হিন্দু-মুসলিম
=====
নিয়োগ পরীক্ষা শেষ। এবার উত্তরপত্র যাছাই।
একুশ জন বিসিএস অফিসার উত্তরপত্র নীরিক্ষায় আমন্ত্রিত।
সার্বিক দায়িত্বে জনাব আবু তাহের, কমিশনার। নিজেই প্রশ্ন-পত্র করেছেন।
উত্তরপত্র সামনে নিয়ে সবাই কমিশনার সাহেবের অপেক্ষায়।
মুখে এক সমুদ্র অহঙ্কার নিয়ে রুমে ঢুকেন তাহের সাহেব: অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রশ্ন-পত্রটা করেছি। দু রাত ঘুমোতে পারিনি। তোমরা হলে দু মাস ঘুমোতে পারতে না। আনসার স্ক্রিপ্ট করেছি। আনসার-স্ক্রিপ্ট ছাড়া তোমরা উত্তরপত্র যাছাই করতে পারবে না বলে এত কষ্ট করতে হয়েছে। আমি বিসিএস অফিসারদের দৌঁড় জানি, এক লাইনে চৌদ্দটি ভুল করো। সিএসপি পরীক্ষা দিলে বুঝতে কত রসে কত গুড়, কত চুল কাটে ক্ষুর।
সিএসপিদের এ একটা বড় দোষ। তারা ছাড়া বাকিরা গণ্ডমূর্খ।
আজাদের ভাষায় সিএসপি মিনস- কন্ট্রাকচুয়্যাল সার্ভিস বাই পাম্প। মুনীর চৌধুরীর ভাষায়: কাম সার্ভ এন্ড পাম্প। শামীমেরটা আরও যৌক্তিক: ক্রিমিনাল সাপ্লাইয়ার্স টু দ্যা পলিটিশিয়ানস্।
তাহের সাহেব নিজে হেটে হেটে সবার হাতে আনসার স্ক্রিপ্ট দিচ্ছেন।
জাকিরের ভাগে বাংলা সাহিত্য ও সাধারণ জ্ঞান।
আনসার স্ক্রিপ্টের একটি লাইনে এসে জাকিরের চোখ আটকে- “নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন।”
হোয়াট? মনে মনে প্রশ্ন করে জিবে কামড় দেয় জাকির।
‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র। লেখা হয়েছে মীর মোশাররফ হোসেন। বাংলা সাহিত্যে নীলদর্পণ পিরিয়ডে মীর মোশাররফ হোসেন বলে কোন সাহিত্যিক ছিল না। ‘জমিদার দর্পণ’ নামের একটি নাটক আছে। রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন নয়।
সম্ভবত প্রিন্টিং মিস্টেক।
টু এরর ইজ হিউম্যান। ভুল শোধরে দেয়া কৃতিত্বের কাজ, কর্তব্যও বটে।
জাকির দাঁড়িয়ে দৃষ্টি টানেন তাহের সাহেবের: স্যার, সাত নম্বর প্রশ্নের উত্তরটা আনসার-স্ক্রিপ্টে ভুল লেখা হয়েছে। সম্ভবত কারণিক ভূল।
আঁতকে উঠেন আবু তাহের: কী বললে? তুমি কী আমাকে কেরানি মনে করো? জানো, আমি কেরানিদের সাথে কথাও বলি না! আমি নিজে আনসার স্ক্রিপ্ট করেছি, তুমি আমাকে কেরানি বানিয়ে ছাড়লে। আমার উত্তরে ভুল, অসম্ভব!
জ্বী স্যার, ভুল।
হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু সে?
আরেকটু উত্তপ্ত হন আবু তাহের।
জাকির: নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন নয়, দীনবন্ধু মিত্র। মীর মোশাররফ বলে কোন লেখক তৎকালে ছিল না। থাকলেও তিনি নীলদর্পণ লিখেননি।
আবু তাহের: তুমি কোন্ ব্যাচের?
ভয় পেলেও সাহস হারাননি জাকির। যারা জানেন তারা সহজে সাহস হারান না। অজ্ঞতা ভীরুতার ফ্ল্যাটফরম,ঋদ্ধতা সাহসের আধার। জ্ঞান সাহসীদের কান্ডারি। জাকির ভুল ধরেছে, ভয়ের কিছু নেই। কারও বালখিল্য হুমকি জ্ঞানীদের এট বেস্ট হাসায়- ভোগায়; তার বেশি নয়।
তাহের সাহেব জাকিরের উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলে যেতে থাকে: তোমার চেয়ে অনেক সিনিয়র, অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি দিয়ে আনসার-স্ক্রিপ্ট করা হয়েছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না তুমি বিসিএস পাশ করলে কীভাবে? মীর মোশাররফ হোসেনকে চেন না! এমন একটি গর্দভ বিসিএস ক্যাডারের সদস্য, ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। ‘বিষাদসিন্ধু’ কী তোমার বাপে লিখেছে? নাকি তাও জানো না?
