গিয়েছিলাম।
কেন?
দাওয়াত দিতে। চৌদ্দ তারিখ আমার বিয়ে।
তুমি বিয়ে করোনি?
না স্যার।
তাহলে সেদিন যে আমাকে রিং করে বললে আমার পা-ুলিপি পড়ে তোমার পোয়াতি বউ পাগল হয় গেছে।
কোন পা-ুলিপি পড়ে স্যার?
ভূমিকা লিখতে যেটা দিয়েছিলাম।
আপনি তো স্যার আমাকে কোনো পা-ুলিপি দেননি।
কেন? পরশু আমি তোমাকে রিং করে আসতে বলেছিলাম। তুমি আমার বাসায় এসে নিয়ে গেলে। নিজের হাতে তোমাকে দিয়েছি।
আমি তো স্যার গত সপ্তাহে দেশেই ছিলাম না। আজ ভোরে এসেছি।
কিন্তু তুমি আমার পা-ুলিপি নিলে, তারপর তোমার বউ নাকি ছিড়ে ফেলেছে। তোমার মা নালায় ফেলে দিয়েছে। এসে আমার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলে!
ছাত্র বলল: কী আবোলতাবোল বকছেন স্যার।
আমি আমতা আমতা করে বললাম: কিন্তু গতরাতে তো তোমাকে ল্যান্ড ফোনে রিং করলাম। নতুন পা-ুলিপিটা নিয়ে যেতে। তুমি বললে আগের পা-ুলিপিটা পড়ে যে বিপদ হয়েছে তা সামলাতে পারছি না, আবার নতুন- - -।
ছাত্র বলল: আসলে স্যার আপনি পাগলই হয়ে গেছেন। আমি তো আজ ভোরে দেশে ফিরলাম। তাছাড়া আমার বাসার ল্যান্ডফোন চার মাস যাবত ডেড। ভূতের বই লিখতে লিখতে আপনি নিজেই ভূত হয়ে গেছেন।
লজ্জায় মনটা ছোট হয়ে যায়। ছাত্রের কাছ থেকে এমন কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে। বাসায় এসে স্যার্গিন্নীর দেওয়া খামটা খুললাম। কোনো টাকা নেই। একটা চিরকুট। ভৌতিক হাতে লেখা: এ বই প্রকাশ করলে মরতে হবে।
এতক্ষণ পর বুঝলাম, সব ইউরোভূতের কা-। আমি বইতে ইউরোভূতদের বন্দি করে ফেলেছি। এজন্য তারা চাইছে না বইটি প্রকাশ হোক। কিন্তু সম্মানির টাকাগুলো কোথায়?
স্যারকে রিং করে বললাম: স্যার, আমার খামটা পেয়েছেন?
ওটা তো হারিয়ে ফেলেছি। অনেক খুজেছি পাইনি। মনে হয় কোনো বইয়ের ভেতর ঢুকে আছে।
ভূত, চিরকুট দিয়েছে কিন্তু টাকাগুলো ঠিকই মেরে দিয়েছে। ভূতও টাকা চিনে।
পাঠক আমার কথা যদি বিশ্বাস না-হয় তো, ঢাকা শহরের দিকে তাকান।
No comments:
Post a Comment