জাকির: ‘বিষাদসিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন নয়। ‘মো’ আর ‘ম’ এক নয়; যেমন এক নয় গরু আর গুরু।
তাহের সাহেব লাফ দিয়ে উঠেন: এ ছেলে তো গন্ডমূর্খ। জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে গিয়ে দেখে এসো, মীর মোশাররফ হোসেন হল।
তাঁরা ভুল করেছেন।
আবু তাহের: না জেনে শাখামৃগের মত তর্ক করে সময় নষ্ট করো না। কাজ করো। তোমার শাস্তি পরে হবে। দেখি তোমার চাকুরি কোন শালা বাঁচায়।
জাকির : আমি স্যার জেনেই বলছি।
আবু তাহের: আমাকে শেখানোর চেষ্টা করো না, আমি যতটি বই পড়েছি তুমি ততটি বাক্যও পড়োনি?
অভিব্যক্তিতে সব অফিসার জাকিরের দিকে, কিন্তু কারও প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ মানে প্রতিঘাত, চাকরের অত সাহস থাকে না। হোক ডিসি, এসপি, জজ-ব্যারিস্টার, সচিব, কমিশনার সবাই চাকর।
ডেপুটি কমিশনার পুলিন বিহারী দেব এতক্ষণ পর মুখ খুলেন: স্যার, জাকিরের কথাই ঠিক, দীনবন্ধু মিত্রই ‘নীলদর্পণ’ লিখেছেন।
আবু তাহের: তুমি হিন্দু মানুষ, তাই হিন্দুদের প্রতি টান।
পুলিন: না স্যার, আমি অসাম্প্রদায়িক মানুষ।
আবু তাহের: তোমরা এখানে কয়জন?
পুলিন বিহারী: একুশ ।
কয় জেলার দায়িত্বে?
এক জেলার।
আমি কয়জন?
একজন।
কয় জেলার দায়িত্বে?
সতের।
তোমরা একুশ জন আমি একজনের সমান। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ। কোন্ ইডিয়ট বলেছে দীনবন্ধু? আমার চেয়ে বেশি জানলে তোমরাও কমিশনার হতে। আন্ডারস্ট্যান্ড?
জ্বী, বলে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে পুলিন বাবু।
জাকির : স্যার, আমার কাছে বইটা আছে, নিয়ে আসি?
জাকিরের কথায় আবু তাহের আরও রেগে। এবার তেলে-বেগুনে তপ্ত কড়াই: আমি কমিশনার বলছি বিশ্বাস হয় না, আর কোন্ বইয়ে কী লেখা আছে, কোথাকার কোন নচ্ছার কী লিখেছে তা নিয়ে তুমি আমার সাথে তর্ক করে যাচ্ছো, বেয়াদব!
লক্ষণ ভালো নয়।
জাকিরকে থামাতে হবে। পুলিন বাবু মরিয়া। তিনি ধীরে ধীরে জাকিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
কানে মুখ নিয়ে বলেন: জাকির, তুই আমার বাপ, তোর পায়ে পড়ি যাদু, একটু থাম্। ‘নীলদর্পণ’ কেউ না, তুমিই লিখেছ, প্রয়োজনে আমি তোমার নামে অফিস আদেশ করে দেব, আমাকে রেহাই দাও। নিয়োগটা ভণ্ডুল করে দিও না।
সহকারী কমিশনার মোনায়েম রাগে এতক্ষণ হুলো বিড়ালের মত ফুসছিল। তবু ডিসি সাহেবের বিগলিত বিনয় তার সহানুভূতি টানে।
জাকিরকে লক্ষ্য করে বলল: স্যার,কমিশনার স্যার যা বলছেন তাই ঠিক। দুমাস আগে এ কক্ষেই এক সেক্রেটারি কালিদাসের বিখ্যাত উক্তি, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই”-চরণকে রবীন্দ্রনাথের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। দুজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করেননি। আপনি কেন অযথা বিপদে পড়তে যাবেন।
কী ব্যাপার, এত তর্ক কিসের? দরজার দিকে সবার চোখ যায়।
ধবধবে জামায় আবৃত একজন লম্বা লোক ধীর পায়ে রুমে ঢুকেন।
কাতেবুর। জয়েন্ট সেক্রেটারি।
তাকে দেখে আবু তাহের সাহেবের বগলে জোয়ার আসে। কাছে গিয়ে তাহের সাহেব অনেকটা আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন: “নীলদর্পণ” নাকি মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা নয়, দীনবন্ধু লিখেছে।
কাতেবুর : কে বলেছে? কোন বানচুত? দেখিয়ে দাও, দুটো লাথি মারি দুগালে।
আবু তাহের: গণ্ডমুর্খ জাকির।
লাথির ভাষা হারিয়ে ফেলেন কাতেব, তার চোখে আফশোসের কালো রাগ।
জাকিরকে তিনি চেনেন। আস্ত বেয়াদব।
পিয়ন কাতেবুরের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। চেয়ারের বসতে বসতে কাতেবুর সাহেব বললেন: আমি বুঝি না, আজকালকার ছেলেগুলো সব ক্রেডিট কেন হিন্দুদের দিয়ে দিতে চায়।
আবু তাহের: এজন্যই তো আজ মুসলমানদের এ দুর্দশা।
কাতেবুর: আই এ্যাম সিউর, ‘নীলদর্পণ’ মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছেন, দীনবন্ধু নয়। মোশাররফ সাহেব আমার পাশের বাড়ির লোক। তার সাথে আমার অনেক বার দেখা হয়েছে। ভদ্রলোক খুব জ্ঞানী। আমাকে খুব স্নেহ করেন। এ তো কিছুদিন আগেও টেলিফোনে আলাপ হয়েছে।
কাতেব সাহেবের কথায় আবু তাহের লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে জাকিরের উপর চোখ রাখেন।
কাতেবুরের সেদিকে খেয়াল নেই, তিনি বলেই যাচ্ছেন: নীলদর্পণ নিয়ে এত তর্ক করে লাভ কী ? বেলজিয়ামের দর্পণই সবচেয়ে ভাল। মোশাররফের দর্পণ কিংবা দীনবন্ধুর দর্পণ দিয়ে ঈদানীং চলে না, ব্যাকড্যাটেড, সহজে নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানির দর্পণের উপর কোন দর্পণ নেই। আছে কি?
=====
নিয়োগ পরীক্ষা শেষ। এবার উত্তরপত্র যাছাই।
একুশ জন বিসিএস অফিসার উত্তরপত্র নীরিক্ষায় আমন্ত্রিত।
সার্বিক দায়িত্বে জনাব আবু তাহের, কমিশনার। নিজেই প্রশ্ন-পত্র করেছেন।
উত্তরপত্র সামনে নিয়ে সবাই কমিশনার সাহেবের অপেক্ষায়।
মুখে এক সমুদ্র অহঙ্কার নিয়ে রুমে ঢুকেন তাহের সাহেব: অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রশ্ন-পত্রটা করেছি। দু রাত ঘুমোতে পারিনি। তোমরা হলে দু মাস ঘুমোতে পারতে না। আনসার স্ক্রিপ্ট করেছি। আনসার-স্ক্রিপ্ট ছাড়া তোমরা উত্তরপত্র যাছাই করতে পারবে না বলে এত কষ্ট করতে হয়েছে। আমি বিসিএস অফিসারদের দৌঁড় জানি, এক লাইনে চৌদ্দটি ভুল করো। সিএসপি পরীক্ষা দিলে বুঝতে কত রসে কত গুড়, কত চুল কাটে ক্ষুর।
সিএসপিদের এ একটা বড় দোষ। তারা ছাড়া বাকিরা গণ্ডমূর্খ।
আজাদের ভাষায় সিএসপি মিনস- কন্ট্রাকচুয়্যাল সার্ভিস বাই পাম্প। মুনীর চৌধুরীর ভাষায়: কাম সার্ভ এন্ড পাম্প। শামীমেরটা আরও যৌক্তিক: ক্রিমিনাল সাপ্লাইয়ার্স টু দ্যা পলিটিশিয়ানস্।
তাহের সাহেব নিজে হেটে হেটে সবার হাতে আনসার স্ক্রিপ্ট দিচ্ছেন।
জাকিরের ভাগে বাংলা সাহিত্য ও সাধারণ জ্ঞান।
আনসার স্ক্রিপ্টের একটি লাইনে এসে জাকিরের চোখ আটকে- “নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন।”
হোয়াট? মনে মনে প্রশ্ন করে জিবে কামড় দেয় জাকির।
‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র। লেখা হয়েছে মীর মোশাররফ হোসেন। বাংলা সাহিত্যে নীলদর্পণ পিরিয়ডে মীর মোশাররফ হোসেন বলে কোন সাহিত্যিক ছিল না। ‘জমিদার দর্পণ’ নামের একটি নাটক আছে। রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন নয়।
সম্ভবত প্রিন্টিং মিস্টেক।
টু এরর ইজ হিউম্যান। ভুল শোধরে দেয়া কৃতিত্বের কাজ, কর্তব্যও বটে।
জাকির দাঁড়িয়ে দৃষ্টি টানেন তাহের সাহেবের: স্যার, সাত নম্বর প্রশ্নের উত্তরটা আনসার-স্ক্রিপ্টে ভুল লেখা হয়েছে। সম্ভবত কারণিক ভূল।
আঁতকে উঠেন আবু তাহের: কী বললে? তুমি কী আমাকে কেরানি মনে করো? জানো, আমি কেরানিদের সাথে কথাও বলি না! আমি নিজে আনসার স্ক্রিপ্ট করেছি, তুমি আমাকে কেরানি বানিয়ে ছাড়লে। আমার উত্তরে ভুল, অসম্ভব!
জ্বী স্যার, ভুল।
হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু সে?
আরেকটু উত্তপ্ত হন আবু তাহের।
জাকির: নীলদর্পণ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন নয়, দীনবন্ধু মিত্র। মীর মোশাররফ বলে কোন লেখক তৎকালে ছিল না। থাকলেও তিনি নীলদর্পণ লিখেননি।
আবু তাহের: তুমি কোন্ ব্যাচের?
ভয় পেলেও সাহস হারাননি জাকির। যারা জানেন তারা সহজে সাহস হারান না। অজ্ঞতা ভীরুতার ফ্ল্যাটফরম,ঋদ্ধতা সাহসের আধার। জ্ঞান সাহসীদের কান্ডারি। জাকির ভুল ধরেছে, ভয়ের কিছু নেই। কারও বালখিল্য হুমকি জ্ঞানীদের এট বেস্ট হাসায়- ভোগায়; তার বেশি নয়।
তাহের সাহেব জাকিরের উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলে যেতে থাকে: তোমার চেয়ে অনেক সিনিয়র, অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি দিয়ে আনসার-স্ক্রিপ্ট করা হয়েছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না তুমি বিসিএস পাশ করলে কীভাবে? মীর মোশাররফ হোসেনকে চেন না! এমন একটি গর্দভ বিসিএস ক্যাডারের সদস্য, ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। ‘বিষাদসিন্ধু’ কী তোমার বাপে লিখেছে? নাকি তাও জানো না?
জাকির: ‘বিষাদসিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন নয়। ‘মো’ আর ‘ম’ এক নয়; যেমন এক নয় গরু আর গুরু।
তাহের সাহেব লাফ দিয়ে উঠেন: এ ছেলে তো গন্ডমূর্খ। জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে গিয়ে দেখে এসো, মীর মোশাররফ হোসেন হল।
তাঁরা ভুল করেছেন।
আবু তাহের: না জেনে শাখামৃগের মত তর্ক করে সময় নষ্ট করো না। কাজ করো। তোমার শাস্তি পরে হবে। দেখি তোমার চাকুরি কোন শালা বাঁচায়।
জাকির : আমি স্যার জেনেই বলছি।
আবু তাহের: আমাকে শেখানোর চেষ্টা করো না, আমি যতটি বই পড়েছি তুমি ততটি বাক্যও পড়োনি?
অভিব্যক্তিতে সব অফিসার জাকিরের দিকে, কিন্তু কারও প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ মানে প্রতিঘাত, চাকরের অত সাহস থাকে না। হোক ডিসি, এসপি, জজ-ব্যারিস্টার, সচিব, কমিশনার সবাই চাকর।
ডেপুটি কমিশনার পুলিন বিহারী দেব এতক্ষণ পর মুখ খুলেন: স্যার, জাকিরের কথাই ঠিক, দীনবন্ধু মিত্রই ‘নীলদর্পণ’ লিখেছেন।
আবু তাহের: তুমি হিন্দু মানুষ, তাই হিন্দুদের প্রতি টান।
পুলিন: না স্যার, আমি অসাম্প্রদায়িক মানুষ।
আবু তাহের: তোমরা এখানে কয়জন?
পুলিন বিহারী: একুশ ।
কয় জেলার দায়িত্বে?
এক জেলার।
আমি কয়জন?
একজন।
কয় জেলার দায়িত্বে?
সতের।
তোমরা একুশ জন আমি একজনের সমান। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের রচয়িতা মীর মোশাররফ। কোন্ ইডিয়ট বলেছে দীনবন্ধু? আমার চেয়ে বেশি জানলে তোমরাও কমিশনার হতে। আন্ডারস্ট্যান্ড?
জ্বী, বলে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে পুলিন বাবু।
জাকির : স্যার, আমার কাছে বইটা আছে, নিয়ে আসি?
জাকিরের কথায় আবু তাহের আরও রেগে। এবার তেলে-বেগুনে তপ্ত কড়াই: আমি কমিশনার বলছি বিশ্বাস হয় না, আর কোন্ বইয়ে কী লেখা আছে, কোথাকার কোন নচ্ছার কী লিখেছে তা নিয়ে তুমি আমার সাথে তর্ক করে যাচ্ছো, বেয়াদব!
লক্ষণ ভালো নয়।
জাকিরকে থামাতে হবে। পুলিন বাবু মরিয়া। তিনি ধীরে ধীরে জাকিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
কানে মুখ নিয়ে বলেন: জাকির, তুই আমার বাপ, তোর পায়ে পড়ি যাদু, একটু থাম্। ‘নীলদর্পণ’ কেউ না, তুমিই লিখেছ, প্রয়োজনে আমি তোমার নামে অফিস আদেশ করে দেব, আমাকে রেহাই দাও। নিয়োগটা ভণ্ডুল করে দিও না।
সহকারী কমিশনার মোনায়েম রাগে এতক্ষণ হুলো বিড়ালের মত ফুসছিল। তবু ডিসি সাহেবের বিগলিত বিনয় তার সহানুভূতি টানে।
জাকিরকে লক্ষ্য করে বলল: স্যার,কমিশনার স্যার যা বলছেন তাই ঠিক। দুমাস আগে এ কক্ষেই এক সেক্রেটারি কালিদাসের বিখ্যাত উক্তি, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই”-চরণকে রবীন্দ্রনাথের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। দুজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করেননি। আপনি কেন অযথা বিপদে পড়তে যাবেন।
কী ব্যাপার, এত তর্ক কিসের? দরজার দিকে সবার চোখ যায়।
ধবধবে জামায় আবৃত একজন লম্বা লোক ধীর পায়ে রুমে ঢুকেন।
কাতেবুর। জয়েন্ট সেক্রেটারি।
তাকে দেখে আবু তাহের সাহেবের বগলে জোয়ার আসে। কাছে গিয়ে তাহের সাহেব অনেকটা আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন: “নীলদর্পণ” নাকি মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা নয়, দীনবন্ধু লিখেছে।
কাতেবুর : কে বলেছে? কোন বানচুত? দেখিয়ে দাও, দুটো লাথি মারি দুগালে।
আবু তাহের: গণ্ডমুর্খ জাকির।
লাথির ভাষা হারিয়ে ফেলেন কাতেব, তার চোখে আফশোসের কালো রাগ।
জাকিরকে তিনি চেনেন। আস্ত বেয়াদব।
পিয়ন কাতেবুরের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। চেয়ারের বসতে বসতে কাতেবুর সাহেব বললেন: আমি বুঝি না, আজকালকার ছেলেগুলো সব ক্রেডিট কেন হিন্দুদের দিয়ে দিতে চায়।
আবু তাহের: এজন্যই তো আজ মুসলমানদের এ দুর্দশা।
কাতেবুর: আই এ্যাম সিউর, ‘নীলদর্পণ’ মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছেন, দীনবন্ধু নয়। মোশাররফ সাহেব আমার পাশের বাড়ির লোক। তার সাথে আমার অনেক বার দেখা হয়েছে। ভদ্রলোক খুব জ্ঞানী। আমাকে খুব স্নেহ করেন। এ তো কিছুদিন আগেও টেলিফোনে আলাপ হয়েছে।
কাতেব সাহেবের কথায় আবু তাহের লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে জাকিরের উপর চোখ রাখেন।
কাতেবুরের সেদিকে খেয়াল নেই, তিনি বলেই যাচ্ছেন: নীলদর্পণ নিয়ে এত তর্ক করে লাভ কী ? বেলজিয়ামের দর্পণই সবচেয়ে ভাল। মোশাররফের দর্পণ কিংবা দীনবন্ধুর দর্পণ দিয়ে ঈদানীং চলে না, ব্যাকড্যাটেড, সহজে নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানির দর্পণের উপর কোন দর্পণ নেই। আছে কি?
No comments:
Post a Comment